পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ 

আলবানী (রহঃ) কর্তৃক ছহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীছের সমালোচনা :

(১) قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِىَ فَلْيَسْتَقِئْ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। কেউ ভুলে গিয়ে পান করে থাকলে সে যেন তা বমি করে ফেলে’।[1]

আলবানী বলেন, ‘এই বাক্যে হাদীছটি মুনকার। হাদীছটি ইমাম মুসলিমعُمَرُ بْنُ حَمْزَةَ أَخْبَرَنِى أَبُو غَطَفَانَ الْمُرِّىُّ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, উক্ত হাদীছের রাবী عُمَرُ بْنُ حَمْزَةَ থেকে ইমাম মুসলিম হাদীছ গ্রহণ করলেও ইমাম আহমাদ, ইবনু মা‘ঈন ও নাসাঈসহ অন্যান্য ইমামগণ তাকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। সেকারণে ইমাম যাহাবী স্বীয় ‘মীযানুল ই‘তিদাল’ গ্রন্থে তাকে যঈফ রাবীদের মধ্যে উল্লেখ করে বলেছেন, তার বর্ণিত হাদীছে নাকারাত (অপরিচিতি) থাকার কারণে ইবনু মা‘ঈন তাকে যঈফ বলেছেন। ইবনু হাজার স্বীয় তাক্বরীবে বলেন, সে যঈফ।

আলবানী বলেন, আমার বক্তব্য হ’ল- দাঁড়িয়ে পান করা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে একাধিক ছাহাবী থেকে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আবু হুরায়রাও রয়েছেন। তবে তা ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বমির কথা রয়েছে, তবে ভুলে যাওয়ার কথা নেই। আর এ অংশটিই মুনকার। বাকি পুরো হাদীছটিই মাহফূয। তাই ঐ অংশটি আমি সিলসিলা ছহীহাহ-তে[2] সংকলন করেছি।[3]

উক্ত হাদীছে আলবানী نسيان বা ভুলে যাওয়ার বিষয়টিকে মুনকার সাব্যস্ত করেছেন। যা কেবলমাত্র মুসলিমে সংকলিত ‘উমার ইবনু হামযার সূত্রেই এসেছে। অথচ অধিকাংশ মুহাদ্দিছের মতে তিনি দুর্বল। উপরন্তু উক্ত শব্দটি যুক্ত করার মাধ্যমে তিনি কয়েকজন ছাহাবী থেকে বর্ণিত ছহীহ হাদীছের বিরোধিতা করেছেন।

তবে ইমাম নববী এর প্রতিবাদ করে অন্যান্য বর্ণনার সাথে এর সমন্বয় সাধনের প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর মতে, কিছু বিদ্বান হাদীছটির ব্যাপারে অনেক বাতিল বক্তব্য পেশ করেছেন এবং এর সনদের কোন রাবীকে যঈফ সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন। অথচ তা বাতিলযোগ্য। বরং হাদীছের মধ্যে কোন দুর্বলতা নেই। এর পুরোটাই ছহীহ।[4]

কিন্তু উক্ত প্রতিবাদের ক্ষেত্রে নববী ‘উমার ইবনু হামযার ব্যাপারে কিছু বলেননি, যা আলবানী উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ড. হামযা মালিয়াবারীর মতে, ইমাম মুসলিমের মানহাজ হ’ল, মুসলিমে সংকলিত কোন হাদীছের মধ্যে ত্রুটি থাকলে তা তিনি অনুচ্ছেদের শেষাংশে উল্লেখ করেন।[5] আলবানীর সিদ্ধান্তের সাথে এটা মিলে যায়। কেননা ইমাম মুসলিম উক্ত হাদীছের ক্ষেত্রে এমনটিই করেছেন। তথা হাদীছটি অনুচ্ছেদের শেষাংশে উল্লেখ করেছেন। অতএব উক্ত হাদীছের ব্যাপারে আলবানীর সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকারযোগ্য।[6]

(২) عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ إِنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الرَّجُلِ يُجَامِعُ أَهْلَهُ ثُمَّ يُكْسِلُ هَلْ عَلَيْهِمَا الْغُسْلُ وَعَائِشَةُ جَالِسَةٌ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم্রإِنِّى لأَفْعَلُ ذَلِكَ أَنَا وَهَذِهِ ثُمَّ نَغْتَسِلُগ্ধ আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার কোন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, স্ত্রী সহবাসের ক্ষেত্রে কেউ যদি বীর্যপাতের পূর্বেই পুরুষাঙ্গ বের করে নেয়, তবে কি তাদের উপর গোসল ফরয হবে? এ সময়ে আয়েশা (রাঃ) সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি এবং সে (‘আয়েশা) এরূপ করি। অতঃপর আমরা গোসল করি।

হাদীছটি মুসলিম (হা/৩৫০) ও বায়হাক্বীতে عياض بن عبد الله عن أبي الزبير عن جابر بن عبد الله عن أم كلثوم عن عائشة থেকে মারফূ‘ সূত্রে সংকলিত হয়েছে।

