পর্ব ১ ।
৫. চিন্তা-ভাবনা না করা গাফেল ও মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য :
যাদের মাঝে চিন্তা-ভাবনার গুণ নেই, অমানিশার ঘোর আঁধারে আচ্ছন্ন হয় তাদের হৃদয়জগৎ। ফলে তারা আল্লাহর দেওয়া আলো-বাতাস এবং অথৈ নে‘মতে ডুবে থেকেও তাঁর বড়ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। মহাবিশ্বের অনাচে-কানাচে আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টি নিদর্শন দেখেও তারা সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে তারা নিজেদের অজান্তেই শিরকের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, وَكَأَيِّنْ مِنْ آيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَمُرُّوْنَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُونَ، وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُوْنَ- ‘আর নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে কতই না নিদর্শন রয়েছে, যেগুলি তারা অতিক্রম করে। অথচ সেগুলিকে তারা এড়িয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ তারা শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৫-১০৬)। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতের মাধ্যমে পূর্ববতী সম্প্রদায়ের শাস্তির দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যারা আল্লাহর সৃষ্টিরাজি অবলোকন করত। কিন্তু এগুলো নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করত না’।[1]
আব্দুর রহমান আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, তারা আকাশ-যমীন ও যাবতীয় সৃষ্টিরাজি দেখে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিত। আল্লাহ্কে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা এবং সবকিছুর নিয়ন্তা হিসাবে বিশ্বাস করত। কিন্তু তাঁর ইবাদত করতে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হ’ত। অর্থাৎ তাওহীদে রুবূবিয়্যাতে বিশ্বাসী হ’লেও তাওহীদে উলূহিয়্যাতের ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে শরীক করত। এর মূল কারণ হচ্ছে তারা আল্লাহর সৃষ্টি ও নিজেদের নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করত না।[2] ইমাম বাগাভী (রহঃ) বলেন, মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য হ’ল-لَا يَتَفَكَّرُوْنَ فِيْهَا وَلَا يَعْتَبِرُوْنَ بِهَا، ‘তারা (আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে) চিন্তা-গবেষণা করে না এবং উপদেশ হাছিল করে না’।[3]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এই আয়াতে মহান আল্লাহ্ অধিকাংশ মানুষের উদাসীনতার ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন, যারা আল্লাহর তাওহীদের অকাট্য প্রমাণবাহী নিদর্শন সমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। কেননা আল্লাহ আকাশ-যমীন সৃষ্টি করেছেন। চন্দ্র, সূর্য, দেদীপ্যমান তারকারাজি এবং ঘূর্ণয়মান নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে তিনি আকাশের শোভা বর্ধন করেছেন। আর সবকিছু করেছেন তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। অপরদিকে যমীনকে বসবাসযোগ্য করে ছড়িয়ে দিয়েছেন অগণিত নে‘মত। গাছ-গাছালী, বাগ-বাগিচা, সুদৃঢ় পর্বতমালা, ঊর্মিল স্ফীত সমুদ্র, তটভূমির উপরে আছড়ে পড়া উন্মত্ত তরঙ্গমালা, জন-মানবাহীন বিরাণ মরুভূমি, একই মাটি থেকে উৎপন্ন নানা ধরনের ভিন্ন স্বাদের ফল-ফলাদী এবং হরেক সুবাসের রঙ-বেরঙের পুষ্পরাজি, জন্ম-মৃত্যু, উষর ভূমিকে আসমানী বারিধারায় সিক্ত করে তাতে উদ্ভিদ অঙ্কুরোদগমের অলৌকিকত্ব- এসবই মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির অনন্য নির্দশন। এতে রয়েছে চিন্তাশীল বান্দাদের জন্য উপদেশ। এতে রয়েছে আল্লাহর একত্ব, বড়ত্ব, অমুখাপেক্ষিতা এবং সীমাহীনতার সমুজ্জ্বল প্রমাণ।[4]
বান্দা যদি তার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়ে এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে, তাহ’লে সে জেনে হোক বা না জেনে হোক শিরক করে বসবে। সুতরাং শিরকের মতো ঈমান বিধ্বংসী ভয়ংকর পাপ থেকে বাঁচার জন্য চিন্তার ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম।
৬. চিন্তা-ভাবনা করা বিচক্ষণ বান্দার বৈশিষ্ট্য :
