ইমারতে
আহলেহাদীছ ছাদেকপুর, পাটনার আমীর, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত
ছাদিকপুরী পরিবারের কৃতীসন্তান, প্রখ্যাত আলেম মাওলানা সাইয়িদ আব্দুস
সামী‘ জা‘ফরী গত ৪ঠা অক্টোবর রবিবার দিবাগত রাত ১০-টা ৪৫ মিনিটে পাটনার
শ্রী রাম হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন।
পরের দিন সকাল সাড়ে ১০-টায় সানীচারা ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত তাঁর ১ম
জানাযায় ইমামতি করেন তাঁর পুত্র নায়েবে আমীর মাওলানা গাযী ইছলাহী। অতঃপর
মীর শিকারটোলী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ২য় জানাযা শেষে যোহরের ছালাতের পর
মসজিদের পিছনে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। হাযার হাযার মুসলমান
তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
এক্সিডেন্টে নিতম্বের হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়ায় তিনি কয়েক বছর যাবৎ শয্যাশায়ী
ছিলেন এবং মৃত্যুর ১ মাস পূর্বে তাঁকে শ্রী রাম হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়েছিল। কয়েদিন যাবৎ তিনি অচেতন ছিলেন। এমনিতেই তিনি হালকা-পাতলা গড়নের
ছিলেন। তদুপরি ভাইয়ের হত্যা ও মেয়েদের মৃত্যু শোকে তিনি আরো কৃশকায় হয়ে
গিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ১ বিধবা মেয়ে, ৩ ছেলে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী
রেখে গেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
মাওলানা আব্দুস সামী‘ জা‘ফরী ১৯৩৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ছাদিকপুর (মীর শিকারটোলী), পাটনায় ঐতিহ্যবাহী মুজাহিদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা আব্দুল খবীরের কাছে শিক্ষার হাতে খড়ি হওয়ার পর তাঁর তত্ত্বাবধানেই মাদরাসা ইছলাহুল মুসলিমীন (পাথরের মসজিদ) থেকে তিনি ফারেগ হন। এরপর দারুল উলূম নাদওয়াতুল ওলামা, লাক্ষ্ণৌ থেকে সাহিত্যে ‘তাখাছছুছ’ ডিগ্রী অর্জন করেন। ইছলাহুল মুসলিমীন মাদরাসায় (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৩০৮ হিঃ, প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুর রহীম ছাদিকপুরী) শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। অতঃপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ করে সঊদী সরকারের পক্ষ থেকে নাইজেরিয়াতে দাঈ হিসাবে প্রেরিত হন এবং আড়াই বছর জামা‘আতে নুছরাতুল ইসলাম (প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আবুবকর লোমী, বাদশাহ ফায়ছাল পুরস্কারপ্রাপ্ত)-এর তত্ত্বাবধানে নাইজেরিয়ার কাদূনা শহরে দাওয়াতী ও তাবলীগী খিদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন। সেখানে তিনি কাদিয়ানীদের সাথে বাহাছ-মুনাযারা, নওমুসলিমদেরকে শিক্ষাদান এবং উক্ত জামা‘আত প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসায় শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। সেখানকার আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি পুনরায় সঊদী আরবে ফিরে আসেন এবং মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে চাকুরীতে নিয়োজিত হন। সঊদী আরবে অবস্থানকালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি জামা‘আতে আহলেহাদীছ-এর আমীর নির্বাচিত হন। অতঃপর জামা‘আতে আহলেহাদীছ, পাটনার পীড়াপীড়িতে তিনি ১৯৯৪ সালে ভারতে চলে আসেন এবং মাদরাসা ইছলাহুল মুসলিমীন-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাদিকপুর, পাটনায় অবস্থিত পৈত্রিক নিবাসের বিক্রয়লব্ধ পুরা অর্থ তিনি এ মাদরাসা নির্মাণে ব্যয় করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি জামে‘আ ইছলাহিয়া সালাফিইয়ায় উন্নীত হয়।
সঊদী আরব থেকে ফিরে আসার পর তিনি জীবনের বাকী সময়টুকু শিক্ষকতা, দাওয়াত, তাবলীগ ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্যয় করেন। তিনি একজন উঁচুদরের আলেম, নির্ভীক দাঈ, খ্যাতিমান শিক্ষক, খতীব, বাগ্মী এবং নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন দানশীলতা, উদারতা, সরলতা ও বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক। মানুষজন অত্যন্ত আগ্রহভরে তাঁর বক্তব্য শুনত। বিশেষ করে ঝাড়খন্ড ও বাংলা অঞ্চলে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখত। দাওয়াতী কাজে তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। পাটনার সকল মসজিদে জুম‘আর খুৎবার জন্য তিনি নিজেই খতীব নিযুক্ত করতেন। তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি যা সত্য মনে করতেন তা খোলাখুলি প্রকাশ করতেন।নিজের ভুল বুঝতে পারলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা শুধরে নিতেন। আবুল কালাম আযাদ ইসলামিক এ্যাওয়েকিনিং সেন্টার, নয়া দিল্লীর তিনি অন্যতম ট্রাস্টি ছিলেন। তিনি পাটনায় মারিয়াম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
একটি শিক্ষণীয় ঘটনা :
সঊদী আরব থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলে মাওলানা আব্দুস সামীর অনেক বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী তাঁকে নিষেধ করেন। তিনি নিজেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন যে, আয়েশী জীবন ছেড়ে ভারতে থাকতে পারবেন কি-না? তিনি বলেন, ‘আমি একদিন আমার কামরা বন্ধ করি। এসি অফ রাখি। বিছানা-তোষক আলাদা করে চাদরের উপর ঘুমাই। বালিশের জায়গায় ইট রাখি। তাতে আমার ঘুম চলে আসলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে, আমি ভারতে গিয়ে কাজ করতে পারব’। এরপর তিনি ভারতে চলে আসেন। যার ধমনীতে বইছে জিহাদী রক্তের উত্তরাধিকার। তিনি দ্বীনের জন্য আয়েশী জীবন ত্যাগ করতে পারবেন না তাকি হয়?
