পর্ব ১ ।  পর্ব ২ । পর্ব ৩ 

ইবাদতের উপরে হারামের প্রভাব :

আক্বীদা ছহীহ, তরীকা সঠিক ও যথার্থ ইখলাছ না থাকলে কোন আমল আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। এই সাথে আমলকারীর খাদ্য-পানীয় ও পোষাক হালাল না হ’লেও তার কোন আমল বা ইবাদত কবুল হয় না। ইবাদত কবুল হওয়ার তিনটি স্তর বা পর্যায় রয়েছে। যেমন- ১. আমলের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি, আমলকারীর প্রশংসা, তার সম্পর্কে ফেরেশতামন্ডলীর মাঝে আলোচনা করা এবং তাকে নিয়ে গর্ব করা, ২. আমল বা ইবাদতের প্রতিদান ও ছওয়াব লাভ করা, ৩. ফরযিয়াত রহিত হওয়া। আমল কবুল হওয়ার দ্বারা মূলতঃ প্রথম দু’টি অর্থ উদ্দেশ্য। তৃতীয়টির অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদান ব্যতীত ফরযিয়াত আদায় হওয়া। আর সালাফে ছালেহীন সর্বদা আমল কবুল না হওয়ার ভয় করতেন। কেননা আল্লাহ বলছেন, إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কেবল মুত্তাক্বীদের আমলই কবুল করে থাকেন’ (মায়েদাহ ৫/২৭)। সুতরাং খাদ্য হারাম হ’লে ইবাদত কবুল হয় না। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّى بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ) وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ). ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ.

‘আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কবুল করেন না। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলদের প্রতি যে নির্দেশ করেছেন তদ্রূপ নির্দেশ মুমিনদেরকেও করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র রূযী খাও এবং নেক আমল কর’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা জীবিকা স্বরূপ দান করেছি সেই পবিত্র বস্ত্তসমূহ ভক্ষণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। অতঃপর তিনি দৃষ্টান্ত হিসাবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন, এ ব্যক্তি দূর-দূরান্তের পথ সফর করেছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ধূলাবালিতে মাখা। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে বলছে, হে রব! হে রব! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরনের পোষাক হারাম। আর এ হারামই সে ভক্ষণ করে থাকে। এমন ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হ’তে পারে’?[1] এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, জীবিকা হালাল না হ’লে দো‘আ কবুল হয় না। অর্থাৎ ইবাদত কবুল হয় না। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দো‘আ হচ্ছে ইবাদত’।[2]

আবু আব্দুল্লাহ আল-বাজী বলেন,

خَمْسُ خِصَالٍ بِهَا تَمَامُ الْعَمَلِ: الْإِيْمَانُ بِمَعْرِفَةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَعْرِفَةُ الْحَقِّ، وَإِخْلَاصُ الْعَمَلِ لِلَّهِ، وَالْعَمَلُ عَلَى السُّنَّةِ، وَأَكْلُ الْحَلَالِ، فَإِنْ فَقَدْتَ وَاحِدَةً، لَمْ يَرْتَفِعِ الْعَمَلُ، وَذَلِكَ أَنَّكَ إِذَا عَرَفْتَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ، وَلَمْ تَعْرِفِ الْحَقَّ، لَمْ تَنْتَفِعْ، وَإِذَا عَرَفْتَ الْحَقَّ، وَلَمْ تَعْرِفِ اللهَ، لَمْ تَنْتَفِعْ، وَإِنْ عَرَفْتَ اللهَ، وَعَرَفْتَ الْحَقَّ، وَلَمْ تُخْلِصِ الْعَمَلَ، لَمْ تَنْتَفِعْ، وَإِنْ عَرَفْتَ اللهَ، وَعَرَفْتَ الْحَقَّ، وَأَخْلَصْتَ الْعَمَلَ، وَلَمْ يَكُنْ عَلَى السُّنَّةِ، لَمْ تَنْتَفِعْ، وَإِنْ تَمَّتِ الْأَرْبَعُ، وَلَمْ يَكُنِ الْأَكْلُ مِنْ حَلَالٍ لَمْ تَنْتَفِعْ.