আলবানী বলেন, দু’টি কারণে এর সনদ যঈফ। (১) আবূয যুবায়ের সনদে ‘আন‘আনা করেছেন। অথচ তিনি মুদাল্লিস। ইবনু হাজার তাকে ‘সত্যবাদী কিন্তু তাদলীস করেন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যাহাবী বলেছেন, ছহীহ মুসলিমে কয়েকটি হাদীছ রয়েছে যেখানে আবূয যুবায়ের জাবের থেকে শ্রবণের বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। এছাড়া লাইছ সূত্রেও তা স্পষ্ট হয়নি। (২) ‘ইয়ায ইবনু ‘আব্দিল্লাহর দুর্বলতা। তিনি হ’লেন ইবনু ‘আব্দির রহমান আল-ফিহরী আল-মাদানী। ইমাম বুখারী তাকে মুনকিরুল হাদীছ বলেছেন। একথার দ্বারা ইমাম বুখারী তার চরম দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেন। আবু হাতিম বলেছেন, তিনি শক্তিশালী নন। ইবনু হিববান তাকে স্বীয় ‘ছিক্বাত’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইবনু মা‘ঈন বলেছেন, ‘যঈফুল হাদীছ’। ইবনু শাহীন তাকে ছিক্বাহ রাবীর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। আবু ছালিহ বলেছেন, নির্ভরযোগ্য। ইবনু হাজার সব মতামতের সারাংশ স্বরূপ স্বীয় ‘তাক্বরীবে’ বলেছেন, فيه لين। যাহাবী স্বীয় মীযানে যারা তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন তাদের বক্তব্যকে যঈফ সাব্যস্ত করে বলেন, ‘তারা তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন! অথচ আবু হাতিম বলেছেন, সে শক্তিশালী নয়। সেকারণে তাকে স্বীয় ‘কিতাবুয যু‘আফা’য় অন্তর্ভুক্ত করেছেন’। অতঃপর আলবানী বলেন, এ রাবী দুর্বল। তার থেকে একক কোন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও তার বিপরীতে কোন বর্ণনা না আসে।

অথচ মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত উক্ত দুর্বল হাদীছের বিপরীতে আয়েশা থেকে মাওকূফ সূত্রে আশ‘আছ ইবনু ছাউয়ার কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ আহমাদ ও আবু ইয়া‘লাতে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে তিনি আবূয যুবায়ের থেকে আয়েশার সূত্রে বলেছেন তিনি বলেন, আমরা একবার এরূপ করেছিলাম। তারপর দু’জনে গোসল করেছিলাম। অর্থাৎ আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মিলিত হয়ে বীর্যপাত ছাড়াই পৃথক হন। অতঃপর গোসল করেন। আলবানী বলেন, তাক্বরীবের বর্ণনা মতে আশ‘আছ যঈফ রাবী। মুসলিম তার হাদীছ মুতাবা‘আত হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তবে তার বর্ণনা আমার নিকটে ‘ইয়াযের বর্ণনার চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য। কেননা অন্য তুরুক থেকে এর শাহেদ রয়েছে। যেটি আব্দুর রহমান ইবনুল ক্বাসিম তার পিতা থেকে আয়েশার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তাকে বীর্যপাত ব্যতীত সহবাস শেষ করা ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি এবং রাসূল এরূপ করেছি। তারপর একত্রে গোসল করেছি। এটি আবু ইয়া‘লা স্বীয় মুসনাদে, ইবনুল জারূদ স্বীয় ‘মুনতাক্বা’-য় এবং অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ ছহীহ সনদে সংকলন করেছেন। অতএব হাদীছটি মাওকূফ হওয়ারই উপযুক্ত। মারফূ‘ সূত্রটি ছহীহ নয়। তবে পরবর্তীতে ‘মুদাওয়ানা’-তে আমি আলোচ্য হাদীছের আরেকটি মারফূ‘ সূত্র পেয়েছি। যেটা হ’ল- ابن وهب عن عياض بن عبد الله القرشي وابن لهيعة عن أبي الزبير عن جابر । ফলে ‘ইয়াযের তাফাররুদ দূরীভূত হ’ল। হাদীছটির ‘ইল্লত কেবল আবূয যুবায়েরের ‘আন‘আনা মা‘আল মুখালাফা-তে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।[7]

পর্যালোচনা :

প্রথমতঃ ইমাম মুসলিম হাদীছটি স্বীয় বাবে মৌলিক দলীল হিসাবে সংকলন করেননি। বরং শাহেদ হিসাবে এনেছেন। অর্থাৎ এ বিষয়ক অনুচ্ছেদে তিনি কয়েকটি হাদীছ এনেছেন যা মিলনের পর গোসল ওয়াজিব হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে। তারপর উক্ত হাদীছ দ্বারা অনুচ্ছেদটি সমাপ্ত করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ আলবানী হাদীছটি পুরোপুরি যঈফ সাব্যস্ত করেননি। বরং এটাকে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য হিসাবে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন এবং রাসূলের আমল সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ)-এর বক্তব্য হিসাবে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী হিসাবে নয় বরং তার কর্ম হিসাবে বর্ণিত রেওয়ায়াতটি গ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন। মূলতঃ এর মারফূ‘, মাওকূফ উভয় সূত্রই দুর্বল। কিন্তু মাওকূফ সূত্রটি অন্য তুরুকে মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত ছহীহ শাওয়াহেদ দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং হাদীছ শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে মাওকূফ সূত্রটিকে তিনি ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।[8]

সারকথা :

