ভূমিকা :
ত্যাগের মাধ্যমে দ্বীন বেঁচে থাকে। বিশ্বের দিগ্দিগন্তে ইসলামের অমিয় বাণী পৌঁছিয়ে দেওয়ার পিছনে আল্লাহর ত্যাগী বান্দাদের অবদান অনস্বীকার্য। নবী-রাসূল এবং তাদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। তারা যমীনের বুকে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এ পথে নির্যাতনের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় সঁপে দিতেও তারা বিন্দুমাত্র পরওয়া করেননি। এমনকি নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তারা নিজেদের জান-মাল, সময়-শ্রম সবকিছুই উৎসর্গ করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের সেই ত্যাগপূত অবদানের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাদের রক্তের অক্ষরে লেখা ত্যাগের অমলিন ইতিহাস আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
ত্যাগ স্বীকার বলতে কি বুঝায়?
ত্যাগ স্বীকার বলতে বুঝায় কোন কিছু বিসর্জন দেওয়া। একে আরবীতে التضحية বা الفداء বলা হয়। এর পারিভাষিক অর্থ হ’ল- هو بذل النَّفس أو الوقت أو المال لأجل غاية أسمى، ولأجل هدف أرجى، مع احتساب الأجر والثواب على ذلك عند الله عزَّ وجلَّ، ‘আল্লাহর কাছে প্রতিদান ও ছওয়াব লাভের আশায় কোন মহান ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে সম্পদ, সময় কিংবা জীবন বিসর্জন দেওয়া’।[1] অর্থাৎ পরকালীন মুক্তির জন্য আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ, সময়-শ্রম ব্যয় করা এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনবোধে নিজের জীবন উৎসর্গ করা। একে জিহাদ নামেও অভিহিত করা হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য আপতিত বিপদাপদ ও কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হওয়া এবং নেকীর আশায় ধৈর্যের সাথে সেগুলো সহ্য করাও দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বেলাল বিন রাবাহ, মুছ‘আব বিন উমায়ের, খাববাব ইবনুল আরাত্ব, ইয়াসির পরিবারসহ ছাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী মনীষীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার নমুনা ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে দেদীপ্যমান হয়ে আছে।
উৎসর্গের প্রকারভেদ :
উৎসর্গ দু’ভাগে বিভক্ত : (ক) নন্দিত বা প্রশংসিত উৎসর্গ এবং (খ) নিন্দিত বা মন্দ উৎসর্গ।
ক. প্রশংসিত উৎসর্গ :
আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে শরী‘আত অনুমোদিত কোন পন্থায় নিজের প্রিয় জিনিস বিসর্জন দেওয়াই হ’ল প্রশংসিত উৎসর্গ। এই প্রিয় জিনিস বস্ত্তগত হ’তে পারে আবার অবস্ত্তগত হ’তে পারে। যেমন ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নিজের নয়নের পুত্তলী সন্তানকে আল্লাহর নিকটে উৎসর্গ করেছিলেন। তাবূকের যুদ্ধে আবুবকর, ওমর, ওছমান (রাঃ) প্রমুখ ছাহবীগণ নিজেদের সহায়-সম্পদ উৎসর্গ করেছিলেন। অনুরূপভাবে ছাহাবায়ে কেরাম মাক্কী জীবনে নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের কষাঘাতে ছবর করেছিলেন এবং বদর, ওহোদ ও মুতা প্রান্তরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন কেবল দ্বীনের জন্যই। এগুলো প্রশংসিত উৎসর্গের উদাহরণ। প্রতি বছর ঈদুল আযহাতে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সেই ত্যাগের আদর্শ জাগরুক রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলিমগণ পশু কুরবানী করে থাকেন। যেন পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজের জীবন কুরবানী করার অনুপ্রেরণা লাভ করা যায়। প্রশংসিত উৎসর্গের মাধ্যমে বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেকী ও মর্যাদা প্রাপ্ত হন।
(খ) নিন্দিত উৎসর্গ :
