মিয়ানমারের  রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। জ্বালাও-পোড়াও, যুলুম-নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণ যাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে তারা সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। লক্ষ্য একটাই- রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্থায়ীভাবে দেশছাড়া করা। ফলে বিভিন্ন মুসলিম দেশে তারা শরণার্থী হয়েছে। কেবল বাংলাদেশেই অবস্থান নিয়েছে ৫ লক্ষাধিক। ১৯৪২ সাল থেকে শুরু হয়েছে নির্যাতনের এই ধারাবাহিকতা। তারপর ১৯৪৮, ৭৮, ৯২ ও ২০১২ সালেও চলেছে নির্যাতনের স্টীম রোলার। একই ধারাবাহিকতায় এ বছর ৯ই অক্টোবর’১৬ থেকে তাদের উপর আবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হয়। ৯ জন পুলিশ হত্যার অভিযোগ তুলে সরকারী আইন-শৃংখলা বাহিনী বৌদ্ধ ভিক্ষু আর মগ সন্ত্রাসীরা সম্মিলিতভাবে শুরু করে সীমাহীন বর্বরতা। ফলে পূর্বের ন্যায় এবারও হাযার হাযার রোহিঙ্গা মুসলমান সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চল কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নিতে শুরু করে। ইতিমধ্যে এই সংখ্যা ৬৫ হাযার অতিক্রম করেছে। যাদের সবাই সহায়-সম্বল, অর্থ-সম্পদ ফেলে জীবনটুকু নিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের উপর এই অমানবিক নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং নাগরিকত্বহারা এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের জন্মভূমি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাকে স্বাধীন ‘আরাকান রাষ্ট্র’ ঘোষণার জন্য জাতিসংঘের প্রতি জোর দাবী জানায়। একই সাথে আশ্রয়প্রার্থী সহায়-সম্বলহীন অসহায় মানুষগুলোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করে।

গত ৯ই ডিসেম্বর শুক্রবার মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব জুম‘আর খুৎবার মাধ্যমে এ মহতী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে দেশের ও প্রবাসের সাংগঠনিক যেলা, এলাকা ও শাখা সহ আম জনসাধারণ ব্যাপকভাবে সাড়া প্রদান করেন।

অতঃপর আমীরে জামা‘আতের নির্দেশনা মতে রাজশাহী থেকে আমি এবং ঢাকা থেকে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য জনাব হারূনুর রশীদ ১৯শে ডিসেম্বর কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক আমাদের সাথে যুক্ত হন।

২০শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৮-টায় কক্সবাজার পৌঁছে যেলা ‘আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন এলাকা ও শাখার দায়িত্বশীলদের সাথে পরামর্শ পূর্বক কয়েকদিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা হয়। অতঃপর কক্সবাজারের উখিয়া উপযেলায় অবস্থিত ‘কুতুপালং’ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়।

কুতুপালং ক্যাম্পে :

প্রথম দিন আমরা সিএনজি যোগে কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত ঘেঁষে নির্মিত মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে কুতুপালং ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বেলা ১১-টায় দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে আমরা ক্যাম্পে প্রবেশ করি। যাতে আমাদের উদ্দেশ্য কেউ বুঝতে না পারে। আমার সাথে স্থানীয় একজন দ্বীনী ভাই ছিলেন। তার বক্তব্য, ক্যাম্পের পাহারারত বিজিবির নিকটে পরিচয় গোপন রাখতে হবে।

মনটা বিদ্রোহ করে উঠলো। সহায়-সম্বলহীন মযলূম রোহিঙ্গা-মুসলিম ভাই-বোনদের সাহায্যার্থে এসে পরিচয় গোপন করতে হবে? আমরা কি বিদেশী? নাকি চুরি করতে এসেছি? সামান্য সহযোগিতা করতেও কি প্রশাসন বাধা দিবে?

