পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।
ভূমিকা :
মানব
জীবনে সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সম্পদ বিনে ছোট্ট একটি পরিবার
পরিচালনাও দুঃসাধ্য। সেকারণ প্রত্যেক বনু আদমকেই প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের
জন্য আয়-রোযগারের পথ অবলম্বন করতে হয়। আল্লাহ বলেন, فَإِذَا قُضِيَتِ
الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ
وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ- ‘যখন ছালাত শেষ হবে
তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর, আর অধিক পরিমাণে
আল্লাহ্কে স্মরণ কর, যেন তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (জুম‘আ ৬২/১০)।
রাসূল (ছাঃ) নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যকে উত্তম খাদ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ
مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ
كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ- ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম
খাদ্য কেউ কখনো খায় না। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতে উপার্জন করে
খেতেন’।[1] শুধু দাঊদ (আঃ) নন অন্যান্য নবী-রাসূলগণও নিজ হাতে উপার্জন
করতেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا بَعَثَ اللهُ نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الْغَنَمَ
فَقَالَ أَصْحَابُهُ وَأَنْتَ فَقَالَ نَعَمْ كُنْتُ أَرْعَاهَا عَلَى
قَرَارِيْطَ لأَهْلِ مَكَّةَ- ‘আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি
যিনি বকরী চরাননি। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ
আমিও কয়েক ক্বিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম’।[2]
সুতরাং মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে ধন-সম্পদ। এর প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এর উপার্জন ও ব্যয়-বণ্টনে সীমালংঘনের পরিণতিও ভয়াবহ। আলোচ্য নিবন্ধে সম্পদ উপার্জনে ইসলামের বিধান এবং এক্ষেত্রে সীমালংঘনের বিভিন্ন দিক ও এর পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-
ধন-সম্পদ ফিৎনা:
দুনিয়ার
সবচেয়ে বড় ফিৎনা হচ্ছে ধন-সম্পদ। সম্পদের কারণেই মানুষ মানুষকে খুন করছে।
স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, ভাই-ভাইয়ে মারামারি, প্রতিবেশীর সাথে দ্বন্দ্ব,
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে সম্পদ।
সম্পদের মাধ্যমে মানুষ জান্নাত লাভ করতে পারে। আবার এর অপব্যবহারের ফলে সে
জাহান্নামের ইন্ধন হবে। সম্পদ তাই বাস্তবিকই এক মহা ফিৎনা। এ কথা স্মরণ
করিয়ে দিয়েই মহান আল্লাহ বলেন,وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ
وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيْمٌ- ‘জেনে
রেখ! নিশ্চয়ই তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সন্তানরা হচ্ছে ফিৎনা বা
পরীক্ষা। আর আল্লাহর নিকটে রয়েছে মহা পুরস্কার’ (আনফাল ৮/২৮)।
কা‘ব বিন ‘ইয়ায (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ
فِتْنَةً وَفِتْنَةُ أُمَّتِى الْمَالُ- ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিৎনা
রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিৎনা হচ্ছে সম্পদ’।[3] তবে আল্লাহভীরু ব্যক্তির
জন্য তা কখনো ফিৎনা নয়। কেননা সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ধন-সম্পদ উপার্জন ও
বিলি-বণ্টন করে। দুনিয়ার জন্য দুনিয়া নয়, বরং আখেরাতের জন্য সে দুনিয়া
অর্জন করে। আল্লাহ বলেন, فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى- وَصَدَّقَ
بِالْحُسْنَى- فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও
আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে, অচিরেই আমরা তাকে
সরল পথের জন্য সহজ করে দিব’ (লায়ল ৯২/৪-৭)। যায়েদ বিন আসলাম (রাঃ)
বলেন, ‘সরল পথের জন্য’ অর্থ ‘জান্নাতের জন্য’। কেননা জান্নাতের পথই সরল পথ
বা ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’। আর এ পথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত।[4]