‘পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমল পূর্ণতা লাভ করে। জেনেশুনে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করা, হক জানা, আমলে ইখলাছ থাকা, সুন্নাত মুতাবিক আমল করা এবং হালাল ভক্ষণ করা। এর একটি না পাওয়া গেলে আমল উপরে উঠবে না। অর্থাৎ কবুল হবে না। আর এটা হ’ল যখন তুমি আল্লাহকে চিনবে কিন্তু হক জানবে না এতে কোন ফায়েদা নেই। আর যখন তুমি হক জানবে এবং আল্লাহকে চিনবে না, এতেও কোন ফায়েদা নেই। যদি তুমি আল্লাহ ও হক জান কিন্তু তোমার আমলে ইখলাছ না থাকে, কোন ফায়েদা নেই। যদি তুমি আল্লাহকে জান ও হক জান, আমলে ইখলাছও থাকে, কিন্তু তা যদি সুন্নাত মোতাবেক না হয়, তাহ’লে ফায়েদা নেই। আর যদি চারটি পূর্ণ কর কিন্তু খাদ্য হালাল না হয়, তাহ’লেও কোন ফায়েদা নেই’।[3]

ইবাদত কবুলে প্রতিবন্ধকতা :

ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ যেমন আল্লাহর রহমত লাভে ধন্য হয়, তেমনি পরকালীন জীবনে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভ করে সফল ও কামিয়াব হয়। তবে এই ইবাদত আল্লাহর কাছে কবুল ও মঞ্জুর হ’লেই কেবল ঐ ফযীলত লাভ করা যাবে। আর আল্লাহ ও তদীয় রাসূল প্রদর্শিত পথে ইবাদত করা হ’লে তা কবুল হয়। অন্যথা নয়। সুতরাং যেসব কারণে ইবাদত কবুলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. ঈমানহীন আমল :

ইসলাম গ্রহণ না করে কোন ব্যক্তি যত ভাল আমলই করুক না কেন তার আমল আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ، ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। ইসলামের আগমণের পর অন্যান্য সকল ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। বিধায় আল্লাহ তাদের কোন আমল কবুল করবেন না। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ أَنَّ الْعَاصَ بْنَ وَائِلٍ أَوْصَى أَنْ يُعْتَقَ عَنْهُ مِائَةُ رَقَبَةٍ فَأَعْتَقَ ابْنُهُ هِشَامٌ خَمْسِيْنَ رَقَبَةً فَأَرَادَ ابْنُهُ عَمْرٌو أَنْ يَعْتِقَ عَنْهُ الْخَمْسِيْنَ الْبَاقِيَةَ فَقَالَ حَتَّى أَسْأَلَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ أَبِى أَوْصَى بِعِتْقِ مِائَةِ رَقَبَةٍ وَإِنَّ هِشَامًا أَعْتَقَ عَنْهُ خَمْسِيْنَ وَبَقِيَتْ عَلَيْهِ خَمْسُوْنَ رَقَبَةً أَفَأُعْتِقُ عَنْهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّهُ لَوْ كَانَ مُسْلِمًا فَأَعْتَقْتُمْ عَنْهُ أَوْ تَصَدَّقْتُمْ عَنْهُ أَوْ حَجَجْتُمْ عَنْهُ بَلَغَهُ ذَلِكَ.

‘আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন শু‘আইব স্বীয় পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আছ বিন ওয়াইল তার পক্ষ হ’তে ১০০টি ক্রীতদাস মুক্ত করার অছিয়ত করে মারা যায়। অতঃপর তার ছোট ছেলে হিশাম ৫০টি দাস মুক্ত করে। আর বড় ছেলে আমর বাকী ৫০টি দাস মুক্ত করার ইচ্ছা করে। তখন তিনি বললেন, (পিতা কাফের অবস্থায় মারা গেছে) তাই আমি এ কাজ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস না করে করব না। সুতরাং তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে ঘটনা খুলে বলে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি বাকী ৫০টি দাস পিতার পক্ষ থেকে মুক্ত করব? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, সে যদি মুসলিম হ’ত এবং তোমরা তার পক্ষ থেকে দাস মুক্ত করতে অথবা ছাদাক্বাহ করতে অথবা হজ্জ করতে তাহ’লে তার ছওয়াব তার নিকট পৌঁছত’।[4]

