পৃথিবীতে মানুষের আগমনের স্বাভাবিক মাধ্যম হচ্ছে পিতা-মাতা। এই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য অনেক। তাদের সাথে যেমন সদাচরণ করতে হবে, তেমনি তাদের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। সেই সাথে তাদের সাথে সর্বোচ্চ শিষ্টাচার বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا، ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না। তোমরা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর’ (নিসা ৪/৩৬)। তিনি আরো বলেন,أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيْرُ، ‘অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই’ (লোক্বমান ৩১/১৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا، ‘আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে অবশ্যই আমরা তাদেরকে সৎকর্মশীলদের মধ্যে প্রবেশ করাব (অর্থাৎ অন্যান্য সৎকর্মশীলদের সঙ্গে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব)’ (আনকাবূত ২৯/৯)। তাই পিতা-মাতার সাথে শালীন আচরণ করতে হবে। পিতা-মাতার সাথে যেসব আদব পালন করতে হয় সে সম্পর্কে আলোচ্য নিবন্ধে আলোচনা করা হ’ল।-
১. পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করা :
পিতা-মাতার মাধ্যমেই মানুষ দুনিয়াতে আসে এবং তারাই সন্তানকে শৈশবে অকৃত্রিম স্নেহে লালন-পালন করে। তারা শৈশবে প্রতিপালন না করলে কোন সন্তানেরই সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা সম্ভব হ’ত না। তাই তাদের সাথে আদবের অন্যতম দিক হচ্ছে তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। আল্লাহ বলেন,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيْرُ، ‘আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই’ (লোক্বমান ৩১/১৪)। হাদীছে এসেছে, আবু বুরদা (রহঃ) বলেন, তিনি ইবনে ওমর (রাঃ)-এর সাথে ছিলেন-
وَرَجُلٌ يَمَانِيٌّ يَطُوْفُ بِالْبَيْتِ حَمَلَ أُمَّهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ يَقُولُ: إِنِّي لَهَا بَعِيْرُهَا الْمُذَلَّلْ* إِنْ أُذْعِرَتْ رِكَابُهَا لَمْ أُذْعَرْ، ثُمَّ قَالَ: يَا ابْنَ عُمَرَ، أَتَرَانِي جَزَيْتُهَا؟ قَالَ:لَا، وَلَا بِزَفْرَةٍ وَاحِدَةٍ. ثُمَّ طَافَ ابْنُ عُمَرَ فَأَتَى الْمَقَامَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ قَالَ: يا ابْنَ أَبِيْ مُوْسَى، إِنَّ كُلَّ رَكْعَتَيْنِ تُكَفِّرَانِ مَا أَمَامَهُمَا،
‘ইয়ামনের এক ব্যক্তি তার মাকে তার পিঠে বহন করে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছিল ও বলছিল, ‘আমি তার জন্য তার অনুগত উটতুল্য ও আমি তার পা দানিতে আঘাতপ্রাপ্ত হ’লেও নিরুদ্বেগে তা সহ্য করি’। অতঃপর সে ইবনে ওমর (রাঃ)-কে বলল, আমি আমার মাতার প্রতিদান দিতে পেরেছি বলে কি আপনি মনে করেন? তিনি বলেন, না, তার একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও হয়নি। অতঃপর ইবনে ওমর (রাঃ) তাওয়াফ করলেন। তিনি মাকামে ইবরাহীমে পৌঁছে দুই রাক‘আত ছালাত পড়ার পর বলেন, হে আবু মূসার পুত্র প্রতি দুই রাক‘আত ছালাত পূর্ববর্তী পাপের কাফফারা’।[1]
২. তাদের সাথে নম্র ভাষায় কথা বলা এবং তাদেরকে আদবের সাথে ডাকা :
পিতা-মাতা প্রত্যেক মানুষের নিকটে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। তাদেরকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে এবং তাদের সাথে নম্র-ভদ্র আচরণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيْمًا، ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা কর না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহ’লে তুমি তাদের প্রতি উহ শব্দটিও বল না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে নরমভাবে কথা বল’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৩)।
তায়সালা ইবনে মায়্যাস (রহঃ) বলেন, আমি যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলাম। আমি কিছু পাপ কাজ করে বসি, যা আমার মতে কবীরা গুনাহের শামিল। আমি বিষয়টি ইবনে ওমর (রাঃ)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি? আমি বললাম, এই এই ব্যাপার। তিনি বলেন, এগুলো কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত নয়। কবীরা গুনাহ নয়টি- (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা (২) মানুষ হত্যা করা (৩) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা (৪) সতী-সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে যেনার মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (৫) সূদ খাওয়া (৬) ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা (৭) মসজিদে ধর্মদ্রোহী কাজ করা (৮) ধর্ম নিয়ে উপহাস করা এবং (৯) সন্তানের অসদাচরণ, যা পিতা-মাতার কান্নার কারণ হয়। ইবনে ওমর (রাঃ) আমাকে বলেন, তুমি কি জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি তাই চাই। তিনি বলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম, আমার মা জীবিত আছেন। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! তুমি তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বললে এবং তার ভরণপোষণ করলে তুমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদি কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাক’।[2]
