ইবাদতের স্তরসমূহ :
ইবাদতের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যথা- ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব। এর মধ্যে কিছু উম্মতের ঐক্যমতের ভিত্তিতে আর কিছু দলীলের ভিত্তিতে নির্ণীত। এভাবে স্তরের ভিন্নতা শরী‘আত প্রণেতার সম্বোধন, নির্দেশিত বিষয় কাজে বাস্তবায়ন এবং বর্জনীয় বিষয় পরিহার করার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ফরয বা ওয়াজিব : যে ইবাদত পালনের জন্য ছওয়াব পাওয়া যায় এবং যা পরিত্যাগকারী শাস্তির হকদার হয়। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা, রামাযান মাসের ছিয়াম পালন করা, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক কর্তৃক যাকাত দেওয়া ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি কর্তৃক হজ্জ পালন করা ইত্যাদি।
সুন্নাত : যে ইবাদত রাসূল (ছাঃ) করেছেন, করতে বলেছেন বা সমর্থন করেছেন। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত সংশ্লিষ্ট সুন্নাত আদায় করা, সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ছিয়াম পালন করা, ই‘তিকাফ করা ইত্যাদি।
মুস্তাহাব : যে ইবাদত করলে ছওয়াব পাওয়া যায় কিন্তু পরিত্যাগকারীর শাস্তি হয় না। যেমন ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করা, আযানের জওয়াব দেওয়া ইত্যাদি।
ইবাদতের রুকনসমূহ :
ইবাদতের রুকন তিনটি। যেগুলো ব্যতীত ইবাদত সিদ্ধ হয় না। সেগুলি নিম্নরূপ-
১. আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ মহববত :
আল্লাহর মহববত হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তি। যার উপর ইসলামের ইবাদতসমূহ প্রতিষ্ঠিত। দেহের সাথে মাথার যেমন সম্পর্ক, ইবাদতের সাথে আল্লাহর মহববতের তদ্রূপ সম্পর্ক। অতএব যে দেহের মাথা নেই তার প্রাণ নেই। অনুরূপ যে ইবাদতে আল্লাহর মহববত নেই সেই ইবাদত অস্তিত্বহীন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহববত দ্বারা বিদ‘আতীদের মিথ্যা মহববত, দার্শনিকদের কাল্পনিক মহববত কিংবা ছূফীদের মহববতের দাবী উদ্দেশ্য নয়। বরং যে মহববতে বিনয় এবং আল্লাহর মহত্ব ও তাঁর আনুগত্য প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত মহববত। বান্দা তার সর্বাধিক প্রিয় রবের জন্য উৎসর্গ হ’তে সদা প্রস্ত্তত থাকবে। যা আল্লাহ পসন্দ করেন বান্দাও তা পসন্দ করবে। যা আল্লাহ অপসন্দ করেন বান্দাও তা অপসন্দ করবে। আল্লাহর আদেশসমূহ বান্দা প্রতিপালন করবে এবং নিষেধগুলো বর্জন করবে। আল্লাহর প্রিয়জনকে বন্ধু ভাববে। আল্লাহর শত্রুকে শত্রু গণ্য করবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয় জানার একমাত্র পথ হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। এজন্য আল্লাহ বলেছেন,قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ، ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
মুখে ভালোবাসার দাবী করলে এবং কুরআন ও হাদীছের অনুসরণ থেকে দূরে থাকলে ক্বিয়ামত দিবসে ঐ ভালোবাসা কোন উপকারে আসবে না। এটা হবে ভালবাসার নামে আল্লাহর সাথে মিথ্যা ও প্রতারণার শামিল।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এ আয়াত ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফায়ছালাকারী যে আল্লাহর মহববতের দাবী করে, অথচ সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে না, তার দাবীতে সে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত হবে। যতক্ষণ না সে সকল কথা ও কাজে শরী‘আতে মুহাম্মাদী এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর দ্বীনের অনুসরণ করবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল, যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারী ‘তরজমাতুল বাব-২০; মুসলিম হা/১৭১৮)। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন’। অর্থাৎ এর দ্বারা তোমরা যা চাও, তার চেয়ে বড়টা তোমাদের অর্জিত হবে। তাহ’ল তোমরা আল্লাহকে নয়, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, কতিপয় লোক দাবী করে তারা আল্লাহকে ভালবাসে। এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।[1]
২. আশা করা :
রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণে মানুষ আল্লাহর জন্য যেসব ইবাদত করবে, তাতে সে আল্লাহর কাছে ছওয়াবের আশা করবে। আর আল্লাহর অশেষ দান ও অগণিত অনুগ্রহে সে আনন্দিত হবে। এ অনুগ্রহ ও নে‘মত সমূহের জন্যও সে আল্লাহর রহমত কামনা করবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آَمَنُوْا وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أُولَئِكَ يَرْجُوْنَ رَحْمَةَ اللهِ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ- ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর রহমত আশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (বাক্বারাহ ২/২১৮)। তিনি আরো বলেন,مَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لَآَتٍ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর দীদার কামনা করে (অর্থাৎ পার্থিব কৃতকর্মের উত্তম প্রতিদান চায় তার জানা আবশ্যক যে,) আল্লাহর সেই নির্ধারিত সময়টি আসবেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ (অর্থাৎ তিনি সকলের সব কথা শোনেন ও সকলের অন্তরের খবর জানেন)’ (আনকাবূত ২৯/৫)।