তবে আল্লাহর রহমতে কঠোর প্রহরারত বিজিবির সামনে দিয়ে বিনা বাধায় বিনা জিজ্ঞাসাবাদে আমরা ক্যাম্পে প্রবেশ করি। পরে জানলাম এই ক্যাম্প বরাবর রাস্তা আরাকান পর্যন্ত চলে গেছে। তার সাথে যোগ হয়েছে চরমোনাই পীর ছাহেবের লংমার্চ কর্মসূচী। তাই এই জোর নযরদারী।

সেখানে প্রবেশের পর প্রথমেই দেখি রোহিঙ্গাদের বাজার।  সব দোকানী রোহিঙ্গা। নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই সেখানে  পাওয়া যায়। সামনে নতুন-পুরাতন শরণার্থীদের ভীড়। চেহারাগত পার্থক্যের কারণে আমাদের দিকে অনেক মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আশায় আছে, যদি কিছু মেলে। কর্মহীন মানুষগুলোর আকুতিপূর্ণ চেহারা দেখে কথা বলতে মন চাইল। কিন্তু না। বাধ সাধলো দেলোয়ার। একদিকে প্রশাসন, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত শরণার্থীদের ঘেরাওয়ের শিকার হওয়ার ভয়। তাই কথা বলতে মানা। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রোহিঙ্গাদের উপর ‘ওম শান্তি’র প্রচারক, অহিংসের ধ্বজাধারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মীদের অবিশ্বাস্য নির্যাতন কাহিনীর বাস্তবতা যাচাইয়ে ব্যাকুল। তাইতো মনে ছিল সদ্য নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদগ্র বাসনা।

পাহাড়, টিলায় ভরা বিশাল ক্যাম্পে হাযারো বনু আদমের ভীড়। নতুন-পুরাতন পার্থক্য করা বড়ই দুষ্কর। তারপরেও আমরা খুঁজে ফিরছি সদ্য আগত রোহিঙ্গাদের। উদ্দেশ্য- গোপনে কিছু সাহায্য দেওয়া। সাথে সাক্ষাৎকার নেওয়া।

প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর দেখা মিলল একটু ফাঁকা জায়গার। সেখানে বিজিবির সশস্ত্র পাহারা এবং অনেক শরণার্থীর ভীড়। তারা আমাদের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এ সময়ে কেউ কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য চাইলো বটে। কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও কিছু দিতে পারলাম না।

সেখানে পেলাম একটি শিক্ষা কেন্দ্র ও ১টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ব্রাক পরিচালিত ক্যাম্পের একমাত্র শিক্ষা কেন্দ্রটির শিক্ষক জনাব মঞ্জুর আলমের সাথে কথা হল। তিনি বললেন, আমরা শুধু পুরাতন রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক ভাষা শিক্ষা দেই। পাশে একটি টিনের মসজিদ। ইমাম ছাহেবের সাথে অনেক কষ্টে কথা বললাম। কারণ ভাষার বৈপরিত্য। সাথী ভাই দোভাষীর দায়িত্ব পালন করল। ইমামের বক্তব্য- ‘আমি এখানে ১২ বছর আছি। সরকারী খাস জমিতে বসবাস করছি। সরকারী কার্ড (পিএফ) পেয়েছি। কিন্তু সামান্য কিছু চাল ছাড়া অন্য কোন সরকারী সাহায্য পাই না। কোন রকমে আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর ওপর আবার নতুন রোহিঙ্গাদের আগমন। বাইরে কাজ করতে গেলে প্রশাসন আমাদেরকে জেলে ঢুকায়, তাড়িয়ে দেয়। তার মতে এখানে মাত্র ১২ হাযার শরণার্থীর আইডি কার্ড আছে। অথচ নতুন-পুরাতন মিলে মোট সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।

ইমাম ছাহেবের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কিছুটা এগোতেই সাক্ষাৎ হ’ল সদ্য আগত মাদ্রাসা পড়ুয়া দুই যুবকের সাথে। ৭ দিন পূর্বে হোয়াইকং সীমান্ত দিয়ে এরা পালিয়ে এসেছে। বাড়ি আরাকানের মংডু থানায়।

