দুই : কোন আমলকে সৎ আমল বলা যায় না এবং তা কবুলও হয় না, তাতে আল্লাহর জন্য ইখলাছ এবং রাসূলের সুন্নাতের পূর্ব অনুসরণ ব্যতীত :

আল্লাহর কিতাবে দৃষ্টিনিবদ্ধকারী ব্যক্তি এমন অনেক আয়াত পাবেন যেখানে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, কবুলযোগ্য আমল হ’ল যা সৎ আমল। আর সৎ আমল হ’ল, যা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি মোতাবেক হয় এবং সেটি তাঁর নবী (ছাঃ)-এর অনুসরণে করা হয়। এমর্মে আল্লাহর বাণী, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ، ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে ব্যক্তি সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা অবশ্যই তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)

হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, এটা ঐ ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পুরস্কার, যে সৎ আমল করে। তা হ’ল এমন আমল, যা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও তাঁর নবীর অনুসরণে করা হয়, তা পুরুষ অথবা নারী যেকোন আদম সন্তান করুক না কেন। আর তার অন্তর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী। সেই আমলটি করতে বলা হয়েছে, যা আল্লাহর নিকট শরী‘আত হিসাবে স্বীকৃত। (তার পুরস্কার হ’ল) আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতে পবিত্র উত্তম জীবন দান করবেন এবং আখেরাতে তাকে তার আমলের উত্তম পুরস্কার দান করবেন। আর উত্তম জীবন বলতে বুঝায়, সকল দিক দিয়ে এক প্রশান্তিময় জীবন লাভ করা।[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে (আমরা তাদের পুরস্কৃত করি)। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, আমরা তার পুরস্কার বিনষ্ট করি না’ (কাহফ ১৮/৩০)

শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘আমল সুন্দর করার অর্থ হচ্ছে- বান্দা তার সেই আমলের মাধ্যমে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং শরী‘আত মেনে সে কাজটি করে। এমন আমলকে আল্লাহ তা‘আলা নষ্ট করেন না। এমনকি এর কোন অংশকেও না। বরং তা আমলকারীর জন্য সংরক্ষণ করেন। অতঃপর তাদেরকে তাদের আমল, এর ফযীলত ও সৌন্দর্য অনুযায়ী পূর্ণ প্রতিদান দান করেন।[2]

তিনি আরো বলেন,فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا، ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)

তিনি আরো বলেন,فَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا كُفْرَانَ لِسَعْيِهِ وَإِنَّا لَهُ كَاتِبُونَ، ‘অতএব যে ব্যক্তি মুমিন অবস্থায় কোন সৎকর্ম করে, তার কোন সৎকর্মই অস্বীকৃত হবে না। আর আমরা তা লিপিবদ্ধ করে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৯৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ، ‘তাঁর দিকেই ঊর্ধ্বারোহন করে পবিত্র বাক্য সমূহ। আর সৎকর্ম তাকে উচ্চ করে’ (ফাত্বির ৩৫/১০)

শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘সৎ আমল হ’ল, যা করতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) আদেশ করেছেন, তা ওয়াজিব হ’তে পারে এবং মুস্তাহাবও হ’তে পারে। আর যা কিছু এই মূলনীতির আওতায় পড়ে না, তা কোন ছওয়াবের কাজ নয় এবং তা সৎআমলও নয়’।[3]

তিনি আরো বলেন, ‘সৎ আমল হ’ল যা খালেছ এবং বিশুদ্ধ। খালেছ বলতে বুঝায়, যা আল্লাহর জন্য করা হয়। আর বিশুদ্ধ বলতে বুঝায়, যা আল্লাহর নির্দেশে করা হয়’।[4]

নিঃসন্দেহে রাসূল (ছাঃ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى، ‘তিনি নিজ খেয়াল-খুশীমত কোন কথা বলেন না। (যা বলেন) সেটি অহী ব্যতীত নয়, যা তার নিকট প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)

যখন কোন আমল কবুল হবে, তখন আমলকারীকে ক্বিয়ামতের দিন পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে এবং তার প্রতিদানে কোন কমতি করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِنْ تُطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ لَا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا، ‘বস্ত্ততঃ যদি তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর, তাতে তোমাদের কর্মফলে কোন কমতি করা হবে না’ (হুজুরাত ৪৯/১৪)। অর্থাৎ তোমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তাহ’লে তাঁর আদেশ ও তাঁর রাসূলের আদেশ মেনে চল। তোমাদের উপর যা ফরয করা হয়েছে সে অনুযায়ী আমল কর এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাক। তোমাদের আমলের প্রতিদান প্রদানে তোমাদের উপর কোনরূপ যুলূম করা হবে না এবং এর ছওয়াবেও তোমাদেরকে কম দেয়া

