সুন্নাতের পরিচয়
সুন্নাতের শাব্দিক অর্থ : সুন্নাত (سُّنَّةُ) শব্দটি আরবী, যা سَّنَّ)) থেকে নির্গত। এর অর্থ সীরাত ও চলার পথ, তা ভাল হোক অথবা মন্দ। এর ভিত্তি হ’ল যেমন তারা বলে থাকে, আমি রেত দিয়ে কোন কিছুকে আঘাত করলাম অর্থাৎ সেটিকে তার উপর ঘষা দিয়ে অতিক্রম করালাম, যেন তাতে আঘাতের ছাপ ফেলে বা রাস্তা তৈরী করে।
বলা হ’য়ে থাকে, এর অর্থ- চলমান। সুতরাং আমরা যদি বলি, সুন্নাত; তাহ’লে এর অর্থ হবে, চলমান রাখার নির্দেশনা। যেমন তারা বলে থাকে, আমি পানিকে চলমান রেখেছি, তথা তা পর্যায়ক্রমে ঢেলেছি।[1]
আবুল হাসান ইবনে ফারিস বলেন, সুন্নাত অর্থ- ধারাবাহিকতা তথা কোন কিছুকে সহজেই চালু রাখা এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এখান থেকেই বলা হয়, সুন্নাত। তা হ’ল, সীরাত। আর রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত হ’ল তাঁর সীরাত।
সুন্নাত নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে, তা চলমান। এজন্য বলা হ’য়ে থাকে, তুমি তোমার সুন্নাত মোতাবেক চল। বাতাস চলমান রয়েছে, যদি তা একইভাবে প্রবাহিত হয়।[2]
সুন্নাত শব্দটি শারঈ বিভিন্ন দলীলেও বর্ণিত হয়েছে, যেখানে এর দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয় প্রশংসনীয় পথ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يُرِيدُ اللهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ، ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য (হালাল-হারাম) ব্যাখ্যা করে দিতে চান এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের (সুন্দর) রীতি সমূহের প্রতি তোমাদের পথ প্রদর্শন করতে চান ও তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/২৬)।
আবার সুন্নাত দ্বারা মন্দ পথও বুঝানো হ’য়ে থাকে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا لأَنَّهُ كَانَ أَوَّلَ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ ‘যদি কোন ব্যক্তি মাযলূম হ’য়ে খুন হয়, তবে তার সে খুনের একাংশ (পাপ) আদম (আঃ)-এর পুত্র (ক্বাবীল)-এর উপর বর্তায়। কেননা সেই সর্বপ্রথম খুনের প্রচলন করেছিল’।[3]
হুযালী খালিদ বিন যুহাইর বলেন,فَلَا تَجْزَعَنْ مِنْ سُنَّةٍ أَنْتَ سِرْتَهَا- فَأَوَّلُ رَاضٍ سُنَّةً مَنْ يَسِيْرُهَا. ‘যে রীতির প্রচলন আপনি করেছেন তাতে নিজেই অস্থির হবেন না। কেননা কোন রীতির প্রতি সে-ই প্রথম সন্তুষ্ট ব্যক্তি, যে সেটার প্রচলন করে’।[4]
কোন কোন দলীলে সুন্নাতের দু’টি অর্থই একত্রে এসেছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ سَنَّ فِي الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَه،ُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ-
‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন সুন্দর রীতি চালু করল এবং পরবর্তী কালে সে অনুসারে আমল করা হ’ল, তাহ’লে আমলকারীর সমান প্রতিদান তার জন্য লিখা হবে। এতে তাদের প্রতিদানে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতি চালু করল এবং তারপরে সে অনুযায়ী আমল করা হ’ল, তাহ’লে ঐ আমলকারীর সমান গুনাহ তার জন্য লিখা হবে। এতে তাদের পাপ সামান্য হ্রাস হবে না’।[5]
সুন্নাতের পারিভাষিক অর্থ :
فَهِيَ مَا أَمَرَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَهَى عَنْهُ، وَنَدَبَ إِلَيْهِ قَوْلًا وَفِعْلًا مِمَّا لَمْ يَنْطِقْ بِهِ الْكِتَابُ الْعَزِيْزُ-
‘তা হ’ল এমন বিষয়, যা নবী করীম (ছাঃ) করতে আদেশ করেছেন ও যা থেকে নিষেধ করেছেন এবং কথা ও কর্ম দ্বারা এর প্রতি তিনি উৎসাহিত করেছেন, যে বিষয়ে মহিমান্বিত কিতাব বলেনি’। এজন্য শরী‘আতের দলীলগুলি সম্পর্কে বলা হয়, কিতাব ও সুন্নাত। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছ।[6]
যেমন নবী করীম (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তাঁর ইবাদতকে কম মনে করা তিনজন ব্যক্তিকে তিনি বলেন,