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ ابْنُ جُدْعَانَ كَانَ فِى الْجَاهِلِيَّةِ يَصِلُ الرَّحِمَ وَيُطْعِمُ الْمِسْكِيْنَ فَهَلْ ذَاكَ نَافِعُهُ قَالَ لاَ يَنْفَعُهُ إِنَّهُ لَمْ يَقُلْ يَوْمًا رَبِّ اغْفِرْ لِى خَطِيئَتِى يَوْمَ الدِّيْنِ.

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ইবনু জুদ‘আন জাহেলী যুগে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখত এবং দরিদ্রদের আহার দিত। (আখিরাতে) এসব কর্ম তার উপকারে আসবে কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কোন উপকারে আসবে না। সে তো কোন দিন এ কথা বলেনি যে, হে আমার রব! ক্বিয়ামতের দিন আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিও’।[5] অর্থাৎ সে আল্লাহর অনুগত হয়নি। তাই তার আমল কোন কাজে আসবেন।

২. শিরক করা :

ইবাদতের কোন কিছু আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য করা অথবা আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করা কিংবা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য কোন কিছু দান করা শিরক। যেমন কাউকে ইলমে গায়েবের অধিকারী মনে করা, কোন পীর-অলীর নামে মান্নত ও কুরবানী করা ইত্যাদি। শিরক করলে আমল বাতিল হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ أُوحيَ الَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ منْ قَبْلكَ لَئنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ، ‘নিশ্চিতভাবে তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের (নবীদের) প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক কর, তাহ’লে অবশ্যই তোমার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُون، ‘তবে যদি তারা শিরক করত, তাহ’লে তাদের সমস্ত আমল নিস্ফল হয়ে যেত’ (আন‘আম ৬/৮৮)

৩. কুফরী করা :

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সাথে কুফরী করে তার আমল কবুল করা হয় না। যেমন রাসূল (ছাঃ) মানুষের মাঝে এ কথা প্রচার করার নির্দেশ দেন যে,إِنَّهُ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلاَّ نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ، ‘নিশ্চয়ই মুসলিম ব্যতীত কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[6] আল্লাহ বলেন,وَمَا مَنَعَهُمْ أَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَبِرَسُولِهِ، ‘আর তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী’ (তওবা ৯/৫৪)

তবে কাফেরদের সৎকাজের প্রতিদান আল্লাহ দুনিয়াতে দিয়ে থাকেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللهَ لاَ يَظْلِمُ مُؤْمِنًا حَسَنَةً يُعْطَى بِهَا فِى الدُّنْيَا وَيُجْزَى بِهَا فِى الآخِرَةِ وَأَمَّا الْكَافِرُ فَيُطْعَمُ بِحَسَنَاتِ مَا عَمِلَ بِهَا لِلَّهِ فِى الدُّنْيَا حَتَّى إِذَا أَفْضَى إِلَى الآخِرَةِ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَةٌ يُجْزَى بِهَا.

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, একটি নেকীর ক্ষেত্রেও আল্লাহ কোন মুমিন বান্দার প্রতি যুলম করবেন না। বরং তিনি এর ফলাফল দুনিয়াতে দান করবেন এবং আখিরাতেও দান করবেন। আর কাফির ব্যক্তি পার্থিব জগতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে নেক আমল করে এর প্রতিদান স্বরূপ তিনি তাকে জীবিকা দান করেন। পরিশেষে আখিরাতে প্রতিফল দেয়ার মতো তার কাছে কোন সৎ আমলই থাকবে না’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّهُ حَدَّثَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الْكَافِرَ إِذَا عَمِلَ حَسَنَةً أُطْعِمَ بِهَا طُعْمَةً مِنَ الدُّنْيَا وَأَمَّا الْمُؤْمِنُ فَإِنَّ اللهَ يَدَّخِرُ لَهُ حَسَنَاتِهِ فِى الآخِرَةِ وَيُعْقِبُهُ رِزْقًا فِى الدُّنْيَا عَلَى طَاعَتِهِ.

