পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি রোহিঙ্গা। এক সময় নিজ দেশে যাদের সব ছিল, আজ তারা রাতারাতি পথের ভিখারী। ধনী-গরীব সবাই একই মিছিলে শামিল। এ মিছিল যেন শেষই হচ্ছে না। চলছেই অদ্যাবধি। কক্সবাজার-এর উখিয়া উপযেলাধীন কুতুপালং, বালুখালী, সীমান্তবর্তী টেকনাফ এবং তমব্রু নো ম্যান্স ল্যান্ড প্রভৃতি স্থান এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীতে গম গম করছে। দুর্গম পাহাড়গুলি এখন অনেকটাই সুগম। বর্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার অসহায় রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার গগণবিদারী আর্তনাদ পাহাড়ের প্রান্তে প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছে। শত-সহস্র ইয়াতীম-অনাথ শিশুর চোখের পানি যে কোন পাষাণ হৃদয়েও করুণার ধারা বিগলিত করতে বাধ্য। অসহায় এ মানুষগুলির অবস্থা সরেযমীন পরিদর্শন এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর চলমান ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির জন্য মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর নির্দেশে ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ কক্সবাজারে যান। কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশীদ আখতার, সাধারণ সম্পাদক মুস্তাকীম আহমাদ, অর্থ সম্পাদক আব্দুল্লাহিল কাফী, প্রশিক্ষণ সম্পাদক আবুল কালাম, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ইহসান ইলাহী যহীর, তথ্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মুস্তাফীযুর রহমান সোহেল, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুখতারুল ইসলাম, সমাজকল্যাণ সম্পাদক সা‘দ আহমাদ সহ এ কাফেলায় আমি, সিরাজগঞ্জ যেলা ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি শামীম আহমাদ এবং থাইল্যান্ড প্রবাসী আব্দুল হাই (বগুড়া) শামিল ছিলাম। দু’দিন পর এক ইন্দোনেশীয় সহপাঠীর সাথে সাক্ষাৎ উপলক্ষে যোগ দেন ‘যুবসংঘ’-এর সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ গবেষণা বিভাগের পরিচালক আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব।
হাকিমপাড়া, থ্যাংখালী :
১লা নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় রাজশাহী থেকে যাত্রা শুরু করে পরদিন বিকেল সোয়া ৩-টায় আমরা কক্সবাজার পৌঁছি। যেলা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীলবৃন্দের সাথে রাতে পরামর্শ করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। ৩রা নভেম্বর শুক্রবার সকালে আমরা পাঁচ শতাধিক পিস কম্বল ভর্তি পিকআপ ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ি উখিয়ার উদ্দেশ্যে।
উখিয়া সরকারী ডিগ্রী কলেজে স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর নামে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নথিভুক্ত করার পর ত্রাণ বিতরণস্থল নির্ধারিত হয় উখিয়া উপযেলার থ্যাংখালীর হাকিমপাড়া ৭নং ক্যাম্প। সাড়ে দশটার দিকে সেখানে পৌঁছে ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মী অফিসারের কাছে ত্রাণসামগ্রী হস্তান্তর করি। সেগুলি বিতরণের জন্য ছুটে আসেন কয়েকজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক। ইতিমধ্যে মাঝির (দলনেতা) মাধ্যমে আহূত রোহিঙ্গারা সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশীদ আখতার, কক্সবাজার যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলাম, সহ-সভাপতি আমীনুল ইসলাম, কক্সবাজার যেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী ও কক্সবাজার যেলা আইজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আবুল আ‘লা প্রমুখ তাদের হাতে কম্বল তুলে দেন। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত একজন অফিসার জানান, এখানে নতুন দায়িত্বে আসা অনেক পুলিশ সদস্য আমাদের কাছে এসে শোয়ার জন্য কম্বল চায়। অথচ আমরা রোহিঙ্গাদের ত্রাণের কোন জিনিস ব্যবহার করি না। আমরা চাইলে দু’তিনটা কম্বল মাথার নিচে দিয়ে রাতে আরামে ঘুমোতে পারি। কিন্তু তা করি না। বালিশ ছাড়াই আমরা পার্শ্ববর্তী স্কুলে ঘুমাই। তার কথা শুনে সেনাবাহিনীর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার পারদ আরো বৃদ্ধি পায়।