أَنْتُمْ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لأخْشَاكُمْ للهِ، وَأَتْقَاكُمْ لَه، لَكِنِّي أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي-
‘তোমরা কি ঐসব লোক, যারা এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশী অনুগত। অথচ আমি ছিয়াম পালন করি, আবার তা থেকে বিরতও থাকি। ছালাত আদায় করি এবং নিদ্রাও যাই। নারীদেরকে বিবাহ করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ হবে, তারা
আমার দলভুক্ত নয়’।[7]
ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘এখানে সুন্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, তরীক্বা বা পথ। এটা দ্বারা ফরযের বিপরীত কিছু উদ্দেশ্য নয়। আর কোন কিছু থেকে বিমুখ হওয়ার অর্থ, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। অর্থাৎ যে আমার পথ পরিত্যাগ করে অন্য কোন পথ গ্রহণ করল, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়। তথা আমার পথের উপরে নেই’।[8]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,السُّنَّةُ هِيَ مَا كَانَ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابُهُ اِعْتِقَادًا وَاقْتِصَادًا وَقَوْلًا وَعَمَلًا- ‘সুন্নাত হ’ল, রাসূল (ছাঃ), তাঁর ছাহাবীগণ আক্বীদা, মধ্যমপন্থা, কথা ও কর্মগত দিক দিয়ে যার উপরে ছিলেন’।[9]
তিনি আরোও বলেন, সালাফের বক্তব্যে সুন্নাত শব্দটি দ্বারা ইবাদত ও আক্বীদার ক্ষেত্রে সুন্নাতকে বুঝানো হয়। যদিও তাঁদের অনেকেই সুন্নাত বিষয়ে গ্রন্থ সংকলন করে তা দ্বারা আক্বীদাকে উদ্দেশ্য করেছেন। এটি ইবনে মাসঊদ, উবাই বিন কা‘ব ও আবূ দারদা (রাঃ)-এর কথার ন্যায়اِقْتِصَادٌ فِيْ سُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ اجْتِهَادٍ فِيْ بِدْعَةٍ، ‘সুন্নাত পালনে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা বিদ‘আত পালনে ইজতেহাদ করার চেয়ে উত্তম’।[10]
আবার সুন্নাতকে বিদ‘আতের বিপরীতে উল্লেখ করা হয়। যেমন বলা হয়, অমুক সুন্নাতের অনুসারী, যখন সে নবী করীম (ছাঃ)-এর আমল অনুযায়ী আমল করে। চাই তা কিতাবে বর্ণিত হোক অথবা না হোক। তেমনি বলা হয়, অমুক বিদ‘আতী, যখন সে সুন্নাতের বিপরীতে আমল করে।[11]
অনুরূপভাবে সুন্নাত দ্বারা ছাহাবীগণের আমলকেও বুঝানো হয়, তা কিতাবে অথবা সুন্নাতে বর্ণিত হোক অথবা না হোক। যেহেতু তা তাদের নিকট সাব্যস্ত সুন্নাত অনুসরণে আমল করা হয়েছে, যা আমাদের নিকট পৌঁছেনি। অথবা সে বিষয়ে তাঁদের সম্মিলিত ইজতেহাদের মাধ্যমে অথবা তাদের খলীফাগণের মাধ্যমে তা সাব্যস্ত হয়েছে।[12]
এরপর যখন বিভিন্ন বিষয়ক ইলম প্রকাশ পেল এবং পরিভাষা বিশেষজ্ঞরা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তখন সুন্নাতকে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার শুরু হল প্রত্যেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞের উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে। আহ্লেহাদীছরা সুন্নাত বলতে বুঝান, مَا أُضِيْفَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ أَوْ صِفَةٍ خَلْقِيَّةٍ أَوْ خُلُقِيَّةٍ، وَكَذَا أَيَّامُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম, সম্মতি অথবা চারিত্রিক বা সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর সময়কাল’।
তাদের অনেকের নিকট সুন্নাত হাদীছের সমার্থবোধক শব্দ। অনেক ঊছূলবিদের নিকটও অনুরূপ।[13] ঊছূলবিদদের মতে সুন্নাত বলতে বুঝায়,مَا أُضِيْفَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ مِمَّا يَصْلُحُ أَنْ يَكُوْنَ دَلِيْلًا لِحُكْمٍ شَرْعِيٍّ- ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম, সম্মতি যা শারঈ বিধানের দলীল হওয়ার উপযুক্ত’।[14]
