পর্ব ১। পর্ব ২। 

পাঁচ : নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত আঁকড়ে ধরা এবং তার আনুগত্য করা হেদায়াত লাভ এবং ভ্রান্ত ফিরকা ও ভ্রষ্টতা হ’তে দূরে থাকার মাধ্যম :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَاأَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ، يَهْدِي بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ-

‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমাদের নিকট আমাদের রাসূল এসেছে। যেসব বিষয় তোমরা তোমাদের কিতাব থেকে গোপন কর, সেসব বিষয় সে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিচ্ছে এবং বহু বিষয় সে এড়িয়ে যায়। বস্ত্ততঃ তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে এসেছে একটি জ্যোতি ও স্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাব। তা দ্বারা (অর্থাৎ কুরআন দ্বারা) আল্লাহ ঐসব লোকদের শান্তির পথ সমূহ প্রদর্শন করেন, যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তিনি তাদেরকে স্বীয় অভিপ্রায়ে (কুফরীর) অন্ধকার হ’তে (ঈমানের) আলোর দিকে বের করে আনেন। আর তিনি তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (মায়েদাহ ৫/১৫-১৬)

আল্লাহ তা‘আলা এখানে তাঁর নিজের মহিমাময় সত্তার পক্ষ থেকে এই সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে যমীনের সকল আরব-অনারব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার জন্যই প্রেরণ করেছেন। তিনি তাকে সুষ্পষ্ট দলীল, হক ও বাতিলের পার্থক্য সহকারে পাঠিয়েছেন। এর যা কিছু তারা পরিবর্তন, বিকৃতি, অপব্যাখ্যা করেছে এবং সে বিষয়ে আল্লাহর উপর যা মিথ্যারোপ করেছে তিনি সবই সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তারা পরিবর্তন করেছে এমন অনেক বিষয়ে তিনি চুপ থেকেছেন যা বর্ণনা করাতে কোন উপকার নেই।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীম সম্পর্কে বলেন, যা তাঁর মহান নবীর উপর নাযিল করেছেন, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তষ্টি কামনাকারীদেরকে হেদায়াত ও সুপথ সমূহ দেখিয়ে থাকেন। তথা নাজাত, নিরাপদ ও ইসতেকামাতের পথে পরিচালিত করেন। তাঁরই ইশারায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান। তাদেরকে ছিরাত্বে মুস্তাক্বীমের পথে পরিচালিত করেন। অর্থাৎ তাদেরকে ধ্বংসাত্মক সকল কিছু থেকে নাজাত দেন এবং তাদের জন্য সুন্দর পথ সমূহ দেখিয়ে দেন। ফলে সকল রকমের অনিষ্টকে তাদের থেকে সরিয়ে রাখেন, তাদের জন্য ভাল কাজ সমূহ করার পথ সুগম করেন, সকল প্রকার ভ্রষ্টতাকে তাদের থেকে দূরে রাখেন এবং তাদেরকে সঠিক অবস্থার দিকে দিকনির্দেশনা দান করেন।[1]

আল্লাহ বলেন,قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ- ‘তুমি বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যার জন্যই আসমান ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু দান করেন। অতএব তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, যিনি নিরক্ষর নবী। যিনি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন আল্লাহ ও তাঁর বিধান সমূহের উপর। তোমরা তার অনুসরণ কর যাতে তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হ’তে পার’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)

তিনি আরোও বলেন,قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ- ‘বল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহ’লে রাসূলের দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী হবেন এবং তোমাদের দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী হবে। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে। বস্ত্ততঃ রাসূলের উপর দায়িত্ব হ’ল কেবল সুস্পষ্টভাবে (আল্লাহর বাণী সমূহ) পৌঁছে দেওয়া’ (নূর ২৪/৫৪)

তিনি আরোও বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘আর নিশ্চয়ই তুমি পথ প্রদর্শন করে থাক সরল পথের দিকে’ (শূরা ৪২/৫২)। তিনি আরোও বলেন,وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)

* আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يوما خَطًّا، ثُمَّ قَالَ: هَذَا سَبِيلُ اللهِ، ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ، ثُمَّ قَالَ: هَذِهِ سُبُل- عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ، ثُمَّ تَلَا- وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا... (الأنعام: 153)

‘রাসূল (ছাঃ) আমাদের জন্য একদা একটি রেখা টানলেন। অতঃপর বললেন, এটি আল্লাহর পথ। এরপর সেই রেখার ডানে ও বামে আরও কিছু রেখা টানলেন। অতঃপর বললেন, এগুলিও পথ। এর প্রত্যেকটি পথে একজন করে শয়তান বসে আছে যে সেদিকে আহবান করছে। অতঃপর তিন তিলাওয়াত করেন- ‘আর এটিই আমার সরল পথ’ (আন‘আম ৬/১৫৩)[2]

* ইরবায বিন সারিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصُّبْحَ ذَاتَ يَوْمٍ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ، وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ، فَقَالَ قَائِلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا؟ فَقَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا، وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ-

‘একদা রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে ফজরের ছালাত পড়ালেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরালেন। এরপর আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিলেন যাতে চোখগুলি অশ্রুসিক্ত হ’ল এবং অন্তরসমূহ বিগলিত হ’ল। জনৈক একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মনে হচ্ছে এটাই শেষ উপদেশ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে কি আদেশ করবেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি, (আমীরের) আদেশ শোনা ও আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি হাবাশী কৃতদাসও হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অচিরেই চরম ইখতেলাফ দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমরা আমার ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতের অনুসরণ করবে, তোমরা তা অবশ্যই আঁকড়ে ধরবে, তা তোমরা মাঢ়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। (শরী‘অতে) সকল নতুন সৃষ্ট বিষয় থেকে সাবধান থাকবে। কেননা সকল নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত। আর সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।...

মুসনাদে আহমাদ ও আবূ দাউদে এসেছে,

أَتَيْنَا الْعِرْبَاضَ بْنَ سَارِيَةَ، وَهُوَ مِمَّنْ نَزَلَ فِيهِ {وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ} [التوبة: 92] فَسَلَّمْنَا، وَقُلْنَا: أَتَيْنَاكَ زَائِرِينَ وَعَائِدِينَ وَمُقْتَبِسِينَ، فَقَالَ الْعِرْبَاضُ:...

‘আমরা ইরবায বিন সারিয়ার নিকট আসলাম। তিনি হ’লেন তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে :

وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ،

‘আর ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাবো’ (তওবা ৯/৯২)। তাকে আমরা সালাম দিলাম এবং বললাম, আমরা আপনার সাথে সাক্ষাত করতে, আপনার অসুস্থতার খবর নিতে এবং কিছু অর্জন করতে এসেছি। তখন ঈরবায বললেন,...।[3]

ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ اسْمَعُوْا قَوْلِيْ فَإِنِّيْ لَا أَدْرِيْ لَعَلِّيْ لَا أَلْقَاكُمْ بَعْدَ يَوْمِيْ هَذَا فِي َهذَا الْمَوْقِفِ، أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ إِلَى يَوْمِ تَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا وَإِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ فَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ وَقَدْ بَلَّغْتُ، فَذَكَرَ كَلَامًا كَثِيْرًا وَقَالَ فِي آِخِرِهِ: فَاعْقِلُوْا أَيَّهَا النَّاسُ قَوْلِي فَإِنِّي قَدْ بَلَّغْتُ وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ مَا إِنْ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أَبَدًا، كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ...