৩. তাদের অনুমতি ব্যতীত সফর না করা :
পিতা-মাতা সর্বদা সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন। সন্তান কখনো তাদের চোখের আড়াল হ’লে তারা চিন্তিত থাকেন। এজন্য সন্তানের কর্তব্য হচ্ছে কোথাও গেলে তাদেরকে জানিয়ে এবং তাদের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে যাওয়া। এ মর্মে একটি হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَاسْتَأْذَنَهُ فِى الْجِهَادِ فَقَالَ أَحَىٌّ وَالِدَاكَ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَفِيْهِمَا فَجَاهِدْ- ‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে জিহাদে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তবে (তাদের খিদমতের মাধ্যমে) তাদের মধ্যে জিহাদের চেষ্টা কর’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَقْبَلَ رَجُلٌ إِلَى نَبِىِّ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أُبَايِعُكَ عَلَى الْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ أَبْتَغِى الأَجْرَ مِنَ اللهِ قَالَ فَهَلْ مِنْ وَالِدَيْكَ أَحَدٌ حَىٌّ قَالَ نَعَمْ بَلْ كِلاَهُمَا قَالَ فَتَبْتَغِى الأَجْرَ مِنَ اللهِ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا-
‘একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত ও জিহাদে অংশগ্রহণের বায়‘আত করতে চাই। এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে প্রতিদান কামনা করি। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাতা-পিতার কেউ কি জীবিত আছেন? উত্তরে সে বলল, হ্যাঁ, বরং উভয়েই। তখন তিনি বললেন, তুমি কি আল্লাহর নিকটে প্রতিদান কামনা কর? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি তখন বললেন, তুমি তোমার মাতা-পিতার নিকট ফিরে যাও এবং সর্বদা তাদের সাথে সদাচরণ কর’।[4]
৪. রাগান্বিত হয়ে তাদের মুখোমুখী না হওয়া :
পিতা-মাতার সাথে শালীনতা বজায় রাখার অন্যতম দিক হচ্ছে, তাদের সাথে রাগান্বিত হয়ে কখনও কথা না বলা। কেননা এতে তারা কষ্ট পায়। আর মনঃকষ্টের কারণে তারা সন্তানের বিরুদ্ধে কোন বদ দো‘আ করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ لاَ شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْوَالِدِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ- ‘তিন ব্যক্তির দো‘আ নিঃসন্দেহে কবুল হয়- ১. পিতা-মাতার দো‘আ, ২. মুসাফিরের দো‘আ, ৩. মযলূমের দো‘আ’।[5]
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইজ নামক একজন লোক ছিলেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তাঁর মা তাকে ডাকলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন না। তিনি বললেন, ছালাত আদায় করব, না কি তার জবাব দেব? তারপর মা তাঁর কাছে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! তাকে মৃত্যু দিও না যে পর্যন্ত তুমি তাকে কোন পতিতার মুখ না দেখাও। একদিন জুরাইজ তার ইবাদতখানায় ছিলেন। এমন সময় এক মহিলা বললেন, আমি জুরাইজকে ফাঁসিয়ে ছাড়ব। তখন সে তার নিকট গেল এবং তার সাথে কথাবার্তা বলল। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। তারপর সে মহিলা এক রাখালের কাছে এসে স্বেচ্ছায় নিজেকে তার হাতে সঁপে দিল। তার কিছুদিন পর সে একটি ছেলে প্রসব করল। তখন সে বলে বেড়াতে লাগল যে, এ ছেলে জুরাইজের! এ কথা শুনে লোকেরা জুরাইজের নিকট এল এবং তার ইবাদতখানা ভেঙ্গে তাকে বের করে দিল ও তাকে গালিগালাজ করল। এরপর তিনি (জুরাইজ) ওযূ করলেন এবং ছালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি ছেলেটির কাছে এসে বললেন, হে ছেলে! তোমার পিতা কে? সে জবাব দিল, রাখাল। তখন লোকেরা বলল, আমরা তোমার ইবাদতখানাটি সোনা দিয়ে তৈরী করে দিব। জুরাইজ বললেন, না মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও (যেমনটা পূর্বে ছিল)।[6] সুতরাং পিতা-মাতার সাথে রাগারাগি করা যাবে না এবং তাদের মনঃকষ্টের কারণ হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।
৫. পিতা-মাতার সেবা করা :