উপরে উল্লেখিত কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আলবানী নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতামতের ভিত্তিতে ছহীহুল বুখারী ও মুসলিমে সংকলিত হাদীছের সমালোচনা করেননি। বরং ইলমুল হাদীছের একজন মুজতাহিদ বিদ্বান হিসাবে উছূলুল হাদীছের নীতিমালা এবং রাবীদের ব্যাপারে পূর্ববর্তী বিদ্বানগণের মতামতের ভিত্তিতে ইলমী গবেষণা পেশ করেছেন। তাঁর এই নিরপেক্ষ সমালোচনার ফলে যে কেবল ছহীহাইনের কিছু হাদীছের দুর্বলতার দিকসমূহ প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, বরং ছহীহাইনের অনেক হাদীছের ক্ষেত্রে তিনি সমালোচকদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন এবং শাওয়াহেদ ও মুতাবা‘আতসহ বিভিন্ন দলীল-প্রমাণের সাহায্যে সেগুলো ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।

উদাহরণ স্বরূপ : (১) ছহীহুল বুখারীর হাদীছ- مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ... -এর ব্যাপারে ইমাম যাহাবী ও ইবনু রজব হাম্বলী সমালোচনা পেশ করেছেন। আর তার জবাব দিয়েছেন ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)। আলবানী তাঁদের সমালোচনার জবাবে সিলসিলা ছহীহায় ইবনু হাজারের দলীলসমূহ উল্লেখ করে বলেন, হাদীছটি ইমাম বুখারী স্বীয় গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তাই কেবল সনদগত দুর্বলতার ভিত্তিতে তার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সমালোচনা করা সহজ নয়। কেননা তাকে শক্তিশালী করার মত প্রয়োজনীয় শাওয়াহেদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অতঃপর তিনি সমালোচনার জবাব দিয়েছেন এবং হাদীছটি ছহীহ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে ১১ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিস্তারিত আলোচনা পেশ করেছেন।[9]

(২) ছহীহ মুসলিমের হাদীছ خلق الله البريت يوم السبت... -এর ব্যাপারে ইমাম বুখারী, তাঁর উস্তায আলী ইবনুল মাদীনী, বায়হাক্বী প্রমুখ বিদ্বান সমালোচনা করেছেন। তাঁরা হাদীছটির মর্মার্থ মুনকার ও কুরআন বিরোধী সাব্যস্ত করেছেন। আলবানী সিলসিলা ছহীহায় উক্ত সমালোচনার জবাব দিয়েছেন এবং বিস্তারিত আলোচনা পেশ করে হাদীছটিকে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।[10]

(৩) ছহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীছ إِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا... -কে ইমাম বুখারী, আবূদাঊদ, ইবনু মা‘ঈন, ইবনু খুযায়মা প্রমুখ বিদ্বান যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। আলবানী তার প্রতিবাদ করেছেন এবং আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীছ থেকে এর শাওয়াহেদ পেশ করে একে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।[11]

মোদ্দাকথা এরূপ সমালোচনার ক্ষেত্রে আলবানী প্রথম মুহাদ্দিছ নন। বরং তাঁর পূর্বে ইমাম দারাকুৎনীসহ অনেক অগ্রগণ্য বিদ্বান এরূপ করেছেন।[12] আলবানী বলেন, আমার পূর্বে অনেক বিদ্বান প্রায় হাযার বছর পূর্বে এরূপ সমালোচনা করেছেন, যারা ইলমুল হাদীছের ময়দানে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও অগ্রগামী। যেমন ইমাম দারাকুৎনীসহ অন্যান্য বিদ্বান, যারা ছহীহাইনের অনেক হাদীছের সমালোচনা করেছেন। আর আমার সমালোচনাকৃত হাদীছের সংখ্যা দশের বেশী হবে না।[13]

ইমাম দারাকুৎনী বুখারীর সর্বাধিক সংখ্যক হাদীছের সমালোচনা করেছেন।[14] যদিও তার অধিকাংশের জবাব ইবনু হাজার আসক্বালানী ও নববীসহ পরবর্তী বিদ্বানগণ পেশ করেছেন। তবে ইবনু হাজার কর্তৃক ফাৎহুল বারীর ভূমিকা ‘হাদীউস সারী’তে প্রদত্ত জবাব সবচেয়ে বিস্তারিত ও প্রসিদ্ধ।

তবে ইবনু হাজার-এর পর্যালোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, ইমাম বুখারী স্বীয় গ্রন্থে কেবল ছহীহ হাদীছই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে মুতাবা‘আত হিসাবে কখনও কখনও ক্রটিযুক্ত হাদীছও এনেছেন। তবুও সেটি কেবল ঐ সময়ই এনেছেন, যখন বিভিন্ন তুরুকে রাবীদের সংখ্যায় বা ধীশক্তিতে অথবা অন্য কোন ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত উভয় সনদের কোনটিকেই প্রাধান্য দিতে না পেরে ইমাম বুখারী দু’টিকেই স্বীয় গ্রন্থে এনেছেন।[15] এদিকে ইঙ্গিত করে ইমাম যাহাবী বলেন, ‘সংখ্যার সমতা থাকলেও যদি মুখস্তশক্তিতে দু’টি সনদের রাবীদের মধ্যে তারতম্য থাকে এবং সেকারণে একটি সনদকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেয়া সম্ভব না হয়, তখন ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয় সূত্রকেই স্ব স্ব গ্রন্থে এনেছেন। বিশেষত শব্দের ভিন্নতা থাকলেও যখন অর্থের দিক দিয়ে সমন্বয় সম্ভব হয়েছে’।[16]