ছাদিকপুরী পরিবারের ঐতিহ্য :
বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক বেলায়াত আলী (১৭৯০-১৮৫২) ও মাওলানা এনায়েত আলীর (১৭৯২-১৮৫৮) স্মৃতিধন্য ছাদিকপুরী পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি অসাধারণ নাম, একটি অনন্য ইতিহাস। ১৮৩১ সালে বালাকোট বিপর্যয়ের পর জিহাদ আন্দোলনের সার্বিক নেতৃত্ব পাটনা আযীমাবাদের ছাদিকপুরী পরিবারের উপরে পড়ে। আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের যোগ্যতম নেতৃত্বে বাংলাদেশ হ’তে সীমান্ত পর্যন্ত সমগ্র উপমহাদেশ জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মৃত্যুর পরে তাঁদের উত্তরসুরীগণ জিহাদের আগুন তাজা রাখেন, সীমান্তে যা বৃটিশ রাজত্বের জন্য একটা স্থায়ী ভীতি হিসাবে বিরাজ করে।[1] এই পরিবারের কৃতীপুরুষ মাওলানা আব্দুস সামী‘ জা‘ফরীর পিতা মাওলানা আব্দুল খবীর বিন মাওলানা আব্দুল হাকীম ভারত স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সীমান্তে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের শেষ সিপাহসালার ছিলেন। তিনি উঁচুদরের আলেম ও মুত্তাক্বী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জামা‘আতে আহলেহাদীছের আমীর ছিলেন।[2] সূরা ফাতিহার তাফসীর তাঁর অনন্য কীর্তি।[3] তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মাওলানা আব্দুস সামী‘ আমীর হন এবং আমৃত্যু এ গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা
আব্দুল খবীরের দাদা মাওলানা আহমাদুল্লাহ ছাদিকপুরী ও নানা মাওলানা আব্দুর
রহীম ছাদিকপুরী বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আম্বেলা ষড়যন্ত্র
মামলার আসামী হিসাবে ১৮৬৪ সালে আন্দামানে নির্বাসিত হন। ব্রিটিশ সরকার
তাদের সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করা ছাড়াও সমস্ত ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে
দেয়। ভিটা উচ্ছেদ করে সেখানে লাঙল চালানো হয়। মাওলানা ফারহাত হুসাইনসহ
ছাদিকপুরী পরিবারের বুযর্গ ব্যক্তিদের কবরস্থান সমান করে সেখানে হিন্দু
হরিজনদের শূকর পোষার আখড়া এবং শহরের পায়খানা ফেলার গাড়ী রাখার জায়গা বানানো
হয়। কিছু অংশে মহিলাদের মীনাবাজার বসানো হয়। বাকী অংশে এখন
মিউনিসিপ্যালিটির বিল্ডিংসমূহ নির্মিত হয়েছে। অথচ এখানেই একদিন সারা ভারতের
মুক্তির জন্য জিহাদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ হ’ত। জান্নাতের মজলিস সমূহ সদা
গুলযার থাকত। যাদের রেখে যাওয়া জিহাদের খুনরাঙা পথ ধরে আসে ১৮৫৭-এর সিপাহী
বিদ্রোহ ও ১৯৪৭-এর ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন। মাওলানা আহমাদুল্লাহ ‘ভাইপার’
(Viper island) দ্বীপে ১৮৮১ সালের ২১শে নভেম্বরে অবর্ণনীয় কষ্ট ও
নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাওলানা বেলায়েত আলীর
ভাতীজা মাওলানা আবদুর রহীম বিন ফারহাত হুসাইন দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর পর
মুক্তি পেয়ে ১৮৮৩ সালের মার্চে পাটনায় ফিরে আসেন। কিন্তু সেখানে তখন তাঁর
ঐতিহাসিক জমিদার পরিবারের বাস্ত্তভিটার চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার মত অবস্থা
পর্যন্ত ছিল না। তাঁর পরিবার তখন ‘নান্মূহিয়া’ (ننموهيه) মহল্লাতে থাকেন।
তিনি সেখানে শেষ জীবনের দুঃখময় দিনগুলি কাটান এবং ছাদিকপুরী পরিবারের
একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলীল ‘আদ-দুররুল মানছূর’ ওরফে ‘তায্কেরায়ে
ছাদেক্বাহ’ রচনা করেন। ১৩৪১/১৯২৩ সালের ২৫শে জুলাই ৯২ বছর বয়সে তিনি সেখানে
মৃত্যুবরণ করেন।[4]
বালাকোটের ময়দানে সাইয়িদ
আহমাদ ও শাহ ইসমাঈল-এর শাহাদত বরণের পর শতাধিক বছর ব্যাপী ছাদিকপুরী
পরিবার ভারতের স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, সে সম্পর্কে