তাদের একজনের ভাষ্য- আমাদের ছিল ৩২ কানি (বিঘা) জমি আর অনেক গরু-ছাগল। বর্মী সেনারা পিতা আব্দুস সালামকে গ্রেফতার করার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। ৫৫ বছর বয়সী মা আর ১৮ বছরের বোনকে পাশবিক নির্যাতনের পর তাদেরকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। আরেক বোন জেসমিন ও ভাই আনছার বেঁচে থাকলেও কোথায় আছে জানি না। ওরা আমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর আমরা কোনমতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।

দাওরায়ে হাদীছ পাশ করা আরেক নতুন শরণার্থী আবূ তৈয়ব (৪০)-এর সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। তিনি বললেন, আমরা বার্মায় নাগরিক অধিকার ছাড়াই বসবাস করি। সরকার চায় না যে আমরা ঐ দেশে থাকি। এজন্য আমাদের উপর যুগ যুগ ধরে চালিয়ে আসছে বর্বর নির্যাতন। তিনি বলেন, সম্প্রতি সেনারা আমার এক ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে। আরেক বোনকে ৩ ঘণ্টা ধরে ধর্ষণের পর সেও মারা যায়। পরে আমি পালিয়ে এসে বর্মী সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বিজিপি’কে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে জীবনটুকু নিয়ে নদী পার হয়ে এদেশে এসেছি। 

এনামুল হক (৩৫) বললেন, ৭ দিন পূর্বে আমি এই ক্যাম্পে পালিয়ে এসেছি। ৬ ভাই-এর মধ্যে ৩ ভাই বেঁচে আছে। আদরের বোনটাকে বর্মী সেনারা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সে আর ফেরেনি। ঘর-বাড়ি সব আগুনে পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয়া হয়েছে।

আরেকটু অগ্রসর হলে সাথী ভাই নিয়ে গেল একটি ঝুপড়ি ঘরে। সেখানে অবস্থানরত ৯ জন নারী ও শিশুকে সাহায্য দেয়া হ’ল। সবাই বোরক্বা পরিহিতা। তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের করুণ কাহিনী। খালেদা (১৯) নাম্নী সদ্য পালিয়ে আসা মেয়েটি বলল- ‘সেনারা আমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। পিতা-মাতা, ৩ ভাই ও ৪ বোন সবাই নিখোঁজ। আমি আল্লাহর রহমতে কোন রকমে পালিয়ে এসেছি। তার ভাষ্য- আমি পড়তে জানি। তবে ওখানে বেশী লেখা-পড়া করার সুযোগ নেই।

৬০ বছরের বৃদ্ধা মাহমূদা বললেন, ১০ দিন পূর্বে এখানে এসেছি। ৬ সদস্যের মধ্যে ৪ জনকে সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। শুনেছি দুই মেয়ে বেঁচে আছে। তবে কোথায় তা জানি না। আরেক বৃদ্ধা নায়লা (৬৭) বললেন, তার স্বামী নিহত। আর ছেলে নিখোঁজ।

নির্যাতিত এসব মানুষের আকুতি শুনতে শুনতে বিদায়ের সময় চলে আসল। অন্য প্রান্ত দিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করা সাথী ভাইদের দলটি ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আমরা একত্রে কোর্ট বাজার এলাকায় চলে আসলাম এবং সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন দ্বীনী ভাইয়ের সাথে মিলিত হ’লাম। অতঃপর কক্সবাজার শহরে ফিরে এসে শহরের কয়েকটি স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হ’ল।

