পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ 

চিন্তার ইবাদতে সক্ষম হওয়ার উপায়

১. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া :

চিন্তার ইবাদতের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হ’ল শয়তানের কুমন্ত্রণা। শয়তান বিভিন্ন ধরনের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিয়ে বান্দার চিন্তা-ভাবনাকে আল্লাহ বিমুখ করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এমনকি ছালাতে দাঁড়ালে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে বান্দার চিন্তা-ভাবনা এলোমেলা করে দেয়। যেহেতু ইবলীস মানুষকে গোমরাহ করার জন্য আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছে, তাই সে তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের দিয়ে মানবজাতিকে সর্বদা ভালো কাজ থেকে বাধা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে অন্তরের ইবাদতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করতে তারা সবচেয়ে বেশী তৎপর থাকে। আর অন্তরের ইবাদতগুলোর মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী ইবাদত হ’ল চিন্তার ইবাদত। বান্দার সকল ইবাদত নিয়তের উপরে নির্ভরশীল। আর এই নিয়তও চিন্তা-ভাবনার উপরে পুরোপুরি নির্ভর করে থাকে।

কিরমানী (রহঃ) বলেন, علامة استحواذ الشيطان على العبد: أن يشغل قلبه عن التفكر في آلاء االله ونعمائه والقيام بشكرها، ويشغل له عن التفكر والمراقبة بتدبير الدنيا وجمعها، ‘বান্দার উপরে শয়তানের বিজয়ী হওয়ার আলামত হ’ল- সে আল্লাহর প্রকাশ্য ও গোপন নে‘মতরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও এর শুকরিয়া আদায় করা থেকে বিরত থাকবে, এবং পার্থিব জীবনের স্বরূপ ও দুনিয়া কামানোর বিষয়ে অন্তরকে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বাধা দিয়ে রাখবে’।[1]

অনেক সময় আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সাজেক সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করি। তরঙ্গায়িত সমুদ্র সৈকত, সুদৃঢ় পর্বতমালা, নয়নাভিরাম গাছ-গাছালী ও দৃষ্টিন্দন বিবিধ দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। হয়তোবা কেউ সুবাহানাল্লাহ বলি, কেউ বলি না। কিন্তু এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা আল্লাহর এই অপরূপ সৃষ্টিরাজিকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে অবলোকন করেন এবং এর মধ্যে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্ধান লাভে তৎপর থাকেন। মূলতঃ শয়তান আমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধা দেয়। ফলে আমাদের সফর শুধু সেলফিবাজি, ফটোসেশন, বিনোদন ও হরেক পদের খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সফরের ব্যানারে ‘শিক্ষা সফর’ লেখা থাকলেও কোন শিক্ষা লাভ করা হয় না। সফরে কারো অবস্থা যদি এরকম হয়, তাহ’লে বুঝে নিতে হবে যে, শয়তান তাকে বশীভূত করে ফেলেছে।

তাছাড়া আল্লাহর নিদর্শনাবলী মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হ’ল পবিত্র কুরআন। কুরআন তেলাওয়াতের আগে মহান আল্লাহ শয়তানের কাছে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ বান্দা যদি ‘আঊযুবিল্লাহ...’ না বলে তেলাওয়াত শুরু করে, তাহ’লে শয়তানে কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতের আগে ‘আঊযুবিল্লাহ...’ পাঠ করার মর্মার্থ হচ্ছে- যাতে তেলাওয়াতের সময় ইবলীস তেলাওয়াতকারীকে কুমন্ত্রণা দিতে না পারে এবং তাদাববুর ও তাফাক্কুর থেকে বঞ্চিত করতে না পারে’।[2]