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘যদি দেশের
স্বাধীনতার জন্য পেশকৃত ত্যাগগুলিকে দাড়ির এক পাল্লায় রাখা হয় এবং
ছাদিকপুরের আলেমদের ত্যাগগুলি অন্য পাল্লায় রাখা হয়, তাহ’লে ছাদিকপুরী
আলেমদের ত্যাগের পাল্লা ভারী হবে’।[5]
Central Bharat Sevak Samaj-এর চেয়ারম্যান স্বামী হরিনারায়নন্দ (M. Swami Harinarayananand) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ছাদিকপুরী পরিবারের ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের কথা স্মরণ করে (who have historically participated in the freedom struggle against the British Rule) তাদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে বলেন, Their patriotism and the high spirit of devotion to motherland is well known. ‘তাঁদের দেশপ্রেম এবং জন্মভূমির প্রতি তীব্র অনুরাগ সুবিদিত’।
তিনি আরো বলেন, This is high time that
the contributions and sacrifices of freedom fighters particularly
Ulemas of Sadiquepur should be remembered to inspire the new generation
for inculcating the spirit of national unity, communal harmony,
emotional unity and truth and non-violence. ‘নতুন প্রজন্মের মধ্যে জাতীয়
ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সংহতি, আবেগভরা একতা, সত্য ও অহিংস চেতনার উন্মেষ ঘটাতে
মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে ছাদিকপুরী আলেমগণের অবদান ও ত্যাগসমূহ স্মরণ
করার এখনই উপযুক্ত সময়’।[6]
শ্রী গৌরগোবিন্দ
সিং কলেজ, পাটনার সাবেক অধ্যক্ষ মেজর বলবীর সিং বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে,
ঊনবিংশ শতকে রায়ব্রেলীর জনাব সাইয়িদ আহমাদ স্বাধীনতার যে পতাকা উড্ডীন
করেছিলেন, তাকে আমাদের ছাদিকপুর ঘরানার জনাব বেলায়াত আলী ও এনায়েত আলী
দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন। এটা ঠিক যে, এই কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য তাদেরকে
দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের সবকিছু নিঃশেষ করেও
তারা স্বাধীনতার প্রদীপকে উজ্জ্বল রাখেন। এটা গর্বের কথা যে, এই স্বাধীনতার
প্রদীপে তেল দেয়ার জন্য জনাব ইয়াহইয়া আলী ও জনাব আহমাদুল্লাহ নিজেদের সকল
সম্পত্তি উৎসর্গ করেছিলেন।[7]
মোদ্দাকথা,
পাক-ভারত উপমহাদেশকে গোলামীর শৃংখল হ’তে মুক্ত করার জন্য এবং একই সাথে
কুরআন ও হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য দিল্লীর
অলিউল্লাহ পরিবার ও তার পরে পাটনার ছাদিকপুরী পরিবারের যে অবিস্মরণীয় অবদান
রয়েছে, ভারতবর্ষে তার তুলনা নেই। এ বিষয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর
আমীর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ
আসাদুল্লাহ আল-গালিব বলেন, ‘জিহাদ আন্দোলন ও আহলেহাদীছ আন্দোলন একই সাথে
চালাতে গিয়ে একদিকে বৃটিশ শাসনশক্তির নিষ্ঠুরতম আচরণ, জেল-যুলুম, ফাঁসি,
সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, আন্দামান ও কালাপানির লোমহর্ষক
নির্যাতন, অপরদিকে প্রতিবেশী ঈর্ষাকাতর আলেমদের ও তাদের অন্ধ অনুসারীদের
প্রদত্ত অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও ভূমিকম্পসদৃশ মুছীবতসমূহ হাসিমুখে বরণ করে
নেওয়ার মাধ্যমে ছাদিকপুরী পরিবার যে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছে, তা
ভবিষ্যতের যে কোন আদর্শবাদী মুজাহিদের জন্য স্থায়ী প্রেরণার উৎস হয়ে
থাকবে’।[8]