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘কাফির যদি দুনিয়াতে কোন সৎ আমল করে তবে এর প্রতিদান স্বরূপ দুনিয়াতেই তাকে জীবনোপকরণ প্রদান করা হয়। আর মুমিনদের নেকী আল্লাহ আখিরাতের জন্য জমা করে রেখে দেন এবং আনুগত্যের প্রতিফল স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীতেও জীবিকা দান করেন’।[8]

৪. বিদ‘আত করা :

আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করার মানসে এমন কোন কাজ করা যে ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোন নির্দেশনা নেই, সেটাই দ্বীনের মাঝে নতুন সৃষ্টি বা বিদ‘আত। যে আমলে বিদ‘আত করা হয় তা কবুল হয় না। 

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ.

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[9] অন্য বর্ণনায় এসেছে,مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا، فَهْوَ رَدٌّ. ‘যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যে ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[10]

সুতরাং বিদ‘আতযুক্ত ইবাদত কবুল হবে না। উল্লেখ্য, মাযহাবী ও বাতিল ফিরক্বার অনুসারীদের দ্বারা দ্বীনের মাঝে বহু বিদ‘আত চালু হয়েছে। আর এগুলোকে তারা ইসলামের প্রতি সম্বন্ধিত করেছে। অথচ এগুলো ইসলাম নয়। এসবের দ্বারা আমলকারীরা কোন নেকী লাভ করবে না, বরং গোনাগার হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالًا، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا، ‘বল, আমরা কি তোমাদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে জানিয়ে দেব? তারা হ’ল সেই সব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিফলে গেছে। অথচ তারা ভেবেছে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)

৫. ধর্ম ত্যাগ করা :

ধর্ম ত্যাগ করা বলতে কোন মুসলিম কর্তৃক ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করাকে বুঝায়। সুতরাং মুরতাদ ব্যক্তির পূর্বে কৃত আমল ও ইবাদত বাতিল হয়ে যায়, যখন সে ধর্মত্যাগী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ، ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করবে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)

৬. ফিসক, কুফর ও নিফাকী করা :

ফাসেকী, কুফরী ও নিফাকী করার কারণে ইবাদত কবুল হয় না। আল্লাহ বলেন,قُلْ أَنفقُواْ طَوْعًا أَوْ كَرْهًا لَّنْ يُتَقَبَّلَ مِنْكُمْ انَّكُمْ كُنتُمْ قَوْمًا فَاسقيْنَ، ‘তুমি বল যে, তোমরা খুশীতে দান কর বা অখুশীতে দান কর, তোমাদের থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না। নিশ্চিতভাবে তোমরা পাপাচারী সম্প্রদায়’ (তওবা ৯/৫৩)। সুতরাং মুসলমানদেরকে সর্বপ্রকার ফাসেকী ও নিফাকী হ’তে মুক্ত থাকতে হবে যাতে নেক আমল ও ইবাদত প্রত্যাখ্যাত না হয়।

৭. রিয়া বা লৌকিকতা :

মানুষ যখন তার আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি বাদ দিয়ে মানুষের নিকটে যশ-খ্যাতি, মর্যাদা ও শীর্ষস্থান লাভের আশা করে সেটা হয় রিয়া বা লৌকিকতা। আর এ আমলের কোন ছওয়াব সে পাবে না। বরং ক্বিয়ামতের দিন তাকে বলা হবে যাও যাদের জন্য আমল করেছ তাদের কাছে প্রতিদান তালাশ কর। আবূ সা‘দ ইবনে আবূ ফাযালা আল-আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا جَمَعَ اللهُ الأَوَّلِينَ وَالآخِرِينَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ لِيَوْمٍ لاَ رَيْبَ فِيهِ نَادَى مُنَادٍ مَنْ كَانَ أَشْرَكَ فِى عَمَلٍ عَمَلَهُ لِلَّهِ فَلْيَطْلُبْ ثَوَابَهُ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ فَإِنَّ اللهَ أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ. ‘আল্লাহ যখন ক্বিয়ামতের দিন পূর্বাপর সকলকে একত্রিত করবেন, যে দিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই। তখন একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে গিয়ে এর মধ্যে কাউকে শরীক করেছে, সে যেন গায়রুল্লাহর নিকটে নিজের ছওয়াব চেয়ে নেয়। কেননা আল্লাহ শরীকদের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত’।[11]