চিন্তা-ভাবনা ছাড়া মানব হৃদয় প্রশস্ত হয় না। জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত হয় না। হৃদয় যমীনে উপকারী ভাবনার আবাদ হয় না। সেজন্য মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের চিন্তার ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা তাঁর সৃষ্টির নিপুণত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তাদেরকে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হিসাবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,إِنََّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ، الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- ‘নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে জ্ঞানীদের জন্য (আল্লাহর) নিদর্শন সমূহ রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এগুলিকে অনর্থক সৃষ্টি করনি। মহা পবিত্র তুমি। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও!’ (আলে ইমরান ৩/১৯০-১৯১)।
আব্দুর রহমান আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন,دل هذا على أن التفكر عبادة من صفات أولياء الله العارفين، فإذا تفكروا بها، عرفوا أن الله لم يخلقها عبثا، ‘এই আয়াত প্রমাণ করে যে, চিন্তার ইবাদত করা আল্লাহর জ্ঞানী বন্ধুদের বৈশিষ্ট্য। যখন তারা এগুলো (আকাশ-যমীন, দিন-রাতের আবর্তন-বিবর্তন) নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, তখন তারা বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি’।[5]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) ‘উলুল আল্বাব’ বা জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন,هي التفكر في قدرة الله تعالى ومخلوقاته والعبر الذي بث، ليكون ذلك أزيد بصائرهم: وفي كل شيء له آية + تدل على أنه واحد، ‘সেটা হচ্ছে আল্লাহর কুদরত, তাঁর সৃষ্টিরাজি এবং ছড়িয়ে থাকা দৃষ্টান্ত সমূহ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, যেন তাদের দূরদর্শিতা আরো বৃদ্ধি পায়। কেননা সবকিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, তিনি এক ও একক’।[6]
শায়খ আবূ সুলাইমান আদ-দারাণী (রহঃ) বলেন, একদিন আমি চিন্তাশীল হৃদয়ে ঘর থেকে বের হ’লাম। ফলে যে বস্ত্ততেই আমার চোখ পড়ল, সেখানেই দেখতে পেলাম আল্লাহর অফুরন্ত নে‘মত এবং আমার জন্য উপদেশের খোরাক’।[7]
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, يَا ابْنَ آدَمَ، كُلْ فِي ثُلُثِ بَطْنِكَ، وَاشْرَبْ فِي ثُلْثِهِ، وَدَعْ ثُلُثَهُ الْآخَرَ تتنفَّس لِلْفِكْرَةِ، ‘হে আদম সন্তান! তুমি তোমার পেটের এক-তৃতীয়াংশে খাদ্য খাও, এক তৃতীয়াংশে পান কর এবং বাকীটুকু রেখে দাও চিন্তা-ভাবনার সাথে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য’।[8]
৭. বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে চিন্তার প্রভাব :
বিশ্বে দু’ভাবে যুদ্ধ হয়। একটি হ’ল বিপদজনক হাতিয়ার ব্যবহার করে রক্তপাতের মাধ্যমে। আরেকটি হ’ল কোন রক্তপাত ছাড়াই প্রতিপক্ষের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব ফেলার মাধ্যমে। যুদ্ধের এই দ্বিতীয় প্রকারকে বলা হয় Ideological War বা চিন্তাযুদ্ধ। এই যুদ্ধ সশস্ত্র যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর। অধুনা বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ বাতিলপন্থীদের পক্ষ থেকে একটি সর্বগ্রাসী ও মারাত্মক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মতাদর্শিক আক্রমণের শিকার। বর্তমান মুসলিমদের সাথে অমুসলিমদের সশস্ত্র যুদ্ধ না থাকলেও চিন্তাযুদ্ধ চলছে তুমুলভাবে। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, এই চিন্তাযুদ্ধে মুসলিমরাই ধরাশায়ী হচ্ছে বেশী। সেক্যুলারিজমের বিষবাষ্পে নীল হয়ে যাচ্ছে আমাদের কোমল চেতনাবোধ। সাম্রাজ্যবাদ প্রাচ্যবাদের কাঁধে ভর করে চষে বেড়াচ্ছে আমাদের মনজগত। ইহুদীদের গুপ্ত সংগঠন ও সংস্থাগুলো কেটে দিচ্ছে আমাদের ঈমানী প্রতিরোধব্যূহের একেকটি শিকড়। গ্লোবালাইজেশন অন্তসারশূণ্য করে ফেলেছে আমাদের চিন্তা-চেতনা। গ্রিকদর্শন, মুক্তচিন্তা, হিউমেনিজম, ইনলাইটম্যান্ট মুভমেন্ট, মর্ডানিজম সহ হরেক রকমের তত্ত্ব ও মতবাদের ধূম্রজালে মুসলিম সমাজ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে তারা নামে মুসলিম থাকলেও চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে আচরণ করছে অমুসলিমদের মতই। ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ভুলে গিয়ে আমদানী করছে বস্তা পঁচা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। মুসলিম হয়েও ধর্মহীন পৃথিবী গড়ার খোয়াব দেখছে প্রতিনিয়ত। ঈমানী শক্তির বদলে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে প্রযুক্তি ও অস্ত্রশক্তির উপর। কিন্তু এই তাইরে নাইরে প্রচেষ্টার ফলাফল নেই বললেই চলে। উপরন্তু লাঞ্ছনার ঘানি টানতে হচ্ছে আমাদের গোটা মুসলিম জাতিকে।