এখানে মংডুর ওয়াইক্যাম্প থেকে আগত জনৈক মুহাম্মাদ আসাদ ও জাফর আলমের সাথে কথা হয়। তাদের পরিবারের সবাই নিরাপদে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। তারা জানালেন, আমাদের লাকড়ির (খড়ি) খুব প্রয়োজন। লাকড়ির অভাবে রান্নাবান্না করতে সমস্যা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী বাজারে ছোট এক আটি লাকড়ির দাম ১০০ টাকা। তাছাড়া উর্দূতে কথা হ’ল আকিয়াব যেলার বলিবাজার গ্রামের মাওলানা আব্দুল জলীলের সাথে। সেখানকার আল-ইদারাতুল ইসলামিয়া দারুল উলূম, রিদা মাদরাসার শিক্ষক তিনি। জামা‘আতে উলা পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা হ’ত। ছিল মক্তব ও হিফয বিভাগ। ছাত্র সংখ্যা ২০০-এর বেশী ছিল। তিনি ছাত্রদের মীযান-মুনশা‘ইব ও উছূলুশ শাশী পড়াতেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় পুরো গ্রাম, মসজিদ, মাদরাসা বর্মী সেনারা আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রাণভয়ে সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালিয়ে অবশেষে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি আরো জানালেন, বর্মী সেনারা কেŠশলে বড় বড় আলেম-ওলামা ও মুহাদ্দিছদেরকে ক্যাম্পে ডেকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে। মাদরাসা পরিচালনার অর্থের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে বিদেশী কানেকশনের ছুঁতোয় বহু মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কম্বল বিতরণ শেষে ‘যুবসংঘ’ সভাপতি আব্দুর রশীদ আখতার ভাই কক্সবাজার পাহাড়তলী আহলেহাদীছ মসজিদে খুৎবা দিতে গেলেন। আর আমরা ক্যাম্পেই জুম‘আর ছালাত আদায়ের লক্ষ্যে কুতুপালং-এর ঘুমধুম ত্রাণকেন্দ্র-২ এ পাহাড়ের উপর ‘আন্দোলনে’র উদ্যোগে স্থাপিত ‘মসজিদুত তাওহীদ-২’ এ গমন করি। প্রায় ৩০০ মুছল্লী সেখানে ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখি। উর্দূ ও বাংলা মিশ্রিত বক্তব্যে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আপনাদের উপর নির্যাতনের মূল কারণ আপনারা মুসলিম। সুতরাং প্রকৃত মুসলিম হওয়ার উপলব্ধি জাগ্রত না হ’লে এ থেকে কোন শিক্ষা অর্জিত হবে না। বিপদে-আপদে সর্বদা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে এবং ছবরে জামীল এখতিয়ার করতে হবে। কোন অবস্থাতেই কুরআন-সুন্নাহকে ছাড়া যাবে না। সর্বদা এ দু’টিকে শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরতে হবে। আমাদের যাবতীয় আমল এ দু’টির মানদন্ডেই যাচাই করতে হবে। ছালাত সেভাবেই আদায় করতে হবে যেভাবে রাসূল (ছাঃ) আদায় করেছেন। আমাদের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে গড়ে তুলতে হবে। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সেদিকেই মানুষকে আহবান জানায়’। আমার বক্তব্য স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গাদের বুঝিয়ে দেন যেলা ‘আন্দোলন’-এর সমাজকল্যাণ সম্পাদক আরমান হোসাইন ভাই। আরমান ভাইয়ের কথা একটু না বললেই নয়। উখিয়া নিবাসী হওয়ার কারণে ‘আন্দোলনে’র বিভিন্ন প্রকল্পগুলো সরেযমীন তদারকি করছেন মূলতঃ তিনিই। অত্যন্ত কর্মচঞ্চল এই ভাইটি নিজস্ব ব্যস্ততার মধ্য দিয়েও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন!
