সাগরতীর ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে এগিয়ে চলেছি টেকনাফের পথে। অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর পুরোটা পথ। তবুও তাতে বাড়তি কোন আকর্ষণ ছিল না। বরং মযলুম মানুষের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা এবং তাদের চাহিদার তুলনায় তেমন কিছু করতে না পারার খেদ ঘিরে ছিল পুরো সময়। মন পড়ে ছিল শাহপরীর দ্বীপে সদ্যাগত ধুলোমলিন বাক্স-পেটরা কাঁধে নিয়ে চলা নগ্নপদ, ছিন্নবস্ত্র বনু আদমের মিছিলে। এ যাত্রায় আমরা শামিল ছিলাম রাজশাহী থেকে আগত মাসিক আত-তাহরীক-এর সম্পাদক ও ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, হাফাবা গবেষণা বিভাগের ব্যবস্থাপক আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব ও আমি এবং কক্সবাজার যেলা ‘আন্দোলন’ সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলামসহ মোট ৯ জনের একটি দল। 

শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ :

৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে টেকনাফে হারিয়াখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত আর্মী ক্যাম্পে পৌঁছে দেখতে পেলাম শরণার্থীদের লম্বা লাইন। ত্রাণসামগ্রীর বিরাট স্ত্তপ। সেনাসদস্যরা দূর্গতদের মাঝে তা বন্টনে সহায়তা করছে। অতঃপর ট্রাকে কিংবা পিকআপে পাঠিয়ে দিচ্ছে উখিয়ার অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে। সেনাবাহিনীর সুশৃংখল তৎপরতার দৃশ্য নিমিষেই মন ভাল করে দেয়।

সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে শাহপরীর দ্বীপ অভিমুখে আমাদের গন্তব্য। টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সংযোগ সড়কটি বর্ষা মৌসুমের কারণে এখন বিচ্ছিন্ন। ফলে একটা অংশ নৌযানে অতিক্রম করতে হয়। সে পর্যন্ত পৌঁছতেও কাঁচা রাস্তায় অনেকখানি হাঁটার পথ। এ পথে থিকথিকে কাদা মাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের যাতায়াত চলছে গত দেড় মাসাধিককাল। পত্রপত্রিকায় সন্তানের কোলে বা কাঁধে চড়ে শরণার্থী বৃদ্ধ পিতা বা মাতার আবেগঘন আগমণদৃশ্য দেখেছি। তেমনি দৃশ্য চোখে পড়ল ২০/২২ বছরের এক তরুণের কাঁধে আশীতিপর এক বৃদ্ধা, সম্ভবতঃ তার নানী বা দাদী। পথের মাঝে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দেয়া ছাড়া কিছু জানার সুযোগ হ’ল না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসেছে শরণার্থী স্রোত দেখতে। কেউ কেউ নগদ অর্থ, চকলেট, পানি, বিস্কুট প্রভৃতি হাতে তুলে দিচ্ছে। এরই মাঝে কিছু সুযোগসন্ধানীও নযরে আসে, যারা রোহিঙ্গা ছদ্মবেশে অর্থ সংগ্রহে লিপ্ত। সবকিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি কাড়ে শরণার্থীদের বাকহারা ক্লান্ত-শ্রান্ত চেহারাগুলো। বিরামহীন গতিতে সামনে এগিয়ে চলেছে। এক দন্ড পিছু ফেরার সাহস যেন নেই। যে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশান্তরিত হতে হয়েছে, সে প্রাণ বাঁচাবার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত ফুরসৎ নেই। তাদের সেই অন্তহীন ছুটে চলার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি আর ইতিহাসের পাঠ নেই। মহাকালের খাঞ্জাজীখানায় রক্তের আঁখরে লেখা কত অযুত-নিযুত যুলুমের ইতিহাস, কত যালেমের নিষ্ঠুরতার আলেখ্য, কত মযলুমের মর্মন্তুদ বেদনার আখ্যান বিগত হয়েছে.. তবুও না যুলুমের ধরণের কোন পরিবর্তন হয়েছে, আর না তা থেকে কেউ শিক্ষা নিয়েছে। ফলে কত সহস্র বছর পূর্বের ফেরাউন বাহিনীর নৃশংসতায় পলায়নপর কিবতীদের সাথে বিংশ শতাব্দীর অংসান সুকী বাহিনীর নৃশংসতায় পলায়নপর রোহিঙ্গাদের দৃশ্যত কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, ফারাকটা এতটুকুই যে, সেই সময়কালকে আমরা ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করি, আর আমাদের কালকে সভ্যতা ও মানবিকতাগর্বী এক আলোকিত বিশ্বের মর্যাদা দেই। দেশ, কাল আর সভ্যতা ভেদে মানবতার করুণ পরাজয় এভাবে চলছেই নিরন্তর, যুগ থেকে যুগান্তরে, নিছক সেখানে পরিবর্তন ঘটে চরিত্র আর উপলক্ষ্যগুলোর।

শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে নাফ নদীর ওপর জেটিঘাটে এসে দাঁড়াই। এটিই সাবরাং পয়েন্ট। দিনের বেলা তেমন লোকজন চোখে পড়ে না। তবে রাত হ’লেই রোহিঙ্গাদের ভীড়ে ভরপুর হয়ে ওঠে। পাশেই গরুর হাট। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা গরুগুলোই সাধারণতঃ বিক্রি হয়। পানির দরে। নির্যাতিত মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কত মানুষ যে দৈনিক এই এলাকা থেকে পাপের সাগর আর মযলূমের তপ্ত অভিশাপ নিয়ে সগৃহে ফিরছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই।

বিজিবি ক্যাম্পের অফিসারদের সাথে কথা বলে জানা গেল সাধারণতঃ সন্ধার পর থেকে রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকাগুলো আসা শুরু করে। ভোর অবধি তা অব্যাহত থাকে। তারা নবাগত রোহিঙ্গাদের খানাপিনা এবং উখিয়ার অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে পাঠানোর কাজ তদারকি করছেন।

শাহপরীর দ্বীপ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে সাঁঝবেলায় উখিয়ার থাইংখালীতে যাত্রাবিরতি করলাম। জেলা সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলামের একজন কলায়েন্ট জনাব হারূন ছাহেব আমাদের আতিথেয়তা করলেন। উপস্থিত স্থানীয় কিছু ভাইয়ের সাথে আলাপ হ’ল। যারা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় দিন-রাত খাটছেন। কেউ কেউ নিজের বাড়ীর একাংশে রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়েছেন। তারা ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। পরে নবগঠিত উখিয়া উপযেলা ‘আন্দোলন’-এর আহবায়ক এ্যাডভোকেট সেলিম ভাইয়ের আমন্ত্রণে উখিয়া বাযারে এসে আরেকটি যাত্রাবিরতি করা হয়। ক্যাম্পগুলোর আশেপাশের রাস্তা রোহিঙ্গাদের ইতস্ততঃ আসা-যাওয়ায় মুখোরিত। ত্রাণের আশায় বেসামালভাবে ঘুরছে তারা। কোথাও ত্রাণ নিতে লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের অনেক স্থানেই দেখা ক্যাম্প উচ্ছেদের চিহ্ন। বিচ্ছিন্নভাবে নির্মিত ক্যাম্পগুলো ভেঙ্গে দিয়ে সবাইকে কুতুপালং -বালুখালী এলাকায় একত্রিত করা হচ্ছে। রাস্তায় ত্রাণের আশায় বসে থাকতে দেখা গেল বোরক্বা পরিহিত বহু মহিলাকে, যাদের পচানববই শতাংশ সন্তানকোলে। এদের সাথে যোগ দিয়েছে পুরোনো রোহিঙ্গারা। যোগ দিয়েছে মৌসুমী ভিক্ষুকরাও।

তমব্রু নো ম্যানস ল্যান্ড :   

পরদিন ১লা অক্টোবর গন্তব্য তমব্রু নো ম্যানস ল্যান্ড। আমি অসুস্থতার কারণে আজ বের হতে পারি নি। তবে মাসিক আত-তাহরীক সম্পাদক মহোদয়ের নিজ জবানীতে সফর বিবরণী অব্যাহত রাখছি। কক্সবাজার হ’তে দুই কার্টন কুরআন, নগদ অর্থ ও কিছু ছালাতুর রাসূল বই নিয়ে সকাল ৮-টায় আমরা রওয়ানা হই। উখিয়া সরকারী ডিগ্রী কলেজে স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে সেনা সদস্যদের মাঝে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বই বিতরণ করা হয়। যথেষ্ট আগ্রহের সাথে সেনা সদস্যরা বইগুলো গ্রহণ করলেন। সেখান থেকে বান্দরবান যেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তে পৌঁছি বেলা সাড়ে ১১-টায়। সেখানে নো ম্যানস ল্যান্ডে তাবু স্থাপন করে অবস্থান করছে শত শত রোহিঙ্গা পরিবার। পাশেই বার্মা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। মাঝে শুধু চিকন একটি খাল। বেড়ার ঐপাশে আগুনে পোড়া বাড়ীঘরের চিহ্ন দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। পুড়ে অঙ্গার হওয়া বৃক্ষগুলো পত্র-পল্লবহীন ঠায় দাড়িয়ে আছে। বেড়ার পাশেই পাহারারত দেখা গেল সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘নাসাকা’কে।

বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে আমাদের পরিচয় দিয়ে কিছু কুরআন বিতরণ করতে চাইলে ক্যাম্পের দায়িত্বশীল রেজিষ্ট্রার খাতায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর নাম এন্ট্রি করে দু’জন রোহিঙ্গাকে ডেকে আমাদের সাথে কথা বলিয়ে দিলেন।