ফক্বীহদের নিকটে সুন্নাত বলতে বুঝায়,الْفِعْلُ الْمَطْلُوْبُ طَلَبًا غَيْرَ جَازِمٍ، وَهُوَ الَّذِيْ يُثَابُ فَاعِلُهُ، وَلَا يُعَاقَبُ تَارِكُهُ- ‘এমন সব কর্ম যা করতে বলা হয়েছে, তবে জোরালোভাবে নয়। যার কর্তা ছওয়াব পায় কিন্তু পরিত্যাগকারী শাস্তিযোগ্য হয় না’।[15]
সুন্নাতের পারিভাষিক অর্থে এমন ইখতেলাফের কারণ হ’ল, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ বিদ্বানগণ স্ব স্ব ইলমের অর্থ ও উদ্দেশ্যের সাথে মিল রেখে এটিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা। যেমন হাদীছ বিশারদগণ রাসূল (ছাঃ)-কে একজন সুপথপ্রদর্শক ইমাম, যাকে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা উত্তম আদর্শ ও নমুনা বলে জানিয়েছেন, এ সকল বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা রাখে রাসূল (ছাঃ)-এর এমন সব বিষয়ে তারা গবেষণা করেন। যেমন তাঁর সীরাত, মর্যাদা, খবর, কথা ও কর্ম; তা দ্বারা শারঈ কোন হুকুম সাব্যস্ত হোক অথবা না হোক।
ঊছূলবিদগণ রাসূল (ছাঃ)-কে একজন শরী‘আত প্রবক্তা, যিনি তাঁর পরবর্তী মুজতাহিদদের জন্য মূলনীতি রেখে গেছেন এবং মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বর্ণনা করেন, সে হিসাবে তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন। সেজন্য তারা তাঁর কথা, কর্ম, সম্মতি যা আহকাম সাব্যস্ত করে ও নির্ধারণ করে এসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
ফক্বীহগণ রাসূল (ছাঃ)-এর এই দিকটি নিয়ে গবেষণা করেছেন যে, তাঁর কর্মসমূহ শারঈ বিধানের দলীল। তাই তারা বান্দাদের কর্মগুলি ওয়াজিব, হারাম অথবা বৈধ ইত্যাদি হওয়ার ক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে গবেষণা করেন।[16]
নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত সম্পর্কে জানার গুরুত্ব :
আল্লাহ আমাদের রব। তিনি সর্বজ্ঞ। তিনি কোন কিছুকেই অনর্থক সৃষ্টি করেননি এবং তাদেরকে অহেতুক ছেড়েও দেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ، فَتَعَالَى اللهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيْمِ، ‘তোমরা কি ভেবেছিলে যে, আমরা তোমাদেরকে বৃথা সৃষ্টি করেছি এবং ভেবেছিলে যে, তোমাদেরকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না? অতএব মহামহিম আল্লাহ যিনি যথার্থ অধিপতি। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি মহান আরশের মালিক’ (মুমিনূন ২৩/১১৫-১১৬)।
তিনি আরও বলেন,وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَاطِلًا ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَوَيْلٌ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنَ النَّارِ- ‘আমরা আকাশ, পৃথিবী ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী কোন কিছুকে বৃথা সৃষ্টি করিনি। এটি হ’ল কাফেরদের ধারণা মাত্র। অতএব কাফেরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ’ (ছোয়াদ ৩৮/২৭)।
সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার বিষয়ে তাঁর অন্যতম হিকমত হ’ল, তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীস্থাপন করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ- ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। তিনি আরোও বলেন,وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لِيَجْزِيَ الَّذِيْنَ أَسَاءُوْا بِمَا عَمِلُوا وَيَجْزِيَ الَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا بِالْحُسْنَى، ‘নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। যাতে তিনি অসৎ কর্মীদের প্রতিফল এবং সৎকর্মীদের উত্তম প্রতিদান দিতে পারেন’ (নাজম ৫৩/৩১)।
