গীবতের পরিণাম ও ভয়াবহতা
গীবত বা পরনিন্দা একটি সর্বনাশা মহাপাপ। এই পাপের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট হয়। কারণ পরনিন্দার মাধ্যমে অন্যের সম্মান হানি করা হয় এবং তার মর্যাদার ওপর চরমভাবে আঘাত করা হয়, যা আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের উপর হারাম করেছেন। দুনিয়া ও আখেরাতে গীবতকারীর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হয়। নিমেণ গীবতের পরিণাম ও ভয়াবহতা সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল।-
১. গীবত একটি ভয়াবহ কাবীরা গুনাহ :
মুসলিমের জীবনে অন্যান্য কবীরা গুনাহের চেয়ে গীবতের প্রভাব ও পরিণাম অপেক্ষাকৃত বেশী ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গীবতের ভয়াবহতা বুঝাতে যে উপমা দিয়েছেন, অন্য কোন মহাপাপের ব্যাপারে এত শক্তভাবে বলেননি। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি একবার ছাফিয়া [রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী]-এর দিকে ইশারা করে বললাম, أَنَّهَا قَصِيرَةٌ ‘সে তো বেঁটে মহিলা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اغْتَبْتِهَا ‘তুমি তো তার গীবত করে ফেললে’।[1] অপর বর্ণনায় এসেছে তিনি বললেন, لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِمَاءِ الْبَحْرِ لَمَزَجَتْهُ، ‘তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যদি তা সমুদ্রে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে সমুদ্রের পানির রং পাল্টে যাবে’।[2] অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘এই গীবত এতটাই দুর্গন্ধময় ও জঘন্য যে, যদি এটাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়, তবে সমগ্র সাগরের পানির স্বাদ ও গন্ধ উভয়টাই পরিবর্তন হয়ে যাবে’।[3] ইবনে আল্লান (রহঃ) বলেন,فإذا كانت هذه الكلمة بهذه المثابة، في مزج البحر، الذي هو من أعظم المخلوقات، فما بالك بغيبة أقوى منها، ‘গীবতের এই কথা সৃষ্টিকূলের সবচেয়ে বড় সৃষ্টি সমুদ্রের সাথে মিশে যদি এত ভয়াবহ হ’তে পারে, তবে গীবতের চেয়ে শক্তিশালী পাপ আর কি হ’তে পারে’।[4] অর্থাৎ নিন্দাবাদের ছোট্ট একটি কথা যদি বিশাল সমুদ্রের রঙ বদলে দিতে পারে, বিস্তীর্ণ সাগরের পানির স্বাদ পরিবর্তন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তবে এই গীবত আমাদের দ্বীনদারিতা ও আমলনামার কি অবস্থা করে ছাড়বে তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, هذا الحديث من أعظم الزواجر عن الغيبة أو أعظمها وما أعلم شيئا من الأحاديث بلغ في ذمها هذا المبلغ، ‘এই হাদীছটি পরনিন্দার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ধমকের অন্যতম অথবা সবচেয়ে বড় ধমক। গীবতের নিন্দাবাদে এত কঠোর হাদীছ আছে বলে আমার জানা নেই’।[5]
সুতরাং হাদীছের বাণী ও ওলামায়ে কেরামের ভাষ্যগুলো পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায় গীবত কত মারাত্মক পাপ। তাছাড়া এখানে আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হ’ল মুসলমানদের মাঝে গীবত এত সন্তর্পণের বিচরণ করে যে, নেককার বান্দারাও নিজের অজান্তে এই পাপে জড়িয়ে যেতে পারেন। আয়েশা (রাঃ)-এর এই হাদীছটি তার বড় প্রমাণ।
২. গীবত মৃত মানুষের গোশত খাওয়ার চেয়েও নিকৃষ্ট পাপ :
মানুষের গোশত খাওয়া হারাম। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন,وَلا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ، ‘আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করো না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إنما ضرب الله هذا المثل للغيبة لأن أكل لحم الميت حرام مستقذر، وكذا الغيبة حرام في الدين وقبيح في النفوس، ‘আল্লাহ গীবতের এই উপমা দিয়েছেন এজন্য যে, মৃত মানুষের গোশত খাওয়া যেমন ঘৃণ্য এবং হারাম, ঠিক তেমনি দ্বীন ইসলামে গীবত করা হারাম এবং নফসেরে জন্য ঘৃণার্হ’। ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন,كما يمتنع أحدكم أن يأكل لحم أخيه ميتا كذلك يجب أن يمتنع من غيبته حيا، ‘তোমাদের কেউ যেমন তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকে। একইভাবে তার অবশ্য কর্তব্য হ’ল তার জীবিত ভাইয়ের গোশত খাওয়া বা গীবত করার থেকে বিরত থাকা’।[6]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে গেলে অপর একজন সেই ব্যক্তির সমালোচনায় লিপ্ত হয়। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, تَخَلَّلْ! ‘দাঁত খেলাল কর’। সে বলল,وممَّا أتَخَلَّلُ؟ ما أكَلْتُ لحماً! ‘আমি তো গোশত খাইনি; দাঁত খেলাল করব কেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,إنَّك أكَلْتَ لَحْمَ أخيكَ، ‘তুমি তো (এইমাত্র) তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করলে’।[7]
আমর ইবনুল ‘আছ একদিন একটা মরা গাধার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচিছলেন। গাধাটির দিকে ইশারা করে তার সাথীদের বললেন,لأَنْ يأكُلَ الرجلُ مِنْ هذا حتى يَمْلأ بَطْنَهُ، خيرٌ له مِنْ أنْ يأكُلَ لحْمَ رجلٍ مسْلِمَ، ‘একজন মুসলিমের গোশত খাওয়া বা গীবত করার চেয়ে কোন মানুষের জন্য এই (মরা গাধার) গোশত খেয়ে পেট ভরানো উত্তম’।[8] আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ما الةقم أحد لقمةً شرًّا من اغتياب مؤمن، ‘মুমিন ব্যক্তির গীবতের চেয়ে নিকৃষ্ট লোকমা কেউ গ্রহণ করে না’।[9] একবার ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) কিছু মানুষকে দাওয়াত করলেন। তারা এসে খাবারের জন্য বসে এক ব্যক্তির দোষচর্চা শুরু করল। তখন ইবরাহীম (রহ.) বললেন, আমাদের পূর্বকালের লোকেরা গোশত খাওয়ার আগে রুটি খেত। আর আপনারা তো আগেই গোশত খাওয়া শুরু করে দিলেন (অর্থাৎ গীবত শুরু করে দিয়েছেন)।[10]
৩. যিনা-ব্যভিচার ও সূদ-ঘুষের চেয়েও নিকৃষ্ট পাপ গীবত :
সমাজে প্রচলিত পাপগুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয় জঘন্য পাপ হ’ল ব্যভিচার ও সূদ। লম্পট, যেনাকার ও সূদ-ঘুষখোর নর-নারীকে সমাজের সবাই ঘৃণা করে। তাদেরকে কেউ অন্তরে ঠাঁই দেয় না। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হ’ল সূদ-ঘুষ ও যিনা-ব্যভিচারের চেয়েও ক্ষতিকর, ঈমান বিধ্বংসী ও নিকৃষ্ট পাপ হ’ল গীবত। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হ’ল মুসলিম সমাজের অনেকেই ব্যভিচার ও সূদের পাপ থেকে নিজেকে হেফাযত করতে পারলেও অবলিলায় গীবতের পাপে জড়িয়ে পড়েন। বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الرِّبَا اثْنَانِ وَسَبْعُونَ بَابًا، أَدْنَاهَا مِثْلُ إِتْيَانِ الرَّجُلِ أُمَّهُ، وَأَرْبَى الرِّبَا اسْتِطَالَةُ الرَّجُلِ فِي عِرْضِ أَخِيهِ، ‘গীবতের বাহাত্তরটি দরজা আছে। তন্মধ্যে নিকটবর্তী দরজা হ’ল কোন পুরুষ কর্তৃক তার মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। আর সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল অপর ভাইয়ের সম্মানহানি করা (অর্থাৎ গীবত করা)’।[11] আমরা জানি, যিনা-ব্যভিচার এমনিতেই নিকৃষ্ট মানের পাপ। ব্যভিচারীকে মানুষ সবসময় ঘৃণার চোখে দেখতে অভ্যস্ত। তার উপর আপন মায়ের সাথে এমন জঘন্য কাজের কথা মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। আবার এই কল্পনাতীত গুনাহটাই নাকি সূদের সবচেয়ে লঘু স্তর। তাহ’লে সূদ আরো কত ভয়াবহ পাপ? আর সেই সূদের চেয়েও বড় পাপ হ’ল গীবত। তাহ’লে এই গীবত কত নিকৃষ্ট, জঘন্য ও নিন্দনীয় পাপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওলামায়ে কেরাম বলেন, সূদের চেয়ে গীবতের পাপ মারাত্মক হওয়ার কারণ হ’ল মুসলিম ব্যক্তির সম্পদের চেয়ে তার মান-মর্যাদা অনেক বেশী মূল্যবান। তাই তার সম্পদ আত্মসাৎ করার চেয়ে তার সম্মান নষ্ট করার ভয়াবহতা অনেক বেশী।[12]