তবে জবাব প্রদান শেষে ইবনু হাজারও বলেছেন,لَيْسَت كلهَا قادحة بل أَكْثَرهَا الْجَواب عَنهُ ظَاهر والقدح فِيهِ مندفع وَبَعضهَا الْجَواب عَنهُ مُحْتَمل واليسير مِنْهُ فِي الْجَواب عَنهُ تعسف ‘এর সবগুলো ত্রুটিযুক্ত নয়। বরং অধিকাংশের জবাব স্পষ্ট হয়েছে এবং দোষ-ত্রুটি দূরীভূত হয়েছে। কিছু জবাব সম্ভাবনার উপর দেওয়া হয়েছে। আর সামান্য কতিপয় সমালোচনার জবাব দেওয়া কষ্টকর’।[17] তিনি বলেন,فهذه جملة أقسام ما انتقده الأئمة على الصحيح، وقد حررتها وحققتها، وقسمتها، وفصّلتها. لا يظهر منها ما يؤثر في أصل موضوع الكتاب بحمد الله إلا النادر ‘আমি বুখারীর হাদীছসমূহ সমন্বয় করেছি, তাহক্বীক্ব করেছি, ভাগ করেছি এবং সুবিন্যস্ত করেছি। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া যে সামান্য কিছু (দোষ-ত্রুটি) ব্যতীত এর মধ্যে এমন কিছু প্রকাশ পায়নি, যা গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্ত্তর উপর প্রভাব ফেলতে পারে’।[18]

অতঃপর সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা যায়, ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের ব্যাপারে যেসকল ইমাম সমালোচনা করেছেন তারা কেউ এর বিশুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেননি। বরং সেখানে অন্তর্ভুক্ত কেবল ক্রটিযুক্ত হাদীছগুলোর ত্রুটিসমূহ উল্লেখ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবল এসকল হাদীছের ত্রুটিসমূহের উপর ইলমী পর্যালোচনা পেশ করা; সার্বিক মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান নয়। কেননা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইমামদ্বয় দিয়ে গেছেন।[19]

অতএব ছহীহাইনের অন্তর্ভুক্ত সকল হাদীছই বিশুদ্ধতার নিরিখে উত্তীর্ণ। ইমাম বুখারীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ এই কিতাবের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে দৃঢ়মত পোষণ করেছেন। আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির যথার্থই বলেছেন, ‘ছহীহ বুখারীর যে সব হাদীছ সমালোচিত হয়েছে তার অর্থ হ’ল সেগুলো ইমাম বুখারীর শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেনি। তবে হাদীছগুলো স্বীয় অবস্থানে ছহীহ। তিনি বলেন, মুহাক্কিক ওলামায়ে হাদীছদের নিকট এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের প্রতিটি হাদীছই ছহীহ। এ দু’টি গ্রন্থের কোন একটি হাদীছও দুর্বল বা ত্রুটিযুক্ত নয়। ইমাম দারাকুৎনীসহ মুহাদ্দিছগণের কেউ কেউ যে সমালোচনা করেছেন, তার অর্থ হ’ল তাদের নিকট সমালোচিত হাদীছসমূহ ইমাম বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক স্ব স্ব গ্রন্থে গৃহীত শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারেনি। তবে স্বাভাবিকভাবে হাদীছগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে কেউই মতভেদ করেননি’।[20]

অভিযোগ নং ৫ : ইমামগণের বক্তব্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা

শু‘আইব আরনাঊত্ব আলবানীর ব্যাপারে উক্ত অভিযোগ পেশ করে বলেন, ‘তিনি হাদীছের উপর হুকুম আরোপের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইমামদের মন্তব্যসমূহ এড়িয়ে যান। তিনি যখন কোন হাদীছকে ছহীহ সাব্যস্ত করেন, যেটাকে অন্যান্য (হাদীছের) হাফেযগণ যঈফ বলেছেন; তখন অন্যান্য (হাফেয, ইমামদের) মন্তব্যসমূহ তিনি উল্লে­খ করেন না। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মানুষকে নিজের সিদ্ধান্তের দিকে আনুগত্যশীল করতে চান’।[21]

পর্যালোচনা :

আলবানীর তাখরীজসমূহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত অভিযোগ সঠিক নয়। বরং যেকোন হাদীছ যঈফ বা ছহীহ সাব্যস্তকরণের ক্ষেত্রে তিনি পূর্বোক্ত ইমামদের মন্তব্যসমূহ যথাসম্ভব উল্লেখ করেছেন এবং তার আলোকেই দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে যেটিকে তিনি সঠিক মনে করেছেন, তার অনুকূলে সমাধান পেশ করেছেন। এক্ষেত্রে ইমামগণের কারো কোন সিদ্ধান্ত তার নিকটে ভুল মনে হ’লে স্বাধীনভাবে তিনি তা পেশ করেছেন। যেমন-