সুতরাং আমাদের করণীয় হ’ল জীবনে যেসব ক্ষেত্রে আমাদেরকে দো‘আ পাঠ করার বিধান দেওয়া হয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে দো‘আ পাঠ করতে অভ্যস্থ হওয়া। আর সব সময় আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ অসংখ্য দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন, তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল-رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ، وَأَعُوْذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُوْنِ، ‘হে আমার প্রতিপালক! শয়তানদের কুমন্ত্রণা সমূহ থেকে আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর আমার নিকট যেন ওরা উপস্থিত হ’তে না পারে, সেজন্য হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি’ (মুমিনূন ২৩/৯৭-৯৮)। অত্র আয়াতে শয়তান বলতে জিন ও মানুষ উভয় শয়তানকে বুঝানো হয়েছে।

২. গুনাহ থেকে দূরে থাকা :

মানুষ যখন পাপ করে তখন তার হৃদয়ের শুভ্র দেয়ালে কালো দাগ পড়ে যায়। পাপ যত বাড়ে হৃদয়ের কালিমা তত বৃদ্ধি পায় এবং অন্তর আল্লাহ বিমুখ ও গাফেল হয়ে যায়। আর উদাসীন হৃদয়ে কখনো চিন্তার ইবাদত করা সম্ভব হয় না। সেজন্য সাধ্যানুযায়ী পাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্ট করতে হয়। আর শয়তানের প্ররোচনায় কখনো পাপ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবার দরজা দিয়ে আবার আল্লাহর আনুগত্যে দিকে ফিরে আসতে হয়। আল্লাহ বলেন, 

سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَإِنْ يَرَوْا كُلَّ آيَةٍ لَا يُؤْمِنُوا بِهَا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الرُّشْدِ لَا يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الْغَيِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ-

‘এ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। তারা আমার সমস্ত আয়াত (নিদর্শন) দেখলেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা হেদায়াতের পথ দেখলেও সে পথে যাবে না। কিন্তু যদি ভ্রষ্টতার পথ দেখে তাহ’লে তারা সেটাই গ্রহণ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তারা এ থেকে উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৪৬)। হাসান বছরী (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে আল্লাহ বলেছেন, পাপচারের কারণে আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বাধা দিয়ে রাখব।[3]

আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বাধা দানকারী সবচেয়ে বড় পাপগুলোর একটি হচ্ছে ‘গান শোনা’। ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন,إعلم أن سماع الغناء يلهي القلب عَنِ التفكر فِي عظمة الله سبحانه، ‘জেনে রাখ! গান শোনা আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত রাখে’।[4] সুতরাং চিন্তার ইবাদতের তাওফীক্ব পেতে হ’লে ছোট-বড় সকল পাপ থেকে নিজেকে হেফাযত করে সর্বদা নেকীর কাজে নিয়োজিত থাকা প্রয়োজন।

৩. কবর যিয়ারত করা :

কল্পনার দেয়ালে মৃত্যুর ভাবনা জাগিয়ে রাখা চিন্তার ইবাদতের একটি আবশ্যিক অংশ। আর মৃত্যুর স্মরণে হৃদয় যমীনকে সিক্ত রাখার একটি শক্তিশালী উপায় হ’ল কবর যিয়ারত করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنِّي كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُوْرُوْهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُكُمِ الـمَوْتَ وَ الْآخِرَةَ، ‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন (নির্দেশ দিচ্ছি যে,) তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার। এটা তোমাদেরকে মৃত্যু ও আখেরাতের কথা মনে করিয়ে দেবে’।[5] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন,كنت نهيتكم عن زيارة القبور ألا فزوروها فإنها ترق القلب وتدمع العين وتذكر الآخرة، ‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা যিয়ারত করতে পার। কেননা এটা অন্তরকে নরম করে দেয়, চোখকে অশ্রুসিক্ত করে এবং আখেরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়’।[6]

ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন,أن الإنسان إذا خرج يمشي في الأسواق، ويبصر زينة الدنيا، ثم دخل إلى المقابر، فتفكر، ورق قلبه، فإنه يحس بين الحالتين فرقًا بينًا، ‘যখন কোন মানুষ বাইরে বের হয়ে বাজারে ঘোরাফেরা করে এবং পার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করে, তারপর কবরস্থানে প্রবেশ করে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন তার মনটা নরম হয়ে যায়। ফলে তিনি জীবন ও মরণের দু’টি অবস্থার মাঝে একটা

সুস্পষ্ট পার্থক্য অনুভব করতে পারেন’।[7]

শামসুদ্দীন মানবাজী (রহঃ) বলেন, জান্নাত পিয়াসী বান্দাদের বেশী বেশী কবর যিয়ারত করা উচিত। কবরের পাশে গিয়ে তিনি চিন্তা-ভাবনা করবেন যে, এই ভয়ংকর কবর গহবরে কোন্ কোন্ জিনিস আমার উপকারে আসবে এবং এখানে কী বিভীষিকাময় শাস্তি প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে। যদি তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কবরটাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং এতে অভ্যস্থ হ’তে পারেন, তবে আল্লাহর ইবাদতে তিনি কখনো গাফলতী করবেন না এবং তার আমলনামায় নেক আমলের পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকবে। তিনি যতই ইবাদত করবেন, ততই তার মনে হবে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই আমলগুলো খুবই নগণ্য।[8]

৪. অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়া :

আল্লাহর নে‘মতের ব্যাপারে চিন্তাশীল হওয়ার অনেক উপায় আছে। তন্মধ্যে একটি কার্যকর উপায় হ’ল- রোগীকে দেখতে যাওয়া এবং হাসপাতালের যরূরী বিভাগগুলো যিয়ারত করা। এজন্য ইসলাম মানুষকে রোগীদের সেবা করতে ও তাদের দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে। এমনকি জোরালোভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, কেউ অসুস্থ হ’লে অপর মুসলিম যেন তাকে দেখতে যায়। আর এটাকে সুস্থ ব্যক্তির উপরে রোগীর অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।[9] এমনকি রোগীকে দেখতে যাওয়ার ফযীলত উল্লেখ করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُودُ مَرِيضًا إِلا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ، كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ، إِنْ كَانَ مُصْبِحًا حَتَّى يُمْسِيَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنَّةِ، وَإِنْ كَانَ مُمْسِيًا خَرَجَ مَعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ، كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ حَتَّى يُصْبِحَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنَّةِ، ‘যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে বের হয়, তখন সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওনা হয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। উপরন্তু তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরী করা হয়। আর সে যদি সন্ধ্যা বেলা কোন রোগীকে দেখতে বের হয়, তাহ’লে সত্তর হাযার ফেরেশতা তার সাথে রওনা দেয়। প্রত্যেক ফেরেশতাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান বরাদ্দ করে রাখা হয়।[10] শুধু মুসলিম রোগী নয়; রবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অমুসলিম, কাফের রোগীদেরও দেখতে যেতেন।[11]

রোগীকে দেখতে যাওয়ার এই ফযীলত বর্ণনার কারণ মূলতঃ দু’টি: (১) যাতে রোগী মনসিকভাবে সুস্থতা অনুভব করতে পারে এবং বিপদে অপর মুসলিমকে কাছে পেয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারে। (২) রোগী যিয়ারতের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির চিন্তাশক্তি যেন শাণিত হয়। বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষকে দেখে যেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারে এবং আল্লাহর আযাবের কথা স্মরণ করতে পারে। এতে সবাই একমত হবেন যে, আমরা যখন কোন মুমূর্ষু রোগীকে ছটফট করতে দেখি বা হসপিটালের যরূরী বিভাগে নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেখি, তখন মনটা এমনিতেই নরম হয়ে যায়। ঈমানের স্বচ্ছ সলিলে যার হৃদয়টা ভেজা থাকে, তিনি এই পর্যায়ে চিন্তার ইবাদতের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী উপদেশ লাভ করতে পারেন।