যদি আমরা আমাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করতে না পারি, ইহুদী-খ্রিষ্টানদের মুহুর্মুহু চৈন্তিক আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য ঈমানী বর্মে আচ্ছাদিত হয়ে হৃদয়জগতে বিশুদ্ধ চিন্তার লালন না করি, শারঈ বিধি-বিধানকে স্বাভাবিক করার কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেদের হেফাযত করতে না পারি, চিন্তাযুদ্ধে ধরাশায়ী মুসলিম উম্মাহর জন্য উত্তোরণের পথ তালাশ না করি, তাহ’লে আমাদের এই দৈন্যদশার কালো মেঘ অপসারণ করা কখনো সম্ভব হবে না। সুতরাং বিধর্মীদের ঈমান বিধ্বংসী ষড়ষন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ইসলামের চিরন্তন আদর্শকে সমুজ্জ্বল মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মেষ সাধন ছাড়া মুসলিম উম্মাহর কোন গত্যন্তর নেই। আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মেষের মূল যোগানদাতা হ’ল চিন্তার ইবাদত। মুসলিমরা যখন চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্ত হবেন, কুরআন-হাদীছ গবেষণায় উন্মীলিত হবেন, নির্ভরযোগ্য আলেমদের বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ অধ্যয়নে গুরুত্বারোপ করবেন, তখন তাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হবে। ফলে তারা আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সবগুলো রণাঙ্গণে ইসলামের চৌকষ ও যোগ্য সৈনিকে পরিণত হবেন। আর মুহাম্মাদী আদর্শের আলোকিত চিন্তার অধিকারী এই বান্দাদের জামা‘আতবদ্ধ ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামের বিপ্লব সাধিত হবে। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
৮. গাফেল হৃদয় শাস্তির সম্মুখীন হয় :
যাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা সেই হৃদয় দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টি নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না এবং উপদেশ হাছিল করে না, তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ- ‘আমরা বহু জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না। চোখ আছে কিন্তু দেখে না। কান আছে কিন্তু শোনে না। ওরা হ’ল চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চাইতেও পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
আবূ জা‘ফর তাবারী (রহঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, لهؤلاء الذين ذرأهم الله لجهنم من خلقه قلوب لا يتفكرون بها في آيات الله، ولا يتدبرون بها أدلته على وحدانيته، ولا يعتبرون بها حُجَجه لرسله، فيعلموا توحيد ربِّهم، ويعرفوا حقيقة نبوّة أنبيائهم، ‘মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে তাদেরকেই জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যাদের হৃদয় আছে; কিন্তু সেই হৃদয় দিয়ে আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না, তাঁর একত্বের প্রমাণবাহী দৃষ্টান্তসমূহ নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখে না এবং তাঁর নবী-রাসূলদের দলীল-প্রমাণ থেকেও উপদেশ হাছিল করে না। যদি তারা গভীরভাবে চিন্তা করত, তাহ’লে তাদের রবের তাওহীদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করত এবং তাদের নবীদের নবুঅতের সত্যতা সম্পর্কেও অবগত হ’তে পারত’।[9] অর্থাৎ মানুষ যদি আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা করত, তাহ’লে তারা আল্লাহর প্রতি খালেছভাবে ঈমান আনত এবং তাঁর নবী-রাসূলদের অনুগত্য করত। কিন্তু গভীর চিন্তার অধিকারী না হওয়ার করণে তারা চোখ থাকতেও অন্ধ, কান থাকতেও বধির হয়ে পড়েছে। তাদের চিন্তা-ভাবনার শুষ্কতা ও অনুধাবনের ঔদাসীন্যের কারণে খুব সহজে তারা শয়তানের খপ্পরে পড়ে গেছে এবং আল্লাহর অবধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে। বিশর আল-হাফী (রহঃ) বলেন, لو تفكر الناس في عظمة الله تعالى لما عصوه، ‘মানুষ যদি আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত, তাহ’লে তারা কখনই আল্লাহর অবাধ্যতা করত না’।[10] অর্থাৎ মানুষের পাপাচার ও অবাধ্যতার অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে চিন্তার ইবাদতে নিমগ্ন না থাকা।
চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রসমূহ