‘হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শোন! কেননা আমি জানি না, হয়তো আজকের দিনের পর এই জায়গাতে আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে আর কোন কথা বলব না। হে লোক সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদসমূহ তোমাদের জন্য সম্মানিত তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত, যেমন সম্মানিত তোমাদের এ দিনটি, তোমাদের এ নগরীতে। তোমরা অচিরেই তোমাদের রবের সাক্ষাত পাবে, আর তিনি তোমাদের আমলসমূহ সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করবেন। আমি তো (তাঁর পয়গাম) পেঁŠছিয়ে দিয়েছি। এভাবে তিনি অনেক কথা বলেছেন। শেষে বলেন, হে লোকসকল! আমার কথা ভালোভাবে বুঝ। কেননা আমি (তাঁর পয়গাম) পৌঁছিয়ে দিয়েছি। আর হে লোকসকল! তোমাদের মাঝে যা রেখে যাচ্ছি, তা যদি মযবূত করে আঁকড়ে ধর তাহ’লে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তা হ’ল, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’।[4]

নবী করীম (ছাঃ) সুন্নাত আঁকড়ে ধরাকে ইখতেলাফ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হওয়ার সময়ের এমন আশ্রয়স্থল করেছেন যা মজবূতভাবে আঁকড়ে ধরে এসব থেকে বেঁচে থাকা যায় এবং এটিকে যাবতীয় ভ্রষ্টতা ও ফ্যাসাদ থেকে নিরাপদ থাকার সুরক্ষক আশ্রয়কেন্দ্র নির্ধারণ করেছেন।

ছয় : নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত আঁকড়ে ধরা আল্লাহর মুহাববত হাছিলের মাধ্যম :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ-

‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)

এই আয়াত ঐ সকল ব্যক্তির ব্যাপারে ফায়ছালাকারী যারা আল্লাহকে ভালোবাসার দাবী করে কিন্তু সে মুহাম্মাদী পথে চলে না। এমন ব্যক্তি তার দাবীতে মিথ্যুক, যতক্ষণ সে তার সকল কথা ও অবস্থায় মুহাম্মাদী শরী‘আত এবং নবীর দ্বীন অনুসরণ না করবে।

এজন্য পূর্ববর্তী বিদ্বানগণ এই আয়াতটিকে آيَةُ الْمِحْنَةِ ‘পরীক্ষার আয়াত’[5] নামে নামকরণ করতেন। সেটি এমন পরীক্ষা যার মাধ্যমে আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে পরীক্ষা করেন, যে তাঁকে ভালোবাসার দাবী করে। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। আর আনুগত্য হ’ল সত্যিকারের ভালোবাসার আলামত। কবি কত-ই না সুন্দর বলেছেন,

تَعصي الإِلَهَ وَأَنتَ تُظهِرُ حُبَّهُ - هَذا مَحالٌ في القِياسِ بَديعُ

لَو كانَ حُبُّكَ صادِقاً لَأَطَعتَهُ - إِنَّ المُحِبَّ لِمَن يُحِبُّ مُطيعُ.

‘তুমি ইলাহ-এর অবাধ্যচারণ কর অথচ বাহ্যিকভাবে তার প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখাও। এটা তো অসম্ভব, নিয়ম-নীতিতেও একদম নতুন। তোমার ভালোবাসা যদি সত্যিই হ’ত, তাহ’লে তুমি অবশ্যই তার আনুগত্য করতে। কেননা

যে যাকে ভালোবাসে, সে তারই অনুগত হয়’।[6]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, যখন ভালোবাসার দাবীদারদের সংখ্যা বেড়ে অনেক হ’ল এবং ভালোবাসার সত্যতা প্রমাণের স্বপক্ষে দলের সংখ্যা বেড়ে গেল তখন ভালোবাসার সত্যতা প্রমাণের স্বপক্ষে তাদের দলীল চাওয়া হ’ল। এভাবে যখন নানা রকম দাবীদারদের উপস্থিতি পাওয়া গেল, তখন বলা হ’ল, এই দাবী গ্রহণ করা হবে না স্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীত। তখন দেখা গেল সকল দাবীদাররাই পিছু হটল। কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সত্যিকারের অনুসারীরা (فَاتَّبِعُوْنِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ) তাদের কর্মে, কথায় এবং চরিত্রে অবিচল থাকল।[7]