আর আল্লাহর ইবাদত করার কোন রাস্তা নেই তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো পদ্ধতি ব্যতীত, যিনি তাঁর শরী‘আতের মুবাল্লিগ। সেজন্য তিনি তাকে কিতাব দান করেছেন, তাকে হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি জাগ্রত জ্ঞান সহকারে মানুষকে সেদিকে দাওয়াত দিয়েছেন। উম্মতের জন্য জানা আবশ্যক এমন সবকিছুই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কোন কিছুই বাকী রাখেননি। যেসব বিষয় পরিত্যাগ করা আবশ্যক এমন সবকিছু সম্পর্কেই তিনি তাদেরকে সতর্ক করেছেন। এভাবেই দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا، ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।
ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَجُلاً مِنَ الْيَهُودِ قَالَ لَهُ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، آيَةٌ فِي كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا لَوْ عَلَيْنَا مَعْشَرَ الْيَهُودِ نَزَلَتْ لاَتَّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا قَالَ أَىُّ آيَةٍ قَالَ (الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا) قَالَ عُمَرُ قَدْ عَرَفْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ وَالْمَكَانَ الَّذِي نَزَلَتْ فِيهِ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ قَائِمٌ بِعَرَفَةَ يَوْمَ جُمُعَةٍ-
‘জনৈক ইহুদী তাকে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা আপনারা পাঠ করে থাকেন, তা যদি আমাদের ইহুদী জাতির উপর নাযিল হ’ত, তাহ’লে অবশ্যই আমরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসাবে পালন করতাম। তিনি বললেন, কোন আয়াত? সে বলল,الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا، ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩) এই আয়াতটি। ওমর (রাঃ) বললেন, এটি যে দিনে এবং যে স্থানে নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছিল তা আমরা জানি। তিনি সেদিন আরাফায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর দিনটি ছিল জুম‘আর দিন’।[17]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, এই উম্মতের জন্য এটাই আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় নে‘মত যে, তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছেন। সুতরাং তারা এই দ্বীন ব্যতীত অন্য কোন দ্বীনের মুখাপেক্ষী নয়। তারা তাদের নবী ব্যতীত অন্য কোন নবীরও মুখাপেক্ষী নয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাকে সর্বশেষ নবী করেছেন। তাকে মানব ও জিন সকলের জন্য প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তিনি যা হালাল করেছেন তা ব্যতীত কোন হালাল নেই। আর তিনি যা হারাম করেছেন তা ব্যতীত কোন হারাম নেই। তিনি যে শরী‘আত দিয়েছেন তা ব্যতীত কোন দ্বীন নেই। তিনি যা কিছু বলেছেন সবই হক ও সত্য। তাতে মিথ্যার লেশ মাত্র নেই, নেই কোন অসঙ্গতি।
যখন তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছেন, তখন তাদের জন্য নে‘মতও পরিপূর্ণ হয়েছে। কেননা সেটা তো এমন মহান দ্বীন, যাকে আল্লাহ তা‘আলা পসন্দ করেছেন, সেটাকে ভালোবেসেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূলকে সেই দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং এর জন্য সর্বোত্তম কিতাব নাযিল করেছেন। আসবাত্ব সুদ্দী হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘এই আয়াতটি আরাফাতের দিন নাযিল হয়েছে। এরপর আর কোন হালাল ও হারাম বিধান নাযিল হয়নি। রাসূল (ছাঃ) ফিরে এসে মারা যান’।
আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,تَرَكَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا طَائِرٌ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا عِنْدَنَا مِنْهُ عِلْمٌ. ‘রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে এমন অবস্থায় রেখে গেছেন যে, কোন পাখি তার দুই ডানার সাহায্যে উড়লে তাও আমরা জানতাম’।[18]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাতের মাধ্যমে পূর্ণ করেছেন। তার উম্মতের সকলের উপর এ দু’টি মেনে চলা আবশ্যক করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (হাশর ৫৯/৭)।