মহান আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন চিন্তাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং কল্যাণকর কাজের জন্য সেই চিন্তা শক্তি ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে যেন মহাবিশ্ব, আকাশ-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, রাত-দিনের আবর্তন-বিবর্তন, অন্ধকার-আলো, পৃথিবীর আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতি, জন্ম-মৃত্যু, গাছ-গাছালী, ফসল-ফলাদি প্রভৃতি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে, এর মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং তাঁর অনুগত্যে নিজেকে সোপর্দ করতে পারে। ইসলামী শরী‘আতে চিন্তা-ভাবনা করার কিছু ক্ষেত্র ও উপাদান বাৎলে দেওয়া হয়েছে। নিমেণ এ ব্যাপারে আলোকপাত করা হ’ল-
১. নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা :
অন্য কিছুর চেয়ে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা অতি উত্তম। কারণ আমরা অন্যদের চেয়ে নিজেদের সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী থাকি। তাই অন্য কিছুর চেয়ে নিজেদের সম্পর্কে আমরা অধিক জানি। এজন্য মহান আল্লাহ নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ- ‘আর নিদর্শন রয়েছে তোমাদের মাঝেও, তোমরা কি দেখ না’ (যারিয়াত ৫১/০৮)? এখানে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চর্ম চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে বলা হয়নি; বরং অন্তরের গভীর দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে।
ইমাম গাযালী বলেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মাঝে অন্যতম নিদর্শন হ’ল ‘বীর্য থেকে মানুষের সৃষ্টি’। আপনার জন্য সবচেয়ে নিকটবর্তী নিদর্শন আপনি নিজেই। আপনার মাঝেই তো কত আশ্চর্যের বিষয় বিদ্যমান। এসব আশ্চর্যের বিষয় আমাকে-আপনাকে আল্লাহর বড়ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানব সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর কত কুদরত বিদ্যমান, তার শতভাগের এক ভাগ জানতে গেলেও শত শত বছর কেটে যাবে, তবুও জানার শেষ হবে না। কিন্তু আপনি তো অন্যমনস্ক! হে গাফেল ব্যক্তি! আপনি নিজের সম্পর্কে উদাসীন, নিজেকেই আপনি জানেন না, তাহ’লে অন্য কিছু সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আপনি কিভাবে আগ্রহী হবেন? ভেবে দেখুন! আপনি কেবল এক ফোঁটা বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়েছেন।
আল্লাহ বলেন, قُتِلَ الْإِنْسَانُ مَا أَكْفَرَهُ، مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ، مِنْ نُطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَه، ثُمَّ السَّبِيلَ يَسَّرَهُ، ثُمَّ أَمَاتَهُ فَأَقْبَرَهُ، ثُمَّ إِذَا شَاءَ أَنْشَرَهُ، ‘ধ্বংস হৌক মানুষ! সে কতই না অকৃতজ্ঞ। (সে কি ভেবে দেখে না) কি বস্ত্ত হ’তে (আল্লাহ) তাকে সৃষ্টি করেছেন? শুক্রবিন্দু হ’তে। তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তার তাক্বদীর নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর তার (ভূমিষ্ঠ হওয়ার) রাস্তা সহজ করে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার মৃত্যু ঘটান ও তাকে কবরস্থ করেন। অতঃপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন তাকে পুনর্জীবিত করবেন’ (আবাসা ৮০/১৭-২২)। তিনি আরো বলেন,وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِذَا أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُونَ- ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা এখন (জীবিত) মানুষ হিসাবে ছড়িয়ে পড়েছ’ (রূম ৩০/২০)।
যদি আপনি দেওয়ালের ওপর কোন মানুষের ছবি দেখেন, তবে আশ্চর্য হয়ে যান। আবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। চিত্রকরের চিত্রকর্ম আপনাকে বিমুগ্ধ করে। ছবিটি মানুষের আকৃতির মতো হওয়ার কারণে অবলিলায় বলে ফেলেন- ‘এটা তো একদম মানুষের মতই!’। চিত্রকরের শিল্পকৌশল, দক্ষতা, তাঁর হাতের নিপুণতা এবং পারদর্শিতা আপনাকে মুগ্ধ করে তোলে। আপনার অন্তরে সে বিরাট স্থান করে নেয়। যদিও আপনি জানেন যে, এটা কেবল রঙ ও কলমের সংমিশ্রণ। এগুলোর কোনটিই চিত্রকরের নিজের কাজ বা নিজের সৃষ্টি নয়। দুর্ভাগ্যজন হ’লেও সত্য যে, আপনি মানুষের তৈরী একটা স্থির চিত্রকর্ম দেখে যতটা অবাক হয়ে যান, বাস্তব মানুষকে দেখে অতটা বিস্মিত হ’তে পারেন না। এমনকি আপনার সেই মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনুভূতিও হৃদয়ে জাগ্রত হয় না। মনের উঠানে একবারো ঝরে পড়ে না শুকরিয়ার বৃষ্টি ফোঁটা। কিন্তু আপনি যদি ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে নিজের দিকে একবার তাকান, তাহ’লে আরো বিস্ময়াভিভূত ও হতভম্ব হয়ে যাবেন।