সেখানে দেখা হ’ল গত ২৫শে আগষ্ট এদেশে আসা দাওরায়ে হাদীছ পাশ আলেম মাওলানা মকবূল আহমাদের সাথে। তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর যাবত সীমান্তের ঐ পাড়ে মংডু থানাধীন তমব্রু আবু দারেমী জামে মসজিদে ইমামতি করেছেন। দারুল উলূম হেমায়েতুল ইসলাম মাদরাসার শিক্ষকও ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১২ সালে পর সবকিছুই তছনছ হয়ে যায়। বর্মী সেনাবাহিনী বন্ধ করে দেয় মসজিদ-মাদরাসা। মুসলমানদের উপর নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন। কুরআন দেওয়ার কথা শুনে তিনি খুশী হ’লেন। অতঃপর দুই কার্টুন কুরআন (১৭৫টি) তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ক্যাম্পে যারা কুরআন পড়তে জানেন তাদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য। সাথে প্রায় তিন শতাধিক কায়েদাও দেওয়া হল বাচ্চাদের জন্য।

একই সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুযযামান খান কামাল এসেছেন তমব্রু সীমান্তে। তমব্রু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানের। সেকারণ আমাদের যাত্রা বিলম্ব হ’ল। পার্শ্ববর্তী তমব্রু পুরাতন জামে মসজিদে গিয়ে আমরা যোহর ও আছরের ছালাত জমা কছর আদায় করলাম। সেখানে সমবেত ১২জন রোহিঙ্গা ভাইয়ের সাথে কিছু সময় কথা হ’ল। যেলা সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলাম কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি তাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ শুনার পাশাপাশি তাদের উদ্দেশ্যে সান্ত্বনামূলক কিছু কথা বললেন এবং শিরক-বিদ‘আত মুক্ত ছহীহ দ্বীন পালনেরও উপদেশ দেন। এখানে সমবেত ১২ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন আলেম। কথা হ’ল মৌলভী নাজমুল হকের সাথে, যিনি ক্বারিয়ানা পাশ। মংডু থানার তমব্রু গ্রামের বাসিন্দা। সেদেশের একটি মসজিদে ইমামিত করতেন। ছিলেন রিয়াযুল জান্নাহ হিফযখানার শিক্ষক। কুরবানীর ঈদের পরের দিন বর্মী ম্যালিটারী ও মগ দস্যুদের নির্যাতনের মুখে সে গ্রামের ২ হাযার ৩শ’ জন একসঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে পাশে বসা মুহাম্মাদ নাছিম (৬৩) জানালেন, তাদের গ্রামের নাম তুলাতুলি। সে গ্রামের ৩০০ পরিবারে প্রায় ২০০০ লোক সংখ্যা। এর মধ্যে ৮০০ জনকে নির্যাতনের মুখে মেরে ফেলা হয়েছে। তার নিজ ভাগিনাদের তিনটি পরিবারের মাত্র ১ জন বেঁচে আছে। বাদবাকী সবাইকে দস্যুরা কুপিয়ে মেরেছে। এতদসত্ত্বেও মৌলভী নাজমুল হককে সে দেশে ফিরে যাবেন কি-না জিজ্ঞেস করলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘পাক্কা এরাদা আবার ফিরে যাব ইনশাআল্লাহ’।

কথা হ’ল দাওরায়ে হাদীছ পাশ আলেম মাওলানা নূরুল আলম (৪৫) এর সাথে। যিনি মাদরাসা দারু আবী যার গিফারী (রাঃ), তমব্রু, মংডু-এর শিক্ষক। তিনি বর্মীদের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্মী দস্যুরা সে দেশের জামে‘আ ইসলামিয়া দারুল উলূম, সা‘দুল্লাচর, উত্তর বলিবাজার, মংডু-এর শায়খুল হাদীছ, ১১৭ বছরের বৃদ্ধ, প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আহমাদ হোসাইনকেও রেহাই দেয়নি। আগুনে পুড়িয়ে তাঁকে হত্যা করেছে। টুপি, দাড়ি ও পাঞ্জাবীর উপরে এদের যত রাগ। ২০১২ সালের পর থেকে আমরা পঞ্জাবী-টুপি পরে চলাফেরা করতে পারিনি। মসজিদ-মাদরাসাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানালেন, মগ ও আর্মীদের পাশাপাশি বরুয়া ও চাকমারাও মুসলিম নিধনে একাকার হয়ে কাজ করছে। সকলে একাট্টা হয়ে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে।