যখন বান্দা কোন গুনাহ করে বা পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন সে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না এবং আল্লাহর ক্ষমা হ’তে হতাশ হবে না। বরং গুনাহ হ’তে মুক্তির আশায় সে দ্রুত আল্লাহর নিকট তওবা করবে। আল্লাহ বলেন,قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ، ‘বল, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (যুমার ৩৯/৫৩)।
হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِى بِى، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِى، ‘আমি আমার বান্দার ধারণামত হয়ে থাকি। আর আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে’।[2]
বান্দার জন্য উচিত আল্লাহর রহমত, ছওয়াব এবং ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে শরী‘আত অনুযায়ী আমল করা, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধকে বাস্তবে রূপ দানের চেষ্টা করা। যেমন আল্লাহ বলেন,فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا، ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)। কারণ সৎ আমল ছাড়া জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির আশা করা ধোঁকাবাজী বৈ কিছুই নয়।
৩. আল্লাহর ভয় :
আল্লাহকে ভয় করা প্রত্যেকের উপর ফরয। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوْهُمْ وَخَافُوْنِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ. ‘নিশ্চয়ই এরাই সে শয়তান শুধুমাত্র তার বন্ধুদের থেকে তোমাদের ভয় দেখায়। কিন্তু যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক তবে তাদের ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় কর’ (আলে ইমরান ৩/১৭৫)। আল্লাহর বাণী,إِيَّايَ فَارْهَبُوْنِ ‘আমাকেই ভয় কর’ (বাক্বারাহ ২/৪০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা তাদের পালনকর্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, যারা তাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করে না, আর যারা যা দান করবার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে যে, তারা তাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। তারাই দ্রুত কল্যাণ অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী’ (মুমিনূন ১৬১)।
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর বাণী وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آَتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ... ‘এবং যারা যা দান করবার তা দান করে ভীত কম্পিত হৃদয়ে ...’ (মুমিনূন ২৩/৬০) এ আয়াত কি ব্যভিচারী, মদ্যপায়ী ও চোরের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন, হে ছিদ্দীকের কন্যা! না ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়নি। বরং ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, যে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং এই ভয়ে থাকে যে, যদি আমার এ আমলসমূহ কবুল না হয়’।[3]
মুমিনদের মধ্যে সর্বদা আশা ও ভীতি বিরাজ করে। আর মুনাফিকদের মধ্যে বিরাজ করে অকল্যাণ ও বাসনা। ইসলামী শরী‘আত বান্দার নিকট এমন ভীতি কামনা করে, যা তার মধ্যে ও আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্ত্তসমূহ লঙ্ঘন করার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ এ সীমা অতিক্রম করলে আল্লাহর রহমত হ’তে হতাশা জন্ম নিতে পারে। আর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কাফিরদের বৈশিষ্ট্য।
আশা ও ভীতির মধ্যবর্তী অবস্থান :
বান্দার জন্য অবশ্য করণীয় হচ্ছে আশা ও ভীতির মধ্যে অবস্থান করা। কেবল আশাহীন ভয়ের মধ্যে থাকাই নিরাশা ও হতাশা। আল্লাহ বলেন,إِنَّهُ لَا يَيْئَسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয় না অবিশ্বাসী সম্প্রদায় ব্যতীত’ (ইউসুফ ১২/৮৭)। আল্লাহ আরো বলেন, وَمَنْ يَّقْنَطُ مِنْ رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّوْنَ. ‘পথভ্রষ্টরা ব্যতীত তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হ’তে কে হতাশ হয়? (হিজর ১৫/৫৬)।