সুতরাং রাসূল (ছাঃ) কিতাব ও সুন্নাতের যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই মেনে চলা আমাদের উপর আবশ্যক। তার অনুসরণ করা আমাদের উপর ওয়াজিব। এ দু’টি ইসলামী শরী‘আতের এমন উৎস যার একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যা বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। এমনভাবে সংযুক্ত, যা আলাদা হওয়ার নয়। সুতরাং কিতাবের সাথে সুন্নাতের বন্ধন খুবই দৃঢ়। পরস্পরে সম্পর্ক খুবই মযবূত। তাই আপনি সুন্নাতকে দেখতে পাবেন, কুরআনে যা আছে তার বিশদ বর্ণনা করছে অথবা তারই গুরুত্ব বর্ণনা করছে বা তার সংক্ষিপ্ত বিধানকে বিস্তারিত আকারে বর্ণনা করছে কিংবা তার ‘মুত্বলাক’কে ‘মুক্বাইয়াদ’ করছে অথবা ‘আম’কে ‘খাছ’ করছে বা দুর্বোধ্য বিষয়কে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করছে।
এমনকি কুরআনে সুস্পষ্ট বলা নেই এমন শারঈ বিষয় তাতে পেয়ে যাবেন। অনুরূপ উম্মতের উপর তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক করা হয়েছে। যদি হালাল হয়, তাহ’লে সেটাকে হালালই মনে করতে হবে। যদি হারাম হয়, তাহ’লে সেটাকে হারামই গণ্য করতে হবে। যদি সাব্যস্ত খবর হয়, তাহ’লে সেটিকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আর এটাই হলো মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে আল্লাহর রাসূল এই সাক্ষ্যদানের পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُتَوَشِّمَاتِ، وَالْمُتَنَمِّصَاتِ، وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ، الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ، قَالَ: فَبَلَغَ امْرَأَةً فِي الْبَيْتِ، يُقَالُ لَهَا: أُمُّ يَعْقُوبَ، فَجَاءَتْ إِلَيْهِ، فَقَالَتْ: بَلَغَنِي أَنَّكَ قُلْتَ كَيْتَ وَكَيْتَ؟ فَقَالَ: مَا لِي لَا أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ؟ فَقَالَتْ: إِنِّي لَأَقْرَأُ مَا بَيْنَ لَوْحَيْهِ، فَمَا وَجَدْتُهُ، فَقَالَ: " إِنْ كُنْتِ قَرَأْتِيهِ، فَقَدْ وَجَدْتِيهِ، أَمَا قَرَأْتِ: {ومَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا} [الحشر: 7] قَالَتْ:بَلَى، قَالَ: فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْهُ.
‘আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐ সমস্ত নারীর প্রতি, যারা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে, নিজেদের শরীরে উল্কি অঙ্কন করায়। যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রূ উপড়িয়ে ফেলে ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। সেসব নারী আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি আনয়ন করে। এরপর বণী আসাদ গোত্রের উম্মু ইয়াকূব নামের এক মহিলার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে সে এসে বলল, আমি জানতে পারলাম, আপনি এ ধরনের মহিলাদের প্রতি লা‘নত করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যার প্রতি লা‘নত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লা‘নত করা হয়েছে, আমি তার প্রতি লা‘নত করব না কেন? তখন মহিলা বলল, আমি দুই ফলকের মাঝে যা আছে তা (পূর্ণ কুরআন) পড়েছি। কিন্তু আপনি যা বলেছেন, তা তো এতে পাইনি। আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, যদি তুমি কুরআন পড়তে, তাহ’লে অবশ্যই তা পেতে। তুমি কি পড়নি যে, (আল্লাহ বলেছেন) রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)। মহিলাটি বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পড়েছি। তখন আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বললেন, রাসূল (ছাঃ) এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন’।[19]