অতঃপর যে ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর যথাযথ ইত্তেবা করল, সে আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসার দাবীর চেয়ে বড় কিছু পেয়ে ধন্য হ’ল। তাহ’ল, তার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা। আর এটি নিঃসন্দেহে প্রথমটির চেয়ে উত্তম। যেমন কিছু বিদ্বান বলেছেন, তুমি ভালোবাস এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তুমি ভালোবাসা পাও এটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ) সত্যই বলেছেন,

الطُّرُقُ كُلُّهُا مَسْدُوْدَةٌ عَلَى الْخَلْقِ، إِلَّا عَلَى مَنْ اقْتَفَى أَثَرَ الرَّسُوْلِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

‘সৃষ্টির জন্য (সৃষ্টির বানানো) সকল তরীক্বা বন্ধ। কেবল যে ব্যক্তি রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণ করেছে তার জন্য রাস্তা খোলা রয়েছে’।[8]

আলে ইমরানের ৩১নং আয়াতের কাছাকাছি অর্থে আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا-

‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি ফিরে যায়, তাদের উপর আমরা তোমাকে রক্ষক হিসাবে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)

আবূ জা‘ফর ত্বাবারী বলেন, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বিষয়ে বান্দার নিকট ওযর। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বলেন, হে মানবজাতি! তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে তার আনুগত্যের মাধ্যমে মূলতঃ আমারই আনুগত্য করল। সুতরাং তোমরা তার কথা শ্রবণ কর, তার আদেশের আনুগত্য কর। কেননা সে যে নির্দেশই দেয়, তা মূলতঃ আমার পক্ষ থেকেই নির্দেশনা। সে যে নিষেধই করুক না কেন, তা মূলতঃ আমারই নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন একথা অবশ্যই না বলে যে, মুহাম্মাদ তো আমাদের মতই একজন। সে কেবল আমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চায়’।[9]

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ ‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হ’ল, সে আল্লাহরই অবাধ্যতা করল’।[10]

হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ফাৎহুল বারীতে বলেন, অর্থাৎ আমি কেবল সেটারই আদেশ করি, যার আদেশ আল্লাহ আমাকে করেছেন। সুতরাং কেউ যদি আমার আদেশ মেনে চলে, তাহ’লে সে তাঁরই আনুগত্য করল যিনি আমাকে আদেশ করেছেন। এর অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, যেহেতু আল্লাহ মানুষকে আমার আনুগত্য করতে আদেশ করেছেন, সেহেতু যে আমার আনুগত্য করল, সে মূলতঃ আল্লাহর আদেশের আনুগত্যই করল। অনুরূপ অবাধ্যতার ক্ষেত্রেও। আর আনুগত্য বলতে বুঝায়, যা আদেশ করা হয়েছে তা করা এবং যা নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জন করা। এর বিপরীত করাই হ’ল অবাধ্যতা।[11]

সাত: নবী করীম (ছাঃ)-এর আনিত হেদায়াত ও ইলমের ইত্তেবা করা বিশুদ্ধ নফসের পরিচয় :

ছহীহাইনে আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

مَثَلُ مَا بَعَثَنِي اللهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيرِ أَصَابَ أَرْضًا، فَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ، وفي لفظ مسلم: طَيِّبَةٌ، قَبِلَتِ الْمَاءَ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيرَ، وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ، فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَرِبُوا وَسَقَوْا وَزَرَعُوا، وَأَصَابَتْ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَى، إِنَّمَا هِيَ قِيعَانٌ لاَ تُمْسِكُ مَاءً، وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِي دِينِ اللهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِي اللهُ بِهِ، فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا، وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللهِ الَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ‏-

‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার দৃষ্টান্ত হ’ল যমীনের উপর পতিত প্রবল বর্ষণের ন্যায়। কোন কোন ভূমি থাকে উর্বর, যা সে পানি শুষে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে ঘাসপাতা এবং সবুজ তরুলতা উৎপাদন করে। আর কোন কোন ভূমি থাকে কঠিন, যা পানি আটকে রাখে। পরে আল্লাহ তা‘আলা তা দিয়ে মানুষের উপকার করেন; তারা নিজেরা পান করে ও (পশুপালকে) পান করায় এবং তা দ্বারা চাষাবাদ করে। আবার কোন যমীন রয়েছে, যা একেবারে মসৃণ ও সমতল; তা না পানি আটকে রাখে, আর না কোন ঘাসপাতা উৎপাদন করে। এই হ’ল সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তাতে সে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে শিক্ষা লাভ করে এবং অপরকে শিক্ষা দান করে। আর ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে সেদিকে মাথা তুলে তাকায় না এবং আল্লাহর যে হেদায়াত নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি, তা গ্রহণও করে না’।[12]

রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীفَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ، وفي لفظ مسلم: طَيِّبَةٌ، قَبِلَتِ الْمَاءَ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيْرَ ‘কোন কোন ভূমি থাকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর (উর্বর) যা সে পানি শুষে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে ঘাসপাতা এবং সবুজ তরুলতা উৎপাদন করে’ প্রমাণ করে যে, যার নিকট নবী (ছাঃ)-এর হেদায়াত পৌঁছল এবং সে তার প্রতি ঈমান আনল ও তা গ্রহণ করল, তার নফস পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হ’ল। সুতরাং তার নফস বিশুদ্ধ ও কল্যাণ গ্রহণকারী। এজন্যই তার ও অন্যদের উপর এই ইত্তেবার কল্যাণ প্রকাশ পেয়েছে।

ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযী (রহঃ) এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত এবং সুন্দর কথা বলেন।[13] তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর আনিত ইলম ও হেদায়াতকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। এ দু’টির প্রত্যেকটির মাধ্যমে জীবন, উপকার, খাদ্য ও বান্দার সকল প্রকার কল্যাণ অর্জিত হয়। এগুলি সবই ইলম ও বৃষ্টির মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর তিনি অন্তরসমূহকে বৃষ্টি পতিত হয় এমন ভূমির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা তা এমন স্থান, যা পানিকে ধরে রাখে। ফলে সেখানে সকল প্রকার উপকারী উদ্ভিদ জন্মায়। ঠিক যেমন অন্তরসমূহ ইলম সংরক্ষণ করে তাতে সুফল ফলায়। অতঃপর তার কল্যাণ ও সুফল প্রকাশ পায়।

অতঃপর তিনি মানুষকে ইলম গ্রহণ, এর সংরক্ষণ প্রস্ততি নেয়া, অর্থ উপলব্ধি করা, এর আহকাম উৎঘাটন করা, হিকমত ও উপকারিতা বের করার অবস্থার দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

প্রথম প্রকার : মুখস্থকারী ও উপলব্ধিকারী। যারা তা মুখস্থ করে, বুঝে, অর্থ জানে এবং এর মধ্যকার আহকাম, হিকমত ও উপকারিতা উৎঘাটন করে। তাদের অবস্থা সেই ভূমির ন্যায় যা পানি ধরে রাখে। আর এটাই হ’ল সংরক্ষণ করার সমপর্যায়ভুক্ত। এরপর তা লতা-গুল্ম ও প্রচুর ঘাস গজাতে সাহায্য করে। আর এটাই হ’ল, ইলম বুঝা, জানা ও মাসআলা উৎঘাটন করা। এটাই হ’ল পানির মাধ্যমে লতাপাতা ও ঘাস গজানোর পর্যায়ভুক্ত। এটাই হ’ল হাফেয ফক্বীহগণ যারা আহলে রেওয়ায়াত ও দিরায়াতের অধিকারী তাদের দৃষ্টান্ত।