এক ফোঁটা বীর্যের কথা চিন্তা করুন! এটা যদি কোথাও ফেলা হয়, তাহ’লে বাতাসে নষ্ট হয়ে যাবে, পঁচে যাবে। কিন্তু কিভাবে রাববুল আলামীন স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে পুরুষের মেরুদন্ড ও বক্ষপাঁজরের থেকে সেই শুক্রবিন্দু বের করে আনলেন? কিভাবে শিরা-উপশিরা থেকে নির্গত করে নারীর স্রাবের রক্তকে রেহেমের মাঝে প্রবেশ করালেন? এরপর কিভাবে তিনি শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করলেন একটি প্রাণ! কিভাবে তাকে সেখানে আহার যোগালেন! কিভাবে তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন, তাকে প্রতিপালন করলেন! কিভাবে তিনি সাদা-শুভ্র শুক্রবিন্দুকে লাল রক্তপিন্ডে পরিণত করলেন! এরপর তাকে পরিণত করলেন গোশতপিন্ডে! এরপর কিভাবে তিনি সেই গোশতপিন্ডতে তৈরী করলেন রগ, ধমনী, শিরা-উপশিরা, হাড় ও গোশত! কিভাবে তিনি গোশত, হাড়, শিরা-উপশিরা প্রভৃতিকে বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে স্থাপন করলেন! এরপর সৃষ্টি করলেন গোলাকার মাথা। শরীরের মাঝে উদ্ভাসিত করলেন নাক, কান, চোখ, মুখসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এরপর হাত-পার সংযোজন করলেন। হাত-পায়ের মাথায় দিলেন আঙুল। আর আঙুলের মাথায় দিলেন নখ। তারপর কিভাবে তিনি গঠন করলেন হৃদয়, পাকস্থলী, যকৃত, প্লীহা, ফুসফুস, গর্ভাশয়, মূত্রাশয়, অন্ত্রাদির মতো আভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো! যার প্রতিটি বিশেষ আকারের, বিশেষ পরিমাপের বিশেষ কর্যক্রমের জন্য সৃষ্টি। তারপর কিভাবে তিনি এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে সংস্থাপন করলেন। অতঃপর তৈরী করলেন হাড়-হাড্ডি। আর সেই হাড়কে শরীরের মূলভিত্তি বানালেন। এর মধ্যে কিছু হাড় ছোট, কিছু বড়। কিছু লম্বা তো কিছু গোলাকার। কিছু ফাঁপা, আবার কিছু ভরাট। কিছু মোটা তো কিছু চিকন। কিছু নরম, কিছু শক্ত।
কিভাবে তিনি এক ফোঁটা শুক্রাণুকে মাতৃগর্ভে এমন সুন্দর আকার দিলেন? তার জন্য সর্বোত্তম তাক্বদীর নির্ধারণ করলেন? অতঃপর তার মাঝে পয়দা করলেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি। তাকে দিলেন বোধশক্তি ও বাকশক্তি। তার জন্য সৃষ্টি করলেন পিঠ, যা পেটের জন্য ভিত্তি হয়েছে। তার পেটকে সৃষ্টি করলেন বিবিধ খাদ্যের আধার হিসাবে। তার মাথাকে সৃষ্টি করলেন সকল ভাবাবেগ, অনুভূতি ও জ্ঞান সংরক্ষণকারী রূপে।
এবার গর্ভাশয়ে অন্ধকারের মাঝে ভ্রূণের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করে দেখুন! যদি গর্ভাশয়ের ওপর থেকে এ আরবরণ সরিয়ে নেওয়া হ’ত, যদি তার মাঝে দেখার সুযোগ পাওয়া যেত, তাহ’লে কিভাবে ধীরে ধীরে একটি শিশুর আকৃতি আসে তা দেখা যেত। সাথে এও দেখা যেত যে, একজন রূপকার তাঁর অলৌকিক নৈপুণ্যে কিভাবে আকৃতি দিচ্ছেন, কিন্তু তার কোন সরঞ্জাম দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। আপনি কি এমন কোন রূপকার ও কাজের লোককে দেখেছেন, যিনি তার যন্ত্রে হাত না দিয়ে কাজ করে? আপনি কি দেখেছেন- কোন কারিগর তার বানানো বস্ত্তকে না ধরে, সেই জিনিষের সামনে না এসেই কাজ করে? সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহ কতই না উচ্চ মর্যাদার অধিকারী! কতই না অনুপম তাঁর সৃষ্টি কৌশল! কতই না সুস্পষ্ট তাঁর নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণ!’[11]
২. আসমান-যমীন ও অন্যান্য সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা :
মহান আল্লাহর অজস্র সৃষ্টির মধ্যে এক রহস্যময় সৃষ্টির নাম আকাশ। সুনিপুণ আকাশের দিকে তাকালে, একটু চিন্তা করলে মনের গহিনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়, কে সেই কারিগর? যিনি এ খুঁটিহীন বিশাল আকাশকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন? আল্লাহ বলেন, وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا، وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا، وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا، لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا، وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا، ‘আমরা তোমাদের মাথার উপরে নির্মাণ করেছি কঠিন সপ্ত আকাশ এবং তন্মধ্যে স্থাপন করেছি কিরণময় প্রদীপ। আমরা পানিপূর্ণ মেঘমালা হ’তে প্রচুর বারিপাত করি। যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য ও উদ্ভিদ এবং ঘনপল্লবিত উদ্যানসমূহ’ (নাবা ৭৮/১২-১৬)।