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্যে বা বাতিলকে সহযোগিতা করার জন্য যে বিসর্জন দেওয়া হয়, সেটা নিন্দিত উৎসর্গ।[2] প্রকারান্তরে এটা শিরকের সমপর্যায়ভুক্ত মহাপাপ। যেমন জাহেলী আরবের মুশরিকরা মূর্তি ও দেব-দেবীর নামে পশু বলি দিত এবং সেই পশুর রক্ত কা‘বার দেয়ালে লেপে দিত। অধুনা হিন্দুরা পাঠা বলি দেয়। নামধারী মুসলিমরা (?) খানকা-মাযারে পীরের নামে বিভিন্ন ধরনের পশু যবেহ করে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী রাজনীতিবিদরা ইহুদী-নাছারাদের কপোলকল্পিত আদর্শকে বাস্তবায়নের জন্য অর্থ-শ্রম বিসর্জন দেয় এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করে। এই মন্দ উৎসর্গের পরিণতি জাহান্নাম। এমনকি কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে জিহাদ করে এবং জান-মাল উৎসর্গ করে, তাহ’লে সেটাও মন্দ উৎসর্গ হিসাবে গণ্য হবে এবং এর কারণে তাকে জাহান্নামে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হ’তে হবে।[3] কেননা আল্লাহর কাছে তাক্বওয়া ও ইখলাছবিহীন উৎসর্গর্ বা ত্যাগের কোন মূল্য নেই। মহান আল্লাহ বলেন,لَنْ يَنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ، ‘ওগুলির গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের আল্লাহভীরুতা’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
আবূ হাইয়ান আন্দালুসী (রহঃ) বলেন, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নিয়ত ও ইখলাছের বিশুদ্ধতা ছাড়া উৎসর্গকারীরা কখনোই আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে না। কারণ যেকোন আমল সম্পাদনের ক্ষেত্রে তাক্বওয়া অবলম্বন করা ওয়াজিব। তাই উৎসর্গ ও কুরবানী যত বড়ই হোক না কেন, তাক্বওয়া ও ইখলাছের শর্ত পূরণ না করলে তা কোনই কাজে আসবে না।[4] সুতরাং বলা যায়, জিহাদের ময়দানে হোক বা দাওয়াতের ময়দানে হোক, যতই টাকা-পয়সা, সময়-শ্রম কুরবানী দেওয়া হোক না কেন, তা যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য না হয়, তাহ’লে সেই ত্যাগ স্বীকারের পাঁচ পয়সা মূল্য নেই; বরং সেটা নিন্দিত উৎসর্গ হিসাবে গণ্য হবে।
ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যম সমূহ :
১. জীবন উৎগর্স :
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পার্থিব সম্পদ হ’ল তার জীবন। এই জীবনকে দু’দন্ড প্রশান্তি দেওয়ার জন্য মানুষ তার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে। এই জীবনকে ঘিরেই মানুষের বুকে কত স্বপ্ন-আশা লালিত হয়। আর সে যখন তার এই প্রিয় জীবনকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে, তখন সেটা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসর্গ। আল্লাহ বলেন,مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا، ‘মুমিনদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। আর তারা তাদের অঙ্গীকার আদৌ পরিবর্তন করেনি’ (আহযাব ৩৩/২৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مِنْ خَيْرِ مَعَاشِ النَّاسِ لَهُمْ، رَجُلٌ مُمْسِكٌ عِنَانَ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللهِ، يَطِيرُ عَلَى مَتْنِهِ، كُلَّمَا سَمِعَ هَيْعَةً، أَوْ فَزْعَةً طَارَ عَلَيْهِ، يَبْتَغِي الْقَتْلَ وَالْمَوْتَ مَظَانَّهُ، أَوْ رَجُلٌ فِي غُنَيْمَةٍ فِي رَأْسِ شَعَفَةٍ مِنْ هَذِهِ الشَّعَفِ، أَوْ بَطْنِ وَادٍ مِنْ هَذِهِ الْأَوْدِيَةِ، يُقِيمُ الصَّلَاةَ، وَيُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَيَعْبُدُ رَبَّهُ حَتَّى يَأْتِيَهُ الْيَقِينُ، لَيْسَ مِنَ النَّاسِ إِلَّا فِي خَيْرٍ، ‘সর্বোত্তম জীবন হ’ল সেই ব্যক্তির জীবন, যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। শত্রুর উপস্থিতি ও শত্রুর দিকে ধাবমান হওয়ার শব্দ শোনামাত্র ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। যথাস্থানে সে শত্রুকে হত্যা এবং নিজ শাহাদতের সন্ধান করে। অথবা ঐ লোকের জীবনই উত্তম, যে ছাগপাল নিয়ে কোন পাহাড় চূড়ায় বা (নির্জন) উপত্যকায় বসবাস করে আর যথারীতি ছালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আমৃত্যু তার প্রভুর ইবাদতে নিমগ্ন থাকে। তখন লোকটি কেবল কল্যাণের মাঝেই বিরাজ করে’।[5]