তমব্রু হ’তে সরাসরি আমরা ফিরে আসি উখিয়ায় বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে, যেখানে ‘আন্দোলন’-এর উদ্যোগে টিউবওয়েল, টয়লেট, বাথরুমের কাজ চলছে। এখানে পাহাড়ের চুড়ায় নির্মাণাধীন এক মসজিদে বসে কথা হয় মংডু থানার বলিবাজার এলাকার গারদবিল গ্রামের আব্দুর রহমানের (২৭) সাথে। তিনি এখানে মাঝির (সরদার) দায়িত্বে আছেন। তার অধীনে আছে ৩১১টি পরিবার। দশম শ্রেণী পাশ আব্দুর রহমান ইংরেজী ও বার্মিজ ভাষা শিক্ষা দিতেন। পাশাপাশি তার ছিল ওয়েল্ডিংয়ের ব্যবসা। কুরবানীর ঈদের দুইদিন আগে ২৯শে আগষ্ট বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি জানালেন তাদের উপর মায়ানমার সরকারের লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা। তাদের গ্রামে ৮শ’ পরিবারে লোক সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ হাযার। এর মধ্যে পাঁচশ’ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বর্মী দস্যুরা। বাকী সবাই পালিয়ে এসেছেন এ দেশে। আর্মী, পুলিশ ও মগ সকলেই তাদের উপর নির্যাতন করেছে। নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বার্মিজ মিলিটারী আমাদেরকে এই মর্মে একটি কাগজে সই করে দিতে বলেছিল যে, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ। এখানে এসেছি কাজ-কাম ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য’। এটি করলে আমাদেরকে ঐ দেশে থাকতে দিবে এই প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু এটি স্রেফ প্রতারণা ও কুটকৌশল বুঝতে পেরে কেউ এই জাতীয় কোন কাগজে সই করতে সম্মত হইনি। ফলে আমাদের উপর এই বর্বরোচিত নির্যাতন শুরু হয়।

এ সমেয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা মুরুববীর সাথেও কথা হয়। আমাদেরকে দেখে তারা উৎসাহের সাথে বসলেন। বার্মায় থাকাবস্থায় কি ধরনের যুলুম-নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হ’তেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, মুসলমানদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। ছিল না কোন কর্মসংস্থান। এমনকি রাখাইন রাজ্য পার হয়ে বার্মার অন্যত্র যাওয়ারও তাদের কোন সুযোগ ছিল না। ফলে তাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল মৎস চাষ, কৃষিকাজ, গরু-ছাগল ইত্যাদি পালন ও ছোটখাট ব্যবসা। কিন্তু এখানেও চলত আর্থিক নির্যাতন। তিন মণ গোশত হবে এমন ওযনের একটি গরু বিক্রি করলে সেদেশের মুদ্রায় দেড় থেকে দুই লাখ কিয়েত চাঁদা দিতে হ’ত। যা বাংলাদেশী টাকায় ১০ হ’তে ১২ হাযার টাকা। ছাগল প্রতি ৩-৪ হাযার টাকা। রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিবাহের আয়োজন হ’লেও প্রায় ১ লাখ কিয়েত চাঁদা দিতে হ’ত। শুধু তাই নয় নিজেদের বসতবাড়ীর বেড়া পাল্টাতে গেলেও দিতে হ’ত এক হ’তে দেড় লাখ কিয়েত। উল্লেখ্য, এক লাখ কিয়েত সমান বাংলাদেশী প্রায় ৬ হাযার টাকা। কোথাও যাতায়াতের ক্ষেত্রেও চলত নির্যাতন। রাস্তায় যানবাহন থেকে নামিয়ে মুসলমানদের থেকে এক হ’তে দেড় হাযার কিয়েত চাঁদা আদায় করা হ’ত। অথচ একই গাড়ীতে মগ বা অন্য কেউ থাকলে তাদেরকে নামানো হ’ত না। অর্থাৎ মুসলমানদের স্বাধীনভাবে কোথাও যাওয়ারও সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ব্যাবসা করতে মাল কিনে ফেরার পথে দিতে হ’ত মোটা অংকের টাকা। উল্লেখ্য, বড় বড় পাইকারী দোকানপাট সবই মগদের মালিকানাধীন। কাজেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের কাছ  থেকেই মালামাল কিনতে হয়। মৎস চাষীদের অবস্থাও তথৈবচ। ঘের প্রতি মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে চাষের অনুমতি মিলত। এরকম হাযারো যুলুম-নির্যাতনের মধ্যে অতিবাহিত হ’ত তাদের প্রতিটি দিন।

অতঃপর পার্শ্ববর্তী আরেকটি পাহাড়ে ‘আন্দোলন’-এর উদ্যোগে একটি মসজিদ নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ পূর্বক জায়গার মালিকের সাথে কথা চূড়ান্ত করতঃ সেদিনের মত কাজ শেষ করে আমরা কক্সবাজারে ফিরে আসি।

বালুখালী-কুতুপালং ক্যাম্প :