(১) ইমাম হাকেম এমন অনেক রাবীকে ছিক্বাহ সাব্যস্ত করেছেন, যাদের ব্যাপারে আলবানীসহ মুহাদ্দিছগণ সমালোচনা করেছেন। কেননা ইমাম হাকেম মুহাদ্দিছগণের নিকটে শৈথিল্যবাদী হিসাবে পরিচিত। যেমন রাবী মুহাম্মাদ ইবনুল মুনক্বাদির-এর ব্যাপারে ইমাম হাকেম বলেন, তিনি বিশ্বস্ত। এর জবাবে আলবানী বলেন, কখনোই তিনি বিশ্বস্ত নন। বরং ইমামগণ তাঁর দুর্বলতার ব্যাপারে একমত। যাহাবী স্বীয় ‘মীযানুল ই‘তিদালে’ এবং ইবনু হাজার স্বীয় ‘লিসানুল মীযানে’ তার ব্যাপারে আলোচনা পেশ করেছেন। সেখানে কেউ তাকে ছিক্বাহ বলেছেন বলে উল্লেখ করা হয়নি। বরং যার বক্তব্যই পেশ করা হৌক না কেন হাকিম ব্যতীত সকলেই তাকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। অতএব তার তাওছীকের উপর নির্ভর করা যাবে না।[22]

(২) অনেক রাবীর ব্যাপারে তিনি ইমাম যাহাবীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। যেমন ছাবীহ আবুল মালীহ আল-ফারেসীর ব্যাপারে যাহাবী হাকেমের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বলেন, স্বল্প সংখ্যক হাদীছ বর্ণনার কারণে তিনি অপরিচিতদের অন্তর্ভুক্ত।[23] এর জবাবে আলবানী বলেন, আবুল মালীহের ক্ষেত্রে এরূপ বক্তব্যের ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। তিনি অপরিচিত নন। আর কিভাবেই বা তিনি অপরিচিত হ’তে পারেন! একদল ছিক্বাহ রাবী তো তার থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যাদের কথা তাহযীব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ওয়াকী‘ ইবনুল জার্রাহ, মারওয়ান ইবনু মু‘আবিয়া আল-ফাযারী, হাতেম বিন ইসমাঈল, আবূ ‘আছেম যাহহাক ইবনু মুখাল্লাদ প্রমুখ। তাহ’লে কোথায় তার অপরিচিতি? এমনকি ইবনু মা‘ঈন এবং ইবনু হাজার তাকে ছিক্বাহ বলেছেন। ইবনু হিববান তাকে স্বীয় ‘ছিক্বাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[24]

(৩) আলবানী ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর গবেষণা থেকে ব্যাপক ফায়েদা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি তার সকল সিদ্ধান্তের অন্ধ অনুসরণ করেননি। বরং যাচাই-বাছাই করেছেন। ফলে উপযুক্ত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে কোন কোন রাবীর সমালোচনায় তার বিরোধিতাও করেছেন। যেমন, ছাখর ইবনু ইসহাকের ব্যাপারে ইবনু হাজার বলেন, তিনি লাইয়েনুল হাদীছ।[25] এর জবাবে আলবানী বলেন, বরং তিনি মাজহূল বা অপরিচিত। ... ইবনু হাজার কর্তৃক স্বীয় তাক্বরীব গ্রন্থে তাকে ‘লাইয়েন’ সাব্যস্ত করাটা উচিৎ হয়নি। কেননা এর অর্থ দাড়ায় সে মা‘রূফ বা পরিচিত। অথচ তিনি দুর্বল হিসাবে পরিচিত। তবে আর কেউ তার উক্ত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেননি।[26] 

উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা যায় যে, আলবানী পূর্ববর্তী ইমামগণের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত তুলে ধরেছেন। অনুসরণও করেছেন। কিন্তু কারো সিদ্ধান্তের অন্ধ অনুসরণ করেননি। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম আবূ হাতেম বা জাওযাজানীর মত কঠোর নীতি অবলম্বন করেননি। আবার ইবনু হিববান, হাকেম বা ‘ইজলীর মত শিথিলতা প্রদর্শন করেননি। আবার এককভাবে ইবনু হাজারের সিদ্ধান্তের উপর আত্মসমর্পণও করেননি। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিক্বাহ, দুর্বল সকল রাবীর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছেন। মুহাদ্দিছগণের মতামত জমা করেছেন। অতঃপর এ শাস্ত্রের মূলনীতির অনুসরণে সম্ভবপর যাচাই-বাছাই করে তার নিকটে অগ্রগণ্য মতটি স্বাধীনভাবে পেশ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। তবে দলীল ব্যতীত কোন রাবীকে ছিক্বাহ বা যঈফ সাব্যস্ত করেননি।

আর দ্বিতীয় অভিযোগ সম্পর্কে বলা যায়, প্রথমতঃ আলবানী স্বয়ং বিভিন্ন লেখনী ও বক্তব্যে বারবার বলেছেন, বিশুদ্ধ জ্ঞান কখনো স্থবিরতাকে গ্রহণ করে না। তিনি বলেছেন, আমি অনেক লেখকের ব্যাপারে বিস্মিত হই, যাদের বিশ বছর পূর্বে লিখিত কোন বই এখনো প্রকাশ হচ্ছে। অথচ তাতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন নেই। এটা কি ইলম! না আসমান থেকে নাযিলকৃত অহি! না এটা মানবীয় প্রচেষ্টা, যা ভুল হ’তে পারে সঠিকও হ’তে পারে?[27] তিনি বলেছেন, ...পরবর্তী যুগের কোন তালিবুল ইলম কোন হাদীছের সনদ যাচাই করে তা ছহীহ বা হাসান হিসাবে পায়, বিশেষত যদি হাদীছটির কোন শাওয়াহেদ বা মুতাবা‘আত খুঁজে পায়, তবে অবশ্যই তার জন্য স্বীয় সিদ্ধান্ত ও ইজতিহাদের উপর নির্ভর করতে হবে। তবে এর জন্য শর্ত হ’ল- উক্ত তালিবুল ইলমকে শক্তিশালী হ’তে হবে।[28] সুতরাং যিনি নিজেই এই সাক্ষ্য ও নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর ব্যাপারে কিভাবে বলা যায় যে, তিনি লোকদেরকে তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে আনুগত্যশীল করতে চান? 