অপর এক হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মাঝে খুৎবাহ দিলেন। খুৎবাতে তিনি সূদের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, إنَّ الدِّرْهَم يصيبُه الرجلُ مِنَ الرِّبا أعْظَمُ عندَ الله في الخَطيئَةِ مِنْ ستٍّ وثَلاثينَ زَنْيَةً يَزْنيها الرجُلُ، وإنَّ أَرْبى الرِّبى عِرْضُ الرجُلِ المسْلِمِ ‘কোন ব্যক্তির জন্য ছত্রিশবার ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ হ’ল এক দিরহাম সূদ গ্রহণ করা। আর সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল মুসলিম ভাইয়ের সম্মানে আঘাত দেওয়া বা গীবত করা’।[13]
৪. গীবতকারী কবরে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে :
মৃত্যুর পর থেকেই গীবতকারীর পরকালীন শাস্তি শুরু হয়ে যায়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقَبْرَيْنِ، فَقَالَ: إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنَ البَوْلِ، وَأَمَّا الآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ، ثُمَّ أَخَذَ جَرِيدَةً رَطْبَةً، فَشَقَّهَا نِصْفَيْنِ، فَغَرَزَ فِي كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، لِمَ فَعَلْتَ هَذَا؟ قَالَ: لَعَلَّهُ يُخَفِّفُ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا ‘নবী করীম (ছাঃ) একদা দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। এ সময় তিনি বললেন, এদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে কোন গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে সতর্ক থাকত না। আর অপরজন চোগলখুরী করে বেড়াত। তারপর তিনি একখানি কাঁচা খেজুরের ডাল নিয়ে ফেড়ে দু’ভাগ করলেন এবং প্রত্যেক কবরের উপর একটা করে পুঁতে দিলেন। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কেন এমন করলেন? তিনি বললেন, আশা করা যায় এই দু’টি ডাল শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আযাব কিছুটা হালকা করা হবে’।[14] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ يَغْتَابُ النَّاسَ، وَأَمَّا الْآخَرُ فَكَانَ لَا يَتَأَذَّى مِنَ الْبَوْلِ، ‘তাদের একজন মানুষের গীবত করত। আর অপরজন পেশাবের
(ছিটার) ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না’।[15]
ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, أَنَّ عَذَابَ الْقَبْرِ ثَلَاثَةُ أَثْلَاثٍ: ثُلُثٌ مِنَ الْغِيبَةِ، وَثُلُثٌ مِنَ الْبَوْلِ، وَثُلُثٌ مِنَ النَّمِيمَةِ، ‘কবরের আযাব তিন ভাগে বিভক্ত : এক-তৃতীয়ংশ গীবতের কারণে, এক-তৃতীয়াংশ পেশাব থেকে সতর্ক না থাকার কারণে আর এক-তৃতীয়াংশ চোগলখুরীর কারণে হবে’।[16] কবি বলেন,
احْفَظْ لسانكَ أيها الإنسان .. لا يلدغنَّك؛ إنَّهُ ثُعْبَانُ
كَمْ فِي المَقَابِرِ مِنْ قَتِيلِ لسَانِهِ .. كَانَتْ تَخَافُ لِقَاءَهُ الأَقْرَانُ
‘হে মানুষ! জিহবাকে সংযত রাখ। তোমার জিহবা একটা (বিষাক্ত) সাপের মতো, সে যেন তোমাকে ছোবল না মারে। কবরে এমন কত নিহত লোক আছে, যাকে তার জিহবা হত্যা করেছে। জিহবা এমন (ভয়ংকর) বস্ত্ত যে, তরবারিও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ভয় পায়’।[17]
৫. গীবত বান্দার দ্বীনদারীকে ধ্বংস করে :
আখেরাত পিয়াসী বান্দার জীবনে অমূল্য সাধনার ফসল হ’ল তার দ্বীনিয়াত। এটাকে উপজীব্য করে সে তার পার্থিব জীবন পরিচালনা করে। কিন্তু গীবত ও পরনিন্দা তার দ্বীনিয়াতকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। তার পরহেযগারিতার বুকে কুঠারাঘাত করে বসে। নীরব ঘাতকের মত তার ধার্মিকতায় পঁচন ধরিয়ে দেয়। বান্দা যদি গীবত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তবে তার ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারে না। উসামা ইবনে শারীক (রাঃ) বলেন, ‘আমি উপস্থিত থাকা অবস্থায় বেদুইনরা নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করল,أَعَلَيْنَا حَرَجٌ فِي كَذَا؟ أَعَلَيْنَا حَرَجٌ فِي كَذَا؟ ‘এতে কি আমাদের গুনাহ হবে, এতে কি আমাদের গুনাহ হবে? তিনি বলেন, عِبَادَ اللهِ، وَضَعَ اللهُ الْحَرَجَ، إِلَّا مَنِ اقْتَرَضَ، ‘আল্লাহর বান্দাগণ! কোন কিছুতেই আল্লাহ গুনাহ রাখেননি, তবে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ইয্যতহানি করে তাতেই গুনাহ হবে’।[18] এজন্য সালাফে ছালেহীন শুধু ছালাত-ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং গীবত থেকে বিরত থাকাকেও ইবাদত গণ্য করতেন। কেননা গীবতের ছিদ্র বন্ধ না থাকলে আমলনামার ঝুলিতে কোন নেকী অবশিষ্ট থাকে না। তাই তো আব্দুল করীম ইবনে মালেক (রহঃ) বলেন,أَدْرَكْنَا السَّلَفَ الصَّالِحَ وَهُمْ لَا يَرَوْنَ الْعِبَادَةَ فِي الصَّوْمِ، وَلَا فِي الصَّلَاةِ، وَلَكِنْ فِي الْكَفِّ عَنْ أَعْرَاضِ النَّاسِ، ‘আমরা সালাফে ছালেহীনকে এমন পেয়েছি যে, তারা শুধু ছালাত, ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং মানুষের সম্মানে হস্তক্ষেপ বা গীবত পরিহার করাকেও ইবাদত হিসাবে গণ্য করতেন’।[19]
হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,وَاللهِ لَلْغَيْبَةُ أَسْرَعُ فِي دِينِ الْمُؤْمِنِ مِنَ الْأَكْلَةِ فِي جَسَدِهِ، ‘আল্লাহর কসম! গীবত মুমিনের দ্বীনিয়াতের জন্য এতটাই দ্রুততম ক্ষতিকারক যে, এটা তার দেহে থেকে গোশত কামড়ে খাওয়ার চেয়েও মারাত্মক’।[20]
তাছাড়া গীবত বান্দার হৃদয়কে রোগাক্রান্ত করে দেয়, ফলে তার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মুমিনের স্তর থেকে ফাসেক্বের স্তরে ছিটকে পড়ে। ওছমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) বলেন,الْغِيبَةُ وَالنَّمِيْمَةُ يَحُتَّانِ الْإِيْمَانَ كَمَا يَعْضِدُ الرَّاعِي الشَّجَرَةَ، ‘রাখাল যেভাবে গাছ কেটে ফেলে, পরনিন্দা ও চোগলখুরী সেভাবে ঈমানকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে’।[21] সুফইয়ান ছাওরী (রহ.) বলেন,إياك والغِيبةَ، إياك والوقوعَ في الناس، فيَهلِك دينُك، ‘গীবত থেকে বেঁচে থাক! মানুষের দোষচর্চা করা থেকে সবধান থাক। অন্যথায় তোমার দ্বীনদারী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’।[22] আবূ হাতেম বুস্তী (রহ.) বলেন, أربح التّجارة ذكر الله، وأخسر التجارة ذكر النّاس، ‘সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হ’ল আল্লাহর যিক্র করা এবং সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবসা হ’ল মানুষের সমালোচনা করা’।[23]
৬. গীবতের মাধ্যমে নেক আমল ক্ষতিগ্রস্ত হয় :
পরনিন্দা একটি মারাত্মক পাপ, যা বান্দার নেক আমলের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং আমলের নেকী অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। যেমন কেউ যদি ছিয়াম রেখে গীবত করে, তাহ’লে সে ছিয়ামের ফযীলত ও নেকী লাভে বঞ্চিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেনمَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَه، ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা ও মুর্খতা পরিত্যাগ করল না, আল্লাহর নিকট (ছিয়ামের নামে) তার পানাহার পরিত্যাগের কোন প্রয়োজন নেই’।[24]
অত্র হাদীছের মর্মার্থ হ’ল, কেউ যদি ছিয়ামরত অবস্থায় গীবতের মতো পাপে জড়িয়ে পড়ে, তাহ’লে সে ঐ ছিয়ামের মাধ্যমে কোন উপকারিতা হাছিল করতে পারবে না। যদি সেটা ফরয ছিয়াম হয়, তবে তার ফরযিয়াত আদায় হয়ে যাবে এবং তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে না। কিন্তু ছিয়ামের পুরস্কার ও ছওয়াব লাভে সে বঞ্চিত হবে। কারণ সে ছিয়াম রেখে মানুষের গোশত ভক্ষণ করেছে’।[25]