আল্লাহভীতি ব্যতীত কেবল তাঁর রহমতের আশা করা হচ্ছে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার শামিল, যা আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন,أَفَأَمِنُوْا مَكْرَ اللهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْخَاسِرُوْنَ، ‘তারা কি তাহ’লে আল্লাহর পাকড়াওয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে? বস্ত্ততঃ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিশ্চিন্ত হয় কেবল ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়’ (আ‘রাফ ৭/৯৯)। এরূপ আরো অনেক বর্ণনা এসেছে, যাতে বান্দাদের আশা ও আল্লাহ-ভীতি উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করে চলার জন্য আহবান করা হয়েছে। আর আল্লাহ ঐ সকল লোকের প্রশংসা করেছেন, যারা উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য করে চলে। আল্লাহ বলেন,أُولَئِكَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ يَبْتَغُوْنَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيْلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُوْنَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُوْنَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُوْرًا، ‘তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে আল্লাহর কত নিকটতর হ’তে পারে। তারা তাঁর দয়া কামনা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অতীব ভয়াবহ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫৭)। তিনি আরো বলেন,أَمْ مَنْ هُوَ قَانِتٌ آَنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَّقَائِمًا يَحْذَرُ الْآَخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ، ‘(বল, শিরককারী ব্যক্তি উত্তম, নাকি ঐ ব্যক্তি উত্তম) যে রাত্রিকালে সিজদা ও ক্বিয়ামের মাধ্যমে একনিষ্ঠভাবে দীর্ঘ ছালাত আদায় করে। যখন সে আখেরাতকে ভয় করে ও তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ কামনা করে?’ (যুমার ৩৯/৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا. ‘যারা (রাত্রি বেলায়) শয্যাত্যাগ করে (তাহাজ্জুদের ছালাতে) তাদের প্রভুকে ডাকে ভয় ও আকাঙ্ক্ষার সাথে’ (সাজদাহ ৩২/১৬)।
আশা ও ভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানকালে বান্দার উচিত স্বীয় মনের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা। কারণ যখন আল্লাহর ভয় মনে অতি প্রবল হয়ে উঠে তখন তাঁর রহমত হ’তে নিরাশ হয়ে যায়। যেমন অসুখ হ’লে এবং পাপ করলে। তখন বান্দার জন্য করণীয় হ’ল উভয়ের মাঝে তুলনা করা এবং ভয়ের প্রবলতা কমানো। আর যখন আশার দিকটা প্রবল হয়ে ওঠে তখন আল্লাহর পাকড়াওকে পরোয়া করে না। যেমন সুস্থতা ও ইবাদত-বন্দেগী করার পর। তখন বান্দা আশা ও ভীতির মাঝে তুলনা করবে এবং আশার প্রবলতা কাটিয়ে উঠবে। যদি আল্লাহর রহমত হ’তে নিরাশ হওয়ার অথবা আল্লাহর পাকড়াও থেকে উদাসীন হবার ভয় না থাকে, তবে উভয়ের মাঝে তার সমতা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে।
এই তিনটি রুকনের মান নির্ণয় হয় মানুষের আত্মা থেকে। মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর ভয় উদাহরণত পাখীর মত। মহববত তার মাথা, আশা এবং ভয় তার দু’টি ডানা। যখন মাথা এবং ডানা দু’টি ভালো থাকবে, পাখীর উড্ডয়নও ভালো হবে। মাথা কেটে ফেলা হ’লে পাখীর মৃত্যু ঘটবে। আর দু’টি ডানা নষ্ট হ’লে পাখিটি শিকারীর লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত হবে। বান্দার উচিত এই তিনটি রুকন সম্মিলিতভাবে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে প্রতিফলন ঘটানো। একটা বা দু’টার প্রতিফলন ঘটানো ও বাকীটা বর্জন বৈধ নয়।
বস্ত্তত: আল্লাহর ভয় ছাড়া মহববত সামান্য কিছু পাপ থেকে বাঁচাতে পারে। আশাহীন ইবাদত মিথ্যা দাবী মাত্র। এজন্য যারা ভয় করে না, শুধু মহববতের দাবী করে তারা বেপরোয়া গোনাহে জড়িয়ে পড়ে। যেমন ইহুদী সম্প্রদায়। তারা বলে, نَحْنُ أَبْنَاءُ اللهِ وَأَحِبَّاؤُهُ، ‘আমরাই আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়জন’ (মায়েদাহ ৫/১৮)। অথচ তারা পাপ কাজে সারা পৃথিবীর শীর্ষে। এজন্য আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, বল, فَلِمَ يُعَذِّبُكُمْ بِذُنُوبِكُمْ، ‘তাহ’লে তোমাদের পাপাচারের জন্য তিনি তোমাদের শাস্তি দিবেন কেন’? (মায়েদাহ ৫/১৮)।
এমনিভাবে শুধুমাত্র আশা করার মধ্যে শিথিলতার জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে সে আল্লাহর কৌশলকে আল্লাহর পক্ষে তার জন্য আশ্রয় মনে করে এবং পাপাচার ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়। আবার শুধু ভীতি বান্দাকে নিরাশ এবং হতাশার দিকে নিয়ে যায় এবং আল্লাহর ব্যাপারে ভুল ধারণা জন্ম দেয়। অতএব বান্দা তার ইবাদত-বন্দেগীসহ সকল কাজে আল্লাহর মহববত, আশা ও ভীতির সম্মিলন ঘটাবে এবং এটাই তাওহীদ ও ঈমান।
ইসলামে ইবাদত সঠিক হওয়ার শর্তাবলী :
১. উদ্দেশ্য শরী‘আত সম্মত হওয়া :
কোন মানুষ যদি এমন কোন ইবাদত করে যা শরী‘আত সাব্যস্ত করেনি অর্থাৎ যে ব্যাপারে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের নির্দেশনা নেই, তাহ’লে সে ইবাদত পরিত্যাজ্য। যেমন মীলাদুন্নবী উদযাপন করা এবং ২৭শে রজব রাত্রিতে রাসূল (ছাঃ)-এর ইসরা ও মি‘রাজ হয়েছিল দাবী করে সে রাত্রে ইবাদত করা। এসব শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত নয়, বিধায় এসব ইবাদত পরিত্যাজ্য।