এই হাদীছে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর পথে উৎসর্গিত জীবনই সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন। সেই উৎসর্গের চূড়ান্ত রূপ হ’ল জিহাদ করে আল্লাহর পথে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করা। তবে জিহাদ বলতে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধকে বুঝানো হয় না। বরং শিরক-বিদ‘আত ও শয়তানের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোই জিহাদের মূলমন্ত্র। সেটা যেমন বিশেষ শর্তে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে হ’তে পারে, তেমনি হ’তে পারে দাওয়াত, বক্তব্য, লেখনী, সংগঠন প্রভৃতি উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে। আল্লাহর রাহে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের উৎসর্গ। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘জান ও মাল উভয়ের মাধ্যমে জিহাদ করা যায়। তবে জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে যে জিহাদ করা হয়, তার প্রতিদান ও ফযীলত সবচেয়ে বেশী’।[6]
২. অর্থ-সম্পদ উৎসর্গ :
আল্লাহর পথে উৎসর্গ করার অন্যতম বড় উপাদান হ’ল অর্থ-সম্পদ। মহান আল্লাহ জীবন ও রক্তের আগে সম্পদ উৎসর্গ করতে বলেছেন। কেননা জীবন চলে গেলে আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করার আর সুযোগ থাকে না। তাই রক্ত দেওথে জিহাদ কর’ )ুলস্নাহ )ওয়ার আগে মাল উৎসর্গ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, انْفِرُوْا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ، ‘তোমরা বেরিয়ে পড় অল্প সংখ্যায় হও বা অধিক সংখ্যায় হও এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল দ্বারা ও জান দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানো’ (তওবা ৯/৪১)। মুফাস্সিরগণ বলেন, জিহাদের জন্য জান-মাল উভয়ই উৎসর্গ করা আবশ্যক। কেননা অধিকাংশ সময় জিহাদের প্রস্ত্ততি নির্ভর করে আর্থিক প্রস্ত্ততির উপরে। সেকারণ আল্লাহর পথে জান বিসর্জন দেওয়ার আগে মাল বিসর্জন দেওয়া প্রয়োজন।[7] যেমন তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার পূর্বে তাদের মাল উৎসর্গ করতে বলেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল, জান ও যবান দ্বারা জিহাদ কর’।[8] সুতরাং দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য জীবন উৎসর্গের পাশাপাশি ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত্তি মযবূত করার জন্য মাল উৎসর্গের গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। কেননা জিহাদ অন্যান্য সরঞ্জামাদির মতো অর্থের উপরেও নির্ভরশীল। তাই আল্লাহর দ্বীনকে সহযোগিতার জন্য অর্থ ব্যয় করা কর্তব্য।
আল্লাহর পথে সম্পদ উৎসর্গ করার আরেকটি উপায় হ’ল দান-ছাদাক্বাহ করা। ছাহাবায়ে কেরাম জান্নাত লাভের আশায় তাদের সহায়-সম্পদ আল্লাহর পথে দান করেছেন। দানশীল ছাহাবীদের অন্যতম ছিলেন আবূ ত্বালহা (রাঃ)। তিনি মদীনার আনছারগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খেজুর বাগানের মালিক ছিলেন। মসজিদে নববীর নিকটবর্তী ‘বায়রুহা’ নামক বাগানটি তার কাছে অধিক প্রিয় ছিল। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার বাগানে প্রবেশ করে এর সুপেয় পানি পান করতেন।
কিন্তু আল্লাহ যখন এই মর্মে আয়াত নাযিল করেন যে,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ- ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত থেকে দান করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তা সবই জানেন’ (আলে ইমরান ৩/৯২)। এখানে পুণ্য বলতে জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে।[9]
তখন আবূ ত্বালহা (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! বায়রুহা বাগানটি আমার কাছে অধিক প্রিয়। আমি এটা আল্লাহর নামে ছাদাক্বাহ করে দিলাম। কাজেই আপনি যাকে দান করা ভাল মনে করেন তাকে দান করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, بَخْ، ذَلِكَ مَالٌ رَابِحٌ، ذَلِكَ مَالٌ رَابِحٌ، ‘বাহ! এটা তো একটা লাভজনক সম্পদ, এটা তো একটা লাভজনক সম্পদ। অতঃপর সেই বাগানটি আবূ ত্বালহা (রাঃ)-এর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হ’ল।[10] অনুরূপভাবে জান্নাতের একটি খেজুর গাছের জন্য আবূ দাহদাহ (রাঃ) একজন ইয়াতীমকে তার দামী বাগানটি দান করে দিয়েছিলেন।[11] তাদের রচিত ত্যাগের ইতিহাস যুগ-যুগান্তরে জান্নাতপিয়াসী মুমিনদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