৫. কুরআনে বর্ণিত উপমা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা :

কুরআন হ’ল জ্ঞানের আধার। যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস পবিত্র কুরআন। যারা যত বেশী কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে, তারা তত বেশী জ্ঞানী হ’তে পারবে এবং তাদের চিন্তার দিগন্ত তত বেশী উন্মোচিত হবে। বিশেষ করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যে দৃষ্টান্ত সমূহ দিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সেগুলো আমাদের চিন্তাশক্তি শাণিত করতে সবচেয়ে বেশী সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এখানে তেমনি একটি উপমা পেশ করা হ’ল। আল্লাহ বলেন,

أَيَوَدُّ أَحَدُكُمْ أَنْ تَكُونَ لَهُ جَنَّةٌ مِنْ نَخِيلٍ وَأَعْنَابٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ لَهُ فِيهَا مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَأَصَابَهُ الْكِبَرُ وَلَهُ ذُرِّيَّةٌ ضُعَفَاءُ فَأَصَابَهَا إِعْصَارٌ فِيهِ نَارٌ فَاحْتَرَقَتْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ-

‘তোমাদের কেউ কি এটা পসন্দ করে যে, তার একটি খেজুর ও আঙ্গুর বাগিচা থাকবে। যার নীচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হবে। যে বাগিচায় সব ধরনের ফল-ফলাদি থাকবে। আর ঐ ব্যক্তি বার্ধক্যে উপনীত হবে এমতাবস্থায় যে, তার দুর্বল সন্তানাদি রয়েছে। এমতাবস্থায় তার বাগানে অগ্নিপূর্ণ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলো, যাতে সবকিছু পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেল? এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’ (বাক্বারাহ ২/২৬৬)

এখানে একজন লোকের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, যে কয়েকভাবে নিজের অন্তরকে তার বাগানের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে :

(১) এটি একটি বাগান, কোন ছোট ক্ষেত নয়।

(২) এ বাগানে বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। খেজুর গাছ, আঙুর গাছ সহ আরো অনেক রকমের ফলমূলের গাছ।

(৩) এ বাগানে পানি সেচ দেওয়ার জন্য কুয়া থেকে কষ্ট করে পানি উঠাতে হয় না এবং দূর থেকে পানি আনার প্রয়োজন পড়ে না; বরং এ বাগানের মাঝ দিয়ে একাধিক প্রবহমান নদী রয়েছে, যা থেকে খুব সহজেই সেচের ব্যবস্থা করা যায়।

(৪) আর লোকটি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার এমন একটি জীবিকার উৎসের প্রয়োজন পড়ে, যেখান থেকে সম্পদ আহরণে খুব বেশী কষ্ট করতে হয় না। সেদিক থেকে এই বাগানটি তার জন্য যথার্থ।

(৫) তার দুর্বল কিছু সন্তান রয়েছে, যারা ছোট ফলে তার বৃদ্ধ পিতার উপার্জনে সহযোগিতা করতে অক্ষম। উপরন্তু বাগান ছাড়া তাদের জীবিকার কোন উৎসও নেই।

তাই এই বাগানকে ঘিরে লোকটির অনেক আশা-ভরসা জড়িয়ে আছে এবং বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবে এই বাগান তার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই বাগানে যদি আগুন লেগে যায় বা প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায়, তাহ’লে তার আশাভঙ্গের অনুভূতিটা কেমন যন্ত্রণাদায়ক হবে? অতঃপর আল্লাহ আয়াতের শেষে বললেন, আমি এই উপমাটি দিলাম, যাতে মানুষ আমার নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।