দ্বিতীয় প্রকার : মুখস্থকারী। যারা ইলম মুখস্থ করা, অন্যের কাছে পেঁŠছে দেয়া ও তা সংরক্ষণ করার তাওফীক্ব লাভ করেছেন। তবে তারা এর সূক্ষ্ম অর্থসমূহ বুঝা, মাসআলা উদঘাটন ও এর বিভিন্ন হিকমত ও উপকারিতা বের করার তাওফীক্ব লাভ করেননি। তাদের অবস্থান সেই ব্যক্তির ন্যায়, যে কুরআন পড়ে, তা মুখস্থ করে, এর শব্দ-বর্ণ ও গ্রামাটিক্যাল দিকগুলির যত্ন নেয়। কিন্তু সে এতে আল্লাহ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভের তাওফীক্ব লাভ করেনি। তাদের স্থান ঐ ভূমির ন্যায়, যা মানুষের জন্য পানি ধরে রাখে, তারা তা দ্বারা উপকৃত হয়, তা থেকে পান করে, সেচ সম্পন্ন করে এবং চাষাবাদ করে। এই দুই প্রকার লোক সৌভাগ্যবান। প্রথম শ্রেণী উঁচু ও বেশী মর্যাদার অধিকারী। এই দুই শ্রেণীই ইলম অর্জন ও তা শিক্ষাদানে অংশ নিয়েছে, যে যতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে এবং তার নিকট পৌঁছেছে। একজন কুরআনের শব্দসমূহ শিখেছে এবং তা মুখস্থ করেছে। অপরজন এর অর্থসমূহ, আহকাম ও নানামুখি জ্ঞান অর্জন করেছে।

তৃতীয় প্রকার : যাদের এতে কোন অংশই নেই। তারা না মুখস্থ করেছে এবং বুঝেছে। আর না রেওয়ায়াত ও দিরায়াত লাভ করেছে। বরং তাদের স্থান ঐ ভূমির ন্যায়, যা কোন পানিই ধরে রাখে না, উদ্ভিদ গজাতে সাহায্য করে না, পানি ধারণও করে না। ঐ শ্রেণীর মানুষেরা হতভাগা। এদের না আছে কোন জ্ঞান, না আছে শিক্ষাদান। ওরা আল্লাহর হেদায়াতের মাধ্যমে মাথা উঁচু করেনি, তা গ্রহণও করেনি। ওরা চতুষ্পদ জন্তু থেকেও নিকৃষ্ট। ওরাই জাহান্নামের জ্বালানী।

এই হাদীছটিতে ইলম ও তা‘লীমের মর্যাদা, এর মর্যাদার বড়ত্ব এবং যে ইলমের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের দীনতার প্রতি সতর্কবাণী রয়েছে।

এখান থেকে বুঝা যায়, বান্দার ইলমের প্রয়োজন তেমন, যেমন তাদের বৃষ্টির প্রয়োজন। বরং তার চেয়ে বেশী দরকার। সুতরাং তারা যখন ইলম হারায়, তখন তারা বৃষ্টিবিহীন ভূমির মত হয়ে যায়। ইমাম আহমাদ বলেন, মানুষের খাদ্য ও পানির প্রয়োজনের চেয়ে বেশী প্রয়োজন ইলমের। কেননা খাদ্য ও পানি প্রত্যহ একবার অথবা দুই বার প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিটি নিঃশ্বাসে ইলমের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّيْلُ زَبَدًا رَابِيًا وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيْهِ فِي النَّارِ ابْتِغَاءَ حِلْيَةٍ أَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِثْلُهُ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللهُ الْحَقَّ وَالْبَاطِلَ فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللهُ الْأَمْثَالَ-

‘তিনি আকাশ হ’তে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। ফলে নদী-নালাসমূহ স্ব স্ব পরিমাণ অনুযায়ী প্রবাহিত হয়। অতঃপর বেগবান স্রোত তার উপরিস্থিত ফেনা রাশি এবং অলংকার ও তৈজসপত্র তৈরীর জন্য (সোনা-রূপা ইত্যাদি) পোড়ানোর উদ্দেশ্যে অনুরূপ বর্জ্য সমূহ বহন করে (যা কোন কাজে লাগে না)। এভাবে আল্লাহ সত্য ও মিথ্যার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন। অতঃপর যা ফেনা তাতো শুকিয়ে যায়। আর যা মানুষের উপকারে আসে, তা মাটিতে থেকে যায়। এভাবেই আল্লাহ উপমা সমূহ দিয়ে থাকেন’ (রা‘আদ ১৩/১৭)