এখানে কয়েকজন আলেমের সাথে আমাদের কথা হয়। তারা মসজিদের জন্য মিম্বর, পৃথক ওযূখানা, মাইক ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের প্রতি আবেদন জানান।
এরপর আমরা সেখানে ‘আন্দোলনে’র স্থাপিত টিউবওয়েল, টয়লেট, গোসলখানা প্রভৃতি প্রকল্প পরিদর্শন করলাম। পরে বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে নগদ অর্থ সহায়তা করি। এ সময় ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে দুই সহস্রাধিক চকলেট বিতরণ করে তাদেরকে সাময়িক খুশী করার চেষ্টা করি।
কুতুপালং-বালুখালী :
পরদিন ৪ঠা নভেম্বর শনিবার সকালে আমরা আবারও উখিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বালুখালীর বায়তুল আমান (মসজিদুত তাওহীদ-১) মসজিদে যাওয়ার পথে আমাদের বড় কাফেলা দেখে আর্মী অফিসাররা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমরা সাংগঠনিক পরিচয় দিলাম। অতঃপর আমরা সরাসরি চলে গেলাম বালুখালীর বি-৮ ব্লকে অবস্থিত মসজিদুত তাওহীদ-১ এ। আমরা সেখানে পৌঁছা মাত্র লোকজন এসে মসজিদে উপস্থিত হ’ল। যোহরের পূর্বে এখানে একটি সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য প্রদান করেন ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি আব্দুর রশীদ আখতার, আমি এবং ছাত্র ও যুববিষয়ক সম্পাদক ইহসান ইলাহী যহীর। মংডু থানার জিমাংখালী গ্রামের হাফেয নূরুল ইসলাম (৪০) ভাইয়ের সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়।
এ মসজিদে ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। তারা হ’লেন মংডু থানার নোয়াপাড়া গ্রামের হাফেয রবীউল হাসান (৩৫), মাওলানা আবুল কাসেম, আখতার ও হাফেয নূরুল ইসলাম। বাদ ফজর এখানে দরস হয়। তারপর সকাল ৯-টা থেকে ১-টা পর্যন্ত ৪টি ক্লাস এবং বাদ যোহর নূরানী তা‘লীম হয়। মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত হোয়াইটবোর্ডে চমৎকার আরবী হাতের লেখা দেখে থমকে গেলাম। এত বিড়ম্বনা ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তারা বাচ্চাদেরকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। সত্যিই হৃদয় শীতলকারী বিষয়। শিক্ষকরা আমাদের হাতে আক্বীদার বই, চক, স্লেট, হাতপাখা, খাতা-কলম ও পেন্সিলের ফর্দ ধরিয়ে দিলেন। আমরা আরমান হোসাইন ভাইকে এগুলি সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করলাম।
সাধারণ সম্পাদক মুস্তাকিম ভাই এ সময় ইনতায আহমাদ নামে মংডুর এক ধনাঢ্য মেম্বারের সন্ধান পান, যিনি সেখানে দেড়শত বিঘা সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কোন কিছুরই অভাব ছিল না তার। সাহায্যের জন্য হাতে নগদ টাকা ধরিয়ে দিলে অশ্রুসজল হয়ে উঠলেন তিনি। ভেতরে পলিথিনের সংকীর্ণ ছাপড়ার ঘরে কেঁদে ওঠেন তার স্ত্রী এবং মা। এক হৃদয়বিদারক মুহূর্ত। কান্না চেপে বেরিয়ে এলেন মুস্তাকীম ভাই।
এরপর আমরা বালুখালী এ-৫ ব্লকে ‘আন্দোলন’ স্থাপিত একটি নবনির্মিত মসজিদ পরিদর্শন করলাম। আমাদের সাথে ছিলেন আরমান ভাই, স্থানীয় মুহাম্মাদ হুসাইন ও হাফেয নূরুল ইসলাম। মসজিদ পরিদর্শন শেষে আমরা আকাবাঁকা পাহাড়ী পথ বেয়ে শিবিরগুলি পরিদর্শন করি এবং নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করি।