২. বস্ত্ত শরী‘আত সম্মত হওয়া :
ইবাদতের ক্ষেত্রে যেসব বস্ত্ত শরী‘আত সম্মত নয়, সেসব দ্বারা ইবাদত করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন কেউ যদি ঘোড়া কুরবানী করে তাহ’লে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা শরী‘আতে চার ধরনের পশু কুরবানী করার কথা এসেছে। তাহ’ল উট, গরু, ছাগল, দুম্বা (আন‘আম ৬/১৪৩-৪৪)। ঘোড়া দ্বারা কুরবানী করা শরী‘আতে অনুমোদিত নয়। তাই কেউ ঘোড়া কুরবানী করলে তা কবুল হবে না।
৩. পরিমাণ শরী‘আত সম্মত হওয়া :
ইবাদতের ক্ষেত্রে শরী‘আত নির্ধারিত পরিমাণে কম-বেশী করলে ইবাদত হয় না এবং আল্লাহর কাছে তা কবুল হয় না। যেমন কেউ যদি দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের ক্ষেত্রে ছয় ওয়াক্ত কিংবা যোহর, আছর ও এশার চার রাক‘আতের পরিবর্তে ছয় রাক‘আত, মাগরিবে তিনের বদলে চার এবং ফজরে দুইয়ের স্থলে চার পড়ে তাহ’লে তা কবুল হবে না। কেননা তা শরী‘আত নির্ধারিত পরিমাণ নয়। অনুরূপভাবে যিকরের ক্ষেত্রে ফরয ছালাতের পর ৩৩ বারের স্থলে ৫০ বার করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পড়লে তা ইবাদত হবে না। কেননা এই পরিমাণ শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত নয়।
৪. পদ্ধতি শরী‘আত সম্মত হওয়া :
ইবাদতের পদ্ধতিও শরী‘আত সম্মত হ’তে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেখানো পদ্ধতির বাইরে কেউ কোন ইবাদত করলে তা ইবাদত হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন কেউ যদি ওযূ করার ক্ষেত্রে আগে পা ধৌত করে অতঃপর মাথা মাসাহ করে, তারপর দু’হাত ধেŠত করে এবং শেষে মুখমন্ডল ধৌত করে তাহ’লে এটা ইবাদত হবে না। কেননা এটা শরী‘আত প্রদত্ত পদ্ধতি নয়।
৫. সময় শরী‘আত সম্মত হওয়া :
ইসলামী শরী‘আত যে ইবাদতের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার বাইরে গিয়ে ইবাদত করলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। যেমন কেউ যদি রামাযানের ফরয ছিয়াম শা‘বান বা শাওয়াল মাসে রাখে অথবা কেউ যদি মুহাররম বা যিলক্বদ মাসে হজ্জ করে তাহ’লে তা ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। অতএব বলা যায় যে, নির্ধারিত সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদত ঐ সময়ের বাইরে আদায় করলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
৬. স্থান শরী‘আত সম্মত হওয়া :
শরী‘আত যে ইবাদতের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে তার বাইরে সেই ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। যেমন হজ্জের ক্ষেত্রে আরাফায় অবস্থান না করে মুযদালিফায় অবস্থান করলে কিংবা বাড়ীতে ই‘তেকাফ করলে তা কবুল হবে না। কেননা হজ্জের প্রধান রুকন হ’ল আরাফায় অবস্থান করা। অনুরূপভাবে ই’তেকাফ করতে হয় মসজিদে, বাড়ীতে নয়।
ইবাদতের বৈশিষ্ট্য :
১. ইবাদতে একনিষ্ঠতা : ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্য হ’তে হবে শিরকমুক্তভাবে (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন।
২. ইবাদত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে নির্ভরশীল : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে উল্লেখ নেই এমন কোন ইবাদত করা বান্দার জন্য জায়েয নয়।
৩. বান্দা ও স্বীয় রবের মাঝে কোন মাধ্যম নেই : মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁর ইবাদত করার জন্য ও তাঁর নিকটে দো‘আ করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন।
৪. ইসলামের ইবাদতসমূহ সরলতার উপরে প্রতিষ্ঠিত : ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানের ক্ষেত্রে মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতি তথা শক্তি-সামর্থ্য, দুর্বলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, অবসাদ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রণীত হয়েছে। অনুরূপভাবে ইবাদত সমূহও সরলতা, সহজতা ও ক্ষমার ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে।
ইবাদত কবুলের শর্তাবলী :
ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত তিনটি। এ শর্তগুলো ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না। শর্তগুলো নিম্নরূপ:
(১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া (عقيدة صحيحة)(২) তরীকা সঠিক হওয়া (طريقة صحيحة) এবং (৩) ইখলাছে আমল (إخلاص عمل)। অর্থাৎ শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস, ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণ এবং শ্রুতি ও প্রদর্শনীমুক্ত ইখলাছ, এই তিনটির সমন্বয় ব্যতীত আল্লাহর নিকটে বান্দার কোন সৎকর্মই কবুল হবে না এবং তাতে কোন ছওয়াবও সে পাবে না।
(১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া :
ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আক্বীদাহ ছহীহ হওয়া অতি যরূরী। কেননা আক্বীদাহ বাতিল হ’লে ইবাদত কবুল হয় না। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ، ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন’ (নিসা ৪/৪৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا، ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)।
আক্বীদার বিষয়টিকে হাদীছেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ৫টি ভিত্তির মধ্যে আক্বীদা বা ঈমানই হচ্ছে প্রধান। রাসূল (ছাঃ) বলেন,بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‘পাচটি ভিত্তির উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিতঃ (১) এই কথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, (২) ছালাত প্রতিষ্ঠা করা, (৩) যাকাত প্রদান করা, (৪) হজ্জ সম্পাদন করা (৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা’।[4] অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَيُؤْمِنُوا بِى وَبِمَا جِئْتُ بِهِ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّى دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّهَا وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ.
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল, আর ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহ’লে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত’।[5] আপর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَ مُعَاذًا رضى الله عنه إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنِّى رَسُولُ اللهِ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِى أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ.
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামনে (শাসক হিসাবে) প্রেরণ করেন। অতঃপর বললেন, সেখানকার অধিবাসীদেরকে এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহবান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত কর যে, আল্লাহ তাদের উপর প্রতেক দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত কর যে, আল্লাহ তাদের উপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে ছাদাক্বা (যাকাত) ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে আর তাদের দরিদ্রদেরকে প্রদান করা হবে’।[6]
আক্বীদা সঠিক থাকলে কোন গোনাহগার ব্যক্তি জাহান্নামে গেলেও চিরস্থায়ীভাবে সেখানে অবস্থান করবে না। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ قَالَ رَجُلٌ لَمْ يَعْمَلْ حَسَنَةً قَطُّ لأَهْلِهِ إِذَا مَاتَ فَحَرِّقُوهُ ثُمَّ اذْرُوا نِصْفَهُ فِى الْبَرِّ وَنِصْفَهُ فِى الْبَحْرِ فَوَاللهِ لَئِنْ قَدَرَ اللهُ عَلَيْهِ لَيُعَذِّبَنَّهُ عَذَابًا لاَ يُعَذِّبُهُ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ فَلَمَّا مَاتَ الرَّجُلُ فَعَلُوا مَا أَمَرَهُمْ فَأَمَرَ اللهُ الْبَرَّ فَجَمَعَ مَا فِيهِ وَأَمَرَ الْبَحْرَ فَجَمَعَ مَا فِيهِ ثُمَّ قَالَ لِمَ فَعَلْتَ هَذَا قَالَ مِنْ خَشْيَتِكَ يَا رَبِّ وَأَنْتَ أَعْلَمُ فَغَفَرَ اللهُ لَهُ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি যে জীবনে কখনো কোন প্রকার ছওয়াবের কাজ করেনি, যখন সে মারা যাবে তার পরিবার-পরিজনকে ডেকে বলল, মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে পুড়িয়ে ফেলে সেটার অর্ধেক ছাই স্থলভাগে (বাতাসে উড়িয়ে) দিবে এবং অর্ধেক পানিতে নিক্ষেপ করবে। কারণ আল্লাহর কসম! আমাকে যদি আল্লাহ ধরতে পারেন তাহ’লে তিনি আমাকে অবশ্যই এমন আযাব দিবেন, যা পৃথিবীর অন্য কাউকে কখনো দেননি। তারপর লোকটি যখন মৃত্যুবরণ করল তখন তার পরিবারের লোকেরা তার নির্দেশ অনুযায়ী তাই করল। তখন আল্লাহ স্থলভাগকে আদেশ দিলে সে তার মধ্যস্থিত যা কিছু আছে (ছাই) একত্রিত করল। এরপর পানিতে মিশ্রিত ভাগকে নির্দেশ দিলেন। সেও তার মধ্যস্থিত সবকিছু একত্রিত করে দিল। অতঃপর আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এরূপ কেন করলে? সে বলল, হে আমার রব! আপনার ভয়ে। আপনি তো সর্বজ্ঞ। তখন আল্লাহ তাকে মাফ করে দিলেন।[7]
সঠিক আক্বীদার কারণে একজন সর্বোচ্চ পাপী ব্যক্তিও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে অবস্থানের পর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ الْجَنَّةَ، وَأَهْلُ النَّارِ النَّارَ يَقُولُ اللهُ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَخْرِجُوهُ. ‘জান্নাতীগণ যখন জান্নাতে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ বলবেন, যার অন্তঃকরণে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে তাকে বের কর’।[8]