দ্বিতীয়তঃ আলবানীর ইলমী মজলিসসমূহে সমসাময়িক অনেক প্রথিতযশা বিদ্বান অংশগ্রহণ করতেন, যারা এখনো ইলমে হাদীছের ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন। আলবানীর ভুল-ত্রুটিসমূহ সংশোধনে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সেকারণে তাঁর রচনাবলীর বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভুল সংশোধনের জন্য ছাত্র ও সাথীবৃন্দের প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে দেখা গেছে। এছাড়া তাঁর অনেক ছাত্র একই হাদীছের ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তের বিপরীত সিদ্ধান্ত পেশ করেছেন। যেমন তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ আবু ইসহাক্ব হুয়ায়নী যেসব হাদীছের ব্যাপারে আলবানীর থেকে ভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তার উপর الترياق باحاديث قواها الالباني وضعفها الحويني ابو اسحاق নামে[29] পৃথক একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

অতএব একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ‘তিনি মানুষকে স্বীয় মন্তব্যসমূহের আনুগত্য করাতে চান’-কথাটি মোটেও সঠিক নয়।

৬. আলবানী কোন শায়খের নিকটে জ্ঞানার্জন করেননি :

শায়খ আলবানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করা হয়েছে যে, তিনি নিজ প্রচেষ্টায় ইলমুল হাদীছ সংশ্লিষ্ট গ্রন্থসমূহ অধ্যয়নের মাধ্যমে ইলম অর্জন করেছেন। সরাসরি কোন শিক্ষকের নিকটে প্রথাগতভাবে জ্ঞানার্জন করেননি। সেকারণে তার মধ্যে অন্তর্নিহিত ইলমের কোন অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই বাহ্যিকতার উপর ভিত্তিশীল। সেকারণে তিনি দলীলের বাহ্যিক অবস্থার ভিত্তিতে মতামত পেশ করেন। আলবানীর বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন হিন্দুস্তানী হানাফী বিদ্বান শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী। তাঁর মতে, আলবানী ওলামায়ে কেরামের মুখনিঃসৃত বাণী শ্রবণের মাধ্যমে ইলম অর্জন করেননি বা ফায়েদা হাছিলের উদ্দেশ্যে তাদের সামনে কখনো বসেননি। বরং নিজে নিজে জ্ঞানার্জন করেছেন। তাঁর একাডেমিক জ্ঞানের পরিধি মুখতাছারুল ক্বুদূরী পর্যন্ত। বরং তাঁর অধিক দক্ষতা ছিল ঘড়ি মেরামতের ক্ষেত্রে।[30]

পর্যালোচনা :

প্রথমতঃ আলবানীর জীবনী পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, উক্ত অভিযোগ সঠিক নয়। আলবানী বংশগতভাবেই ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন পরিবারের সন্তান ছিলেন। পিতা শায়খ নূহ নাজাতী ইবনু আদম আলবানী ছিলেন সমকালীন আরনাউত্বী ওলামায়ে কেরামের মধ্যে হানাফী ফিক্বহের সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম।[31] দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর নিকটে মানুষ ফৎওয়া গ্রহণের জন্য আগমন করত।[32] আলবানী প্রাথমিক শিক্ষার পর পিতার নির্দেশনায় ঘরোয়া পরিবেশে দ্বীনী ইলম অর্জনে ব্রতী হন। পিতার নিকটে তাজবীদসহ কুরআন হিফয, নাহু-ছরফ ও ফিক্বহের তা‘লীম গ্রহণ করেন।[33] উমাইয়া মসজিদের ইমাম ও ছূফী শায়খ মুহাম্মাদ সা‘ঈদ বুরহানীর নিকটে তিনি হানাফী ফিক্বহের ‘মারাকিল ফালাহ শারহু নূরিল ঈযাহ’, আরবী ব্যাকরণের শুযূরুয যাহাবসহ বালাগাতের বেশ কিছু গ্রন্থ পাঠ করেন। সমকালীন হলবের বিশিষ্ট আলেম শায়খ রাগেব আত-তাববাখ তাকে হাদীছের একটি গ্রন্থ পাঠদানের ইজাযত প্রদান করেন।[34] এছাড়াও শায়খ মুহাম্মাদ বাহজা বাইতারের দরসে তিনি নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকতেন। তাই তাঁর শিক্ষকের সংখ্যা কম হ’তে পারে। কিন্তু তাঁর কোন শিক্ষক ছিলেন না, এ কথা বলার অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়তঃ শিক্ষকের নিকট থেকে সরাসরি শ্রবণই জ্ঞানার্জনের একমাত্র মাধ্যম নয়। জ্ঞানার্জনের জন্য অবশ্যই জ্ঞানী ব্যক্তির শরণাপন্ন হ’তে হবে। আর তা দু’ভাবে সম্ভব। মৌখিকভাবে সরাসরি গ্রহণের মাধ্যমে অথবা লেখক ও সংকলকগণের গ্রন্থরাজি অধ্যয়নের মাধ্যমে। তবে এক্ষেত্রে লেখকগণের পরিভাষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং তাঁর লেখনীর উদ্দেশ্য যথাযথ অনুধাবন করার জন্য ওলামায়ে কেরামের সহযোগিতা একান্ত যরূরী।[35] কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এর জন্য বহু শায়খের শরণাপন্ন হ’তে হবে। বহু বিদ্বানকে পাওয়া যাবে, যাদের বিশেষ কোন শিক্ষক ছিল না। নিজস্ব প্রচেষ্টা ও ঐকান্তিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করেছেন। অথচ তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করেছেন, সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করেছেন, শিরক ও বিদ‘আতের মুলোৎপাটন করেছেন।[36]

চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনুল বাজী (রহঃ) তাঁর যুগের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফক্বীহ ও হাফেযুল হাদীছ ছিলেন। তাঁর বর্ণনাসমূহের ক্ষেত্রে সেসময় তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সংরক্ষণশীল রাবী হিসাবে বিবেচিত হ’তেন। অথচ তাঁর পিতাই ছিলেন তাঁর একমাত্র শিক্ষক। মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাসহ অনেক হাদীছ গ্রন্থ এবং অন্যান্য ইলমী ভান্ডার তিনি পিতার কাছ থেকেই অর্জন করেছিলেন। ফলে আর কারো নিকটে তাঁর জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন হয়নি। তাঁর ব্যাপারে ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, ‘তিনি স্বীয় যুগের ফক্বীহ ও ইমাম ছিলেন। সেসময় আন্দালুসে তারা মত বিদ্বান আর কেউ ছিল না।[37] এক্ষণে এরূপ আলেমদের কি কেবল শিক্ষকের আধিক্য না থাকা বা প্রথাগত শিক্ষা না থাকার দোষে অভিযুক্ত করা যাবে?

তৃতীয়তঃ আলবানীর জ্ঞানার্জনের মূল উৎস ছিল (১) বহু বছর যাবৎ নিরবচ্ছিন্ন গবেষণায় লেগে থাকা। এককভাবে ইলমে হাদীছের ময়দানে অধ্যয়ন, গবেষণা, লেখনী ও ছাত্রদের সাথে ইলমী পর্যালোচনার মধ্যে তিনি দীর্ঘ ৬০ বছর ব্যয় করেছেন। যা তাঁকে উক্ত ময়দানে ইলমের মহীরূহে পরিণত করেছে। (২) সমসাময়িক বিদ্বানদের সাথে অধিক উঠাবসা। যে সম্পর্কে প্রথম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।

অতএব কোন জ্ঞান শিক্ষকের মাধ্যমে অর্জিত হ’লেই তা সঠিক হবে, তা না হ’লে তা ভুল হবে, এ চিন্তাধারা সঠিক নয়। মূল বিষয় হ’ল শারঈ জ্ঞান ও ব্যাখ্যাসমূহ দলীল সম্মত হ’তে হবে। দলীলের অনুকূল হ’লে তা গ্রহণীয় হবে, না হ’লে তা বর্জনীয় হবে। এক্ষণে শায়খ আলবানীর চিন্তাধারা, রচনাবলী ও সিদ্ধান্তসমূহ কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তা ইতিপূর্বে বর্ণিত সমসাময়িক বিদ্বানদের মন্তব্য থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ আব্দুল মুহসিন আল- ‘আববাদ বলেন, ‘বর্তমান যুগে ইলমে হাদীছের ব্যাপারে তিনি যে প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী, তাঁর তুলনীয় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই’।[38] তিনি বলেন, ‘হাদীছের ক্ষেত্রে আলবানীর খেদমত খুবই প্রসিদ্ধ। ...প্রত্যেক শারঈ জ্ঞান অন্বেষণকারীই তাঁর গ্রন্থরাজি ও রচনাবলীর মুখাপেক্ষী। সেখানে প্রভূত উপকার রয়েছে, রয়েছে পর্যাপ্ত জ্ঞান। তাঁর ব্যাপক লেখনী খুবই প্রসিদ্ধ। কোন লাইব্রেরীই তাঁর অধিকাংশ কিংবা কমপক্ষে অল্প কিছু গ্রন্থ থেকে মুক্ত নেই।[39] [ক্রমশঃ]


[1]. ছহীহ মুসলিম, ৩/১৬০১, হা/২০২৬।

[2]. সিলসিলা ছহীহাহ, ১/৩৩৭, হা/১৭৫।

[3]. সিলসিলা যঈফাহ, ২/৩২৬, হা/৯২৭।

[4]. নববী, শরহ মুসলিম, পানাহার অধ্যায়, দাড়িয়ে পান করা অনুচ্ছেদ, ১৩/১৬৯-১৭০।

[5]. ড. হামযা মিলিয়াবারী, ‘আবকারিইয়াতুল ইমাম মুসলিম (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৩০-৩৭।