অনুরূপভাবে হাদীছে ছিয়ামকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ঢাল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গীবত সেই ঢালের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الصِّيَامُ جُنَّةٌ، فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ، فَلَا يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَسْخَبْ، ‘ছিয়াম ঢাল স্বরূপ। অতএব তোমাদের কেউ যেন ছিয়ামের দিনে অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল না করে’।[26] ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন, ‘ছিয়ামরত অবস্থায় কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকলে সেই ছিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাল হবে। সুতরাং দুনিয়াতে যদি কেউ কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে, তাহ’লে আখেরাতে সেটা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হবে। আবূ উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ (রাঃ) বলেন, إِشَارَةٌ إِلَى أَنَّ الْغِيبَةَ تَضُرُّ بِالصِّيَامِ ‘অত্র হাদীছে ইঙ্গিত রয়েছে যে, গীবত ছিয়ামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে’।[27]
হাফছাহ বিনতে সীরীন (রহঃ) বলেন,الصيَامُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا صَاحِبُهَا، وَخَرْقُهَا الْغِيبَةُ، ‘ছিয়াম ততক্ষণ ঢাল থাকে, যতক্ষণ না ছায়েম এটাকে ভেঙ্গে ফেলে। আর গীবতের মাধ্যমে ঢাল ভেঙ্গে যায়’।[28] আবূল আলিয়া (রহঃ) বলেন, الصَّائِمُ فِي عِبَادَةٍ مَا لَمْ يَغْتَبْ أَحَدًا، وَإِنْ كَانَ نَائِمًا عَلَى فِرَاشِهِ ‘ছিয়াম পালনকারী যতক্ষণ না কারো গীবত করে, ততক্ষণ সে ইবাদতের মধ্যেই থাকে। এমনকি বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থাতেও সে ইবাদতরত থাকে’।[29] অর্থাৎ গীবত করলে ছিয়াম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সালাফগণ নিজেদের নেক আমলের হেফাযতের জন্য গীবত থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতেন। আবূল মুতাওয়াক্কিল বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) এবং অন্যন্য ছাহাবায়ে কেরাম ছিয়ামরত অবস্থায় মসজিদে বেশী অবস্থান করতেন। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হ’লে বলতেন,نطهر صِيَامَنَا، ‘আমরা আমাদের ছিয়ামকে পবিত্র রাখার জন্য এমন করে থাকি’।[30] মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَسْلَمَ لَهُ صَوْمُهُ فَلْيَجْتَنِبِ الْغِيبَةَ وَالْكَذِبَ، ‘যে ব্যক্তি তার ছিয়ামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, সে যেন গীবত ও মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকে’।[31] শুধু ছিয়ামই নয়; যে কোন ইবাদতকে পবিত্র রাখার জন্য গীবত থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। সালাফগণ বলেছেন, إِنْ ضَعُفْتَ عَنْ ثَلَاثَةٍ فَعَلَيْكَ بِثَلَاثٍ: إِنْ ضَعُفْتَ عَنِ الْخَيْرِ فَامْسِكْ عَنِ الشَّرِّ، وَإِنْ كُنْتَ لَا تَسْتَطِيعُ أَنْ تَنْفَعَ النَّاسَ فَامْسِكْ عَنْهُمْ ضُرَّكَ، وَإِنْ كُنْتَ لَا تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ فَلَا تَأْكُلْ لُحُومَ النَّاسِ ‘তুমি যদি তিনটি কাজ করতে অপারগ হয়ে যাও, তবে অবশ্য অপর তিনটি কাজ থেকে দূরে থাকবে: (১) যদি ভালো কাজ না করতে পার, তবে অবশ্যই অন্যায় থেকে দূরে থাকবে, (২) যদি মানুষের উপকার করতে না পার, তবে অবশ্যই তাদের ক্ষতি করার থেকে দূরে থাকবে এবং (৩) যদি ছিয়াম রাখতে না পার, তবে অবশ্যই মানুষের গোশত খাওয়া বা পরনিন্দা থেকে বিরত থাকবে’।[32]
৭. দুনিয়া ও আখেরাতে নিজের ত্রুটি প্রকাশ পায় :
পৃথিবীর কোন মানুষ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কম-বেশী সবার মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। কেউ যদি নিজের দিকে নযর না দিয়ে অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং গীবত করে, তাহ’লে তার দোষ-ত্রুটিগুলো যে কোন মাধ্যমে আল্লাহ প্রকাশ করে দেন। মূলত গীবতকারীর ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে দিয়ে আল্লাহ তাঁর মুসলিম বান্দার পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেন। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুসলমানদেরকে পরনিন্দা থেকে সাবধান করেছেন। আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ، وَلَمْ يَدْخُلِ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ، لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ، وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ، فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ، ‘ওহে যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়িয়ো না। কারণ যে ব্যক্তি তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তার দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন’।[33] অন্যত্র তিনি (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ، سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ، كَشَفَ اللهُ عَوْرَتَهُ، حَتَّى يَفْضَحَهُ بِهَا فِي بَيْتِهِ، ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করবে, মহান আল্লাহও তার দোষ প্রকাশ করে দিবেন। এমনকি তার ত্রুটি প্রকাশ করার মাধ্যমে তাকে তার ঘরের মধ্যেই লাঞ্ছিত করবেন’।[34]
আযীমাবাদী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীছে মুসলিমের দোষ প্রকাশকারীদের প্রতি কঠিন ধমক দেওয়া হয়েছে। তারা যদি এই নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত না থাকে, তবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকলেও সেখানেই অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের পাকড়াও করবে’।[35] ইবনু হাজার হায়তামী (রহঃ) বলেন,أَنَّ الْمُؤْمِنِينَ كُلَّهُمْ بِمَنْزِلَةِ الْبَدَنِ الْوَاحِدِ إذْ اشْتَكَى بَعْضُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ، فَمَنْ عَابَ غَيْرَهُ فَفِي الْحَقِيقَةِ إنَّمَا عَابَ نَفْسَهُ نَظَرًا لِذَلِكَ، ‘মুমিনগণ সকলে একটি দেহের ন্যায়। শরীরের একটি অংশ ব্যথাহত হ’লে পুরা শরীরে ব্যথিত হয়। সুতরাং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যে অপরের দোষ চর্চা করে, সে মূলত নিজেরই দোষ চর্চায় লিপ্ত হয়’।[36] অর্থাৎ অন্যের দোষ আলোচনা করার মাধ্যমে সে নিজের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। সে যদি নির্জনেও কোন পাপ করে অথবা তার এমন কোন ত্রুটি আছে যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানত না- এমন বিষয়গুলো অন্যের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাবে। হয় সে নিজেই নিজের অজান্তে তার দোষ বলে দিবে অথবা কোন আলামত বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। সেজন্য অন্যের ত্রুটি গোপন রাখার প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক। ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ يَسْتُرُ وَيَنْصَحُ، وَالْفَاجِرُ يَهْتِكُ وَيُعَيِّرُ ‘মুমিন ব্যক্তি দোষ গোপন রাখে এবং সদুপদেশ দেয়। আর পাপিষ্ট ব্যক্তি গোপন বিষয় ফাঁস করে দেয় এবং পরনিন্দা করে’।[37]
৮. ক্বিয়ামতের দিন অন্যের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে চাপে :
ক্বিয়ামতের দিন কড়ায়গন্ডায় গীবতের বদলা নেওয়া হবে। যার গীবত করা হয়েছে তার পাপের বোঝা গীবতকারীর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে, অথচ সেই গীবতকারী হয়ত সারা জীবনে একবারও সেই পাপ করেনি, তথাপি পরনিন্দার কারণে সেই পাপের ঘানি তাকে টানতে হবে। আবার নিজের কষ্টার্জিত আমল- ছালাত, ছিয়াম, দান-ছাদাক্বাহ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেওলাওয়াত প্রভৃতি ইবাদতের নেকীগুলো গীবতের পরিমাণ অনুযায়ী তাকে দিয়ে দিতে হবে। হাশরের ময়দানে মানুষ যখন একটা নেকীর জন্য হন্যে হয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকবে, সেই কঠিন মুহূর্তে নিজের নেকী অন্যকে দিয়ে দিতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ ‘তোমরা কি বলতে পার, নিঃস্ব কে? ছাহবীরা বললেন, الـمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ ‘আমাদের মধ্যে যার টাকা কড়ি ও আসবাপত্র নেই সেই তো নিঃস্ব। তখন তিনি বললেন, إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ، ‘আমার উম্মাতের মধ্যে সেই প্রকৃত নিঃস্ব, যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের আমল নিয়ে উপস্থিত হবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, ওকে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না গেলে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[38]