হবে না।[5]

পক্ষান্তরে যে এই সুস্পষ্ট মানহাজের বিরোধিতা করবে এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর রাসূলের (আদর্শ) মোতাবেক আমল করবে না, তার আমল বাতিল, আল্লাহ তা কবুল করবেন না। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ، ‘কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত’। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন কোন কর্ম করল, যাতে আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[6]

এই হাদীছটি আমল সমূহ কবুলের বিষয়ে বড় ভিত্তি। এটি এমন একটি হাদীছ যাকে কেন্দ্র করে উছূলে ইসলাম আবর্তিত হয়।[7] এটি ইসলামের মৌলিক মূলনীতিগুলির অন্যতম। এটি রাসূলের ‘জাওয়ামিঊল কালিম’ (অল্প কথায় ব্যাপক অর্থবোধক) এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এটিই সকল বিদ‘আত ও নবাবিষ্কৃত বিষয়কে প্রত্যাখ্যানের সুষ্পষ্ট দলীল।[8]

এই হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) খুবই উপকারী কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই হাদীছটি ইসলামের মূলনীতিগুলির অন্যতম মূলনীতি। এটি যাবতীয় বাহ্যিক আমলের মানদন্ড। যেমন إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘আমলসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরর্শীল’ এই হাদীছটি গোপনীয় আমলসমূহের মানদন্ড। যেমন যে সকল আমলে আল্লাহর সন্তষ্টি উদ্দেশ্য করা হয় না, সে সকল আমলকারীর কোন ছওয়াব অর্জিত হয় না। অনুরূপ যেসকল আমল করতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা নেই, তা আমলকারীর উপরেই প্রত্যাখ্যান করা হয়। সুতরাং যে কেউ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, যার নির্দেশনা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দেননি, তা দ্বীনের কোন অংশই না।

তিনি আরো বলেন, এই হাদীছের সরাসরি অর্থ যা বুঝা যায় তাহ’ল, যেকোন আমল যা করতে শরী‘আত প্রবর্তনকারীর নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত। আর ভাবার্থ থেকে বুঝা যায়, যে আমল করতে তাঁর অনুমতি আছে, তা গ্রহণযোগ্য।

এখানে নির্দেশনা বলতে তাঁর দ্বীন এবং শরী‘আত বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য বর্ণনায় তাঁর কথা مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ করাল, তা প্রত্যাখ্যাত’ দ্বারা (দ্বীন) বুঝানো হয়েছে।

তিন : রাসূলের আনীত বিধানের ইত্তেবা করা এবং শরী‘আতের সকল বিষয়ে তাকে ফায়ছালাকারী মান্য করা সত্যিকারের ঈমানের পরিচয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيعُوْا اللهَ وَأَطِيعُوْا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلًا- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)

হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা নির্দেশ যে, দ্বীনের যেসকল ঊছূল ও শাখাগত বিষয়ে লোকদের মাঝে কোন বিষয়ে বিবাদ দেখা দেয়, সে বিষয়ের বিবাদকে কিতাব ও সুন্নাতের দিকে প্রত্যর্পণ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ ذَلِكُمُ اللهُ، ‘আর তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন, তার ফায়ছালা তো আল্লাহরই নিকটে’ (শূরা ৪২/১০)

আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত যে ফায়ছালা দেয় এবং যা বিশুদ্ধ বলে সাক্ষ্য প্রদান করে সেটাই হক। আর হকের পরে ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কি আছে? তাইতো আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও’।

إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ‘যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক’ (নিসা ৪/৫৯)

সুতরাং বুঝা গেল, যদি কেউ বিবাদমান বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাহকে ফায়ছালাকারী মেনে না নেয়, সমাধানের জন্য এই দু’টির দিকে ফিরে না যায়, তাহ’লে সে আল্লাহ এবং আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী নয়।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ذلك خير)) অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতের মাধ্যমে ফায়ছালা করা এবং এই দু’টির দিকে ফিরে যাওয়াই উত্তম اَحسَنُ تَاوِيلاً)) অর্থাৎ পরিণতি ও ফলাফলের দিক থেকে সুন্দর। এমনটি বলেছেন সুদ্দী সহ অন্যান্য বিদ্বান। মুজাহিদ বলেন, পুরষ্কারের দিক থেকে উত্তম। এমতটিই বিশুদ্ধতার বেশী কাছাকাছি’।[9]