শহরে সাক্ষাৎ হওয়া পরিবারগুলির মাঝে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীছ পড়া জনৈক আলেম রয়েছেন। নিজের সহ অন্য ৩ পরিবারের মোট ১৪ জন সদস্য নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত এই পরিবারটির আরাকানে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য আর সহায়-সম্পত্তি। সবকিছু ফেলে প্রবীন স্বজনদের ছেড়ে পরনের কাপড়টুকু নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে এসেছেন। তাঁর বড় ছেলেটি চায় লেখাপড়া করতে। কিন্তু কে তাদের লেখাপড়া করাবে? জীবন তো কাটছে লুকিয়ে-পালিয়ে। মুক্ত ভাবে চলা ফেরা, পড়াশুনার তো কোন সুযোগ এদের নেই।

টেকনাফের পথে :

পরদিন ২১শে ডিসেম্বর। সাথীদের নিয়ে চললাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। পথে সম্মুখীন হ’লাম আরেক অভিজ্ঞতার। খাদ্যের সন্ধানে কোন কোন পরিবার স্থান পরিবর্তন করার জন্য বাসে উঠছে। কিন্তু বিজিবি পথের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে বাস-সিএনজি তল্লাশী করছে। রোহিঙ্গা পেলেই তাদেরকে নামিয়ে দিচ্ছে। উখিয়ায় আমাদের বাসটি প্রথম চেক করা হ’ল। দেখলাম ৫ জন যাত্রী (রোহিঙ্গা)-কে বিজিবি আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিল, আর কন্ট্রাকটারকে বলল তাদের ভাড়া না নিয়ে টেকনাফ নামিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু একটু পরেই সে অসহায় রোহিঙ্গাদের নিকট ভাড়া  চেয়ে বসল। তারা বলল, তাদের কাছে কোন টাকা নেই। ক্ষুধার জ্বালায় কক্সবাজারে যাচ্ছিলাম কাজের সন্ধানে। কিন্তু বিজিবির বাধার মুখে ফিরে যেতে হচ্ছে টেকনাফে। নিষ্ঠুর কনডাকটর তাদের নামিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিছু বলতে চাইলেও সাথী ভাইদের নিষেধাজ্ঞার মুখে তা পারলাম না। আমারই পাশে অবস্থানরত ভারাক্রান্ত ১৫/১৬ বছরের রোহিঙ্গা ছেলে বাসেত। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখে-মুখে ভীতি আর শংকার ছাপ। মনটা বার বার গুমরে কেঁদে উঠছে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। হঠাৎ পাশের সীটে বসা এক যুবক বলল, এই কনডাকটর ওদেরকে নামিয়ে দিয়ো না। ওদের ৩ জনের ভাড়া আমি দিব। বাকী দুই জনেরও ব্যবস্থা হ’ল। পরে সেই যুবককে তাদের দেওয়ার জন্য ১০০০ টাকা দিয়ে মনবেদনা কিছুটা হ’লেও প্রশমিত করলাম।

একসময় টেকনাফ পৌঁছে গেলাম। ওখানকার নও মুসলিম দ্বীনী ভাই আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। উনার চেম্বারে বসে নতুন আগত রোহিঙ্গাদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ হ’ল। অতঃপর সিদ্ধান্ত মোতাবেক শহর থেকে ১০ কি.মি. দূরের মোছনী ক্যাম্প সহ শহরের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সদ্য আগত রোহিঙ্গাদের আনা হ’ল প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থানে। এখানে শতাধিক মানুষের মাঝে ত্রাণ বিরতণ করা হ’ল। ক্যাম্পে বা খোলা স্থানে না দেওয়ার কারণ ছিল নতুন-পুরাতন আর স্থানীয়দের একাকার হয়ে যাওয়া। আর হাযারো মানুষের চাপ সহ্য করতে না পারার সম্ভাবনা। সেকারণ স্থানীয় ভাইদের মাধ্যমে কেবলমাত্র সদ্য আগতদের খুঁজে বের করে আনা হয়েছিল নির্দিষ্ট স্থানে।