ছাহাবায়ে কেরাম এজন্য আক্বীদা তথা ঈমানকে কুরআন শিক্ষার উপরে গুরুত্ব দিতেন। জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন,كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ فِتْيَانٌ حَزَاوِرَةٌ فَتَعَلَّمْنَا الإِيمَانَ قَبْلَ أَنْ نَتَعَلَّمَ الْقُرْآنَ ثُمَّ تَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ فَازْدَدْنَا بِهِ إِيْمَانًا. ‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা নব যুবক ছিলাম। তাই আমরা কুরআন শেখার আগে ঈমান শিখতাম। তারপরে আমরা কুরআন শিখতাম। ফলে এর কারণে আমাদের ঈমান বেড়ে যেত।[9]
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, আমাদের সময়ে আমরা কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার আগে প্রথমে ঈমান সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতাম এবং যখন সূরাগুলো নাযিল হ’ত তখন আমরা শিখে নিতাম সেখানে কি বৈধ আর কি অবৈধ, কি করা নিষিদ্ধ আর কি করতে সূরাগুলো নির্দেশ করছে। আর সেগুলোর প্রতি আমাদের করণীয় কি তাও আমরা শিখে নিতাম। কিন্তু আমি অনেককেই দেখছি যাদেরকে ঈমান বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করার আগেই কুরআন দেওয়া হচ্ছে আর সে এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে নিচ্ছে অথচ সে জানে না এর (কুরআনের) আদেশগুলো কি কি, নিষেধগুলো কি কি এবং সে সম্পর্কে করণীয়গুলোই বা কি কি। সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তির মতো যে খেজুরগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে (অর্থাৎ সে তার কুরআন পড়া থেকে কোন উপকার পাচ্ছে না)।[10]
(২) তরীকা সঠিক হওয়া :
ইবাদত সম্পাদনের পদ্ধতি সঠিক না হ’লে তা আল্লাহর নিকটে কবুল হয় না। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا، أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا،
‘বলে দাও, আমরা কি তোমাদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে জানিয়ে দেব? তারা হ’ল সেই সব লোক যাদের পার্থিব জীবনের সকল প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। অথচ তারা ভেবেছে যে, তারা সৎকর্ম করছে। ওরা হ’ল তারাই, যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহকে এবং তার সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের সকল কর্ম নিস্ফল হয়ে যায়। ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাদের জন্য দাড়িপাল্লা খাড়া করব না’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৫)। অর্থাৎ আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে ইবাদত করার যে পদ্ধতি মানুষকে জানিয়েছেন, সে পদ্ধতিতে ইবাদত না করলে তা কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রবর্তন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত’।[11] তিনি আরো বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا، فَهْوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[12]
সেই সাথে রাসূল (ছাঃ) স্বীয় সুন্নাত আকড়ে ধরার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، ‘অতএব তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! (ধর্মে) প্রতিটি নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হ’ল বিদ‘আত এবং প্রতিটি বিদ‘আত হ’ল ভ্রষ্টতা’।[13]
ইসলামে কোন বিদ‘আত করলে বিদ‘আতকারীর কোন আমল কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَحْدَثَ فِيهَا حَدَثًا، أَوْ آوَى مُحْدِثًا، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ، لاَ يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ. ‘যদি কেউ এতে বিদ‘আত করে অথবা বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয়, তাহ’লে তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতা ও মানুষের অভিসম্পাত। সে ব্যক্তির কোন ফরয এবং নফল ইবাদত কবুল হবে না’।[14] অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে আমল না করাই বিদ‘আত। আর পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
সুন্নাত পরিপন্থী আমল করার কারণে পরকালে ঐ আমলকারী রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ، وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا، لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِى، ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِى وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ. فَيُقَالُ: إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ؟ فَأَقُوْلُ : سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ،
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদের পূর্বেই হাওযে কাওছারের কাছে পেঁŠছে যাব। যে ব্যক্তি আমার কাছে পেঁŠছবে, সে পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে, সে আর কখনো পিপাসিত হবে না। আমার কাছে এমন কিছু লোক আসবে যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, তারাতো আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে তারা কি নতুন সৃষ্টি করেছিল। আমি তখন বলব, যারা আমার অবর্তমানে (আমার দ্বীনে) পরিবর্তন করেছে, তারা দূর হও’।[15] অর্থাৎ এ ধরনের লোক আমার শাফা‘আত ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