এভাবে একসময় পৌঁছে যাই বালুখালীর নূর বাশারপাড়া মসজিদুত তাওহীদে। কলকাতা ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদীছ-এর ভাইদের অর্থায়নে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। সেখানে আমরা যোহর ও আছরের ছালাত জমা ও কছর করি। জামা‘আত শেষ হওয়ার পর দেখা গেল মসজিদে অনেক রোহিঙ্গা শিশু মক্তবে পড়ার জন্য বসে আছে। দায়িত্বরত ইমাম ছাহেব জানালেন, প্রায় ৩০০/৩৫০ শিশু এখানে কুরআন পড়া শিখে। আমরা তাদের মাঝে চকলেট বিতরণ করে সেখান থেকে চলে আসি। আলহামদুলিল্লাহ মসজিদটিতে ইতিমধ্যে ফ্যান ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আযান দেয়ার জন্য মাইকও লাগানো হয়েছে।
মসজিদ থেকে বের হয়ে আমরা বিভিন্ন শিবিরে সুযোগমত নগদ অর্থ সহযোগিতা প্রদান করি এবং আমাদের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করি। এ দিন যে পরিমাণ নগদ অর্থ বিতরণের পরিকল্পনা আমাদের ছিল তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। যেকোন শিবিরে মৌমাছির মত ছোট বাচ্চাদের ঘিরে ধরা ছিল এর পিছনে প্রধান কারণ। চকলেট দিয়েও তাদেরকে সামাল দেয়া ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। এরই মধ্যে সারাদিন বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে আমরা লোকজনের সাথে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলি। সাধ্যমত সহযোগিতার চেষ্টা করি।
এ দিনের সফরে আমরা জানতে পারি যে, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বৃহৎ এনজিওর দায়িত্বশীলরা দায়সারা গোছের টয়লেট নির্মাণ করে বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের নির্মিত বাথরুমগুলো দ্রুত ভরে যাচ্ছে। এজন্য সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেয়ার পর বাথরুম নির্মাণের দায়িত্বও নিতে যাচ্ছে বলে জানালেন একজন আর্মী অফিসার।
ঘুমধুম ও তমব্রু নো ম্যান্স ল্যান্ড :
পরদিন ৫ই নভেম্বর রবিবার আমরা ঘুমধুম ত্রাণকেন্দ্র-১ এ আসলাম। এদিন ৪৫০ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ করা হ’ল। প্যাকেটে ছিল ১০ কেজি চাল, ২ কেজি পেঁয়াজ, ১ কেজি রসুন, ১ কেজি লবণ, ১ কেজি মরিচ ও ২টি কম্বল। কক্সবাজার যেলা ‘আন্দোলনে’র ব্যবস্থাপনায় কর্মরত ইন্দোনেশীয় কয়েকটি এনজিওর প্রতিনিধি সান্দ্রী শায়বান, আহমাদ সুশান্ত, দাদান জুনায়দী, হেরমান প্রমুখ ভাই আমাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন এবং তারাই এ দিনের প্রোগ্রাম স্পন্সর করেন। যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক মুজীবুর রহমান ও শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক শাহ নেওয়ায মাহমূদ তানীদ ভাই সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করলেন। সেনাবাহিনীর ভাইদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমরা সম্পূর্ণ ত্রাণ নিজ হাতে বিতরণ করলাম। এখানে পরিচয় হ’ল রাজশাহীর বেশ কিছু সেনাসদস্য ভাইয়ের সাথে। তারা আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে এবং সাংগঠনিক পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হ’লেন। রাজশাহীতে এলে আমাদের মারকাযে আসার দাওয়াত গ্রহণ করলেন।
এখানে দায়িত্বরত একজন আর্মী অফিসার জানালেন, পাশে একটি মাদরাসা আছে। সেখানে অনেক ইয়াতীম বাচ্চা পড়াশুনা করে। তাদের শাক-সবজি ও প্রয়োজনীয় খাবার মওজূদ রাখার জন্য একটি ফ্রিজ কিনে দিলে তারা উপকৃত হ’ত। আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম।