প্রাচুর্যের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর আশঙ্কা:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উম্মতের দরিদ্র হওয়াকে ভয় করতেন না বরং ধনী হওয়াকেই বেশী ভয় করতেন। কেননা ধনীরা সাধারণত প্রাচুর্যের মোহে দ্বীন-ধর্ম ভুলে যায়। দুনিয়ার প্রতি তারা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, মহান আল্লাহর নে‘মতকেই অস্বীকার করে বসে। যেমনটি বিগত যুগে সম্পদগর্বী কারূণের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। যাকে আল্লাহ এত অধিক পরিমাণে ধনভান্ডারের মালিক করেছিলেন, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল (ক্বাছাছ ২৮/৭৬)। যখন তার কওম তাকে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এর বিনিময়ে আখেরাতের গৃহ সন্ধান করার, অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করার এবং সীমালংঘন না করার উপদেশ দিলেন, তখন গর্বভরে কারূণ বলেছিল,إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ- ‘এই সম্পদ আমি আমার নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতেও শক্তিতে ছিল প্রবল এবং ধন-সম্পদে ছিল অধিক প্রাচুর্যময়। বস্ত্ততঃ অপরাধীদের তাদের পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৮)। ফলশ্রুতিতে কারূণের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসল। তার ধনভান্ডারসহ আল্লাহ তাকে ভূগর্ভে দাবিয়ে দিলেন। আল্লাহ বলেন,فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُوْنَهُ مِنْ دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِيْنَ- ‘অতঃপর আমরা কারূণ ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। তখন তার পক্ষে এমন কোন দলবল ছিল না, যারা আল্লাহর শাস্তি হ’তে বাঁচতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।
এভাবে
আল্লাহ সে যুগের শ্রেষ্ঠ ধনী আত্মঅহংকারী কারূণকে চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন
করে দিয়ে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল সম্পদগর্বীদের সাবধান করে দিলেন যে,
মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত কেবলমাত্র নিজ প্রজ্ঞা ও যোগ্যতা দিয়ে
সম্পদশালী হওয়া যায় না। আর অহংকার করে কেউ স্থায়ী হ’তে পারে না। কেননা
তিনিই হচ্ছেন সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী। তিনি কোন কিছু করার ইচ্ছা করলে
‘হও’ বললেই ‘হয়ে যায়’।[5]
আমর বিন আউফ
আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একবার আবূ ওবায়দাহ ইবনুল
জাররাহকে জিযিয়া আদায় করার জন্য বাহরাইনে পাঠালেন। অতঃপর তিনি বাহরাইন থেকে
প্রচুর মাল নিয়ে ফিরে আসলেন। আনছারগণ তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে ফজরের ছালাতে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে শরীক হ’লেন। যখন তিনি ছালাত পড়ে ফিরে যেতে
লাগলেন, তখন তারা তাঁর সামনে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে দেখে হেসে
বললেন, আমার মনে হয় আবূ ওবায়দাহ বাহরাইন থেকে কিছু মাল নিয়ে এসেছে, তোমরা
তা শুনেছ। তারা বলল, হ্যাঁ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তখন তিনি
বললেন,فَأَبْشِرُوْا وَأَمِّلُوْا مَا يَسُرُّكُمْ، فَوَاللهِ لاَ
الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ
عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ،
فَتَنَافَسُوْهَا كَمَا تَنَافَسُوْهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا
أَهْلَكَتْهُمْ- ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং তোমরা সেই আশা রাখ, যা তোমাদেরকে
আনন্দিত করবে। তবে আল্লাহর কসম! তোমাদের উপর দারিদ্র্য আসবে আমি এ আশঙ্কা
করছি না। বরং আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদেরও
পার্থিব জীবনে প্রশস্ততা আসবে আর তাতে তোমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেমন
তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অতঃপর তা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে, যেমন
তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[6]
একই মর্মে আবূ
সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) একদিন মিম্বরে বসলেন
এবং আমরা তাঁর আশেপাশে বসলাম। এ সময় তিনি বললেন,إِنِّىْ مِمَّا أَخَافُ
عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِى مَا يُفْتَحُ عَلَيْكُمْ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا
وَزِيْنَتِهَا ‘আমি তোমাদের জন্য যার আশঙ্কা করছি তা হ’ল এই যে, তোমাদের
উপরে দুনিয়ার শোভা ও তার সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে’।[7]
এমনকি তিনি তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর উম্মতের শিরকে লিপ্ত হওয়ার চাইতে বরং দুনিয়া অর্জনের প্রতিযোগিতাকেই বেশী ভয় করতেন। বিদায় হজ্জ শেষে মদীনায় ফিরে তিনি মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন,إِنِّىْ فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيْدٌ عَلَيْكُمْ، إنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّىْ وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّىْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ، وَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِى، وَلَكِنِّى أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا وزاد بعضهم: فَتَقْتَتَلُوْا فَتُهْلِكُوْا كَمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ- ‘আমি তোমাদের আগেই চলে যাচ্ছি এবং আমি তোমাদের উপরে সাক্ষ্যদানকারী হব। তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে ‘হাউযে কাওছারে’। আমি এখুনি আমার ‘হাউযে কাওছার’ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পৃথিবীর সম্পদরাজির চাবিসমূহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় নেই যে, আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তোমরা দুনিয়া অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তোমরা পরস্পরে লড়াই করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’।[8]
প্রিয় পাঠক! আমরা জানি, শিরক সবচেয়ে বড় পাপ। যে পাপ ক্ষমা করবেন না মর্মে কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন (নিসা ৪/৪৮)। এমনকি শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম হওয়ার কথাও বিঘোষিত হয়েছে (মায়েদা ৫/৭২)। অথচ আলোচ্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) শিরকের পাপে লিপ্ত হওয়ার চাইতে বরং দুনিয়া অর্জনের প্রতিযোগিতাকেই বেশী ভয় করেছেন। দুর্ভাগ্য যে, আমরা এ প্রতিযোগিতাই লাগামহীনভাবে করে চলেছি। দুনিয়া নিয়ে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে, দুনিয়ার মালিকের কথা বেমা‘লূম ভুলে গেছি। মনে হয় যেন দুনিয়াতে আমরা চিরকাল বেঁচে থাকব। অথচ দুনিয়ার জীবন নিতান্তই মূল্যহীন ও ক্ষণস্থায়ী। আর আখেরাতের জীবন হচ্ছে চিরস্থায়ী। আল্লাহ বলেন,بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى‘তোমরা দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক, অথচ আখেরাতের জীবনই কল্যাণকর ও চিরস্থায়ী’ (আ‘লা ৮৭/১৫-১৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوضَةٍ مَا سَقَى كَافِرًا مِنْهَا شَرْبَةَ مَاءٍ- ‘যদি আল্লাহর নিকটে দুনিয়ার মূল্য একটি মাছির ডানার সমপরিমাণ হ’ত, তাহ’লে তিনি কোন কাফেরকে দুনিয়াতে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না’।[9] দুনিয়ার সাথে আখেরাতের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِى الآخِرَةِ إِلاَّ مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ هَذِهِ- وَأَشَارَ يَحْيَى بِالسَّبَّابَةِ- فِى الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ، ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত ঐরূপ, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রে আঙ্গুল ডুবাল এবং দেখল যে, আঙ্গুলটি সমুদ্রের কতটুকু পানি নিয়ে ফিরেছে’।[10] অর্থাৎ সমুদ্রের পানির তুলনায় আঙ্গুলের সাথে আসা এক বা দু’ফোটা পানির সমপরিমাণ হচ্ছে সৃষ্টি হ’তে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার জীবন। আর সমুদ্রের বিশাল পানিরাশি, যার কোন শেষ নেই, তা হচ্ছে আখেরাতের জীবন।