পিতা-মাতা সন্তানের একমাত্র আশ্রয়স্থল। তারাই শৈশবে সন্তানকে অকৃত্রিম যত্নে প্রতিপালন করেছে। তাই বড় হয়ে তাদের সেবা করা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, মু‘আবিয়াহ ইবনু জাহিমাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ جَاهِمَةَ جَاءَ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيرُكَ فَقَالَ هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَالْزَمْهَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا-
‘তাঁর পিতা জাহিমাহ নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি জিহাদে অংশগ্রহণের ইচ্ছা করছি, এজন্য আপনার সাথে পরামর্শ করতে এসেছি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা জীবিত আছেন কী? তিনি বললেন, জ্বী হ্যাঁ। তিনি বললেন, মায়ের সেবাকেই আবশ্যিক করে নেও। কেননা জান্নাত তাঁর পায়ের কাছে’।[7]
৬. পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে তাদের জন্য দো‘আ করা :
পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বরং তাদের মৃত্যুর পরে তাদের জন্য দো‘আ করা সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيْرًا، ‘বল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে ছোটকালে দয়াবশে প্রতিপালন করেছিলেন’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৪)। সুতরাং পিতা-মাতার প্রতি অন্যতম আদব হ’ল তাদের জন্য দো‘আ করা। যার ছওয়াব তারা কবরে বসেও পেতে থাকেন।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.
‘আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমলের সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের ছওয়াব বন্ধ হয় না। ১. ছাদাক্বায়ে জারিয়া। ২. এমন জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, ৩. নেক সন্তান, যে তার পিতা-মাতার জন্য দো‘আ করে’।[8] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِى الْجَنَّةِ فَيَقُولُ يَارَبِّ أَنَّى لِى هَذِهِ فَيَقُولُ بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ-
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে নেক বান্দার মর্যাদা উন্নত করেন। তখন সে বলে, হে রব! আমার এ (মর্যাদা) কিভাবে হ’ল? আল্লাহ বলেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে’।[9]
৭. তাদের মৃত্যুর পরে তাদের জন্য ছাদাক্বা করা :
পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করলে তাদের মাগফিরাতের জন্য দান-ছাদাক্বা করা তাদের সাথে শিষ্টাচারের অন্তর্গত। এই দানের ছওয়াব তারা কবরে বসে পাবেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها. أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم إِنَّ أُمِّى افْتُلِتَتْ نَفْسُهَا، وَأَظُنُّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ، فَهَلْ لَهَا أَجْرٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ-
‘আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললেন, আমার মায়ের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) কথা বলতে সক্ষম হ’লে কিছু ছাদাক্বা করে যেতেন। এখন আমি তাঁর পক্ষ হ’তে ছাদাক্বা করলে তিনি এর নেকী পাবেন কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ’।[10]
৮. পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের মুসলিম আত্মীয় ও বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা :
পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তাদের সাথে যেমন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তেমনি তাদের মৃত্যুর পরে তাদের মুসলিম বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথেও সুসম্পর্ক রাখতে হবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ إِذَا خَرَجَ إِلَى مَكَّةَ كَانَ لَهُ حِمَارٌ يَتَرَوَّحُ عَلَيْهِ إِذَا مَلَّ رُكُوبَ الرَّاحِلَةِ وَعِمَامَةٌ يَشُدُّ بِهَا رَأْسَهُ فَبَيْنَا هُوَ يَوْمًا عَلَى ذَلِكَ الْحِمَارِ إِذْ مَرَّ بِهِ أَعْرَابِىٌّ فَقَالَ أَلَسْتَ ابْنَ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ قَالَ بَلَى. فَأَعْطَاهُ الْحِمَارَ وَقَالَ ارْكَبْ هَذَا وَالْعِمَامَةَ قَالَ اشْدُدْ بِهَا رَأْسَكَ. فَقَالَ لَهُ بَعْضُ أَصْحَابِهِ غَفَرَ اللهُ لَكَ أَعْطَيْتَ هَذَا الأَعْرَابِىَّ حِمَارًا كُنْتَ تَرَوَّحُ عَلَيْهِ وَعِمَامَةً كُنْتَ تَشُدُّ بِهَا رَأْسَكَ. فَقَالَ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ مِنْ أَبَرِّ الْبِرِّ صِلَةَ الرَّجُلِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ بَعْدَ أَنْ يُوَلِّىَ. وَإِنَّ أَبَاهُ كَانَ صَدِيقًا لِعُمَرَ.