একই মর্মার্থে কিছু পরেই আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে বিচারক হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার বিষয়ে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে স্বীয় মহিমাময় পবিত্র সত্তার কসম করে তিনি বলেন, যে কেউ রাসূল (ছাঃ)-কে সকল বিষয়ে ফায়ছালাকারী না মানবে সে মুমিন হ’তে পারবে না। তিনি যে ফায়ছালা দিয়েছেন সেটাই হক, যার আনুগত্য গোপনে ও প্রকাশ্যে মেনে নেয়া এবং কোনরূপ বিরোধিতা, প্রতিবন্ধকতা ও বিবাদ ছাড়াই তার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা ওয়াজিব।[10]

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে,

أَنَّ رَجُلاً مِنْ الأَنْصَارِ خَاصَمَ الزُّبَيْرَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي شِرَاجِ الْحَرَّةِ الَّتِي يَسْقُونَ بِهَا النَّخْلَ فَقَالَ الأَنْصَارِيُّ سَرِّحْ الْمَاءَ يَمُرُّ فَأَبَى عَلَيْهِ فَاخْتَصَمَا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِلزُّبَيْرِ أَسْقِ يَا زُبَيْرُ ثُمَّ أَرْسِلْ الْمَاءَ إِلَى جَارِكَ فَغَضِبَ الأَنْصَارِيُّ فَقَالَ أَنْ كَانَ ابْنَ عَمَّتِكَ فَتَلَوَّنَ وَجْهُ رَسُولِ اللهِ ثُمَّ قَالَ اسْقِ يَا زُبَيْرُ ثُمَّ احْبِسْ الْمَاءَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى الْجَدْرِ فَقَالَ الزُّبَيْرُ وَاللهِ إِنِّي لأحْسِبُ هَذِهِ الآيَةَ نَزَلَتْ فِي ذَلِكَ (فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ)

‘জনৈক আনছারী নবী (ছাঃ)-এর সামনে যুবায়ের (রাঃ)-এর সঙ্গে হাররার নালার পানির ব্যাপারে ঝগড়া করল, যে পানি দ্বারা তারা খেজুর বাগান সেচ দিত। আনছারী বলল, নালার পানি ছেড়ে দিন, যাতে তা (প্রবাহিত থাকে) কিন্তু যুবাইর (রাঃ) তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। তারা দু’জনে এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বিতর্কে লিপ্ত হ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যুবাইরকে বললেন, হে যুবায়ের! তোমার যমীনে প্রথমে সেচ করে নাও। এরপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও। এতে আনছারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, সে তো আপনার ফুফাতো ভাই। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারায় অসন্তুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ পেল। এরপর তিনি বললেন, হে যুবায়ের! তুমি নিজের যমীন সেচ করে নাও। এরপর পানি আটকিয়ে রাখ যাতে তা বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে। যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় উপরোক্ত আয়াতটি এ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।[11]

একই মর্মার্থের আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহ্যাব ৩৩/৩৬)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা সত্যিকারের মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন যে, কোন বিষয়ে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) ফায়ছালা দেন, সে বিষয়ে শ্রবণ ও আনুগত্য ব্যতীত মুমিন নারী ও পুরুষের নিজস্ব কোন এখতিয়ারের সুযোগ নেই।

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এই আয়াতের বিধান সকল বিষয়েই প্রযোজ্য।[12] এজন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যখন কোন বিষয়ে ফায়ছালা করেন, তখন কারও জন্য বৈধ নয় তার বিরোধিতা করা, নিজস্ব মতামত ও বক্তব্য দেয়ার।

চার : নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত আঁকড়ে ধরা সকল প্রকার ফিতনা থেকে নাজাত ও মুক্তির মাধ্যম :

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে এক দীর্ঘ বর্ণনা দিলেন। দাজ্জালের বিষয়ে তিনি এটাও বললেন যে, দাজ্জালের আবির্ভাব হবে, কিন্তু মদীনার পথে-ঘাটে প্রবেশ করা তার জন্য নিষিদ্ধ ও হারাম হবে। অতঃপর মদীনার নিকটবর্তী কোন এক রাস্তায় পৌঁছলে ঐ দিনই মদীনা হ’তে এক লোক তার নিকট যাবে, যে ব্যক্তি সে সময়কার শ্রেষ্ঠ মানব হবে। সে এসে তাকে বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুই সে দাজ্জাল, যার কথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে শুনিয়েছিলেন। দাজ্জাল বলবে, হে লোক সকল! যদি আমি এ লোকটাকে হত্যা করার পর পুনরায় জীবিত করি তবে তোমাদের মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকবে কি? লোকেরা বলবে, না। অতঃপর সে তাকে হত্যা করবে, তারপর জীবন দান করবে। জীবন দান করার পর সেলোক বলবে, আল্লাহর কসম! এখন তো তোমার ব্যাপারে আমার জ্ঞান আরও বেড়ে গেছে, যা ইতিপূর্বে কখনো ছিল না। দাজ্জাল আবারো তাকে হত্যা করতে মনস্থ হবে কিন্তু আর হত্যা করতে সক্ষম হবে না’।[13]