সেজন্য প্রত্যেক মুসলমানের উপর নবীর সুন্নাতের জ্ঞানার্জন করা ও তা বুঝা আবশ্যক। বরং জ্ঞানার্জন, পানাহার, বাসস্থান, পোষাক ও সকল জীবিকার প্রয়োজনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তার দুই পাজরের মাঝখানের রূহের প্রয়োজনের চেয়েও বেশী প্রয়োজন। কেননা রূহ ব্যতীত সে মারা যেতে পারে। কিন্তু সুন্নাত ব্যতীত তাকে চিরস্থায়ী হতভাগা হয়ে থাকতে হবে।
এক: সুন্নাত আঁকড়ে ধরা রবের সন্তুষ্টি অর্জন, জান্নাত লাভ এবং তাঁর শাস্তি থেকে নাজাতের মাধ্যম :
এমর্মে আল্লাহর কিতাবে সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। যেমন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য আল্লাহর রহমত অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১৩২)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ-
‘আর মুমিন পুরুষ ও নারীগণ পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’ (তওবা ৯/৭১)।
তেমনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ক্বিয়ামতের দিন সফলতা ও মহাবিজয় লাভের মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ-
‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হ’তে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম। আর এরাই হ’ল সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হ’তে বেঁচে থাকে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১-৫২)।
আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন, وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا، ‘আর যে ব্যক্তি আললাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে মহা সাফল্য অর্জন করে’ (আহ্যাব ৩৩/৭১)।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِنَّ لِكُلِّ شَيْءٍ شِرَّةً وَلِكُلِّ شِرَّةٍ فَتْرَةً فَإِنْ كَانَ صَاحِبُهَا سَدَّدَ وَقَارَبَ فَارْجُوهُ وَإِنْ أُشِيرَ إِلَيْهِ بِالأَصَابِعِ فَلاَ تَعُدُّوهُ ‘সকল কাজের পিছনে থাকে প্রেরণা ও উদ্দীপনা। আর প্রত্যেক উদ্দীপনার পিছনেই লুকিয়ে থাকে অলসতা ও কর্মবিমুখতা। কাজেই যে লোক সোজা পথে চলে এবং নিজেকে মাঝামাঝি পর্যায়ে সোজাভাবে অবিচল রাখতে পারে, সে সাফল্য লাভের আশা করতে পারে। আর যদি তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা হয় (লোক দেখানো আমল করে) তাহ’লে তাকে সফলকাম ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য কর না’।[20]
এসবই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য জান্নাতে প্রবেশ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম। এমর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদী সমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন,
وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا-
‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’ল সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যা করতে বলেছেন তা করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করল, আল্লাহ তাকে তাঁর সম্মানজনক বাসস্থানে প্রবেশ করাবেন ও তাকে নবীগণের সাহচর্য দান করবেন। অতঃপর মর্যাদায় তাদের পরের স্তরে যারা রয়েছেন তাদেরও সাহচর্য দান করবেন। যেমন ছিদ্দীক্বগণ, এরপর শহীদগণ, এরপর সকল মুমিনগণ, তারা হ’লেন, সৎকর্মপরায়ণ বান্দাগণ যাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল আমল সঠিক হয়েছে।[21]
এ বিষয়ে নবীর সুন্নাতও বহন করে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَثَلِي كَمَثَلِ رَجُلٍ اسْتَوْقَدَ نَارًا فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهَا جَعَلَ الْفَرَاشُ وَهَذِهِ الدَّوَابُّ الَّتِي فِي النَّارِ يَقَعْنَ فِيهَا وَجَعَلَ يَحْجُزُهُنَّ وَيَغْلِبْنَهُ فَيَتَقَحَّمْنَ فِيهَا قَالَ فَذَلِكُمْ مَثَلِي وَمَثَلُكُمْ أَنَا آخِذٌ بِحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ هَلُمَّ عَنِ النَّارِ هَلُمَّ عَنِ النَّارِ فَتَغْلِبُونِي تَقَحَّمُونَ فِيهَا-