‘ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন তিনি মক্কা অভিমুখে রওনা হ’তেন তখন তাঁর সঙ্গে একটি গাধা থাকত। উটের সওয়ারীতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ক্ষণিক স্বস্তি লাভের জন্য তাতে আরোহণ করতেন। আর তাঁর সাথে একটি পাগড়ী থাকত, যা তিনি মাথায় বেঁধে নিতেন। একদা তিনি উক্ত গাধায় আরোহণ করে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশ দিয়ে একজন বেদুঈন অতিক্রম করছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অমুকের পুত্র অমুক নও? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি তাকে গাধাটি দিয়ে দিলেন এবং বললেন, এতে আরোহণ কর। তিনি তাকে পাগড়ীটিও দান করলেন এবং বললেন, এটি তোমার মাথায় বেঁধে নাও।
তখন তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ তাকে বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি এই বেদুঈনকে গাধাটি দিয়ে দিলেন, যার উপর সওয়ার হয়ে আপনি স্বস্তি লাভ করতেন এবং পাগড়ীটিও দান করলেন, যার দ্বারা আপনার মাথা বাঁধতেন। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার হ’ল কোন ব্যক্তির পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদ্ভাব রাখা। আর এই বেদুঈনের পিতা ছিলেন ওমর (রাঃ)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু’।[11]
৯. মৃত্যুর পরে তাদের কবর যিয়ারত করা :
পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে তাদের কবর যিয়ারত করা। এতে যেমন তাদের কথা স্মরণ হবে, তেমনি তাদের প্রতি কর্তব্য অন্তরে জাগরুক থাকবে। তাই তাদের কবর যিয়ারত করা এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত, যাতে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদেরকে জান্নাত দান করেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেন। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, زَارَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ فَقَالَ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّىْ فِىْ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِى وَاسْتَأْذَنْتُهُ فِىْ أَنْ أَزُوْرَ قَبْرَهَا فَأُذِنَ لِى فَزُوْرُوْا الْقُبُوْرَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ- ‘নবী করীম (ছাঃ) একবার নিজের মায়ের কবরে গেলেন। সেখানে তিনি নিজেও কাঁদলেন এবং তাঁর আশপাশের লোকদেরকেও কাঁদালেন। তারপর বললেন, আমি আমার মায়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলাম। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হ’ল না। তারপর আমি আমার মায়ের কবরের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হ’ল। তাই তোমরা কবরের কাছে যাবে। কারণ কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়’।[12]
১০. পিতা-মাতার নাম ধরে না ডাকা :
পিতা-মাতা সন্তানের নিকটে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। সুতরাং তাদেরকে সর্বদা সম্মান করা কর্তব্য। আর এমন কোন কাজ উচিত নয়, যাতে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। যেমন তাদের নাম ধরে ডাকা। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ أَبْصَرَ رَجُلَيْنِ. فَقَالَ لِأَحَدِهِمَا: مَا هَذَا مِنْكَ؟ فَقَالَ: أَبِيْ. فَقَالَ: لاَ تُسَمِّهِ بِاِسْمِهِ، وَلاَ تَمْشِ أَمَامَهُ، وَلاَ تَجْلِسْ قَبْلَهُ.