[6]. মানহাজুল ‘আল্লামা আলবানী ফী তা‘লীলিল হাদীছ, পৃ. ২৮৮-২৯০।

[7]. সিলসিলা যঈফাহ, ২/৪০৬-৪০৮, হা/৯৭৬।

[8]. রাদ‘উল জানী আল-মু‘তাদ্দা ‘আলাল আলবানী, পৃ. ১২০-২১।

[9]. সিলসিলাতুল আহাদীছিছ ছহীহাহ, ৪/১৮৩-১৯৩, হা/১৬৪০।

[10]. পূর্বোক্ত, ৪/৪৪৯-৫০, হা/১৮৩৩।

[11]. ইরওয়াউল গালীল, ২/৩৮-৩৯, ১২০-১২২, হা/৩৩২, ৩৯৪।

[12]. ইবনুছ ছালাহ, আল-মুক্বাদ্দিমা, পৃ. ২৯।

[13]. উক্কাশা আব্দুল মান্নান আত-ত্বীবী, ফাতাওয়াউশ শাইখ আলবানী ওয়া মুকারানাতুহূ বি ফাতাওয়াইল ‘উলামা (কায়রো : মাকতাবাতুত তুরাছিল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ৫২৬।

[14]. এ সম্পর্কে ইবনু হাজার বলেন, ‘ছহীহুল বুখারীতে সমালোচিত হাদীছের সংখ্যা ১১০টি যার মধ্যে ৭৮টি তিনি এককভাবে এবং বাকী ৩২টি ইমাম মুসলিমের সাথে যৌথভাবে তাখরীজ করেছেন। দ্র. হাদয়ুস সারী মুক্বাদ্দামাতু ফাৎহিল বারী, ১/৩৪৬।

[15]. আবূ বকর কাফী, মানহাজুল ইমাম বুখারী ফি তাছহীহীল আহাদীছ ও তা‘লীলীহা, পৃ. ২২১।

[16]. শামসুদ্দীন যাহাবী, আল মাওক্বিযাহ ফি ‘ইলমিল মুছত্বলাহ (হালব : মাকতাবাতুল মাতবু‘আত আল-ইসলামিয়াহ, তাবি), পৃ. ৫২।

[17]. ফাৎহুল বারী, ১/৩৮৩।

[18]. হাদয়ুস সারী মুকাদ্দামাতু ফাৎহিল বারী, পৃ. ৫০৩।

[19]. আবূবকর কাফী, মানহাজুল ইমাম বুখারী ফি তাছহীহীল আহাদীছ ও তা‘লীলীহা, পৃ. ২২১।

[20]. আল-বা‘ইছুল হাছীছ শারহু ইখতিছারি ‘উলূমিল হাদীছ, পৃ. ৩৩-৩৪।

[21]. আল্লামা শায়খ শু‘আইব আল-আরনাঊত্ব; সীরাতুহূ ফী ত্বলাবিল ‘ইলমি ওয়া জুহূদুহূ ফী তাহক্বীক্বিত তুরাছ, পৃ. ২০৬; মাসিক বাইয়েনাত (পাকিস্তান, ৭৭তম বর্ষ ৮ম সংখ্যা, জুলাই ২০১৫ খ্রি.), পৃ. ৩৪।

[22]. ইরওয়াউল গালীল, ১/৩২৬।

[23]. আবূ ‘আব্দুল্লাহ আল-হাকিম, আল-মুস্তাদরাক্ব ‘আলাছ ছহীহাইন, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ ১৯৯০ খ্রি.), ১/৪৯১।

[24]. সিলসিলাতুল আহাদীছিছ ছহীহাহ, ৬/৩২৪।

[25]. তাক্বরীবুত তাহযীব, ১/৪৩৪।

[26]. আল-আলবানী, তাখরীজু আহাদীছি মুশকিলাতুল ফিকার (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৪৩।

[27]. আলবানী প্রদত্ত সাক্ষাৎকার, মাজাল্লাতুল বায়ান, রবিউল আখের, ১৪১১ হি., ৩৩ তম সংখ্যা, পৃ. ১২।

[28]. আদ-দুরার ফী মাসাইলিল মুছত্বলাহি ওয়াল আছার, পৃ. ১২-১৪।

[29]. কায়রো : মাকতাবাতু দারিল হিজায, ১ম প্রকাশ, ১৪৩৬ হি.।

[30]. হাবীবুর রহমান আ‘যমী, আলবানী : শুযূযুহু ওয়া আখতাউহু (কুয়েত : মাকতাবা দারুল ‘আরূবাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৯।

[31]. ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতুহু, পৃ. ১১।

[32]. নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর, পৃ. ১১।

[33]. ইমাম আলবানী : দুরূস ওয়া মাওয়াকিফ ওয়া ইবার, পৃ. ১৪।

[34]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৪৬-৫২।

[35]. ইবরাহীম আশ-শাত্বিবী, আল-মুওয়াফাক্বাত, (কায়রো : দারু ইবনি আফফান, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭ খ্রি.), ১/১৪৫-৪৭।

[36]. মুহাম্মাদ ইবনু ‘উমার বাযমূল, আল-ইনতিছার লি আহলিল হাদীছ (রিয়াদ : দারুল হিজরাহ, তাবি), পৃ. ১৭৭।

[37]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/৫২৩।

[38]. কুতুবু ও রাসাইলু ‘আব্দিল মুহসিন আল-‘আববাদ, পৃ. ৩০৪।

[39]. নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর, পৃ. ৩৪-৩৫।






মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী - ড. নূরুল ইসলাম
ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৯ম কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইবনু মাজাহ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইবনু মাজাহ (রহঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (জুলাই’১৮ সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা অহীদুয্যামান লক্ষ্মৌভী : তাক্বলীদের বন্ধন ছিন্নকারী খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.