এ ক্যাম্পের ত্রাণ বিতরণস্থল মসজিদুল হিন্দী-২ এ আমরা কয়েকজন আলেমের সাথে আলাপ করলাম। তাদের মাঝে ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি অশ্রুসজল চোখে আবেগঘন বক্তব্য দিলেন। আমি ও ছাকিব কয়েকজন আলেম ও মুরুববীর সাক্ষাৎকার নিলাম। তাদের একজন হাফেয রহীমুল্লাহ। আকিয়াব যেলার মংডু থানায় তার বাড়ি। এক বড় মাদরাসার হিফয বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। মাদরাসাটি বেশ পুরনো ছিল। বার্মার স্বাধীনতার পরপরই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে মোট ৪৫ জন শিক্ষক ও ৮০০ জন ছাত্র ছিল। দাওরায়ে হাদীছ পর্যন্ত পড়ানো হ’ত। ২০১২ সালে মাদরাসাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। মাদরাসা বন্ধের পর তারা কি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে তা‘লীম দিতেন। নূরুল ইসলাম (৭০) নামে আরেকজন মুরুববীর সাথে কথা হ’ল। তিনি জানালেন, ১৯৭৮ সালে যখন ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয় তখন তিনিসহ ৪০ জনকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অনেকদিন যাবৎ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস কাঁধে নিয়ে অনেক কষ্টে তাদেরকে উঁচু পাহাড়ে উঠতে হ’ত। তাদের ৫ জনের একেকটি গ্রুপকে ২ জন আর্মী পাহারা দিত। গুদামে তারা পশুর মত রাত্রি যাপন করতেন।
নাযীর হুসাইন (৮২) বললেন, কুরবানীর পরে তার বড় ছেলেকে মগরা হত্যা করে। উপস্থিত অন্যরা জানালেন, তাদের চলাচলের কোন স্বাধীনতা ছিল না। তারা যেলা শহর আকিয়াবেও কখনও যাননি। সন্তানদের বিয়ে দিতে গেলে ১ লক্ষ কিয়েত চাঁদা দিতে হ’ত। তাদের জাতীয় কোন নেতা নেই, যিনি তাদের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করবেন। শ মং নামে একজন সাবেক রোহিঙ্গা এমপি ছিলেন, যিনি দেশ ত্যাগ করেছেন। তাদের মতে, ২৫শে আগষ্ট নির্যাতন শুরু হওয়ার পর প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের প্রিয় খাবার মাছ, ভাত, আলু, বেগুন। তাদের মাছের ঘের ছিল। সেখান থেকে তারা মাছ মেরে খেতেন। বাংলাদেশের ইলিশ মাছ তারা খেয়েছেন বলে তারা জানালেন।
মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিদের আমরা আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে ছুটলাম বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ি উপযেলার তমব্রু নো-ম্যান্স ল্যান্ডের দিকে। দুপুর দুইটায় আমরা সেখানে পৌঁছলাম। দায়িত্বরত এক বিডিআর জওয়ানের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এখানে বর্তমানে ৬০২২ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের অধিকাংশই অবস্থাপন্ন। দেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ আছে। তারা স্বদেশে ফিরে যাবার আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বসবাস করছে। বাজার করার জন্য তারা বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করতে পারে। আমরা ক্যাম্পে ঢুকে তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে সরকারের নিষেধ আছে বলে তিনি জানালেন। খালের এপার থেকেই তাদেরকে দেখতে হ’ল। তার কাছ থেকে আরো জানতে পারলাম, তারা গোপনে রাতে বা অন্য সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসে। এখানে