হাদীছটি থেকে শিক্ষা : ১. দ্বীনের জ্ঞান থাকলে আল্লাহর রহমতে গোমরাহ হওয়ার সুযোগ থাকে না। যেমন ঐ লোকটি দাজ্জাল ও তার ফিতনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানত। তাই আল্লাহর রহমতে তার ফিতনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। ২. প্রকৃত মুমিন শত ফিতনাতেও ঈমানহারা হয় না; বরং ছবরের সাথে মোকাবেলা করে এবং ফিতনা থেকে মুক্তির পর তার ঈমান আরও মযবূত হয়। ৩. বিপদে মুমিনকে আল্লাহ সাহায্য করেন। ৪. মুমিনের বিজয় সুনিশ্চিত এবং বাতিলের পরাজয় ও ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। -অনুবাদক

সুতরাং এই মুমিন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা সেদিন তাওফীক্ব দান করবেন এবং তাকে হেফাযত করবেন, সে জানতে পারবে যে, এটাই সে মাসীহ দাজ্জাল, যার সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) বলে গেছেন। তিনি তার বিবরণ যেভাবে দিয়েছেন তা স্পষ্টভাবেই দেখতে পাবে। সেজন্য সে দ্বীন ও নফসের বিষয়ে যতবেশী পরীক্ষা ও বিপদের মুখোমুখি হোক না কেন তাতে তার ঈমান কেবল সুদৃঢ় পাহাড়ের মত মযবূত ও দৃঢ় হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে (হকের উপর) এই মহান অবিচলতা দান করবেন নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ অাঁকড়ে ধরা এবং সে বিষয়ে জ্ঞানার্জনের বরকতে। ফলে সেটাই হবে তার নাজাতের মাধ্যম সেই সকল মহা ফিতনা থেকে, যে সকল নিদর্শন ও দলীল আল্লাহ তা‘আলা দাজ্জালের হাতে সংঘটিত করবেন, যার মাধ্যমে অনেক হৃদয় ধোঁকায় পড়বে, পথভ্রষ্ট হবে এবং তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারই আনুগত্য ও দাসত্ব করবে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় ও নিরাপত্তা কামনা করি এবং তিনি যেন তার ফিতনার অনিষ্ট থেকে আমাদের হেফাযত করেন। তিনি সর্বশ্রোতা, আহবানে সাড়াদানকারী। (ক্রমশঃ)

মূল : ড. আব্দুল্লাহ বিন ঈদ আল-জারবূঈ

অনুবাদ : মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান

শিক্ষক, মদীনা ইসলামী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব। পিএইচ. ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৪/৬০১।

[2]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ৪২৬ পৃ.।

[3]. নবুওয়াত ৯৩ পৃ.।

[4]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৭/১২৮।

[5]. জামিঊল বায়ান ২২/৩১৬-৩১৭; তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩৮৯; তাইসীরুল কারীমির রহমান ৭৪৬ পৃ.।

[6]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮।

[7]. জামিঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ২১ পৃ.।

[8]. মিনহাজ ১২/২৪২।

[9]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ২/৩৪৫-৩৪৬।

[10]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ২/৪৪৯।

[11]. বুখারী হা/২৩৫৯; মুসলিম হা/২৩৫৭।

[12]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬/৪২৩।

[13]. বুখারী হা/১৮৮২; মুসলিম হা/২৯৩৮।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
দাওয়াতের ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
খারেজীদের আক্বীদা ও ইতিহাস - মীযানুর রহমান মাদানী
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
মানব জাতির প্রতি ফেরেশতাদের দো‘আ ও অভিশাপ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
কথাবার্তা বলার আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৪তম কিস্তি) - শামসুল আলম
ইখলাছ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৮ম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ইলম অন্বেষণও শিক্ষাদানের গুরুত্বও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মিথ্যা সাক্ষ্য দানের ভয়াবহতা - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
সৃজনশীল প্রশ্ন, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.