পরদিন ২রা সেপ্টেম্বর বালুখালী ক্যাম্পে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে রওয়ানা হ’লাম। এদিন আমাদের সাথী হ’লেন ইন্দোনেশিয়ার মাকাস্সার প্রদেশ থেকে আগত একটি সালাফী এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘আল-ওয়াহদাহ আল-ইসলামিয়া’র পরিচালক ভাই সাহরুদ্দীন (৪০)। ক্যাম্পে পৌঁছে মসজিদ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থানে পৌঁছলাম। এখানে কয়েকজন রোহিঙ্গা আলেমের সাথে সাক্ষাত হ’ল। যাদের একজন মংডু থানার জিমাংখালী গ্রামের হাফেয নূরুল ইসলাম (৪০), অপরজন একই থানার নোয়াপাড়া গ্রামের হাফেয রবীউল হাসান (৩৫)। ১০ দিন পূর্বে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। দু’জনই প্রায় ২০ বছর পূর্বে বাংলাদেশ থেকে দাওরায়ে হাদীছ সম্পন্ন করেছেন বলে ভাল বাংলা বলতে পারেন। এছাড়া আরবী, উর্দূ ও ইংরেজী ভাষাতেও তাদের যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। প্রথমজন শিক্ষকতা করতেন মংডুর বাকিয়ারবিল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসাতুত তাওহীদ আল-ইসলামিয়া’তে। অপরজন নয়াপাড়া ‘দারুত তাহফীয’ মাদরাসায়। দু’টি মাদরাসাই এখন আগুনে পুড়ে এবং রকেট লাঞ্চারের আঘাতে ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত হয়েছে। দু’জনকেই আরবী এবং উর্দূতে আক্বীদা ও তাওহীদ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করলাম। আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে তারা নিজেদের বিশুদ্ধ আক্বীদার কথা জানান দিলেন এবং চমৎকারভাবে কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতিসহ প্রশ্নের উত্তর দিলেন। ইবনে তায়মিয়া এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের আক্বীদার বইগুলো তারা নিজেরা পড়েছেন এবং ছাত্রদের পড়িয়েছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। এভাবেই বুঝি আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরস্পরের সাথে মিলিয়ে দেন। আমরা কোনভাবেই ধারণা করিনি যে, শিক্ষার আলোহীন এই জনপদে কোন বিশুদ্ধ আক্বীদার আলেম পাব। আল্লাহর পরিকল্পনা বোধহয় এভাবেই বাস্তবায়িত হয়। মসজিদ স্থাপনের কাজটি এবার খুব সহজে এবং তৃপ্তির সাথে হাতে নেয়ার সুযোগ এল। ইন্দোনেশিয়ান ভাইটি সব জেনে খুব খুশী হ’লেন এবং নিজের সংস্থা থেকেই মসজিদটি নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিলেন। মুজিব ভাই তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় সব নিয়ম-কানূন অবগত করালেন এবং মাঝির মাধ্যমে মসজিদ, মক্তব ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ পুরো প্রকল্পের কাজটি বুঝিয়ে দিলেন।

অত্র মসজিদে শামসুল হক (৭৫) নামে একজন বৃদ্ধকে পাওয়া গেল, যার ছেলে মুহাম্মাদ তৈয়ব (৪৫) ইয়াংগুনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করেছিলেন। কিন্তু কোন চাকুরী পাননি রোহিঙ্গা হওয়ার অপরাধে। আলেমদের উপর নির্যাতনের ধরণ সম্পর্কে তারা বললেন, সেনারা তাদেরকে ধরে নিয়ে দাঁড়ি পুড়িয়ে দেয়, চেহারায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে। হাত ও জিহবা কেটে দেয়। হাটুতে পেরেক ঢুকায়। ২০১২ সালের পর এমন অবস্থা হয়েছে যে, তারা তাদের সামনে পাঞ্চাবী/টুপি পরতে পারেন না। শার্ট/লুঙ্গি পরতে হয়। মসজিদ-মাদরাসা প্রায় সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জীবন-জীবিকার উৎস ছিল মাছের প্রজেক্ট, ধান, আলু, শাক-সবজির চাষ ইত্যাদি। ২০ গন্ডা (৪০ শতাংশ) জায়গা চাষ করলে সরকারকে দিতে হয় ৬০ হাযার কিয়েট বা ৪/৫ হাযার টাকা। পদে পদে তাদেরকে জরিমানা দিয়ে চলতে হ’ত।