পক্ষান্তরে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বিপরীত আমল করলে পরিণতি হবে জাহান্নাম। তিনি বলেন, وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ. ‘(দ্বীনের মধ্যে) প্রত্যেক নবোদ্ভূত বিষয়ই নিকৃষ্ট। আর প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’।[16]
(৩) ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা :
ইখলাছ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে অনেক বর্ণনা এসেছে। তন্মধ্যে وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّينَ، ‘তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাuঁট মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে’ (বাইয়েনাহ ৯৫/৫)। আল্লাহ বলেন,فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا، ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে, এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)।
আল্লাহ তার নবীকে সম্বোধন করে বলেন,قُلِ اللهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِينِي، فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُمْ مِنْ دُونِهِ، ‘বল, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করি। অতএব তোমরা তাঁর পরিবর্তে যার ইচ্ছা তার ইবাদত কর’ (যুমার ৩৯/১৪-১৫)।
আল্লাহ বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ، أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ- ‘আমি আপনার নিকট এই কিতাব যথার্থরূপে নাযিল করেছি। অতএব আপনি একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহ ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্তে’ (যুমার ৩৯/২-৩)।
ওমর ইবনে খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لاِمْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ. ‘নিঃসন্দেহে যাবতীয় আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেককে জন্য তার নিয়্যত অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে। যার হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে, সে হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি হিসাবেই গণ্য হয়। যার হিজরত দুনিয়া অর্জন অথবা কোন মহিলা বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, সে যার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে সে হিসাবেই গণ্য হবে’ (বুখারী হা/১, ৬৬৮৯; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১)।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ. ‘আল্লাহ কারো আকৃতি অথবা সম্পদের দিকে তাকান না। তবে তার কাজ এবং অন্তরের দিকে তাকান’ (মুসলিম হা/৪৬৫১)।
আবু মূসা আশ‘আরী রা. হতে বর্ণিত,سئل رسول الله عن الرجل يقاتل شجاعة، ويقاتل حمية، ويقاتل رياء، أي ذلك في سبيل الله؟ فقال: من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا، فهو في سبيل الله. ‘তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ঐ সকল ব্যক্তি সর্ম্পকে যারা লড়াই করে বীরত্ব প্রকাশের জন্য, লড়াই করে অহমিকা প্রদর্শনের জন্য, লড়াই করে। লোক দেখানো ভাবনা নিয়ে। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর জন্য লড়াই করল? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে লড়াই করে আল্লাহর কালেমা (বানী) উচু করার জন্য সেই আল্লাহর পথে লড়াই করে’ (বুখারী হা/৬৯০৪)।
প্রকৃত একনিষ্ঠতা হচ্ছে বান্দার বাসনা হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালে শান্তি। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى، إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى، ‘এবং তার প্রতি কারও অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং শুধু তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়’ (লাইল ১৯-২০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا، وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا،
‘যে কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করে, আমি তাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করে দেই, তারা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। আর যারা ঈমান নিয়ে পরকাল কামনা করে এবং এর জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধনা করে, তাদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে’ (বানী ইসরাঈল ১৭/১৮-১৯)।