আবু যার (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মদীনার কাল পাথুরে
যমীনে হাঁটছিলাম। এ সময় ওহোদ পাহাড় আমাদের সামনে পড়ল। তিনি বললেন, হে আবু
যার! আমি এতে খুশী নই যে, আমার নিকট এই ওহোদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকবে, আর এ
অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হবে অথচ তার মধ্য হ’তে একটি দীনারও আমার কাছে
অবশিষ্ট থাকবে না ঋণ আদায়ের জন্য অথবা আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এইভাবে
এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করা ব্যতীত। অতঃপর কিছু দূর এগিয়ে
তিনি বললেন, প্রাচুর্যের অধিকারীরাই ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে। অবশ্য ঐ
ব্যক্তি নয়, যে সম্পদকে এইভাবে এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে ব্যয় করে।
কিন্তু এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম’।[11] একই মর্মে আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَوْ كَانَ لِى مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا، مَا
يَسُرُّنِى أَنْ لاَ يَمُرَّ عَلَىَّ ثَلاَثٌ وَعِنْدِىْ مِنْهُ شَىْءٌ،
إِلاَّ شَىْءٌ أُرْصِدُهُ لِدَيْنٍ، ‘যদি আমার নিকট ওহোদ পাহাড় সমান সোনা
থাকত, তাহ’লে আমি এতে আনন্দিত হ’তাম যে, ঋণ পরিশোধের মত বাকী রেখে অবশিষ্ট
সম্পদ তিনদিন অতিবাহিত না হ’তেই আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলি’।[12]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَيْلٌ لِلْمُكْثِرِينَ إِلاَّ مَنْ قَالَ بِالْمَالِ هَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا أَرْبَعٌ عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ وَمِنْ قُدَّامِهِ وَمِنْ وَرَائِهِ. ‘দুর্ভোগ বিত্তবানদের জন্য। তবে তারা ব্যতীত যারা ধন-সম্পদ সম্পর্কে বলে, এইভাবে এইভাবে এইভাবে এইভাবে অর্থাৎ ডানে, বামে, সামনে ও পিছনে চারদিকে (ব্যয় কর)’।[13] অর্থাৎ সে তার সম্পদকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যথাযথভাবে ব্যয় করে। এভাবে বিভিন্ন হাদীছে রাসূল (ছাঃ) প্রাচুর্যের ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে ধনী হওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
প্রাচুর্যশীল ব্যক্তি দুনিয়ার বিলাসিতা ভুলে যাবে :
সম্পদশালী ব্যক্তি আখেরাতে ব্যর্থ হ’লে একবার জাহান্নামের সাক্ষাৎ ঘটলেই দুনিয়ার সকল প্রাচুর্য ও বিলাসিতা ভুলে যাবে। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يُؤْتَى بِأَنْعَمِ أَهْلِ الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ َيُصْبَغُ فِى النَّارِ صَبْغَةً ثُمَّ يُقَالُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ خَيْرًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ نَعِيْمٌ قَطُّ فَيَقُوْلُ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ وَيُؤْتَى بِأَشَدِّ النَّاسِ بُؤْسًا فِى الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيُصْبَغُ صَبْغَةً فِى الْجَنَّةِ فَيُقَالُ لَهُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ بُؤْسًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ شِدَّةٌ قَطُّ فَيَقُوْلُ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ مَا مَرَّ بِى بُؤُسٌ قَطُّ وَلاَ رَأَيْتُ شِدَّةً قَطُّ.
‘ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হ’তে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো কল্যাণ দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে? সে বলবে, না, আল্লাহর কসম হে প্রভু! অপরদিকে জান্নাতীদের মধ্য হ’তে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে ঢুকানোর পর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো কষ্ট দেখেছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ অতিক্রম করেছে? সে বলবে, না, আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কোন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি’।[14] অতএব অহংকারী বিলাসী দুনিয়াপূজারীরা সাবধান!