অন্যত্র তিনি বলেন, قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ. ‘আল্লাহ বলেন, শিরককারীদের শিরক থেকে আমি অমুখাপেক্ষী। যে কেউ এমন আমল করল যাতে আমার সাথে অপরকে শরীক করেছে, আমি তাকে ও তার শিরককে প্রত্যাখ্যান করি’।[12]

আর লৌকিকতাকে গুপ্ত শিরক বলা হয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ رضي الله عنه قَالَ: خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: أَيُّهَا النَّاسُ! إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ؟ قَالَ: يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي، فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ النَّاسِ إِلَيْهِ، فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ ‘মাহমূদ বিন লাবীদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (একদা সগৃহ হ’তে) বের হয়ে বললেন, হে মানবমন্ডলী! তোমরা গোপন শিরক হ’তে সাবধান হও। সকলে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গোপন শিরক কী? তিনি বললেন, মানুষ ছালাতে দাঁড়িয়ে তার ছালাতকে সুশোভিত করার চেষ্টা করে (সুন্দর করে পড়ে) এই কারণে যে, লোকেরা তার প্রতি লক্ষ্য করে দেখে। এটাই (লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ছালাত পড়া) হ’ল গোপন শিরক’।[13]

৮. নিয়তের অশুদ্ধতা ও হীন উদ্দেশ্য :

যখন ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য করা হয় না বরং অন্য উদ্দেশ্য থাকে, তখন ইবাদত কবুল হয় না। প্রকৃত ইখলাছ হচ্ছে মুমিনের অন্তরে আল্লাহর মহববত-ভালবাসা ও প্রশংসার সাথে দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্য একত্রিত না হওয়া। এরূপ হ’লে তথা নিয়ত সঠিক না হ’লে ইবাদত কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ.

‘নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন যার ওপর ফায়ছালা করা হবে সে ঐ ব্যক্তি, যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে আল্লাহর নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এতে কি আমল করেছ? সে বলবে, আপনার জন্য জিহাদ করেছি, এমনকি শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ। তুমি তো এজন্য জিহাদ করেছ যে, তোমাকে ‘বীর’ বলা হবে। অতএব তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আরও এক ব্যক্তি, যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে, তাকে আনা হবে। অতঃপর তাকে তার নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এতে কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি, শিক্ষা দিয়েছি ও আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ। তুমি ইলম অর্জন করেছ যেন তোমাকে ‘আলেম’ বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন ‘ক্বারী’ বলা হয়। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আরও এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সচ্ছলতা দিয়েছেন ও সকল প্রকার সম্পদ দান করেছেন, তাকে আনা হবে। তাকে তার নে‘মতরাজি জানানো হবে। সে তা স্বীকার করবে। তিনি বলবেন, তুমি এতে কি আমল করেছ? সে বলবে, এমন খাত নেই যেখানে খরচ করা আপনি পসন্দ করেন আমি তাতে আপনার জন্য খরচ করিনি। তিনি বলবেন, মিথ্যা বলেছ। তুমি তা করেছ যেন বলা হয়, সে দানশীল। আর তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[14]