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের উপর নাযিলকৃত ইলমকে আসমান থেকে নাযিলকৃত পানির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা এর প্রত্যেকটির মাধ্যমে বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন ও কল্যাণ অর্জিত হয়। এরপর তিনি অন্তরসমূহকে উপত্যকার সাথে তুলনা করেছেন। যেহেতু প্রশস্ত অন্তর বেশী ইলম ধারণ করে, যেমন প্রশস্ত উপত্যকা অনেক পানি ধারণ করে। পক্ষান্তরে ছোট অন্তর অল্প ইলম ধারণ করে, যেমন ছোট উপত্যকা কম পরিমাণ পানি ধারণ করে...।

আট : নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও হেদায়াত ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাঁর অনুসরণ ও ইত্তেবা করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাছিল হয় :

আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহ্যাব ৩৩/২১)

এই আয়াতের তাফসীরে হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতটি রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও সকল বিষয়ে তাঁর ইত্তেবা করার বড় ভিত্তি। এজন্যই আহযাবের দিন মানুষদেরকে তাঁর ইত্তেবা করার আদেশ দেয়া হয় তাঁর ধৈর্য, ধৈর্যের উপদেশ, তার সাথে পাহারারত থাকা, তার সাথে জিহাদ করা এবং তাঁর রবের পক্ষ থেকে বিপদ মুক্তির অপেক্ষা করা সহ সকল বিষয়ে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বলেন, যারা অস্থির হয়ে পড়েছিল, বিরক্ত হয়েছিল এবং ভয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং আহযাবের দিন তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ পালনে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল, لَقَد کَانَ لَکُم فِی رَسُولِ اللهِ اُسوَةٌ حَسَنَةٌ ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই উত্তম আদর্শ’।

অর্থাৎ তোমরা কি তাঁর ইত্তেবা করবে না? তাঁর বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করবে না? এমর্মে আল্লাহ বলেন,لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)[14]

আব্দুর রহমান সা‘দী (রহঃ) বলেন, এই উত্তম আদর্শ অনুযায়ী তাওফীক্ব লাভ করে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও আখেরাত পাওয়ার আশা রাখে। কেননা তার ঈমান, আল্লাহ ভীতি, ছওয়াবের প্রত্যাশা ও শাস্তির ভয় তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর ইত্তেবা করতে উৎসাহ যোগায়।[15]

উপসংহার :

কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে সুন্নাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক। ইসলামী শরী‘আতে নববী সুন্নাতের মর্যাদা মহান। কিতাব ও সুন্নাত একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হওয়ার নয়। এ দু’টির যেকোন একটিই যথেষ্ট নয়; বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতে অনেক দলীল রয়েছে, যা রাসূলের সুন্নাত অাঁকড়ে ধরার সুমহান মর্যাদার বিষয়ে একাত্বতা পোষণ করেছে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে এর মহা পুরস্কার ও ঈর্ষণীয় সুফল ঘোষণা করেছে। হক মানহাজ ও ছিরাত্বে মুস্তাক্বীম তো সেটাই যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং এটা ব্যতীত কারো কোন কিছুই কবুল করেন না। তা হ’ল, যা রাসূল (ছাঃ) তাঁর রবের পক্ষ থেকে পৌঁছে দিয়েছেন। এতেই রয়েছে আলোকবর্তিকা ও হেদায়াত। এটা ব্যতীত সকল কিছুই অন্ধকার ও ভ্রষ্টতা। সুন্নাত আঁকড়ে ধরার বিপরীতে যা কিছু রয়েছে সেগুলির পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। তা হ’ল, দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করা এবং সুস্পষ্ট এই মানহাজের বিপরীত কিছুর অনুসরণ করা। মুসলিমদের ঐক্য ও তাদের এক কাতারে আসা সম্ভব না সর্বশেষ নবী ও রাসূলের সুন্নাতের ইত্তেবা ব্যতীত। তাই তারা যখনই ঐক্যবদ্ধ ও এক হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তারা যদি সুন্নাত থেকে বিমুখ হয়, তাহ’লে নানা ফিরক্বায় বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং সুস্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত হবে।