৩. সময় উৎসর্গ :
সময় মানুষের অমূল্য সম্পদ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত নে‘মত সমূহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নে‘মত। সময়ের সমষ্টিই জীবন। সময়ের মাঝেই মানুষ বেঁচে থাকে। যারা জীবনের অমূল্য সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারে, সফলতা তাদের পদ চুম্বন করে। সময়ের কুরবানী করে যারা জীবনের মুহূর্তগুলোকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে, তারা উভয়কালে মুক্তির মনযিলে মকছূদে পৌঁছতে সক্ষম হন। আল্লাহর পথে সময় উৎসর্গ করার ফযীলত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَغُدْوَةٌ فِى سَبِيلِ اللهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا، ‘আল্লাহর পথে একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যা ব্যয় করা দুনিয়া ও তার মধ্যবর্তী সকল কিছুর চেয়ে উত্তম’।[12]
বিদ্বানদের মতে, এই হাদীছের মর্মার্থ হ’ল- কেউ যদি দুনিয়া এবং তার মধ্যস্থিত তাবৎ সম্পদের মালিক হয় এবং সেটা আল্লাহর পথে দান করে দেয়, তাহ’লে সে আল্লাহর কাছে যত প্রতিদান পাবে, একজন মুমিন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর পথে একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যা ব্যয়ের মাধ্যমে তার চেয়ে অধিক প্রতিদান লাভ করেন।[13] সুতরাং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে সময় কুরবানী করা যরূরী।
তাছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ইবাদতে বান্দা যে সময় ব্যয় করে, সেটাও সময়ের উৎসর্গ হিসাবে গণ্য হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ، ‘আমরা তাদেরকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, ছালাত আদায় করতে এবং যাকাত প্রদান করতে। আর তারা আমাদেরই ইবাদত করত’ (আম্বিয়া ২১/৭৩)। এই আয়াতে আল্লাহ বান্দাকে সময়ের কুরবানী করে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন এবং যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি অংশ উৎসর্গ করতে বলেছেন। কেননা মানুষ যে সম্পদ উপার্জন করে তা মূলতঃ আল্লাহর দেওয়া সময় খরচ করেই অর্জন করতে হয়। উক্ত আয়াতের তাফসীরে শা‘রাভী বলেন,فالزكاة تضحية بجزء من المال، والمال في الحقيقة نتيجة العمل، والعمل فرع الوقت، أما الصلاة فهي تضحية بالوقت ذاته، ‘যাকাত হ’ল সম্পদের একটি অংশ উৎসর্গ করা। মূলতঃ সম্পদ মানুষের কাজ-কর্মের ফসল। আর কর্ম সময়েরই একটি শাখা। পক্ষান্তরে ছালাত মূলতঃ সময়ের উৎসর্গ হিসাবে বিবেচিত হবে’।[14]
তিনি আরো বলেন, ‘যে সময় আপনি ছালাত আদায় করেন, তখন যেন আপনি সম্পদ উপার্জনের সেই সময়টা আল্লাহর পথে কুরবানী করে দিলেন। ফলে এই সময়ের উপার্জিত সম্পদের একশত ভাগই আপনি আল্লাহর পথে খরচ করে দিলেন। অথচ আপনি সম্পদ কামাই করলে এর এক- দশমাংশ (ওশর), বিশ ভাগের একভাগ (নিছফে ওশর) অথবা চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে ছাদাক্বাহ করে দিতেন। আর বাকী সম্পদ আপনার কাছে থেকে যেত। ফলে এখানে যাকাতের চেয়ে ছালাতই অধিক বড় ও ফযীলতপূর্ণ ছাদাক্বাহ হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে।[15]
অপরদিকে দ্বীনী জ্ঞান অর্জনে ব্যয়িত মুহূর্তগুলোও সময়ের উৎসর্গ হিসাবে বিবেচিত হয়। আহলুছ ছুফ্ফার সদস্য ছাহাবীদের ইলমী তৃষ্ণা এবং পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিছীনে কেরাম, ফুক্বাহায়ে এযাম এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীন জ্ঞান সাধনায় তাদের জীবনের মূল্যবান সময় অকাতরে ব্যয় করেছেন। ইলমী ময়দানে তাদের ত্যাগ স্বীকারের বদেŠলতে অহি-র জ্ঞান আমাদের কাছে পৌঁছেছে।
ইবাদতের জন্য প্রয়োজনীয় শারঈ জ্ঞান অর্জন করা সকল মুমিনের জন্য আবশ্যক। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন,من فضائل العلم، إذ بالعلم يعبد الإنسان ربه على بصيرة، فيتعلق قلبه بالعبادة ويتنور قلبه بها، ويكون فاعلا لها على أنها عبادة لا على أنها عادة، ‘ইলম অর্জনের অন্যতম ফযীলত হচ্ছে- মানুষ ইলমের মাধ্যমে সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে তার রবের ইবাদত করতে পারে। ফলে তার হৃদয় ইবাদতের সাথে লেগে থাকে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয় জগৎ আলোকিত হয়। আর সে অভ্যাসের কারণে নয়; বরং ইবাদতের ভিত্তিতেই আল্লাহর দাসত্ব করে থাকে’।[16]