উপস্থিত সকলের মাঝে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। পাহাড়ের ফাঁকে অলি-গলি ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। পলিথিনের ছাউনী দিয়ে তৈরী ঝুপড়ি ঘরগুলো থেকে উৎসুক দৃষ্টি আমাদের ঘিরে ধরেছে। পিছু নিয়েছে শিশুরা। তাদের সালাম দেয়ার অভ্যাস দেখে মন ভরে যায়। আমাদের হাতে কেবল নগদ অর্থ। বিশৃংখলার ভয়ে তা আর বিতরণ করা হয় না। টিউবয়েল ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। ফলে পানির কষ্ট অনেকটা ঘুচেছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় দৃষ্টিকটুভাবে খুব ঘন ঘন টিউবয়েল পোঁতা হয়েছে, যার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এমনকি কিছু মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় পাশাপাশি, যা নিয়ে পরে সেনাসদস্যদেরও বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখলাম। অতি উৎসাহী এমন কার্যকলাপ যেন অকল্যাণ ডেকে না আনে, সে ব্যাপারে সকলের সতর্ক থাকা উচিৎ। ইতিমধ্যেই মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণে বাঁধা-নিষেধ আসছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মাঝির সহযোগিতায় প্রায় শতাধিক পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ করা হ’ল। এখানেও একজন সেনাসদস্য আপত্তি জানালেন। বললেন, সেনাক্যাম্প থেকে যদি যোগাযোগ করে গাইডলাইন নিয়ে আসতেন, তাহলে আপনাদের বিতরণটা আরও সুষ্ঠু হ’ত। সেখানে এক নবনির্মিত মসজিদে যোহর-আছর ছালাত আদায় করলাম রোহিঙ্গাদের সাথে। ছালাত পর প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা শিশু এক শিক্ষকের অধীনে কুরআন শিক্ষা শুরু করল। চমৎকার সে দৃশ্য। বেরিয়ে এসে আবারও বেশ দীর্ঘ পথ হাঁটা। ভেতরে কিছু দোকানঘর গড়ে উঠেছে। বিস্কুটসহ হালকা খাবারের চাহিদা মেটাচ্ছে এগুলো। সংগঠনের ভাইদের প্রচেষ্টায় নির্মিত টিউবয়েল ও ল্যাট্রিনগুলো পরিদর্শন করে প্রায় আছরের সময় দ্বিতীয় নির্মিতব্য মসজিদের নিকটে আমরা উপস্থিত হলাম। প্রায় ১৩৫টি ঘর রয়েছে এই পাহাড়ের আশপাশে। বেশ নিরিবিলি একটি স্থান নির্ধারিত হয়েছে মসজিদের জন্য। দখলসূত্রে জায়গার মালিক ও স্থানীয়রা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং একবাক্যে এখানে মসজিদ ও মক্তব নির্মাণের জন্য একমত হ’লেন।

এখানেও কয়েকজন আলেমের সাথে দেখা হ’ল। মাসিক আত-তাহরীক সম্পাদক মহোদয় জনৈক আলেম নূর মুহাম্মাদ (৪৬)-এর একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিলেন, যিনি ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীছ ফারেগ হয়েছিলেন। উত্তর মংডুর রোহিঙ্গাদং গ্রামে তার আবাস। বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন হামলা শুরুর পরপরই। ইতিপূর্বে গ্রামেই মাদরাসা মুআয বিন জাবাল নামে মিশকাত জামা‘আত পর্যন্ত একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে ২ শতাধিক ছাত্র ছিল। ২০১২ সালের হামলায় সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে আয়-রোযগার প্রায় বন্ধ। তবে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন সহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার অর্থ সহযোগিতায় দিন গুজরান হয়ে আসছিল। আলেমদের প্রতি সরকারী সেনাদের তাদের কোপটা বেশী ছিল। কারও গায়ে পাঞ্জাবী দেখলেই তারা ধরে নিয়ে যেত। এমনকি কোন বাড়ীতে পাঞ্জাবী পেলে মানুষ ছাড়াই পোষাকে গুলি করত।

আলেমদের প্রতি তাদের বিশেষ ক্রোধ ছিল যে, তারা সাধারণতঃ ৪টি বিয়ে করতেন। এতে তাদের সন্তানাদি বেশী হ’ত। বৌদ্ধরা এটি সহ্য করতে পারত না। তারা সবসময় আরাকানে বৌদ্ধদের সংখ্যাগরিষ্টতা হারানোর ভয়ে থাকত। এতে যদি কখনও নির্বাচন হয়, তবে সরকারী ক্ষমতায় মুসলমানরা চলে আসবে। যেটা তাদের কাছে চক্ষুশূল। প্রধানতঃ এই কারণে তারা ক্ষুব্ধ  ছিল।

মুসলমানদের উপর তারা যে কত যুলুম নির্যাতন করেছে এতদিন, তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমাদের কোন কিছু করার স্বাধীনতা ছিল না। আমরা কখনও জেলা শহর আকিয়াব পর্যন্ত যেতে পারিনি। আমাদের সন্তানরা স্থানীয়ভাবে দশম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করতে পারত না। বিয়ে করা, বাড়ী করা, ফসল, ক্ষেত-খামার যা-ই করি না কেন, মোটা অংকের চাঁদা দেয়া লাগত। ঘুষ ছাড়া পা ফেলা কোন ব্যবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় আমরা সেখানে আছি বছরের পর বছর। জেলখানাও এর চেয়ে উত্তম জায়গা।           

‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভ্যাশন আর্মী)-এর কর্মকান্ড সম্পর্কে তিনি জানালেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম তারা মুসলমানদের উপকারের জন্যই কাজ করছে। কিন্তু পরে বুঝেছি তারা আসলে ক্ষতি করছে। আমাদের কোন গ্রামে হামলা হ’লে তাদেরকে কখনও প্রতিরোধ করতে শুনিনি। এমনকি তাদের কাউকে মারাও পড়তে দেখিনি। সেনারা এলে তারা আগেই পালিয়ে যেত। জানিনা তারা আগে থেকেই সেনাদের কাছ থেকে হামলার সংবাদ পেয়ে যেত কি না। গ্রামের মহিলারা পর্যন্ত লাঠিসোটা নিয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেত, অথচ ‘আরসা’র ছেলেদের কোন খোঁজ পাওয়া যেত না। এদের জিহাদ কেবল মুখে মুখে। আবার ‘আরসা’রা আসলেই বর্মী সেনাক্যাম্পের উপর হামলা করেছিল, এর কোন প্রমাণও আমরা জানিনা। করতেও পারে, নাও করতে পারে। অথবা তাদেরকে দিয়ে করানোও হতে পারে সেনাদের পক্ষ থেকে, মুসলমানদের উপর দোষ চাপানোর জন্য।

বৌদ্ধ বঙ্গী তথা ভিক্ষুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী একাট্টা। তারাই শুরু থেকে সরকারকে মুসলমানদের তাড়ানোর জন্য পড়ক্ষেপ নিতে বলে আসছে। আর সরকার তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করছে।

হিন্দুদের পালিয়ে আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বললেন, এরা এমনিতেই ভয়ে পালিয়ে আসছে। এদের উপর সরকারের কোন নির্যাতন ছিল না। তবে মুসলমানদের এলাকায় বসবাস করার কারণে হয়তবা বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা তাদের গ্রামে ভুল বশত হামলা চালিয়েছিল। তাতেই তারা ভীত হয়ে সীমান্ত পার হয়ে চলে এসেছে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ছিল যারা স্বজাতির সাথে মুনাফিকীতে লিপ্ত ছিল। মূলতঃ সরকারের পদ্ধতিগত কারণে তারা সহজেই এমন কর্মে জড়িয়ে পড়ে। যারা শিক্ষিত যুবক তাদের জন্য সরকারী অফিসে কোন কাজ নেই। এদেরকে টার্গেট করে সেনারা এবং তাদের অফিসে নেয়। কখনও তাদেরকে ইনফরমার হিসাবে রাখে। এভাবে তারা তাদের পক্ষে কাজ করতে করতে একসময় তাদেরই লোক হয়ে যায়।

দেশে ফিরে যাওয়ার আশা আছে কি না সে প্রশ্নের জবাবে তারা সবাই একবাক্যে জোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং বললেন, আমাদের হক্ব ফিরিয়ে দেয়া হ’লে এবং জানমালের নিরাপত্তা দেয়া হ’লে আমরা নিজ জন্মভূমে ফিরে যাওয়ার জন্য যে কোন সময় প্রস্ত্তত ইনশাআল্লাহ।

সাক্ষাৎকার নেয়া শেষে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হল। যেলা ‘আন্দোলন’-এর সমাজকল্যাণ সম্পাদক আরমান হোসাইন ভাই দায়িত্ব বুঝে নিলেন। তারপর সেখান থেকে অপর একটি মসজিদের জায়গা দেখতে গেলাম আমরা। তবে পাশাপাশি মসজিদ থাকায় সেটির পরিকল্পনা বাদ দেয়া হ’ল।

সফরসঙ্গীরা কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে আমি এবং আন্দোলনের উখিয়া উপযেলা সদস্য সাইফুল ইসলাম ভাই স্থানীয় এক দোকান থেকে পানি নিয়ে পান করার জন্য বসেছি। এসময় এক সুন্দর রোহিঙ্গা শিশুর প্রতি নযর পড়ল। বোনের কোলে করে এসেছে। তাকে আদর করতে গিয়ে গলায় তাবীযের অস্তিত্ব টের পেলাম। বোনকে বললাম, তাবীয তো রাখা যাবে না গলায়, এটা শিরক। ভরসা করতে হবে কেবল আল্লাহর ওপর। উপস্থিত বেশ কিছু লোক চারপাশে জমে গেল। ঘটনাক্রমে মাওলানা নূর মুহাম্মাদও একই সময় দোকানে এলেন। আমরা তাবীযটি খোলার কসরত করছি দেখে তিনি বলে উঠলেন হাদীছটি-‘মান আল্লাকা তামীমাতান ফাক্বাদ আশরাকা’। আমি সত্যিই তার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। মাথায় পাগড়ী আর নামের কারণে উনার কাছ থেকে এই হাদীছ শুনব, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কোথা থেকে কেঁচি আনিয়ে তিনি নিজেই আমাদের সহযোগিতা করলেন তাবীযটি কাটাতে। শেষে মাওলানাকে অনুরোধ করলাম তাবীজ খোলার কারণ মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিতে, যেন তার মাকে বুঝিয়ে বলতে পারে। তিনি মেয়েটিসহ উপস্থিত লোকদের বুঝিয়ে বললেন। আমরা মেয়েটির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