এখানেও অনেক মা-বোনের সাক্ষাৎকার নিলাম। বর্মী সেনাদের হাতে সদ্য স্বামীহারা সানজীদা বেগম (৪০) ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে নিয়ে পালিয়ে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

৭/৮ দিন আগে আসা আরাকানের গজবিল এলাকার যমীর হোসাইন (৪৩) অষ্টাদশী মেয়ে ইয়াসমীন সহ ২০/২৫ জন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানালেন ‘সেনারা প্রথমে আমার মাকে গুলি করে মারে। তারপর স্ত্রীকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে’।

মেয়েটি ইতিপূর্বে মাত্র মক্তব পড়েছে। পড়াশুনার অন্য কোন ব্যবস্থা সেখানে নেই। খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলল- গত রাতে কিছু খেয়েছি। আজ দুপুর পর্যন্ত খাবারের কোন ব্যবস্থা হয়নি।

নাগপুরার অধিবাসী ৪৫ বছরের ইউনুস। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার পিতা ও ভাইকে বৌদ্ধরা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। ৪ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে এখন ভিক্ষা করছি।

৩২ বছরের যোহরা বলেন, তার স্বামীকে চোখের সামনে দা দিয়ে জবাই করে মেরে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইজ্জত হরণ করে মগরা। তারপর ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দেয়।

তারই মা নূরজাহান (৫৫)-এর ভাষ্য অনুযায়ী সহস্রাধিক মগ তাদের গ্রামে আক্রমণ করে তার স্বামী সহ বহু মানুষকে প্রথমে গুলি করে। তারপর জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বললেন, আমার অনেক মহিলা আত্মীয়-স্বজনকে তারা একত্রে জঙ্গলে নিয়ে গণধর্ষণ করে। তারপর মেরে ফেলে।

বেশ কিছুক্ষণ সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর তাদের বিদায় দেওয়া হ’ল। তারপর স্থানীয় দ্বীনী ভাইদের সাথে আলাপে আরো অনেক কিছু জানতে পারলাম।

টেকনাফ বাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের চলাফেরা অনেক বেশী। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশীর ভাগ পুরাতন। এমনকি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশে অসহায়ভাবে বসে থাকাদের মাঝে অধিকাংশই পুরাতন রোহিঙ্গা। যদিও তারাও কর্মহীন ও অভাবী। সদ্য আগতরা বাইরে আসে খুব কম। তারা আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভয়ে ভীত থাকে। কারণ ধরা পড়লে বার্মার বর্ডার গার্ড বিজিপির হাতে তুলে দেওয়া হ’তে পারে। শরণার্থীদের মাঝে মহিলাই বেশী। অধিকাংশই অভিভাবক শূন্য। কেউ স্বামীহারা আর কেউবা পিতৃহারা।

স্থানীয় দ্বীনী ভাই বললেন, মাঝে মাঝে কিছু ব্যক্তি নগদ অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যা নিতান্তই অপ্রতুল। তার ভাষ্যমতে, বিজিবির সামনে পড়লে দাতারা হয়রানীর শিকার হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা করার কারণেও  বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ও হুমকি আসছে। একই মন্তব্য করলেন হোমিও চিকিৎসক ভাই ডা. নূরুল ইসলামও।

তবে অন্য এক ভাই বললেন, কোন ক্ষেত্রে বিজিবি বাধা দিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে তারাও তো মানুষ। তারাও চায় অসহায় রোহিঙ্গারা সাহায্য পাক। কিছু পেয়ে অন্তত বেঁচে থাক।

বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মাঝে আনন্দিত হলাম ডা. নূরুল ইসলামের হোমিও চেম্বারের কয়েকটি আলমারীতে থরে থরে সাজানো আত-তাহরীক ও ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত অনেক বই। ২০ কপি আত-তাহরীক-এর নিয়মিত এজেন্ট তিনি। আরেক ভাই বললেন, আমি বিগত কয়েক বছর থেকে আত-তাহরীকের এজেন্ট। কার্যক্রম ভালোই চলছে এদিকে। আগামী তাবলীগী ইজতেমায় যাওয়ার ইচ্ছা আছে। দেশের সর্বদক্ষিণের এই এলাকাতেও আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াত এগিয়ে চলেছে দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। সাথে সাথে সদ্য পরিচিত অথচ যেন কতদিনের আত্মীয় একদল ভাইয়ের বিপুল আন্তরিকতায় অভিভূত হয়ে এদিনের মত কার্যক্রম গুটিয়ে চললাম কক্সবাজারের পথে।

নাইক্ষ্যংছড়ি : পরদিন বিকালে সি.এন.জি যোগে রওনা হ’লাম নতুন গন্তব্য নাইক্ষ্যংছড়িতে। উঁচু-নিচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে, দিগন্ত ছোয়া সবুজ বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ বন পেরিয়ে, রাবার উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘রামু’ অতিক্রম করে সন্ধ্যা লগ্নে আমরা নাইক্ষ্যংছড়ি উপযেলার অদূরে পাহাড়িয়া এলাকায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে আমাদের সাথী হন স্থানীয় দ্বীনী ভাইরা। তাদের সাথে পায়ে হেঁটে চললাম কাংখিত গন্তব্যে। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে অনভ্যস্ত পায়ে প্রায় ২০০ ফুট উচ্চতায় উঠতে বেশ বেগ পেতে হ’ল। মনে মনে ভাবছি এত উপরে মানববসতি আছে কি? হ্যাঁ। নিরিবিলি এই স্থানে দেখা পেলাম বেশ কিছু নতুন রোহিঙ্গা পরিবারের। আমাদের দেখে তারা এগিয়ে এলো। অধিকাংশই নারী ও শিশু। পুরাতনদের সহযোগিতায় কয়েকটি ঝুপড়ি ঘরে তারা আশ্রয় নিয়েছে। ৭০-৮০ জনকে সাহায্য দেওয়া হ’ল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম নির্জন পাহাড়ে আশ্রয়গ্রহণকারী নির্যাতিত এই মানুষগুলোর কাছে সামান্য হ’লেও কিছু সাহায্য পৌঁছাতে পেরে। তাদের কারো কারো সাক্ষাৎকার নেয়া হ’ল দ্রুততার সাথে।

মংডু থানার অধিবাসী ফরীদুন্নেসা। স্বামী নিখোঁজ। ২ মেয়েকে বর্মী সেনারা ধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ২৫ বছরের মুশতারা ৭ সেনার অত্যাচারের শিকার হয়েছে। বাচ্চাটিকে পানিতে ফেলে ডুবিয়ে হত্যা করেছে তারা। তারপরেও সে বলল- ওখানে শান্তি আসলে আমরা ফিরে যাব। ৩ সেনার নির্যাতনে অসুস্থ ৩০ বছরের হাসিনা বললেন, তিনি স্বামী হারিয়ে ইযযত বিলিয়ে উঁচু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে কয়েকদিন পায়ে হেঁটে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।

২৫ বছরের ইয়াসমীন বলেন, ২৫ সেনা আমাদের ৪ বোনকে একনাগাড়ে অত্যাচার করেছে। আমাদের বাড়ীর গরু-ছাগল সব নিয়ে গেছে। পঞ্চাশোর্ধ নারী কুসুম বাহারের সামনে ২০/৩০ জনকে জবাই করা হয়েছে। কয়েকটি শিশুকে আগুনে নিক্ষেপ করেছে ওরা। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জানালেন- তার ২ মেয়ে এখনো নিখোঁজ। এভাবে এখানে আরও অনেকের সাক্ষাৎকার নেই।

অতঃপর সিএনজি যোগে রাতেই কক্সবাজারে ফিরে আসি। সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে সাথে আলোচনা করি। অতঃপর প্রথম দফা ত্রাণ বিতরণ শেষে রাত ১০-টার কোচে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।






আরও
আরও
.