জ্ঞান সাধনার ফযীলত ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে তিনি আরো বলেন,لا شك أن طلب العلم من أفضل الأعمال، بل هو من الجهاد في سبيل الله، ولا سيما في وقتنا هذا، ‘নিঃসন্দেহে ইলম অন্বেষণ করা সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের অন্তর্ভুক্ত। বরং এটা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে’।[17] সুতরাং দাওয়াতের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আল্লাহর দ্বীনের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখা এবং জান্নাতের পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য জীবনের সময়গুলো তাঁরই পথে কুরবানী করা আবশ্যক।
৪. শ্রম বিসর্জন :
দ্বীনের খেদমতের জন্য কখনো শ্রমের প্রয়োজন পড়ে। তখন আল্লাহর পথে শ্রম বিসর্জন দেওয়া মুমিন বান্দার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। খন্দকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম যে মেহনত করেছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে আছে। এ সময় পরিখা খননের কাজে মাটি বহন করার কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহ-পেট ধূলি-ধূসরিত হয়েছিল।[18] আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, মসজিদে নববী নির্মাণের সময় আমরা মাথায় একটি করে ইট বহন করছিলাম। আর আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) একটির বদলে দু’টি করে ইট বহন করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আম্মারের মাথার ধূলা ঝেড়ে দিয়ে বললেন, يَا عَمَّارُ أَلاَ تَحْمِلُ لَبِنَةً كَمَا يَحْمِلُ أَصْحَابُكَ، ‘হে আম্মার! তুমি কি তোমার বন্ধুদের মত একটা করে ইট বহন করতে পার না’? তখন আম্মার (রাঃ) বললেন, إِنِّى أُرِيدُ الأَجْرَ مِنَ اللهِ، ‘আমি আল্লাহর নিকট থেকে অধিক নেকী কামনা করি’।[19] এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ দ্বীনের জন্য জান-মাল ও সময়-শ্রম সব কিছু অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং মুমিন বান্দার অবশ্য করণীয় হ’ল দ্বীনের খেদমতের জন্য শ্রম বিসর্জনে সর্বদা প্রস্ত্তত থাকা। আর সেটা কায়িক শ্রম হ’তে পারে অথবা মানসিক শ্রমও হ’তে পারে। এমনকি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মুসলিম ভাইয়ের উপকার ও সহযোগিতা করাও দ্বীনের পথে শ্রম উৎসর্গের আওতাভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، وَأَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ سُرُورٌ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً أَوْ تَقْضِى عَنْهُ دَيْناً أَوْ تَطْرُدُ عَنْهُ جُوْعاً، وَلأَنْ أَمْشِىَ مَعَ أَخِى الْمُسْلِمِ فِى حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِى هَذَا الْمَسْجِدِ يَعْنِيْ مَسْجِدَ الْمَدِيْنَةِ شَهْرًا، ‘আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশী উপকারী। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হ’ল কোন মুসলিমকে আনন্দিত করা অথবা তার কোন কষ্ট লাঘব করা অথবা তার ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া অথবা তার ক্ষুধা নিবারণ করা। আমার কোন ভাইয়ের সাহায্যে তার সাথে হেঁটে যাওয়া আমার নিকট এই মসজিদে (মসজিদে নববীতে) এক মাস ই‘তিকাফ করার চেয়েও প্রিয়’।[20] সুতরাং একজন শ্রমিক তার শ্রম ব্যয় করে পার্থিব জীবনে যেমন রূযী তালাশ করবে, তেমনি মুমিন বান্দা দ্বীনের জন্য শ্রম বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে জান্নাতের প্রত্যাশী হবেন।
৫. স্বার্থ বিসর্জন :
নিজের পসন্দনীয় জিনিস অপরের জন্য বরাদ্দ করার নামই হ’ল স্বার্থ বিসর্জন। পূর্ণাঙ্গ ঈমানের দাবী হ’ল অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ، ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’।[21] অন্যত্র তিনি বলেন,وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا، ‘তুমি নিজের জন্য যা পসন্দ কর, মানুষের জন্যও তা পসন্দ করবে, তাহ’লে পূর্ণ মুসলিম হ’তে পারবে’।[22]