‘আবু হুরায়রা (রাঃ) দুই ব্যক্তিকে দেখে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করেন, ইনি তোমার কি হন? সে বলল, তিনি আমার পিতা। তিনি বলেন, তাকে নাম ধরে ডেকো না, তার আগে আগে চলো না এবং তার সামনে বসো না’।[13]
ওমর ইবনু যায়েদকে বলা হ’ল-كيف برُّ ابنك بك؟ قال : ما مشيت نهاراً قط إلا وهو خلفي، ولا مشيت ليلاً إلا مشى أمامي، ولا رقى سقفاً وأنا تحته، ‘আপনার ছেলে আপনার সাথে কিরূপ সদাচরণ করে? তিনি বলেন, আমি দিনে কখনো পথ চললে সে আমার পিছনে চলে। রাত্রে পথ চললে সে আমার সামনে চলে। আমি নীচে থাকলে সে ছাদে আরোহণ করে না’।
১১. নিজ পিতা-মাতা ব্যতীত অন্যকে পিতা-মাতা পরিচয় না দেওয়া :
পিতা-মাতা যে মানের ও মর্যাদার হোক না কেন কিংবা তাদের পেশা ও কর্ম যাই হোক না কেন তাদের পরিচয় গোপন করে অন্যকে পিতা-মাতা পরিচয় দেওয়া বৈধ নয়। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تَرْغَبُوْا عَنْ آبَائِكُمْ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ أَبِيهِ فَهُوَ كُفْرٌ- ‘তোমরা তোমাদের পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না (অর্থাৎ অস্বীকার করো না)। কারণ যে লোক নিজের পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় (অর্থাৎ পিতাকে অস্বীকার করে) তা কুফরী’।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ سَعْدٍ رضى الله عنه قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيْهِ، وَهْوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ غَيْرُ أَبِيْهِ، فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ-
সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে অন্যকে নিজের পিতা বলে দাবী করে অথচ সে জানে যে সে তার পিতা নয়, তার জন্য জান্নাত হারাম’।[15]
১২. তাদেরকে গালি দেওয়ার উপলক্ষ তৈরী না করা :
পিতা-মাতা অপমানিত হয় এমন কোন কাজ করা এবং যেসব কাজের কারণে তাদেরকে গালি দেওয়া হয় তদ্রূপ কোন কাজ করা যাবে না। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مِنَ الْكَبَائِرِ شَتْمُ الرَّجُلِ وَالِدَيْهِ قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ هَلْ يَشْتِمُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ قَالَ نَعَمْ يَسُبُّ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ وَيَسُبُّ أُمَّهُ فَيَسُبُّ أُمَّهُ-
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, কবীরা গুনাহসমূহের অন্যতম হ’ল নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেওয়া। তারা (ছাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! নিজের পিতা-মাতাকে কোন লোক কিভাবে গালি দিতে পারে? তিনি বললেন, সে অন্যের পিতাকে গালি দেয়, তখন সে তার পিতাকে গালি দেয় এবং সে অন্যের মাকে গালি দেয়, তখন সে তার মাকে গালি দেয়’।[16]
উপসংহার : পিতা-মাতার সাথে যেমন নম্র-ভদ্র ও শালীন আচরণ করতে হবে, তেমনি তাদের সাথে শিষ্টাচার বজায় রাখতে হবে। সন্তানরা যেন পিতা-মাতার জন্য ছাদাক্বায়ে জারিয়া হ’তে পারে, সে লক্ষে নিজেদের গড়ে তুলার জন্য সচেষ্ট হ’তে হবে। এতে সন্তানের ইহকাল ও পরকাল যেমন কল্যাণকর হবে তেমনি পিতা-মাতারও নেকীর হকদার হবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার সাথে আদব সমূহ সঠিকভাবে পালনের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১, সনদ ছহীহ।
[2]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৮, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৩০০৪, ৫৯৭২; মুসলিম হা/২৫৪৯।
[4]. মুসলিম হা/২৫৪৯; মিশকাত হা/৩৮১৭।
[5]. আবূদাঊদ হা/১৫৩৬; তিরমিযী হা/১৯০৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩২।
[6]. বুখারী হা/২৪৮২, ১২০৬।
[7]. আহমাদ হা/১৫৫৩৮; নাসাঈ হা/৩১০৪; ইবনু মাজাহ হা/২৭৮১; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৪৮৫; মিশকাত হা/৪৯৩৯।
[8]. মুসলিম হা/১৬৩১; আবূদাঊদ হা/২৮৮০।
[9]. আহমাদ হা/১০৬১৮; মিশকাত হা/২৩৫৪, সনদ হাসান।
[10]. বুখারী হা/১৩৮৮, ২৭৬০; মুসলিম হা/১০০৪; মিশকাত হা/১৯৫০।
[11]. মুসলিম হা/২৫৫২; মিশকাত হা/৪৯১৭।
[12]. মুসলিম হা/৯৭৬; আবূ দাঊদ হা/৩২৩৪; মিশকাত হা/১৭৬৩।
[13]. বাযযার, ইবনুস সুন্নী; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৪, সনদ ছহীহ।
[14]. বুখারী হা/৬৭৬৮; মুসলিম হা/৬২; মিশকাত হা/৩৩১৫।
[15]. বুখারী হা/৬৭৬৬; মুসলিম হা/৬৩; মিশকাত হা/৩৩১৪।
[16]. বুখারী হা/৫৯৭৩; মুসলিম হা/৯০; মিশকাত হা/৪৯১৬।