‘আমার দৃষ্টান্ত সে লোকের মত যে আগুন জ্বালিয়েছিল। যখন তার চতুষ্পার্শ আলোকিত হ’ল, তখন পতঙ্গ ও সেসব জন্তু যা আগুনে পড়ে থাকে, তাতে পড়তে লাগল। আর সে লোক সেগুলিকে বাঁধা দিতে লাগল। তবে এরা তাকে হারিয়ে দিয়ে তাতে ঢুকে পড়তে লাগল। তিনি বললেন, এটাই হ’ল তোমাদের ও আমার অবস্থা। আমি আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমরবন্ধগুলি ধরে টানি ও বলি যে, আগুন হ’তে দূরে থাক, আগুন থেকে দূরে থাক। অথচ তোমরা আমাকে পরাস্ত করে তার মধ্যে ঢুকে পড়ছ’।[22]
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَثَلِي وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ أَوْقَدَ نَارًا فَجَعَلَ الْجَنَادِبُ وَالْفَرَاشُ يَقَعْنَ فِيهَا وَهُوَ يَذُبُّهُنَّ عَنْهَا وَأَنَا آخِذٌ بِحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ وَأَنْتُمْ تَفَلَّتُونَ مِنْ يَدِي- ‘আমার ও তোমাদের উপমা সেই ব্যক্তির উপমার মত, যে আগুন জ্বালাল, ফলে ফড়িং ও পতঙ্গ তাতে ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। আর সে লোক সেগুলিকে তা থেকে বিতাড়িত করতে লাগল। আমিও আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর বন্ধ ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ’।[23]
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّمَا مَثَلِي وَمَثَلُ مَا بَعَثَنِي اللهُ بِهِ كَمَثَلِ رَجُلٍ أَتَى قَوْمًا فَقَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي رَأَيْتُ الْجَيْشَ بِعَيْنَيَّ وَإِنِّي أَنَا النَّذِيرُ الْعُرْيَانُ فَالنَّجَاءَ فَأَطَاعَهُ طَائِفَةٌ مِنْ قَوْمِهِ فَأَدْلَجُوا فَانْطَلَقُوا عَلَى مَهَلِهِمْ فَنَجَوْا وَكَذَّبَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ فَأَصْبَحُوا مَكَانَهُمْ فَصَبَّحَهُمْ الْجَيْشُ فَأَهْلَكَهُمْ وَاجْتَاحَهُمْ فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ أَطَاعَنِي فَاتَّبَعَ مَا جِئْتُ بِهِ وَمَثَلُ مَنْ عَصَانِي وَكَذَّبَ بِمَا جِئْتُ بِهِ مِنْ الْحَقِّ.
‘আমার ও আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হ’ল এমন যে, এক লোক কোন এক সম্প্রদায়ের কাছে এসে বলল, হে কওম! আমি নিজের চোখে সেনাবাহিনীকে দেখে এসেছি। আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী। কাজেই তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কর। কওমের কিছু লোক তার কথা মেনে নিল। সুতরাং তারা রাতের প্রথম প্রহরে সে স্থান ছেড়ে রওনা হ’ল এবং একটি নিরাপদ জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ফলে তারা রক্ষা পেল। তাদের মধ্যকার আরেক দল লোক তার কথাকে মিথ্যা মনে করল। ফলে তারা নিজেদের জায়গাতেই রয়ে গেল। সকাল বেলায় শত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালাল এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিল ও উৎপাটিত করে দিল। এটাই হ’ল তাদের উদাহরণ যারা আমার আনুগত্য করে এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে। আর যারা আমার কথা অমান্য করে তাদের দৃষ্টান্ত হ’ল আমি যে সত্য নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে’।[24]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى، ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে কিন্তু যে অস্বীকার করবে সে ব্যতীত। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে অস্বীকার করবে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে,
আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকার করবে’।[25]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘একদল ফেরেশতা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসল। তিনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তাদের কেউ কেউ বলল, তিনি ঘুমিয়ে আছেন। কেউ কেউ বলল, তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত, কিন্তু অন্তর জাগ্রত। তখন তারা বলল, তোমাদের এই সাথীর একটি উদাহরণ আছে। সুতরাং তাঁর উদাহরণ তোমরা বর্ণনা কর। তখন তাদের কেউ বলল, তিনি তো ঘুমন্ত। আবার কেউ বলল, তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত, তবে অন্তর জাগ্রত। তখন তারা বলল, তাঁর উদাহরণ হ’ল সেই লোকের মত, যে একটি বাড়ী তৈরী করল। তারপর সেখানে খানার আয়োজন করল এবং একজন আহবানকারীকে (লোকদের ডাকতে) পাঠাল। যারা আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিল, তারা ঘরে প্রবেশ করে খানা খাওয়ার সুযোগ পেল। আর যারা আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিল না, তারা ঘরেও প্রবেশ করতে পারল না এবং খানাও খেতে পারল না।
ফেরেশতারা বলল, উদাহরণটির ব্যাখ্যা করো, যাতে তিনি বুঝতে পারেন। তখন কেউ বলল, তিনি তো ঘুমন্ত। আবার কেউ বলল, তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত, কিন্তু অন্তর জাগ্রত। তখন তারা বলল, ঘরটি হ’ল জান্নাত, আহবানকারী হ’লেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করল, তারা আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা করল, তারা আল্লাহরই অবাধ্যতা করল’।[26] সুতরাং ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ অর্থাৎ তিনি খাবারের মালিকের রাসূল। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর আহবানে সাড়া দিল, তাঁর দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত হ’ল, সে খাবার খেল। এতে জান্নাতে প্রবেশের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে’।[27] (ক্রমশঃ)
মূল : ড. আব্দুল্লাহ বিন ঈদ আল-জারবূঈ
শিক্ষক, মদীনা ইসলামী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
পিএইচ. ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/১৭২১; তাহ্যীবুল লুগাত ১২/২৯৮; লিসানুল আরব ১৩/২২০; জুরজানী, তা‘রীফাত ১৬১ পৃ:; ইরশাদুল ফুহূল, ১/৯৫।
[2]. মাক্বাইসুল লুগাত ১/৫৪৯-৫৫০।
[3]. বুখারী হা/১০৩/৭৩২১; মুসলিম হা/১৩০৩, ১৬৭৭।
[4]. লম্বা পংক্তির অংশবিশেষ। জাওহারী এটিকে হুযালীর বলে উল্লেখ করেছেন, আছ-ছিহাহ ৫/১৭২১।
[5]. মুসলিম হা/২০৫৯/১০১৭।
[6]. নিহায়াহ ফী গারীবিল আছার ২/৪০৯ পৃ:।
[7]. বুখারী হা/৩/৫০৬৩; মুসলিম হা/১০২০/১৪০১।
[8]. ফাতহুল বারী ৯/৭-৮।
[9]. মাজমূ ফাতাওয়া ৫/১১১।
[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/১৭৮।
[11]. মুওয়াফাক্বাত ৪/৪।
[12]. মুওয়াফাক্বাত ৪/৪।
[13]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া ১৮/৬-৭; ইরশাদুল ফুহূল, ৩৩পৃ:; ফাতহুল মুগীছ ১/১৪-১৫, ২১।
[14]. ইহকাম, আমেদী ১/২২৩।
[15]. কাওকাবুল মুনীর ১/৪০২; আনীসুল ফুক্বাহা ৩২পৃ:; হাশিয়াতুল আত্ত্বার ১/১২৭।
[16]. আস-সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা মিনাত তাশরী‘ইল ইসলামী ৬৭ পৃ:।
[17]. বুখারী হা/৪৫; মুসলিম হা/৩০১৭।
[18]. ছহীহ ইবনে হিববান, হা/২৬৭/৬৫। আবূ হাতিম বলেছেন, এর অর্থ: রাসূল (ছাঃ)-এর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ, খবর, কর্ম এবং তিনি যা কিছু হালাল করেছেন সবই আমরা জানতাম’। ইহসান ফী তাক্বরীবে ছহীহ ইবনে হিববান, শু‘আইব আরনাঊত্ব, ১/২৬৭- অনুবাদক।
[19]. মুসনাদে আহমাদ হা/৪১২৯।
[20]. তিরমিযী হা/২৪৫৩।
[21]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ২/৩৫৩।
[22]. বুখারী হা/৬৪৮৩; মুসলিম হা/২২৮৪।
[23]. মুসলিম হা/২২৮৫।
[24]. বুখারী হা/৬৪৮২; মুসলিম হা/৭২৮৩।
[25]. বুখারী হা/৭২৮০।
[26]. বুখারী হা/৭২৮১।
[27]. ফাতহুল বারী ১৩/২৭০।