এই হাদীছগুলোর মর্ম ছাহাবীদের হৃদয় জগতে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ইতিহাসে তার নযীর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করার পরে আনছারদের সাথে মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দেন। তখন আনছার ছাহাবী সা‘দ বিন রাবী (রাঃ) আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ)-কে বলেছিলেন,إِنِّى أَكْثَرُ الأَنْصَارِ مَالاً فَأَقْسِمُ مَالِى نِصْفَيْنِ، وَلِى امْرَأَتَانِ، فَانْظُرْ أَعْجَبَهُمَا إِلَيْكَ فَسَمِّهَا لِى أُطَلِّقْهَا، فَإِذَا انْقَضَتْ عِدَّتُهَا فَتَزَوَّجْهَا، ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাধিক সম্পদের অধিকারী। আমি আমার সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করে দিব। আমার দু’জন স্ত্রী আছে, আপনার যাকে পসন্দ হয় বলুন, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে তাকে আপনি বিবাহ করবেন’। ইবনু আওফ (রাঃ) তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তার জন্য বরকতের দো‘আ করলেন এবং ব্যবসার পথ বেছে নিলেন’।[23]
অনুরূপভাবে বাহরাইন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানকার পতিত জমিগুলো আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বললেন,حَتَّى تُقْطِعَ لِإِخْوَانِنَا مِنَ الـمُهَاجِرِينَ مِثْلَ الَّذِيْ تُقْطِعُ لَنَا، ‘আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি দেওয়ার পর আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়’।[24] আনছারদের এই অতুলনীয় স্বার্থ ত্যাগ ও মহত্ত্বের প্রশংসা করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন,وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، ‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে (ফাই থেকে) যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)। আল্লাহ আমাদেরকে স্বার্থ ত্যাগের সেই মহান গুণ অর্জনের তাওফীক্ব দান করুন! আমীন!!
৬. পদ ও মর্যাদা বিসর্জন :
দ্বীনের পথে চলতে গেলে কখনো নিজের পদ ও মর্যাদাকে বিসর্জন দিতে হয়। একজন প্রকৃত মুমিন বান্দা দুনিয়ার সব কিছু উৎসর্গ করে হ’লেও আখেরাতের চির শান্তির জন্য উন্মুখ থাকেন। ইসলামের প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য তরুণদের অন্যতম। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের কারণে তিনি পরিবারের সকল উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হন। তাকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তিনি যখন ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হন তাঁর কাফনের জন্য একখন্ড চাদর ব্যতীত কোন কিছু পাওয়া যায়নি। যা দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যেত। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে চাদরটি দিয়ে মাথা ঢেকে ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে পা ঢেকে তাকে দাফন করা হয়।[25]
মক্কার মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নেতৃত্ব, বাদশাহী, সম্পদ, সুন্দরী নারী সবকিছু দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের দাবী একটাই ছিল মুহাম্মাদ (ছাঃ) যেন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ করেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) সকল লোভনীয় প্রস্তাবকে দু’পায়ে দলে সংস্কার ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। বর্তমানে এই নব্য জাহেলিয়াতের যুগেও বাড়ী-গাড়ি, সম্পদ ও নেতৃত্বের লোভনীয় প্রস্তাব আসবে, শয়তান তার সর্বশক্তি দিয়ে দ্বীনের বিশুদ্ধ দাওয়াতকে অবরুদ্ধ করতে চাইবে, কিন্তু নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াত থেকে কখনো পিছপা হওয়া যাবে না। বরং ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে দ্বীনের উপর কায়েম-দায়েম থেকে জান্নাতের রাজপথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখ পানে। অলসতার চাদর ছুঁড়ে ফেলে আখেরাতমুখী দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কেননা আখেরাতমুখী দাওয়াতই মানুষকে দুনিয়া ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে এবং সংস্কার আন্দোলনকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেয়।