মূলতঃ উপদেশ দেওয়ার জন্য আল্লাহ বান্দার সামনে এমন উদাহরণ পেশ করে থাকেন, যাতে বান্দা চিন্তা-ভাবনা করে। আর যখন আমরা আল্লাহর চাহিদা মাফিক এই আয়াত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করব এবং পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে দেখব, তখন এ আয়াতের মাধ্যমে উপস্থাপিত দৃষ্টান্তটি আমাদের নিকট দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর তা হ’ল- আয়াতে বাগানের মালিকের দুরবস্থাটি মূলতঃ রিয়াকারী ও দান করে খোঁটাদানকারীর উদারহণ। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য দান-ছাদাক্বাহ করবে অথবা দান করে খোঁটা দিবে, ক্বিয়ামতের দিন যখন সে নিজের নেক আমলের মুখাপেক্ষী থাকবে, তখন সে তার আমলগুলো বিক্ষিপ্ত ধূলিকণারূপে দেখতে পাবে।

ঘূর্ণিঝড়ে বাগান ধ্বংস হয়ে মালিকের যে দুরবস্থা হয়েছে, তেমনি রিয়া ও খোঁটা দেওয়ার কারণের বান্দার নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং সে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে মানুষ ইখলাছের সাথে আমল করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হবে।

এভাবে কুরআনে আরো অনেক উপমা দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং আল্লাহমুখী হয়।

৬. আত্মসমালোচনা করা :

আত্মসমালোচনার অর্থ হ’ল নিজের কাজের খোঁজ-খবর রাখা। আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার জন্য আমি কতটুকু আমল করতে পারলাম, যতটুকু আমল করার প্রয়োজন ছিল ততটুকু পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে পারলাম কি-না, ইবাদত সঠিকভাবে রাসূলের তরীকায় হচ্ছে কি-না, সঠিকভাবে মনোযোগী হয়ে ছালাত আদায় করতে পারছি কি-না, আখেরাতের পাথেয় কতটুকু সঞ্চয় করতে পারলাম, আগের তুলনায় আমার ইবাদতের অগ্রগতি হচ্ছে কি-না, এই ধরনের বিষয় নিয়ে নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার নাম হ’ল ‘আত্মসমালোচনা’। মহান আল্লাহ আত্মসমালোচনার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ، وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য কি অগ্রিম প্রেরণ করছে? আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’ (হাশর ৫৯/১৮-১৯)

মানুষ যদি আত্মসমালোচনা না করে, তাহ’লে সে তার পাপের চোরাগলিগুলো বন্ধ করতে পারবে না এবং নেকীর কাজে অগ্রগামী হ’তে পারবে না। তাবেঈ মায়মূন ইবনে মেহরান (রহঃ) বলেন,النفس كالشَّريك الخوَّان إن لم تحاسبه؛ ذهب بمالك، ‘মন হ’ল আত্মসাৎকারী শরীকের মতো। যদি তুমি তার হিসাব-নিকাশ না নাও, তাহ’লে সে তোমার ধন-দৌলত নিয়ে পালিয়ে যাবে’।[12]

মাকহূল আশ-শামী (রহঃ) বলেন, مَنْ آوَى إِلَى فِرَاشِهِ، يَنْبَغِي أَنْ يَتَفَكَّرَ فِيمَا صَنَعَ فِي يَوْمِهِ ذَلِكَ، فَإِنْ كَانَ عَمِلَ فِيهِ خَيْرًا، يَحْمَدُ اللهَ تَعَالَى عَلَى ذَلِكَ، وَإِنْ عَمِلَ ذَنْبًا اسْتَغْفَرَ اللهَ مِنْهُ، وَرَجَعَ عَنْ قَرِيبٍ، فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ، كَانَ كَمَثَلِ التَّاجِرِ الَّذِي يُنْفِقُ، وَلَا يَحْسِبُ حَتَّى يُفْلِسَ وَلَا يَشْعُرُ، ‘কোন বান্দা যখন রাতের বেলা ঘুমাতে যাবে, তখন তার কর্তব্য হ’ল দিনের কাজ-কর্ম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। যদি কোন ভাল কাজ করে থাকে, তবে এর জন্য আল্লাহর প্রশংসা করবে। আর যদি কোন পাপ করে থাকে, তাহ’লে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং সেই পাপ থেকে অতিসত্বর তওবা করে ফিরে আসবে। যদি সে চিন্তা-ভাবনার এই কাজটি না করতে পারে, তবে তার তুলনা হ’ল সেই ব্যবসায়ীর মতো, যে হিসাব না করে দেদারচে খরচ করে, অবশেষে নিজের অজান্তেই সর্বস্বান্ত হয়ে যায়’।[13]