আমল বিশুদ্ধ হবার জন্য প্রয়োজন সকল প্রকার মনের রোগ হ’তে অন্তরকে পরিষ্কার করা। যেমন অহংকার, ধোঁকা, গীবত ইত্যাদি। এমনিভাবে মানুষের মন্তব্য পর্যবেক্ষণের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার থেকেও নিজেকে পরিস্কার করা। মানুষের প্রশংসা অর্জন, অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা পাওয়া তাদের খেদমত বা ভালবাসা অর্জন করার উদ্দেশ্য পরিহার করতে হবে। কারণ এই সবই হচ্ছে মাখলুকের নিকট মুখাপেক্ষী হওয়া। যা অবশ্যই শিরক। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,أنا أغنى الشركاء عن الشرك، من عمل عملا أشرك فيه غيري فهو للذي أشرك به وأنا منه بريئ. ‘আমি শিরককারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন কাজ করল, এবং তাতে আমার সাথে কাউকে শরীক করল, তা হবে ঐ ব্যক্তির জন্য যার সাথে সে শরীক করল। আর আমি এ মুশরিক থেকে দায়মুক্ত (ইবনু মাজাহ হা/৪১৯২)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে লোক আমাদের শরী‘আতে নতুন কিছু অন্তর্ভুক্ত করল, তা প্রত্যাখাত। অতএব এই তিনটি শর্ত ছাড়া ইবাদতের কোন কাঠামো দাড় করানো সম্ভব নয়। নিয়ত বা সংকল্পে সত্যবাদী হওয়া ইবাদতের অস্তিত্বের জন্য শর্ত। আল্লাহর জন্য ইখলাছ এবং সুন্নাতের মোতাবেক হওয়া ইবাদত শুদ্ধ এবং কবুল হওয়ার জন্য শর্ত। অতএব কবুল ইবাদতের উপস্থিতি আশা করা যাবে, যদি ঐ তিনটি শর্ত একত্রে পাওয়া যায়। নিয়্যত একনিষ্ঠতা বা ইখলাছ, সংকল্পে সত্যতা ছাড়া, ইবাদত কবুলের আশা করা নির্বুদ্ধিতা এবং বাসনা ছাড়া ছাড়া আর কিছু নয়। সংকল্পে সত্যতা, নিয়্যতের বিশুদ্ধতা ছাড়া ইখলাছের তারতম্যে ইবাদত ছোট অথবা বড় শিরকে পরিণত হয়ে যায়। ইবাদতের উদ্দেশ্য যদি গায়রুলাহ হয়, তাহ’লে তা হবে মোনাফেকী। ইবাদতের শেষে যদি রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনা চলে আসে, আর তার শুরুতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকাল উদ্দেশ্য ছিল, তাহ’লেও ইবাদত প্রকারভেদে ছোট শিরক হয়ে যায়। নিয়তের বিশুদ্ধতা, সংকল্পে সত্যতা থাকারও পরও যদি আমল সুন্নাত মোতাবিক না হয়, তাহ’লে তা হবে বিদ‘আত এবং শরী‘আতে নব আবিষ্কৃত-কুসংস্কার। যা ইসলামে নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ আমাদের সকলকে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করুন। কোন কাজ প্রকাশ পায় না দৃঢ় সংকল্প ছাড়া, আবার ইখলাস এবং সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ ছাড়া কাজটা কবুলও হয় না। এজন্য
قال القضيل بن عياض في قوله تعالي: ليبلوكم أيكم أحسن عملا: هوأخلصه وأصوبه، قالوا يا أبا علي ما أخلصه وأصوبه؟ فقال: إن العمل إذاكان خالصا ولم يكن صوابا لم يقبل، وإذا كان صوابا ولم يكن خالصا لم يقبل، حتى يكون خالصا صوابا، والخالص أن يكون لله، والصواب أن يكون على السنة، ثم قرأ قوله تعالى: فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا،
‘ফুযাইল বিন আয়ায আল্লাহর বাণী,ليبلوكم أيكم أحسن عملا ‘যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন কে তোমাদের কর্মে শ্রেষ্ঠ’ (মুলক ৬৭/২)। এ আয়াতের তাফসীরে বলেন,هوأخلصه وأصوبه তা একনিষ্ঠ ও সঠিক। তাকে প্রশ্ন করা হ’ল এর দ্বারা আপনার উদ্দেশ্য কি? উত্তরে বললেন, আমলে ইখলাছ আছে কিন্তু সঠিক ভাবে আদায় হয় নাই তাহলে কবুল হবে না। আবার সঠিক ভাবে আদায় হচ্ছে কিন্তু ইখলাছ নাই। তাহলেও কবুল হবে না। কবুল হওয়ার জন্য দুইটি বস্ত্ত প্রয়োজন ইখলাছ ও বিশুদ্ধতা, ইখলাছ মানে হচ্ছে ইবাদত হবে আল্লাহর জন্য। আর বিশুদ্ধতা মানে হচ্ছে ইবাদত হবে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী। অতঃপর তিনি আল্লাহর বাণী পাঠ করেন। যার অর্থঃ ‘যে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের আশা করে সে যেন বিশুদ্ধ আমল করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (ক্বাহাফ ১৮/১১০)।
[ক্রমশঃ]
[1]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ২/৩২ পৃঃ, সূরা আলে ইমরান ৩১নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[2]. বুখারী হা/৭৪০৫; মুসলিম হা/২৬৭৫; মিশকাত হা/২২৬৪।
[3]. তিরমিযী হা/৩১৭৫; ইবনু মাজাহ হা/৪১৯৮; ছহীহাহ হা/১৬৫।
[4]. বুখারী হা/৪; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৩।
[5]. মুসলিম হা/২১।
[6]. বুখারী হা/১৩৯৫; মুসলিম হা/১৯; মিশকাত হা/১৭৭২।
[7]. মুসলিম হা/২৭৫৬; মিশকাত হা/২৩৬৯।
[8]. বুখারী হা/৬৫৬০; মিশকাত হা/৫৫৮০।
[9]. ইবনে মাজাহ হা/৬১, সনদ ছহীহ।
[10]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/১০১; সিলসিলা আছারুছ ছহীহাহ আ/১৫৭।
[11]. বুখারী হা/২৬৯৭; মিশকাত হা/১৪০।
[12]. বুখারী তরজমাতুল বাব-২০; মুসলিম হা/১৭১৮।
[13]. আবু দাঊদ হা/৪৬০৭; মিশকাত হা/১৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫৪৯।
[14]. বুখারী হা/১৮৭০; মুসলিম হা/১৩৬৬।
[15]. বুখারী হা/৬৫৮৩; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৫৭১।
[16]. নাসাঈ হা/১৫৭৮; ইবনু মাজাহ হা/৪৫; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৭৮৫।