আমার মনে এই ভাবান্তর এল যে, প্রতিটি মানুষের অন্তরে একটি দিক রয়েছে যা খাঁটিভাবে হক্বপিয়াসী। সময়ে সময়ে তা জেগে ওঠে। বহু আলেম হক্ব জানেন। কিন্তু সামাজিক প্রচলনের ভয়ে কথা বলতে পারেন না। এই আলেমও নিশ্চয়ই সমাজের ভয়ে এতদিন চুপ ছিলেন। আজ আমাদেরকে দেখে তার মুখ থেকে হক্বটি বের হয়ে গেল। সেই সাথে আরও মনে হ’ল, সাহস নিয়ে হক্ব কথা সর্বত্র বলা প্রয়োজন। এতে যারা সত্যিকারের হক্বপিয়াসী, তাদের অন্তরটা আল্লাহ হক্ব গ্রহণের জন্য খুলে দেন। এভাবে আমাদের প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইনশাআল্লাহ সমাজে একদিন হক্বের দাওয়াত বিজয় লাভ করবে।

বালুখালী ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার মুখে সেনাক্যাম্পের দায়িত্বরত সেনাদের সাথে কথা হ’ল। তারা আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংগঠনিক পরিচয় দিয়েই কথা বললাম। তারা ত্রাণ বিতরণে আমাদের নানা পরামর্শ দিলেন। প্রধান অফিসারটি বললেন, আপনারা নগদ টাকার বদলে এদেরকে খাদ্যসামগ্রী দিন। কারণ এদের অধিকাংশই টাকার পরিমাণ বোঝে না। ফলে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। আর খাদ্যদ্রব্য কমপক্ষে যেন এক সপ্তাহের প্রয়োজন পূরণ করে, সেটা খেয়াল রাখবেন। তাহ’লে আমাদের জন্য বিতরণেও সুবিধা হয়। এখানেও তাদের সুশৃংখল পরিকল্পনা জেনে ভাল লাগল। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ছালাতুল রাসূল (ছাঃ)-এর কিছু কপি বিতরণ করে ফিরে আসলাম। গাড়িতে ঢোকার মুখে যথারীতি একদল ত্রাণশিকারী মানুষের তীব্র চাপে পড়ে পিষ্ট হবার জোগাড়। ইন্দোনেশিয়ান ভাইটি এই অবস্থায় টাকার বান্ডিল বের করতে গেলে রীতিমত হুলুস্থুল বেঁধে গেল। আমরা তাঁকে দ্রুত নিবৃত করে গাড়িতে ঢুকে স্থান ত্যাগ করলাম। খোলা রাস্তায় ত্রাণ বিতরণ এই মুহূর্তে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তার একটা চিত্র দেখা হ’ল। সাধারণতঃ পুরনো রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় অভাবী বাঙ্গালীরাই এভাবে ভীড় জমাচ্ছেন বলে জানালেন যেলা ‘আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ।

রাতে কক্সবাজার ফিরে এসে আমরা ইন্দোনেশিয়ান ভাই সাহরুদ্দীনকে হোটেলে পৌঁছে দিলাম। তিনি সরকারীভাবে অনুমতি পেয়ে আগত ৭টি ইন্দোনেশিয়ান এনজিও সংস্থার একটির পরিচালক হিসাবে সপ্তাহখানেক পূর্বে বাংলাদেশে এসেছেন। একমাত্র তাঁর সংস্থাটিই ইসলামী সংস্থা। ইতিপূর্বে গত ফেব্রুয়ারী মাসে আরাকানের সিত্তে (আকিয়াব) শহরে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা কয়েকমাস মযলূম রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজ করেছেন। বাংলাদেশে আসার পূর্বে আমার ইসলামাবাদের এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আজকে আমাদের সরাসরি সঙ্গ পেয়ে এবং ত্রাণ বিতরণে অংশগ্রহণ করে তিনি খুব খুশী হ’লেন।

রাতে হোটেলে ফিরে কক্সবাজার যেলা সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলাম, সেক্রেটারী মুজীবুর রহমানসহ অন্যান্য সাংগঠনিক দায়িত্বশীল ভাইদের সাথে পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক হ’ল। এই সফরে সাংগঠনিক ভাইদের আন্তুরিক আতিথেয়তা ও রোহিঙ্গা ভাইদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। কক্সবাজারের মত শিরক-বিদ‘আত অধ্যুষিত এলাকায় তাদের মত একনিষ্ঠ মুখলিছ কর্মীবাহিনী ছহীহ দ্বীনের প্রসারে যে কত গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন, তা হয়ত তারা নিজেরাও পরিমাপ করতে পারেননি। তবে বাইরে থেকে আমরা যারা যাচ্ছি, তারা ঠিকই অনুভব করছি। আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন এবং দ্বীন ও সমাজের খেদমতে আমৃত্যু কবুল করে নিন। আমীন!







আরও
আরও
.