৭. হৃদয়ের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা :

চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্থ হওয়ার আরেকটি উপায় হ’ল চারপাশের ঘটনা প্রবাহ ও ইতিহাসের কাহিনীগুলো হৃদয়ের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা এবং ভাবনার সাগরে ডুব দেওয়া। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল নবী-রাসূল ও সালাফদের জীবনী অধ্যয়ন ও গবেষণা করে নিজেদের জন্য উপদেশ খুঁজে বের করা। কারণ নবী-রাসূলদের জীবন চরিত গভীরভাবে অধ্যয়ন না করলে খুব কমই শিক্ষা হাছিল করা যায়। সাময়িকভাবে প্রভাবিত হ’লেও হৃদয়জগতে এর সুদূরপ্রসারী আবেদন থাকে না। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে নবীকে সম্বোধন করে বলেছেন, أَرَأَيْتَ ‘(হে নবী!) আপনি কি দেখেননি? যেমন সূরা ফীলে প্রথম আয়াতে বলেছেন, ‘তুমি কি শোনো নি, তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন?’ এখানে চর্ম চোখ দিয়ে দেখতে বলা হয়নি, আর সেটা সম্ভবও ছিল না; বরং এখানে হৃদয়ের চোখ দিয়ে সেই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে, যাতে সেখান থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ২৫জন নবীর কাহিনী বর্ণনা করেছেন কেবল উপদেশ গ্রহণের জন্য। তিনি বলেন,لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَى وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ- ‘নিশ্চয়ই নবীদের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। এগুলি কোন বানোয়াট রচনা নয়। বরং এগুলিতে রয়েছে পূর্বেকার আসমানী কিতাব সমূহের সত্যায়ন ও (মানুষের প্রয়োজনীয়) সকল বস্ত্তর বিশদ বিবরণ এবং রয়েছে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য সুপথ প্রদর্শন ও আল্লাহর রহমত’ (ইউসুফ ১২/১১১)। মানুষ যখন নবীদের জীবনী পড়বে, এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, তখন তার ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। হৃদয় যমীন সিক্ত হবে ঈমানের স্বচ্ছ সলিলে। নবীদের আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণে সে হয়ে উঠবে পাগলপারা। স্বীয় রবের অনুগত্যে সে শতগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ঈমান ও আমলে বলীয়ান হয়ে ছুটবে জান্নাতের পানে।

পাশাপাশি কুরআনে বিভিন্ন অবাধ্য জাতি ও কাফের-মুশরিকদের পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। যেন মানুষ এগুলোকে কেবল কাহিনী হিসাবে অধ্যয়ন না করে; বরং সেখান থেকে শিক্ষা লাভ করে তাদের পথে পা না বাড়ায়। আল্লাহ তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন,فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ- ‘অতএব এদের কাহিনী বর্ণনা কর যাতে তারা চিন্তা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৬)। অতএব পৃথিবীর ঘটিত ও ঘটমান দৃশ্যাবলীকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করা উচিত। এমনকি মানুষ যদি চিন্তার দৃষ্টি দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা খড়-কুটোর দিকেও তাকায়, সেখানেও সে নিজের জন্য উপদেশ খুঁজে পাবে ইনশাআল্লাহ।

৮. শিক্ষা সফর করা :