সুতরাং আমি প্রথমত নিজেকে, অতঃপর সকল মুসলিম ভ্রাতৃমন্ডলিকে নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাতের ইত্তেবা করার অছিয়ত করছি। কেননা এতেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ। সেই সাথে সাবধান বিদ‘আতীদের পথের অনুসরণ করা, তাদের সুন্দর কথা ও সৌন্দর্য দ্বারা ধোঁকায় পতিত হওয়া থেকে। তাই তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিষয় হ’ল, নবী করীম (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে যা সাব্যস্ত হয়েছে তার ইত্তেবা করা। কেননা হক দ্বীন সুস্পষ্ট, তাতে কোন অন্ধত্ব ও গোলক ধাঁধা নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ও আপনাদেরকে আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত করে নিন, যারা তা ভালোভাবে চিনতে পেরেছেন, তা আঁকড়ে ধরেছেন, তার দিকেই মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও সফলতা লাভে ধন্য হয়েছেন।

মূল : ড. আব্দুল্লাহ বিন ঈদ আল-জারবূঈ

শিক্ষক, মদীনা ইসলামী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব। 

অনুবাদ : মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান

পিএইচ. ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩/৬৭-৬৮।

[2]. মুসনাদে আহমাদ, ৪১৪২; সুনানে দারেমী, হা/২০২; সুনানে কুবরা, হা/১১১০৯; ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৮০/৬-৭; মুসতাদরাকে হাকিম, হা/৩১৮, হাদীছটি ‘ছহীহ’।

[3]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৪৫; আবূদাউদ, হা/৪৬০৭; ছহীহ ইবনে হিববান, হা/৫; মুসাতাদরাকে হাকিম, ১/৯৭; আলবানী ছহীহ বলেছেন, যিলালিল জান্নাত, ১/১৭, হা/২৬।

[4]. মুহাম্মাদ বিন নাছির, সুন্নাহ, হা/৬৯; মুসতাদরাকে হাকিম, ১/৯৩; বায়হাক্বী, সুনান কুবরা, ১০/১১৪; হাদীছটি ‘হাসান’।

[5]. মাদারিযুস সালিকীন, ৩/৪৫৫; উছায়মীন, শারহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়াহ, ১/২৩৩।

[6]. দিওয়ানু যির রুম্মাহ, ১৬৪ পৃ.; জাহিয, মাহাসিন ওয়াল আযদাদ, ১৮৩ পৃ.; দিওয়ানু ইমাম শাফেঈ, ৫৮ পৃ.; ফাওয়াতুল ওফায়াত, ইবনু শাকির কুতুবী, ৪/৮১।

[7]. মাদারিযুস সালিকীন, ৩/৩৩৪।

[8]. ইসতেনশাকু নাসীমিল উনস, ৬০ পৃ.।

[9]. জামি‘উল বায়ান, ৮/৫৮৬।

[10]. বুখারী, হা/৭১৩৭; মুসলিম, হা/১৮৩৫।

[11]. ফাতহুল বারী, ১৩/১২০।

[12]. বুখারী, হা/৭৯; মুসলিম, হা/২২৮২।

[13]. মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ, ১/২৪৭-২৪৯।

[14]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬/৩৯১।

[15]. তাইসীরুল কারীমির রহমান, ৬০৯ পৃ.।






বিষয়সমূহ: সুন্নাত
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দুই প্রধান কারণ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
সংগঠনের প্রচার ও প্রসারে তাবলীগী ইজতেমার ভূমিকা - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
সিজদায় গমনকালে আগে হাঁটু রাখতে হবে নাকি হাত? - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ছিয়ামের আদব - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
কথাবার্তা বলার আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
পরকালে পাল্লা ভারী ও হালকাকারী আমল সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.