সহজ কথায় আমরা যদি গীবতের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে হোক অপর মুসলিমের অধিকার নষ্ট করি, তবে ক্বিয়ামতের দিন আমাদের সম্পাদিত নেক আমলের নেকীগুলো তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে। যদি নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে যার গীবত করা হয়েছে তার পাপের বোঝাগুলো নিজের মাথায় নিতে হবে এবং এভাবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে হবে। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالْغِيبَةَ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَهِيَ أَسْرَعُ فِي الْحَسَنَاتِ مِنَ النَّارِ فِي الْحَطَبِ، ‘তোমরা গীবত থেকে সাবধান থাক। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আগুন যেভাবে কাঠ পুড়িয়ে দেয় তার চেয়েও দ্রুতগতিতে গীবত নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়’।[39]
৯. পরকালের কঠিন শাস্তি ভোগ :
নিজের নেকীগুলো অন্যকে দিয়ে যখন গীবতকারী দেওলিয়া হয়ে যাবে, তখন তার জন্য শাস্তি অবধারিত হয়ে যাবে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لما عرجَ بِي ربِّي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وجوهَهم وصدورهم فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ؟ قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ، ‘যখন আমার রব (মি‘রাজের রাতে) আমাকে উপরে নিয়ে গেলেন, আমি সেখানে এমন লোকেদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিল তামা দিয়ে তৈরি। তারা সেসব নখ দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষ খোঁচাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল (আঃ) বললেন, এরা সেসব লোক, যারা (গীবত করার মাধ্যমে) মানুষের গোশত খায় এবং মানুষের মান-সম্মানে আঘাত হানে’।[40] ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, ‘শোকের সময় মুখ ও বুক খামচানো পুরুষ মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়; বরং এগুলো ভাড়াটে বিলাপকারিণী মহিলাদের স্বভাব। মূলত এই উপমা দেওয়ার মাধ্যমে হাশরের মাঠে গীবতকারীদের শোচনীয় ও লাঞ্ছনাদায়ক অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে’।[41]
১০. জান্নাতে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত :
গীবতকারী মুসলিম যদি গীবত থেকে তওবা না করে মারা যায়, তবে তিনি প্রথম সুযোগে জান্নাতে যেতে পারবে না; বরং তাকে গীবতের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। যারা মুমিনদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং তাদের নিন্দা করে, ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ খাওয়ানো হবে। সাহ্ল ইবনে মু‘আয (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ رَمَى مُسْلِمًا بِشَيْءٍ يُرِيدُ شَيْنَهُ بِهِ، حَبَسَهُ اللهُ عَلَى جِسْرِ جَهَنَّمَ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ، ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করবে, মহান আল্লাহ তাকে জাহান্নামের সেতুর উপরে আটক করবেন, যতক্ষণ না তার কৃত কর্মের ক্ষতিপূরণ হয়’।[42] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَالَ فِي مُؤْمِنٍ مَا لَيْسَ فِيهِ أَسْكَنَهُ اللهُ رَدْغَةَ الْخَبَالِ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ، ‘যে ব্যক্তি ঈমানদার লোকের এমন দোষ বলে বেড়ায় যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের (দেহ নিঃসৃত) রক্ত-পুঁজের মাঝে বসবাস করাবেন। যতক্ষণ না সে তার কথা (গীবত) থেকে ফিরে আসবে’।[43] আশরাফ বলেন, গীবত থেকে ফিরে আসার অর্থ হ’ল শাস্তি পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গীবতকারী জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পাবে না।[44] [চলবে]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আহমাদ হা/২৫৭০৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাত ওয়ান নামীমাহ, হা/৭০; পৃ. ২৪, সনদ হাসান।