আর নেক আমলের বিনিময় যার লক্ষ্য হবে দুনিয়া কামাই তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيْهَا وَهُمْ فِيْهَا لاَ يُبْخَسُوْنَ، أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দিব। সেখানে তাদেরকে কোনই কমতি করা হবে না। এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে (বাতিল আক্বীদা ও লোক দেখানো সৎকর্মের কারণে)’ (হূদ ১১/১৫-১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ، ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোন অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ، وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهُ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا قُدِّرَ لَهُ، ‘যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ তা‘আলা সে ব্যক্তির অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন এবং তার যাবতীয় বিচ্ছিন্ন কাজ একত্রিত করে সুসংহত করে দিবেন। তখন তার নিকট দুনিয়াটা নগণ্য হয়ে দেখা দিবে। আর যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে দুনিয়া, আল্লাহ সে ব্যক্তির অভাব-অনটন দু’চোখের সামনে রেখে দিবেন এবং তার কাজগুলো এলোমেলো ও ছিন্নভিন্ন করে দিবেন। তার জন্য যা নির্দিষ্ট রয়েছে, দুনিয়াতে সে এর চাইতে বেশী পাবে না’।[15]

উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এই উম্মতকে গৌরব, উচ্চ মর্যাদা, বিজয় ও পৃথিবীতে শক্তিশালী হওয়ার সুসংবাদ দাও। অতঃপর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আখেরাতের আমল করবে দুনিয়ার জন্য, আখেরাতে তার কোন অংশ থাকবে না’।[16]

৯. ইবাদতে খোঁটা দেওয়া :

ইবাদতে খোঁটা দিলে তা বাতিল হয়। খোঁটা দেওয়া আল্লাহর ক্ষেত্রে হোক বা কোন সৃষ্টির প্রতি হোক। যেমন আল্লাহ বলেন,يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ بَلِ اللهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ‘তারা ইসলাম কবুল করেছে বলে তোমাকে ধন্য করতে চায়। বল, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ বলে মনে করো না। বরং তোমাদেরকে ঈমানের পথ দেখিয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে ধন্য করেছেন। যদি তোমরা (ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী হয়ে থাক’ (হুজুরা৩ ৪৯/১৭)। এ পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য অনুগ্রহ, দয়া। আর এসবের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম হাদিয়া হ’ল বান্দাকে ঈমানের প্রতি হেদায়াত দান করা। সুতরাং বান্দা যখন আল্লাহর আনুগত্য করে তাঁকে খোঁটা দেয় তখন তার ঈমান কোন কাজে আসে না। কেননা আল্লাহ বান্দার আনুগত্য থেকে অমুখাপেক্ষী। বান্দার আনুগত্য ও অবাধ্যতায় আল্লাহর কোন উপকার বা ক্ষতি হয় না।

অনুরূপভাবে বানদার ইবাদত বাতিল হয় যখন সে আল্লাহর বান্দাকে খোঁটা দেয়। সেটা আর্থিক বা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে হ’তে পারে। যেমন দান-ছাদাক্বাহ, অজ্ঞকে ইলম শিক্ষা দেওয়া, পথহারাকে পথ দেখানো ও কারো জন্য সুফারিশ করা ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لَا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না ঐ ব্যক্তির মত, যে তার ধন-সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর জন্য এবং সে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না। ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ প্রস্তরখন্ডের মত, যার উপরে কিছু মাটি জমে ছিল। অতঃপর সেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হ’ল ও তাকে পরিষ্কার করে রেখে গেল। এভাবে তারা যা কিছু উপার্জন করে, সেখান থেকে কোনই সুফল তারা পায় না। বস্ত্ততঃ আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)। হাদীছে উল্লেখ আছে,

عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: الْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى، وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ، وَالْمُنَفِّقُ سَلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ،

‘আবূ যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন তিন প্রকার ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না এবং তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না, বরং তাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন ঐ ব্যক্তি, যে দান করে খোঁটা দেয়; দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে ইযার বা লুঙ্গি ইত্যাদি ঝুলিয়ে পড়ে; তৃতীয় ব্যক্তি যে মিথ্যা শপথ দ্বারা পণ্য বিক্রি করে’।[17]

১০. গোপনে বা নির্জনে গোনাহ করা :