সম্পদ উপার্জনে ইসলামের বিধান :
সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক দু’টি শর্ত হচ্ছে হালাল হওয়া ও পবিত্র হওয়া। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِيْنٌ- ‘হে মানব জাতি! তোমরা পৃথিবী থেকে হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮)। মায়েদা ৮৮, আনফাল ৬৯ ও সূরা নাহল ১১৪ নম্বর আয়াতেও একই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এখানে খাদ্যের জন্য দু’টি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। হালাল হওয়া ও পবিত্র হওয়া। অতএব চুরি করা কলা পবিত্র হ’লেও তা হালাল নয়। অন্যদিকে নিজের গাছের পচা কলা হালাল হ’লেও পবিত্র নয় কিংবা হালাল টাকায় মদের ব্যবসাও জায়েয নয়।
আর কোন বস্ত্তর হালাল বা
হারাম হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর বিধানই চূড়ান্ত। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ
করেন,الْحَلاَلُ مَا أَحَلَّ اللهُ فِى كِتَابِهِ وَالْحَرَامُ مَا حَرَّمَ
اللهُ فِىْ كِتَابِهِ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ مِمَّا عَفَا عَنْهُ-
‘আল্লাহ তাঁর কিতাবে যেসব জিনিস হালাল করেছেন তা হালাল এবং আল্লাহ তাঁর
কিতাবে যেসব জিনিস হারাম করেছেন তা হারাম। আর যেসব জিনিস সম্পর্কে তিনি
নীরব থেকেছেন তা তিনি ক্ষমা করেছেন’।[15]
অপরদিকে হারাম খাদ্য খেয়ে জান্নাতে প্রবেশ অসম্ভব উল্লেখ করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نبَتَ مِنَ السُّحْتِ وَكُلُّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنَ السُّحْتِ كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ- ‘যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত স্থান’।[16] অন্যত্র তিনি বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ ‘ঐ দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে’।[17] অতএব উপার্জনের ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই হারাম বা অবৈধ পথ অবলম্বন করা যাবে না।
ধন-সম্পদে সীমালংঘন :
ধন-সম্পদে সীমালংঘন দু’ভাবে হ’তে পারে। (ক) সম্পদ উপার্জনে সীমালংঘন (খ) ব্যয়-বণ্টনে সীমালংঘন।
(ক) সম্পদ উপার্জনে সীমালংঘন :
সম্পদ উপার্জনে সীমালংঘনের বহু দিক রয়েছে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক ও এর পরিণাম তুলে ধরা হ’ল।-
১. সূদের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ: অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি আছেন, যারা সূদের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করেছেন। সূদ যে হারাম সে বিষয়ে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যে কোন প্রকারে অর্থ উপার্জনই এদের নিকটে মুখ্য, সম্পদ বৃদ্ধিই তাদের একমাত্র টার্গেট, বাড়ি-গাড়ী ও বিলাসিতাই তাদের ভূষণ। অথচ হারাম পন্থায় উপার্জিত এই সম্পদই আখেরাতে তার জাহান্নামের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ-
‘যারা সূদ ভক্ষণ করে, তারা
(ক্বিয়ামতের দিন) দাঁড়াতে পারবে না জিনে ধরা রোগীর ন্যায় ব্যতীত। এর কারণ
এই যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সূদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল
করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার নিকটে তার প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ
এসে গেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তার জন্য পিছনের সব গোনাহ মাফ। তার (তওবা
কবুলের) বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। কিন্তু যে ব্যক্তি পুনরায় সূদ খাবে,
তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
রাসূল (ছাঃ) সূদদাতা, সূদ গ্রহীতা, এর লেখক ও সাক্ষী সকলের উপর লা‘নত
করেছেন। হযরত জাবের (রাঃ) বলেন,لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ
سَوَاءٌ. ‘রাসূল (ছাঃ) সূদ গ্রহীতা, সূদদাতা, সূদ লেখক ও এর সাক্ষীদ্বয়কে
লা‘নত করেছেন এবং তিনি বলেন, এরা সকলে সমান (অপরাধী)’।[18]
সূদের
ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, دِرْهَمُ رِبَا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ
وَهُوَيَعْلَمُ أَشَدُّ مِن سِتَّةِ وَثَلاَثِيْنَ زِيْنَةً. ‘কোন ব্যক্তির
জেনে শুনে এক দিরহাম বা একটি মুদ্রা সমপরিমাণ সূদের উপার্জন ভক্ষণ করা
ছত্রিশ বার যেনা করার চেয়েও কঠিন (পাপ)’।[19]
আব্দুল্লাহ
বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,اَلرِّبَا ثَلَاثَةٌ
وَسَبْعُونَ بَابًا أَيْسَرُهَا مِثْلُ أَنْ يَنْكِحَ اَلرَّجُلُ أُمَّهُ
وَإِنَّ أَرْبَى اَلرِّبَا عِرْضُ اَلرَّجُلِ اَلْمُسْلِمِ ‘সূদের
তিয়াত্তরটি দরজা (স্তর) রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা ছোট হচ্ছে, কোন
ব্যক্তির তার মায়ের সাথে যেনা করার ন্যায়। আর কোন মুসলিম ভাইয়ের সম্মানের
ক্ষতিসাধন করা বড় ধরনের সূদ’।[20]
হযরত সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের ছালাত অন্তে আমাদের দিকে ফিরে বসতেন এবং বলতেন, তোমরা কেউ রাতে স্বপ্ন দেখেছ কি? কেউ দেখে থাকলে তিনি তার ব্যাখ্যা দিতেন। এভাবে একদিন তিনি বললেন, আমি আজ রাতে একটি স্বপ্ন দেখেছি, তোমরা শোন। অতঃপর তিনি বললেন, দু’জন লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে মাঠের মধ্যে দেখলাম যে, একজন লোক বসে আছে। পাশেই একজন লোক মাথা বাঁকানো ধারালো অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত সেটা দিয়ে চিরে দিচ্ছে। তাতে তার মুখমন্ডল দ্বিখন্ডিত হয়ে যাচ্ছে ও পুনরায় জোড়া লাগছে। এভাবে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত এবং বাম কান থেকে ডান কান পর্যন্ত ঐ অস্ত্র দিয়ে মুখমন্ডল চিরে দু’ভাগ করে দিচ্ছে। আর লোকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আমি বললাম, এ ব্যক্তির এই কঠিন শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চলুন।
এরপর আমরা কিছুদূর গিয়ে পেলাম একজন লোককে, যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আরেকজন দাঁড়ানো ব্যক্তি তার মাথায় পাথর মেরে তা চূর্ণ করে দিচ্ছে। অতঃপর লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনার অবসরে মাথাটি আবার পূর্বের ন্যায় ভাল অবস্থায় ফিরে আসছে। অতঃপর পুনরায় তা পাথর মেরে চূর্ণ করা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকটির এ শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চলুন।
এরপরে আমরা গেলাম মেঠে সদৃশ একটা বড় পাত্রের নিকটে। যার মুখ সরু এবং নীচের দিকে প্রশস্ত। পাত্রটির নীচে আগুন জ্বলছে। যার ভিতরে একদল উলংগ পুরুষ ও নারী। যারা আগুনের প্রচন্ড তাপে দগ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। আমি বললাম, এদের এরূপ শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চলুন।
এরপরে আমরা গেলাম একটা রক্তনদীর কাছে। যার মাঝখানে একজন লোক মাথা উঁচু করে আছে। আর নদীর তীরে একজন লোক পাথরের খন্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যখনই ঐ লোকটি সাঁতরে কিনারে উঠতে চাচ্ছে, তখনই তার মাথায় পাথর মেরে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটি এভাবে রক্তের নদীতে সাঁতরাচ্ছে। কিন্তু তীরে উঠতে পারছে না। যখনই সে কাছে আসছে তখনই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে। যা পুনরায় ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, লোকটির এ শাস্তি কেন হচ্ছে? জবাবে তারা বললেন, সামনে চলুন।
এবার কিছু দূর গিয়ে তারা বললেন, ১ম ব্যক্তি যার মুখ চিরা
হচ্ছিল, সে হ’ল মিথ্যাবাদী। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে।
২য় ব্যক্তি যার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছিল, ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ কুরআন শিক্ষা
দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তা ছেড়ে রাতে ঘুমাত এবং দিনের বেলায় সে অনুযায়ী আমল
করত না। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে। ৩য় ব্যক্তিরা
যাদেরকে মাথা সরু বড় পাত্রের মধ্যে দেখা গেছে, ওরা হ’ল ব্যভিচারী। ৪র্থ যে