আকাশের রহস্যের শেষ কোথায় তা আল্লাহই ভালো জানেন। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এ সপ্তস্তর বা সাত আকাশের পুরুত্ব ও দূরত্ব নিয়ে কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ধারণা, এ সপ্তাকাশের প্রথম স্তরের পুরুত্ব আনুমানিক ৬.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। দ্বিতীয় আকাশের ব্যাস ১৩০ হাযার আলোকবর্ষ, তৃতীয় স্তরের বিস্তার ২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। চতুর্থ স্তরের ব্যাস ১০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। পঞ্চম স্তরটি ১ বিলিয়ন আলোকবর্ষের দূরত্বে, ষষ্ঠ স্তরটি অবস্থিত ২০ বিলিয়ন আলোকবর্ষের আর সপ্তম স্তরটি বিস্তৃত হয়ে আছে অসীম দূরত্ব পর্যন্ত। এগুলো স্রেফ অনুমান মাত্র। কারণ প্রকৃত বাস্তবতার সন্ধান পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
কত সময় অযথা নষ্ট হয়, অথচ বান্দা একটু সময় নিয়ে আল্লাহর এ সুনিপুণ আকাশ নিয়ে ভাবে না । তাই তো আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَجَعَلْنَا السَّمَاءَ سَقْفًا مَحْفُوظًا وَهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ، ‘আর আমরা আকাশকে সুরক্ষিত ছাদে পরিণত করেছি। অথচ তারা সেখানকার নিদর্শন সমূহ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে’ (আম্বিয়া ২১/৩২)। ইমাম ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে,لَا يَتَفَكَّرُونَ فِيمَا خَلَقَ اللهُ فِيهَا، ‘আল্লাহ (আসমান সমূহে) যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা নিয়ে তারা চিন্তা-গবেষণা করে না’।[12]
ইমাম শাওক্বানী (রহঃ) বলেন, তারা আকাশ ও সৌর জগৎকে নিয়ে সেইভাবে চিন্তা-গবেষণা করে না, যা তাদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করবে।[13] অর্থাৎ তারা হয়ত এগুলো নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করে, কিন্তু এই চিন্তা-ভাবনা যদি তাদেরকে ঈমানের পথে না নিয়ে আসে, তাহ’লে সেই গবেষণার কোন মূল্য নেই। যেমনভাবে বিশ্বের বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা সৌরজগৎ নিয়ে রাত-দিন গবেষণা করে চলেছে, কিন্তু এগুলোর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি তারা অবিশ্বাসী রয়ে গেছে। যদিও তাদের অনেকেই মহাকাশ গবেষণা করতে গিয়ে তাওহীদের আলোকিত রাজপথের পথিক হয়ে গেছেন। তাই জ্ঞানীদের উচিত আকাশের নান্দনিকতা, সুনিপুণ-সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। যা মহান রবের পরিচয় জানতে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানতে, সর্বোপরি মহান রবের অনুগত বান্দা হয়ে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। জ্ঞানীদের পরিচয় দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- ‘তারা আকাশ ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এগুলিকে অনর্থক সৃষ্টি করোনি। মহা পবিত্র তুমি। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’ (আলে ইমরান ৩/১৯১)।
আকাশ ও যমীন শুধু নিগূঢ় রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু নয়; রবং মনোহর রূপমাধুরী, অনুপম সৌন্দর্য ও নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই সৃষ্টিরাজি। যার লালিত্য অবলোকন করে প্রশান্ত হয় চিত্ত। বিমুগ্ধতার আবেশে সিক্ত হয় মনোজগৎ। নিঃসীম নীলাকাশ ও দিগন্তপ্রসারী যমীন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ-রং বদলায়। সকালে একরম, তো বিকেলে আরেক রকম। দিনে এক রকম, রাতে রূপ পাল্টিয়ে আরেক রকম। এগুলোর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এক মহান কারিগরের অসংখ্য নিদর্শন।
সেজন্য আকাশ-যমীন সহ আল্লাহর যাবতীয় সৃষ্টিরাজি নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা করার কথা বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। ভাবনা, উপলব্ধি ও ইন্দ্রিয়শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই বান্দার কর্তব্য হ’ল- রহস্যময় সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা এবং সেই মহান সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। মহান আল্লাহ যখন প্রত্যেক রাতের শেষ প্রহরে দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে বান্দাকে ডাকতে থাকেন, তখন যেন আমরা যমীন থেকে সেই আকাশের মালিকের ডাকে সাড়া দিতে পারি। আমাদের এই পার্থিব জীবন যেন কেবল তাঁরই ইবাদত ও আনুগত্যে নিঃশেষিত হয়। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
৩. কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা :
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বান্দার জন্য চিন্তা-ভাবনার অগণিত উপাদান সংরক্ষিত আছে। চিন্তাশীল পাঠক খুব সহজেই এটা বুঝতে পারবেন। ভাবনার জানালা খুলে চিন্তা দৃষ্টি দিয়ে কুরআনের বাক্যমালার দিকে তাকালে মনে হয়- যেন অপরিমেয় উপদেশ ও ভাবনার খোরাক সঞ্চিত আছে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের। অন্তরের চোখ দিয়ে কুরআন না দেখলে সেটা উপলব্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়। সেজন্য মহান আল্লাহ কেবল তেলাওয়াতের চেয়ে অর্থ অনুধাবনের ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন। যেন মানুষ তার চিন্তা শক্তি প্রয়োগ করে এর অমিয় মর্ম উপলব্ধি করে এবং এখান থেকে উপদেশ হাছিল করে। যারা শুধু কুরআন পাঠ করে; কিন্তু এর তাৎপর্য ও নিগূঢ় অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করে না আল্লাহ তাদের ভৎর্সনা করে বলেন, أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا- ‘তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,التفكر فِي الْقُرْآن نَوْعَانِ: تفكر فِيهِ ليَقَع على مُرَاد الرب تَعَالَى مِنْهُ، وتفكر فِي مَعَاني مَا دَعَا عباده الى التفكر فِيهِ، فالاول تفكر فِي الدَّلِيل القرآني وَالثَّانِي تفكر فِي الدَّلِيل العياني، ‘কুরআন অনুধান দুই প্রকার। প্রথমত, রাববুল আলামীনের উদ্দিষ্ট মর্মোদ্ধারের জন্য চিন্তা-গবেষণা করা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে (কুরআনের) যে বিষয়ে গবেষণা করতে বলেছেন তার তাৎপর্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। প্রথমটা হ’ল কুরআনের দলীল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা আর দ্বিতীয়টা হ’ল চাক্ষুষ প্রমাণ নিয়ে চিন্তা করা’।[14]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,الْقِرَاءَةُ الْقَلِيلَةُ بِتَفَكُّرٍ أَفْضَلُ مِنْ الْكَثِيرَةِ بِلَا تَفَكُّرٍ، ‘না বুঝে অর্ধেক কুরআন তেলাওয়াত করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অল্প তেলাওয়াত করা অধিকতর উত্তম’।[15]
মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব আল-কুরাযী (রহঃ) বলেন, لَأَنْ أَقْرَأَ فِي لَيْلَتِي حَتَّى أُصْبِحَ بِإِذَا زُلْزِلَتِ، وَالْقَارِعَةُ لَا أَزِيدُ عَلَيْهِمَا، وَأَتَرَدَّدُ فِيهِمَا وَأَتَفَكَّرُ، أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَهُذَّ الْقُرْآنَ لَيْلَتِي هَذًّا، يعني: أَنْثُرَهُ نَثْرًا، ‘কুরআন গদ্যের মতো তাড়াতাড়ি পড়ে রাত শেষ করার চেয়ে আমি যদি রাতের শুরু থেকে সকাল পর্যন্ত কেবল সূরা যিলযাল ও সূরা ক্বারি‘আহ তেলাওয়াত করি, এর চেয়ে আর বেশী কিছু না তেলাওয়াত করে শুধু এদু’টিই পুনরাবৃত্তি করতে থাকি এবং এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি, তাহ’লে এটাই আমার নিকটে অধিকতর পসন্দনীয়’।[16]
না বুঝে কুরআন তেলাওয়াতে প্রভূত নেকী অর্জিত হ’লেও এর মাধ্যমে কুরআন নাযিলের মূল্য উদ্দেশ্য হাছিল হয় না; বরং অর্থ অনুধাবন ও তা নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের মাধ্যমেই কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম হয়। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ হাছিল হয়। ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেছেন,مِنْ أَعْظَمِ مَا يُتَقَرَّبُ بِهِ إِلَى اللهِ تَعَالَى مِنَ النَّوَافِلِ كَثْرَةُ تِلَاوَةِ الْقُرْآنِ، وَسَمَاعُهُ بِتَفَكُّرٍ وَتَدَبُّرٍ وَتَفَهُّمٍ، ‘আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উচ্চমার্গীয় নফল ইবাদত হ’ল বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা এবং মর্ম অনুধাবন করে ও চিন্তা-ভাবনা করে তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা’।[17] ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয (রহঃ) বলেন,دواء القلب خمسة أشياء، قراءة القرآن بالتفكر، وخلاء البطن وقيام الليل، والتضرع عند السحر، ومجالسة الصالحين، ‘পাঁচটি জিনিষে অন্তরের আরোগ্য রয়েছে- (১) চিন্তা-গবেষণা করে কুরআন তেলাওয়াত, (২) পেট খালি রেখে খাদ্য গ্রহণ, (৩) ক্বিয়ামুল লাইল, (৪) শেষ রাতের কাকুতি-মিনতি করে দো‘আ এবং (৫) নেককার মানুষের সাহচর্য’।[18]
৪. আল্লাহর নে‘মতরাজি নিয়ে চিন্তা করা :
চিন্তার ইবাদতের অন্যতম বড় ক্ষেত্র হ’ল আল্লাহর নে‘মতরাজি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। একজন মুসলিম যদি অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে নিজের দিকে লক্ষ্য করে এবং তার চারপাশে চোখ বুলায়, তাহ’লে সে দেখবে মহান প্রতিপালকের অথৈ নে‘মতে সে ডুবে আছে। তাই তো আবূ সুলাইমান আদ-দারাণী (রহঃ) বলতেন, إِنِّي لأخرجُ مِنْ مَنْزِلِي، فَمَا يَقَعُ بَصَرِي عَلَى شَيْءٍ إِلَّا رَأَيْتُ لِلَّهِ عَلَي فِيهِ نِعْمَة، أوْ لِي فِيهِ عِبْرَة، ‘বাড়ি থেকে বের হ’লে যখনই কোন বস্ত্তর উপরে আমার চোখ পড়ে, তখন সেখানে আমাকে দেওয়া আল্লাহর কোন না কোন নে‘মত দেখতে পাই, অথবা সেখানে আমার জন্য কোন উপদেশ পেয়ে যাই’।[19] তাছাড়া নিজের প্রতি আল্লাহর নে‘মতের প্রভাব উপলব্ধি করতে পারাও বিরাট একটি নে‘মত ও অনুগ্রহ। শাক্বীক্ব বলখী (রহঃ) বলেন, التَّفَكُّرُ فِي مِنَّةِ اللهِ شُكْرٌ، ‘আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে চিন্তা করতে পারা শুকরিয়া আদায়ের অন্তর্ভুক্ত’।[20]