চিন্তা করার একটি বড় মাধ্যম হ’ল আল্লাহর যমীনে ভ্রমন করা। আল্লাহ বলেন, قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- ‘তুমি বল, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ কিভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন পুনরায় সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপরে সর্বশক্তিমান’ (আনকাবূত ২৯/২০)। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতে মানুষকে ভ্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং উপদেশ লাভ করতে পারে।[14]

মানুষ যখন দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে, তাহ’লে আল্লাহ বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি দেখে হতবাক না হয়ে পারবে না। বাড়ি থেকে একটু দূরে গেলেই এমন মানুষের সাথে তার দেখা হয়, যারা তাকে চেনে না এবং সেও তাদের চেনে না। আরেকটু দূরে গেলে দেখতে পাবে, সেখানকার মানুষের মুখগুলো অপরিচিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের ভাষাগুলোও অপরিচিত। অথচ তারা আমার মতো দেখতে। কিন্তু তাদের ভাষা, কৃষ্টি-কালচার, খারাব-দাবার, রুচি-অভিরূচি একেবারেই ভিন্ন। আবার এমন অদ্ভূত দৃশ্য ও প্রাণী তার চোখের সামনে পড়বে, যা সে ইতিপূর্বে কখনোই দেখেনি। অনুরূপভাবে সফর করলে মানুষ দেখতে পাবে- পূর্বেকার অবাধ্য জাতিগুলোকে আল্লাহ কিভাবে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করেছেন। অথচ তারা শক্তি-সামর্থ্যে আমাদের চেয়েও অনেক শক্তিশালী ছিল। তাদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, ধনৈশ্বর্য আল্লাহর আযাবের সামনে টিকতে পারেনি।

এভাবে বান্দা যদি উপকারী চিন্তা-ভাবনা করার হৃদয় নিয়ে সফরে বের হয়, তা’হলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে তার শিক্ষা অর্জন শুরু হবে, তার ভাবনার জগৎ প্রসারিত হ’তে থাকবে এবং সে চিন্তার ইবাদতে তাওফীক্ব লাভে ধন্য হবে।

৯. সবকিছু থেকে উপদেশ হাছিলের চেষ্টা করা :

চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার একটি কার্যকরী উপায় হ’ল- পৃথিবীর সবকিছু হৃদয়ের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শেখা। কেউ যদি এটা করতে পারেন, তাহ’লে তিনি চারপাশের সবকিছু থেকে উপদেশ হাছিল করতে পারবেন। যেমন বৃষ্টির কথা ধরা যাক। শ্রাবণের বাদলা দিনে বৃষ্টি দেখে কারো মনে রোমান্টিকতার অনুভূতি তৈরী হয়। কেউ বৃষ্টি বিলাস করে। কেউ আবার এটাকে দো‘আ কবুলের মুহূর্ত হিসাবে গ্রহণ করে। কেউ মেঘের গর্জন শুনে আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। আবার আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টির ফোঁটায় কারো মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয় না। মূলতঃ ঈমানের তারতম্য অনুযায়ী মানুষের মনের এই পরিবর্তন ঘটে। যারা চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্থ হন, তারা এই বৃষ্টিকে নিছক উপভোগের বিষয় মনে করতে পারেন না। রাসূল (ছাঃ) মেঘের গর্জন শুনলে আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে দো‘আ করতেন। বৃষ্টি দেখলে দো‘আ পড়তেন। অনুরূপভাবে রাত-দিনের মাঝে উপদেশ গ্রহণের খোরাক রয়েছে। আল্লাহ বলেন,يُقَلِّبُ اللهُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ، ‘আল্লাহ দিবস ও রাত্রির পরিবর্তন ঘটান। নিশ্চয়ই এর মধ্যে চক্ষুষ্মানদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে’ (নূর ২৪/৪৪)