ব্যক্তি রক্তনদীর মধ্যে সাঁতরাচ্ছে ও পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে,
ওটা হ’ল সূদখোর। ... এবারে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমরা হ’লাম
জিবরীল ও মীকাঈল। এবার তুমি মাথা উঁচু কর। আমি মাথা উঁচু করলাম। দেখলাম এক
খন্ড মেঘের মত বস্ত্ত। তারা বললেন, ওটাই তোমার বাসগৃহ। আমি বললাম, আমি
আমার বাসগৃহে প্রবেশ করব। তারা বললেন, তোমার বয়স পূর্ণ হওয়ার পর তুমি ওখানে
প্রবেশ করবে’।[21]
২. ওযনে কম দান ও প্রতারণামূলক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ : ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থোপার্জনের একটি বৈধ ও সম্মানজনক মাধ্যম। এই পবিত্র মাধ্যমকে কলুষিত করেছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। মিথ্যা, ভেজাল ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এরা ক্রেতাকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা লুটে নিচ্ছে। তাছাড়া ওযনে কম দেওয়ার প্রবণতাও নতুন নয়। যুগ যুগ ধরেই ব্যবসার সাথে এই অসাধুতা জড়িত। যা আরবদের মধ্যে ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ফলে কুরআন মাজীদে ব্যবসায় ওযনে কম দান সম্পর্কে একটি পৃথক সূরা নাযিল করে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল অসাধু ব্যবসায়ীকে সাবধান করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ- الَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ- وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ- أَلَا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوثُوْنَ- لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ- يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ- ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় বা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহা দিবসে, যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১-৬)।
আরবী
বাকরীতি অনুযায়ী وَيْلٌ অর্থ দুর্ভোগ বা ধ্বংস। এখানে وَيْلٌ-এর সাথে
يَوْمَئِذٍ যোগ হওয়ায় এর অর্থ হবে ‘জাহান্নাম’। কেননা ক্বিয়ামতের দিন
দুর্ভোগের একমাত্র পরিণাম হ’ল জাহান্নাম। মাপ ও ওযনে ইচ্ছাকৃতভাবে কম-বেশী
করে যারা, এটাই হবে তাদের পরকালীন পুরস্কার।[22]
অথচ আল্লাহ তা‘আলা মাপ ও ওযন সঠিকভাবে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ لاَ نُكَلِّفُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না’ (আন‘আম ৬/১৫২)। তিনি আরও বলেন,وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُواْ بِالقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيْمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً- ‘তোমরা মেপে দেয়ার সময় মাপ পূর্ণ করে দাও এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করো। এটাই উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে শুভ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৫)।
ওযনে
কম দিলে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস জানিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَمْسٌ بِخَمْسٍ:
مَا نَقَضَ قَوْمٌ الْعَهْدَ إِلاَّ سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوَّهُمْ
وَمَا حَكَمُوْا بِغَيْرِ مَا أَنْزَلَ اللهُ إِلاَّ فَشَا فِيْهِمُ
الْفَقْرُ وَمَا ظَهَرَتْ فِيْهِمُ الْفَاحِشَةُ إِلاَّ فَشَا فِيْهِمُ
الْمَوْتُ (أَوْ إِلاَّ ظَهَرَ فِيْهِمُ الطَّاعُوْنُ) وَلاَ طَفَّفُوا
الْمِكْيَالَ إِلاَّ مُنِعُوا النَّبَاتَ وَاُخِذُوْا بِالسِّنِيْنَ، وَلاَ
مَنَعُوا الزَّكَاةَ إِلاَّ حُبِسَ عَنْهُمُ الْمَطَرَ، ‘পাঁচটি বস্ত্ত
পাঁচটি বস্ত্তর কারণে হয়ে থাকে। ১. কোন কওম চুক্তিভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের
উপরে তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন। ২. কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের
বহির্ভূত বিধান দিয়ে দেশ শাসন করলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। ৩.