প্রকৃত ঈমানের পরিচয় হচ্ছে জনসমক্ষে এবং লোক চক্ষুর অন্তরালে সর্বত্র আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে, তিনি সকল কর্মকান্ড দেখছেন। মুমিন যখন একাকী হবে তখন সে আল্লাহর দৃষ্টিকে ভয় করবে, আল্লাহর মহত্ব অন্তরে পোষণ করবে। ফলে সে নিন্দনীয় কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ ‘যারা না দেখেই তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে’ (আম্বিয়া ২১/৪৯; ফাতির ৩৫/১৮)

সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা কোন পাপ বা অপরাধ করার ক্ষেত্রে মানুষ থেকে গোপন করে। কিন্তু আল্লাহ থেকে গোপন করে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহর ভয়ে পাপাচার থেকে বিরত থাকে না। আল্লাহ বলেন,يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَى مِنَ الْقَوْلِ وَكَانَ اللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا، ‘যারা লোকদের থেকে লুকাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ হ’তে লুকাতে পারে না। তিনি তাদের সঙ্গে থাকেন, যখন তারা রাত্রিতে (আল্লাহর) অপ্রিয় বাক্যে পরামর্শ করে এবং তারা যা করছে আল্লাহ তার পরিবেষ্টনকারী’ (নিসা ৪/১০৮)

এ সম্পর্কে ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لَأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا، فَيَجْعَلُهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُورًا আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি,

যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাঃ) বলেন, يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا جَلِّهِمْ لَنَا، أَنْ لَا نَكُونَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَا نَعْلَمُ. হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বললেন, أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ وَيَأْخُذُونَ مِنْ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُونَ، وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوْهَا তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে’।[18] [ক্রমশঃ]


[1]. মুসলিম হা/১০১৫; তিরমিযী হা/২৯৮৯; মিশকাত হা/২৭৬০।

[2]. আবূদাঊদ হা/১৪৭৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৪০৭।

[3]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, (বৈরূত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৭ম প্রকাশ, ১৪২২হিঃ/২০০১খ্রিঃ), ১/২৬২-৬৩ পৃঃ।

[4]. আবূ দাউদ ২৮৮৫; আহমাদ হা/৬৭০৪; মিশকাত হা/৩০৭৭।

[5]. মুসলিম হা/২১৪।

[6]. বুখারী হা/৩০৬২।

[7]. মুসলিম হা/২৮০৮; মিশকাত হা/৫১৫৯।

[8]. ছহীহাহ হা/২৭৭০।

[9]. বুখারী হা/২৬৯; মুসলিম হা/১৭১৮; আবূ দাঊদ হা/৪৬০৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪; মিশকাত হা/১৪০।

[10]. মুসলিম হা/২৯৮৫।

[11]. তিরমিযী হা/৩১৫৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২০৩; মিশকাত হা/৫৩১৮।

[12]. মুসলিম হা/২৯৮৫।

[13]. বায়হাক্বী হা/৩৪০০; ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/৯৩৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩১।

[14]. মুসলিম হা/১৯০৫, ‘অশুদ্ধ নিয়তকারীর জন্য জাহান্নাম’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২০৫।

[15]. তিরমিযী হা/২৪৬৫; ছহীহাহ হা/৯৪৯-৯৫০; ছহীহুল জামে হা/৬৫১০; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৬৯।

[16]. আহমাদ হা/২১২৫৮; হাকেম হা/৭৮৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮২৫।

[17]. নাসাঈ হা/৫৩৩২; ইবনু মাজাহ হা/২২০৮।

[18]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৫; ছহীহাহ হা/৫০৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৭১৭৪।






আকাশের দরজাগুলো কখন ও কেন খোলা হয়? (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের উপায় - শামসুল আলম
মুসলিম নারীর পর্দা ও চেহারা ঢাকার অপরিহার্যতা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৪তম কিস্তি) - শামসুল আলম
অন্তর কঠিন হওয়ার কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ইখলাছ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হাদীছের অনুবাদ ও ভাষ্য প্রণয়নে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
তালাক সংঘটিত হওয়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায় - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
খেয়াল-খুশির অনুসরণ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ইসলামে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ও শ্রমিকের অধিকার - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
আরও
আরও
.