৭. পরিবার-পরিজনের মায়া বিসর্জন :
পরিবার-পরিজন মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল। কিন্তু দ্বীনের পথে আসলে বান্দা কখনো কখনো এই আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। ফলে তাকে ঈমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হয়। হকের পথে মানুষ যতগুলো বাঁধার সম্মুখীন হয়, তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল পরিবার। পরিবার থেকে বাধা আসলে সেটা দারুণ মনোকষ্ট এমনকি দৈহিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে অবস্থায় মুমিন বান্দা যেন ভেঙ্গে না পড়ে, সেজন্য মহান আল্লাহ সূরা শু‘আরাতে বিগত যুগের সাতজন নবীর কষ্ট ভোগের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের কাছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ছাহাবায়ে কেরাম সহ্য করেছেন অবর্ণনীয় নির্যাতন। কিন্তু দ্বীনের পথ থেকে তারা বিন্দুমাত্র সরে আসেননি; বরং বুকভরা ঈমান নিয়ে শত কষ্টের পাহাড় মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন জান্নাতের পানে। তারা জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে সর্বদা বুকে ধারণ করে রেখেছেন। পরিবার-পরিজনের মায়া ভুলে মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন আল্লাহর নির্দেশে। যায়েদ বিন দাছেনাহ (রাঃ)-কে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, ‘তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবারসহ বেঁচে থাক?’ তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنَّ مُحَمَّدًا الْآنَ فِيْ مَكَانِهِ الَّذِيْ هُوَ فِيهِ تُصِيبُهُ شَوْكَةٌ تُؤْذِيْهِ، ‘আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে মুহাম্মাদ আসুক এবং তাকে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। অতঃপর হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কিঃ মিঃ উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে তাঁকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।[26]
মুছ‘আব বিন সা‘দ (রাঃ) যখন ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলেন, তখন তার মা তাকে কসম দিয়ে বলেন, আল্লাহ কি তোমাকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দেননি? فَوَاللهِ لاَ أَطْعَمُ طَعَاماً وَلاَ أَشْرَبُ شَرَاباً حَتَّى أَمُوْتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدٍ، ‘আল্লাহর কসম! আমি কিছুই খাব না ও পান করব না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফুরী করবে’।[27]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, মা বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার দ্বীন ছাড়বে। নইলে আমি খাব না ও পান করব না, এভাবেই মরে যাব। তখন লোকেরা তোমাকে তিরষ্কার করে বলবে,يَا قَاتِلَ أُمِّهِ! ‘হে মায়ের হত্যাকারী’! তখন মুছ‘আব বিন সা’দ (রাঃ) বললেন,يَا أُمَّاهُ! لَوْ كَانَتْ لَكِ مِائَةُ نَفْسٍ، فَخَرَجَتْ نَفْسًا نَفْسًا مَا تَرَكْتُ دِينِي هَذَا فَإِنْ شِئْتِ فَكُلِي، وَإِنْ شِئْتِ فَلَا تَأْكُلِي، ‘হে মা! যদি তোমার একশ’টি জীবন হয়, আর এক একটি করে এভাবে বের হয়, তবুও আমি আমার এই দ্বীন ছাড়ব না। এখন তুমি চাইলে খাও, চাইলে না খাও! অতঃপর ছেলের এই দৃঢ় অবস্থান দেখে তিনি খেলেন’।[28] এভাবে পরিবার-পরিজনের নির্মল ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে ছাহাবায়ে কেরাম ঈমানকে নিজেদের বক্ষে ধারণ করে রেখেছিলেন।
৭. সদাচরণে ত্যাগ স্বীকার :