সুতরাং রাত-দিনের বিবর্তন, চন্দ্র-সূর্য, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র-মরুভূমি, গাছ-গাছালী, হরেক রকমের জীব-জন্তু, বিভিন্ন স্বাদের ফল-মূল ও খাদ্রসামগ্রী প্রভৃতি থেকে মানুষ শিক্ষা হাছিল করতে পারে। বান্দা যদি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এগুলোর দিকে তাকায়, তাহ’লে সে সবকিছু থেকে উপদেশ লাভ করতে পারবে। ওলামায়ে কেরাম বলেন,مَنْ نَظَرَ إِلَى الدُّنْيَا بِغَيْرِ الْعِبْرَةِ انطَمَسَ مِنْ بَصَرِ قَلْبِهِ بِقَدْرِ تِلْكَ الغَفْلَة، ‘যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণের উদ্দেশ্য না নিয়ে দুনিয়ার দিকে তাকায়, তার গাফলতির মাত্রা অনুযায়ী তার অন্তর্দৃষ্টির চিহ্ন মুছে যায়’।[15]

১০. আল্লাহর কাছে দো‘আ করা :

আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন নেক আমলের তাওফীক্ব লাভ করা সম্ভব হয় না। তাই চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্থ হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী প্রার্থনা করা উচিত। সালাফে ছালেহীন চিন্তার ইবাদতের জন্য সর্বদা উন্মুখ থাকতেন। তারা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলতেন,اللَّهُمَّ اجْعَلْ نَظَرِي عِبَرًا، وَصَمْتِي تَفَكُّرًا، وَمَنْطِقِي ذِكْرًا، ‘হে আল্লাহ! আমার দৃষ্টিকে উপদেশ লাভের মাধ্যম বানিয়ে দাও, আমার মৌনতাকে চিন্তা-ভাবনার সহায়ক বানাও এবং আমরা বাকশক্তিকে তোমার যিকিরে নিয়োজিত করে দাও’।[16]

মহান আল্লাহ আমাদেরকে আলোচিত উপায়গুলো অবলম্বন করে চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্থ হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন এবং আমৃত্যু ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর দৃঢ় রাখুন-আমীন! [ক্রমশঃ]

-আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ*

 এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[1]. তাফসীরে নাসাফী, ৪/২২৭।

[2]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/৬০২।

[3]. গাযালী, ইহ্ইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৪/৪২৪।

[4]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃ. ১৯৮।

[5]. মুসনাদে আহমাদ হা/১২৩৬; নাসাঈ হা/৫৬৫১; ইরওয়াউল গালীল হা/৭৭২; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৭৯, ছহীহ হাদীছ।

[6]. ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫৮৪, সনদ ছহীহ।

[7]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের, পৃ. ৫৪।

[8]. শামসুদ্দীন মানবাজী, তাসলিয়াতু আহলিল মাছায়েব, পৃ. ২০৫।

[9]. বুখারী হা/১২৩৯,১২৪০; মিশকাত হা/১৫২৪।

[10]. আহমাদ হা/৯৭৬; আবূদাঊদ হা/৩০৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭১৭; ছহীহাহ হা/১৩৬৭, সনদ ছহীহ।

[11]. বুখারী হা/১৩৫৬; আবূদাঊদ হা/৩০৯৫।

[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান, ১/৭৯।

[13]. আবূল লায়েস সামারকান্দি, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ৭৫২।

[14]. তাফসীরে ফাৎহু ক্বাদীর ৪/২২৮।

[15]. ইবনু কাছীর, তাফসীরে ইবনে কাছীর ২/১৮৫।

[16]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ৬/৭৭।






বিষয়সমূহ: আমল
রিয়া : পরিচয় ও প্রকারভেদ - ড. নূরুল ইসলাম
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইমামদের দায়িত্ব ও কর্তব্য - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ছিয়ামের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল সমূহ - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আকাঙ্ক্ষা : গুরুত্ব ও ফযীলত - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শিশুদের চরিত্র গঠনে ‘সোনামণি’ সংগঠনের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আদল : মানব জীবনের এক মহৎ গুণ - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
আরও
আরও
.