দু’একটি বাড়ি আমরা কাঁটাতারের ভিতরে অংশেও দেখতে পেলাম। দু’একজনকে পাহাড়ে দেখতে পেলাম আসা-যাওয়া করতে। ঘন্টাখানেক সেখানে অবস্থান করে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। জলপাইতলী নামক স্থানে এক মসজিদে যোহর ও আছর জমা ও কছর করলাম। ফেরার পথে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে আসার সময় আমরা হিমছড়ির দরিয়ানগর এলাকায় এক পাহাড়ী গুহা পরিদর্শনে গেলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ছাকিব ইতিপূর্বে এসেছে বলে গাইড হিসাবে তাকেই অগ্রগামী পেলাম। টর্চ ও মোবাইলের আলোতে পথ দেখে জমাট কালো অন্ধকার ও স্যাঁতসেতে ভেজা গুহায় আমরা প্রবেশ করলাম। দীর্ঘ গুহা। ঊর্ধ্বদেশে একচিলতে ফুটো। বহু যুগ ধরে শ্যাওলা জমে জমে কালচে হয়ে গেছে গুহার গাত্রদেশ। সেই সাথে গাছের ঝুলন্ত শিকড় আর অর্কিডের ঝাড়; চামচিকা, বাদুড়ের ডানা ঝাঁপটানো, চিকন ঝিরিতে বয়ে যাওয়া পানির ধারা, সবমিলিয়ে পিলে চমকানো পরিবেশ। মনে হয় কেউ যেন এখনই শ্বাস চেপে ধরবে। সে এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। সঙ্গে এতবড় দল না থাকলে নিকষ কালো আঁধার মাড়িয়ে এমন ভুতুড়ে গুহা পরিদর্শনের প্রশ্নই উঠত না।
লেদা ও টেকনাফ :
পরদিন ৬ই নভেম্বর সোমবার আমাদের গন্তব্যস্থল টেকনাফের লেদা ক্যাম্প। সকাল ৯-টায় আমরা লেদার উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। আমাদের সাথে ছিল ১০০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী ভর্তি ট্রাক। এখানেও সেনাবাহিনীর আন্তরিক সহযোগিতায় নিজ হাতে পুরা ত্রাণ বিতরণ করি। এছাড়া সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে বেশ মোটা অংকের নগদ অর্থ অসহায় রোহিঙ্গা নারীদের মাঝে বিতরণ করা হয়, যা আমাদেরকে বড় আত্মিক প্রশান্তি দিয়েছে। কারণ গত কয়েকদিন নিজ দায়িত্বে ক্যাম্পগুলোতে অর্থ সহযোগিতা করতে গিয়ে বড় বিড়ম্বনার মুখোমুখি হ’তে হয়েছিল। ফলে তৃপ্তিমত দেয়ার সুযোগ ছিল না। আজ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আর কোন বিশৃংখলা হয়নি। পরে টেকনাফ শহর ঘুরে মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে আমরা কক্সবাজার ফিরে আসি। এখানেই শেষ হয় আমাদের কার্যক্রম।
স্মৃতিময় এই সফরে কয়েকটি জিনিস আমাদের মনের গহীনে চির অমলিন হয়ে থাকবে। যেমন- রোহিঙ্গা বাচ্চাদের লম্বা সুরে সালাম দেয়া এবং মক্তবে তাদের কুরআন মাজীদ শেখার আগ্রহ, রোহিঙ্গাদের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি স্বচক্ষে দেখা। সেইসাথে কক্সবাজার যেলা সাংগঠনিক দায়িত্বশীল ভাইদের অফুরন্ত আন্তরিকতা। যেলা সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক মুজীবুর রহমানসহ সাংগঠনিক ভাইগণ যেভাবে দিন-রাত সময় ও শ্রম ব্যয় করছেন রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনায়, তা সত্যিই অসাধারণ। আল্লাহ তাদের খেদমতকে কবুল করুন।
সর্বোপরি কেন্দ্র ও যেলার সাংগঠনিক ভাইদের সাথে এমন হৃদিক পরিবেশে শরণার্থীর সেবায় ক’টি দিন অতিবাহিত করতে পারাটা ছিল এ সফরের অসামান্য প্রাপ্তি। আল্লাহ আমাদের সকলের তৎপরতাকে কবুল করে নিন এবং যথাশীঘ্র রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই দুঃসহ অমানবিক জীবনযাত্রার অবসান ঘটান, এটাই আমাদের কামনা- আমীন!