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের আরেকটি মাধ্যম হ’ল সদাচরণ। অনেক সময় দাওয়াতের চেয়ে সুন্দর ব্যবহার মানুষকে বেশী প্রভাবিত করে। হকের পথে অশ্রাব্য গালি-গালাজ, হুমকি-ধমকি এবং নিন্দাবাদের বিপক্ষে সদাচরণ প্রদর্শন করা আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ، ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হ’তে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তুমি দেখবে যে, তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।
একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে বসে ছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন এসে মসজিদে প্রস্রাব করতে লাগল। ছাহাবীগণ তাকে থামাতে গেলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ তাকে থামাতে নিষেধ করলেন। তারপর প্রস্রাব করা শেষ হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকে ডেকে কোমল কণ্ঠে বললেন,إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذَرِ إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ، ‘এই মসজিদগুলো প্রস্রাব ও অপবিত্র করার জায়গা নয়। বরং এটা শুধু আল্লাহর যিকর, ছালাত ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্য’। অতঃপর তিনি সেই জায়গাতে পানি ঢেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।[29] তারপর ছাহাবীদের বললেন,إِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ، ‘তোমাদেরকে (মানুষের জন্য) সহজ পন্থা অবলম্বনকারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে, কঠোরতা আরোপকারী রূপে নয়’।[30] সুতরাং দাওয়াতের ময়দানে আচরণ কোমল হ’তে হবে। রাগ, অভিমান, হিংসা, অহংকার ও গীবত-তোহমতের কষাঘাতকে হজম করে ধৈর্যের সাথে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে।
[চলবে]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব, সম্পাদনা: ‘আলাভী বিন আব্দুল ক্বাদের আস-সাক্কাফ (সঊদী আরব : আদ-দুরারুস সানিইয়াহ, তা.বি) ৩/২৫।
[2]. মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব, ৩/২৯।
[3]. মুসলিম হা/১৯০৫; তিরমিযী হা/২৩৮২।
[4]. আবূ হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৭/৫১০।
[5]. মুসলিম হা/১৮৮৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৭; মিশকাত হা/৩৭৯৬।
[6]. উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৫/৩৬১।
[7]. যুহায়লী, আত-তাফসীরুল ওয়াসীত্ব, ১/৯৭।
[8]. আবূদাঊদ হা/২৫০৪; নাসাঈ হা/৩০৯৬; মিশকাত হা/৩৮২১, সনদ ছহীহ।
[9]. শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ১/৪১৩।
[10]. বুখারী হা/১৪৬১; দারেমী হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/১৯৪৫।
[11]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৭৯১-৯৩; হাকেম হা/২১৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৬৪।
[12]. বুখারী হা/২৭৯২; মুসলিম হা/১৮৮০; মিশকাত হা/৩৭৯২।
[13]. ইমাম নববী, শরহে মুসলিম ১৩/২৬-২৭।
[14]. তাফসীরে শা‘রাভী ১৫/৯৫৯৩।
[15]. তাফসীর শা‘রাভী ১৯/১১৬৫৮।
[16]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, কিতাবুল ইলম (মিসর: মাকতাবাতু নূরিল হুদা, তা.বি) পৃ. ১৩।
[17]. কিতাবুল ইলম, পৃ. ১৮।
[18]. বুখারী হা/৪১০৪।
[19]. আহমাদ হা/১১৮৭৯; ইবনু হিববান হা/৭০৭৯, সনদ ছহীহ।
[20]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৬০২৬; ছহীহাহ হা/৯০৬।
[21]. বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।
[22]. তিরমিযী হা/২৩০৫; ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭; মিশকাত হা/৫১৭১; সনদ হাসান।
[23]. বুখারী হা/৩৭৮০; তিরমিযী হা/১৯৩৩।
[24]. বুখারী হা/২৩৭৬; আহমাদ হা/১২০৮৫।
[25]. মুসলিম হা/৯৪০; রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ. ৩০।
[26]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৪/৬৫-৬৬; গৃহীত: সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), ৩৯২-৯৩ পৃ.।
[27]. আহমাদ হা/১৬১৪, সনদ হাসান।
[28]. কুরতুবী হা/৪৮৪৯, ৪৮৫০; তাফসীর ইবনে কাছীর ৬/৩৩৭; তিরমিযী হা/৩১৮৯, হাদীছ ছহীহ; ওয়াহেদী হা/৬৭০, সনদ হাসান, মুহাক্কিক্ব কুরতুবী।
[29]. বুখারী হা/১২২১; মুসলিম হা/২৮৫; মিশকাত হা/৪৯২।
[30]. বুখারী হা/২২০; নাসাঈ হা/৫৬; ইবনু মাজাহ হা/৫২৯; মিশকাত হা/৪৯১।