সুতরাং একজন মুসলিম জীবনের সবকিছু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন। নিজের কর্ম নিয়ে ভাববেন যে, আল্লাহ তাকে জীবিকা অর্জনের একটি পন্থা দিয়েছেন। নিজের পিতা-মাতাকে নিয়ে চিন্তা-করবেন যে, আল্লাহ আমার পিতা-মাতার হৃদয়ে আমার জন্য কতই না ভালোবাসা পয়দা করেছেন, সুখে-দুঃখে তাদের সেণহের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে আমি প্রশান্তি পাই। তাদের আদরের ডানায় ভর করেই আমি জীবনের শত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়েছি। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার অকৃত্রিম ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এক অলৌকিক নে‘মত। সন্তান তার সারা জীবনেও সেই নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবে না। একজন মুসলিম নিজের স্ত্রী নিয়ে ভাববে যে, আল্লাহ তাকে এমন একজন ভালো স্ত্রী দিয়েছেন, অথচ বিয়ের আগে তাকে চিনতই না। এখন সে স্ত্রীই তার জীবনের অংশ। সুখে-দুঃখে, ইবাদত-বন্দেগীতে তার পরম সাথী। জীবন যাপনের নিত্য সহযাত্রী।
তাছাড়া একজন মুসলিম যদি গভীরভাবে চিন্তা করে, তাহ’লে দেখতে পাবে যে, শান্তি-নিরাপত্তা, খাওয়া-দাওয়া এবং জীবন যাপনের মান নির্ধারণ সহ বিবিধ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাকে অসংখ্য সৃষ্টিরাজির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। মানুষ যদি চিন্তার ইবাদতে অভ্যস্ত না হ’তে পারে, তাহ’লে আল্লাহর নে‘মতের ব্যাপারে সে আজীবন অজ্ঞই থেকে যাবে। ক্রমান্বয়ে সে অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন মানুষের দলভুক্ত হয়ে যাবে। ফক্বীহ আবুল লায়েছ সামারকান্দী (রহঃ) বলেন,إِذَا أَرَادَ الْإِنْسَانُ أَنْ يَنَالَ فَضْلَ التَّفَكُّرِ، فَلْيَتَفَكَّرَ فِي الْآلَاءِ وَالنَّعْمَاءِ، ‘মানুষ যদি চিন্তা-ভাবনার মর্যাদা লাভ করতে চায়, সে যেন (আল্লাহর দেওয়া) প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নে‘মতের কথা চিন্তা-ভাবনা করে দেখে’।[21] ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, الفكرة في نعم الله عز وجل من أفضل العبادات، ‘আল্লাহর নে‘মতরাজি নিয়ে চিন্তা করা শ্রেষ্ঠ ইবাদতগুলোর মাঝে অন্যতম’।[22] মহান আল্লাহ আমাদেরকে চিন্তার ইবাদতের মাধ্যমে তার দেওয়া নে‘মতরাজি উপলব্ধি করার এবং তার শুকরিয়া আদায়ে তাওফীক্ব দান করুন।
(ক্রমশঃ)
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তাফসীরে কুরতুবী ৯/২৭২।
[2]. আব্দুর রহমান সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান, পৃ. ৪০৬।
[3]. তাফসীরে বাগাভী ৪/২৮৩।
[4]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/৪১৮।
[5]. তাইসীরুল কারীমির রহমান, পৃ. ১৬১।
[6]. তাফসীরে কুরতুবী, ৪/৩১৩।
[7]. জামালুদ্দীন ক্বাসেমী, মাহাসীনুত তা’বীল (তাফসীরে ক্বাসেমী), ২/৪৮০।
[8]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/১৮৫।
[9]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৩/২৭৮।
[10]. ইবনু কুদামা, মুখতাছার মিনহাজুল ক্বাছেদীন, পৃ. ৩৭৮।
[11]. গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৪/৪৩৫-৪৪০। ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত।
[12]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৫/৩৪১।
[13]. তাফসীরে ফাৎহুল ক্বাদীর, ৩/৪৭৯।
[14]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত, ১/১৮৭।
[15]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা, ৫/৩৩৪।
[16]. ইবনুল মুবারাক, আয্-যুহদু ওয়ার রাক্বায়েক্ব ১/৯৭।
[17]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম, ২/৩৪২।
[18]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/২৯৩।
[19]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ২/১৮৪।
[20]. আবূ নু‘আইম ইছ্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮/৭১।
[21]. সামরকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ৫৭০।
[22]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন উওয়াইযাহ, ফাছ্লুল খিত্বাব ফিয যুহদি ওয়ার রাক্বায়েক্ব ৫/১২৪।