[2]. আবূদাঊদ হা/৪৮৭৫; তিরমিযী হা/২৫০২, সনদ ছহীহ।
[3]. শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৬/১২৬।
[4]. ইবনু আল্লান, দালীলুল ফালিহীন ৮/৩৫২।
[5]. মানাভী, ফায়যুল ক্বাদীর, ৫/৪১১।
[6]. তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৫।
[7]. ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৩৭, সনদ ছহীহ লি গাইরিহী।
[8]. ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৮, সনদ ছহীহ।
[9]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৪, সনদ ছহীহ।
[10]. আবুল লাইছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১২৩।
[11]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭১৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫৩৭; ছহীহাহ হা/১৮৭১, সনদ ছহীহ।
[12]. ফাৎহুল ক্বারীবিল মুজীব ১১/৩৯১।
[13]. ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১, সনদ ছহীহ।
[14]. বুখারী হা/২১৮; মুসলিম হা/২৯২।
[15]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা মাওছিলী হা/২০৫০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৫, সনদ ছহীহ।
[16]. ইবনু হাজার হায়তামী, আয-যাওয়াজির আন-ইক্বতিরাফিল কাবায়ির, ২/১৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, আছ-ছামত, পৃ. ১২৯।
[17]. নববী, আল-আযকার, পৃ. ৩৩৫; ইবনুল জাওযী, বাহরুদ দুমূ‘, পৃ. ১২৫।
[18]. ইবনু মাজাহ হা/৩৪৩৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/২৯১, সনদ ছহীহ।
[19]. আছ-ছাম্তু, পৃ. ১৩০।
[20]. ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাতি ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ২১।
[21]. শামসুদ্দীন সাফ্ফারীনী, গিযাউল আলবাব, ১/১০৫
[22]. আছ-ছাম্তু, পৃ. ১৭১।
[23]. ইবনু আব্দিল বার, বাহজাতুল মাজালিস, পৃ. ৮৬।
[24]. বুখারী হা/১৯০৩; মিশকাত হা/১৯৯৯।
[25]. আতিয়্যাহ মুহাম্মাদ সালিম, শারহে বুলূগুল মারাম, ৭/১৪৭।
[26]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১।
[27]. ইবনু হাজার আসকালানী, ফাৎহুল বারী ৪/১০৪।
[28]. মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক্ব, ৫/৪৮।
[29]. মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক্ব, ৪/৩০৭।
[30]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১২০; ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ, ২/৭৬।
[31]. হান্নাদ ইবনে সির্রী, কিতাবুয যুহ্দ, ২/৫৭২।
[32]. সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১৬৬।
[33]. আবূদাঊদ হা/৪৮৮০; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৮৪; ছহীহ।
[34]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩৮, সনদ ছহীহ।
[35]. আওনুল মা‘বূদ ১৩/২২৪।
[36]. হায়তামী, আয-যাওয়াজির ২/৯।
[37]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম ১/২২৫।
[38]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭।
[39], ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাহ ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ৪৭।
[40]. আবূদাঊদ হা/৪৮৭৮; মিশকাত হা/৫০৪৬, সনদ ছহীহ।
[41]. আওনুল মা‘বূদ ১৩/১৫৩।
[42]. আবূদাঊদ হা/৪৮৮৩, সনদ হাসান।
[43]. আবূদাঊদ হা/৩৫৯৭; মুস্তাদরাকে হাকেম হা/২২২২, হাদীছ ছহীহ।
[44]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ৬/২৩৬৭।