১৯৯৫ সালে রিয়াদ সফরকালে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের সাথে মাওলানা আব্দুস সামী‘-এর সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর ১৯৯৮ সালের ২৮ ও ২৯শে এপ্রিল তিনি ছাদেকপুর সফর করেন। সেখানে তিনি তাদের বর্তমান মারকায পরিদর্শন করেন এবং তাঁকে তাদের সদ্য প্রকাশিত সুভ্যেনির ১৪১৯ হিঃ/১৯৯৮ ও অন্যান্য প্রকাশনাসমূহ উপহার দেওয়া হয়। এ সময় আমীরে জামা‘আত তাঁর ডক্টরেট থিসিসের একটি কপি পাটনা খোদাবকশ লাইব্রেরীতে উপহার দেন। সেদিন তিনি তাদের কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছাদেকপুরী পরিবারের নামে পাটনা ছাদেকপুর ইউনিভার্সিটি রাখা উচিত। তাহ’লেই এই মহান পরিবারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হবে।
শায়খ আব্দুল হামীদ আযহারের মৃত্যু
গত ১৪ই নভেম্বর ২০১৫ পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ইসলামাবাদের শায়খুল হাদীছ মাওলানা আব্দুল হামীদ আযহার মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি ৩ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পাঞ্জাবের কাছূর যেলায় জন্মগ্রহণ করেন। জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া, গুজরানওয়ালা এবং জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ফয়ছালাবাদ থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গমন করেন। সেখানে শায়খ বিন বায, মুহাম্মাদ আমীন শানক্বীতীর মত বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীনের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি শরী‘আহ অনুষদ থেকে লিসান্স ডিগ্রী লাভ করেন এবং দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর সঊদী মাবঊছ হিসাবে জামে‘আ তাদরীসুল কুরআন ওয়াল হাদীছ, রাওয়ালপিন্ডিতে (পরে মাদরাসাটি ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হয় এবং জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ইসলামাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে) যোগদান করেন এবং অত্যন্ত সুনামের সাথে আমৃত্যু এখানেই শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন। তাঁর খ্যাতিমান ছাত্রদের মধ্যে শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল এবং পিএইচ.ডির ভাইভায় তাঁকে এক্সটার্নাল হিসাবে আহবান করা হ’ত। তিনি পয়গাম টিভির নিয়মিত আলোচক ছিলেন। বক্তব্যের পাশাপাশি লেখনীর ময়দানেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। দেশে-বিদেশে তাঁর ছিল লাখো শুভানুধ্যায়ী। রাওয়ালপিন্ডির মুসলিম টাউনের ফুটবল গ্রাউন্ডে তাঁর জানাযায় বিশ-পঁচিশ হাযার মানুষ উপস্থিত হন। দূর-দূরান্ত থেকে বহু আলেম-ওলামা উপস্থিত হন। জানাযায় ইমামতি করেন জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ফয়সালাবাদের শায়খুল হাদীছ শায়খ মাসঊদ আলম।
[আমরা মাওলানা আব্দুস সামী‘ ও আব্দুল হামীদ আযহার-এর মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং তাঁদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সাথে তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।- সম্পাদক]
[1]. আহলেহাদীছ আন্দোলন (পিএইচ.ডি. থিসিস), পৃঃ ৩১৩।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩১৫।
[3]. কুরআন মাজীদ কী তাফসীরেঁ চৌদাশো বরস মেঁ (পাটনা : খোদাবখশ ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরী, ১৯৯৫ খ্রিঃ), পৃঃ ৩১৬-৩১৭।
[4]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩১৪।
[5]. পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৫/২০ সংখ্যা, ১৬-৩১ অক্টোবর ২০১৫, পৃঃ ৩৭।
[6]. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাদিকপুরী আলেমগণের অবদান স্মরণে ১৯৯৮ সালের ২৮ ও ২৯শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী কনফারেন্স উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে প্রদত্ত ‘বাণী’ দ্রঃ।
[7]. ঐ।
[8]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ডক্টরেট থিসিস, পৃঃ ৩১৫।