কোন সম্পদ্রায়ের মধ্যে অশ্লীল কাজ বিস্তৃত হ’লে তাদের মধ্যে মৃত্যু অর্থাৎ
মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। ৪. কেউ মাপে বা ওযনে কম দিলে তাদের জন্য খাদ্যশস্যের
উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। ৫. কেউ যাকাত
দেওয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়’।[23]
অপরদিকে
প্রতারণাকারীদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হচ্ছে- مَنْ
غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا وَالْمَكْرُ وَالْخِدَاعُ فِي النَّارِ ‘যে
ব্যক্তি আমাদেরকে ধোঁকা দেয়, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়। ধোঁকাবাজ ও
প্রতারক জাহান্নামী’।[24]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
একদিন একটি খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি ঐ স্তূপের মধ্যে
হাত ঢুকিয়ে দিলে তাঁর হাত ভিজে যায়। তিনি বিক্রেতাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে
বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তাহ’লে তুমি ভিজা
অংশটি উপরে রাখলে না কেন? মনে রেখ, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى ‘যে
প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[25]
দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে ব্যবসা মানেই যেন ভেজাল আর হারামের ছড়াছড়ি। খাদ্যে ভেজাল, গোশতে ভেজাল, মাছে ভেজাল, ফলমূলে ভেজাল, শাক-সবজিতে ভেজাল, এমনকি ঔষধেও ভেজাল। লোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে পবিত্র এ অঙ্গনটি যারপারনাই কলুষিত হয়ে পড়েছে। আর এই ভেজাল পণ্য খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এমনকি বিষ মিশানো এই সব খাদ্য খেয়ে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অকেজো হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। একজন মানুষকে সরাসরি হত্যার চাইতেও এটি আরো জঘন্য। অতএব ব্যবসায়ীরা সাবধান!
[চলবে]
[1]. বুখারী হা/২০৭২।
[2]. বুখারী হা/২২৬২; মিশকাত হা/২৯৮৩।
[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৯৪, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহা হা/৫৯২।
[4]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ৩০ তম পারা (হাফাবা: ৩য় মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৩), পৃ: ৩৩১।
[5]. বাক্বারাহ ২/১১৭; আলে ইমরান ৩/৪৭; ইয়াসীন ৩৬/৮২।
[6]. বুখারী হা/৩১৫৮; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।
[7]. বুখারী হা/১৪৬৫; মিশকাত হা/৫৯৫৭।
[8]. বুখারী ফাৎহুল বারী হা/৪০৪২-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮; দ্র: সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ৭৩০।
[9]. তিরমিযী হা/২৩২০; মিশকাত হা/৫১৭৭, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৮৬।
[10]. মুসলিম হা/২৮৫৮; তিরমিযী হা/২৩২৩; মিশকাত হা/৫১৫৬।
[11]. বুখারী হা/২৩৮৮।
[12]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৮৫৯।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪১২৯, সনদ হাসান; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪১২।
[14]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৬৬৯।
[15]. তিরমিযী হা/১৭২৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৬৭; মিশকাত হা/৪২২৮; সনদ হাসান।
[16]. আহমাদ, দারেমী, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৭৭২; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫১৯।
[17]. বায়হাক্বী, শু‘আব, মিশকাত হা/২৭৮৭; ছহীহাহ হা/২৬০৯।
[18]. মুসলিম হা/১৫৯৮; বুলূগুল মারাম হা/৮২৯।
[19]. আহমাদ, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/২৮২৫; বাংলা মিশকাত হা/২৭০১।
[20]. ইবনু মাজাহ হা/২২৭৫; হাকেম হা/২২৫৯; বুলূগুল মারাম হা/৮৩১।
[21]. বুখারী হা/১৩৮৬; মিশকাত হা/৪৬২১ ‘স্বপ্ন’ অধ্যায়।
[22]. তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, পৃ: ১৬০।
[23]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৭৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৪০।
[24]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫২০।
[25]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৮৬০।