ঝিকঝিক শব্দের তালে ছুটে চলেছে ট্রেন। পেরিয়ে যাচ্ছি বহু পথ-প্রান্তর। মাঝে-মাঝেই জানালার প্রান্ত ছুয়ে দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে দূর-বহুদূরে। দৃষ্টির স্বাধীনতার সাথে সাথে ভাবনার স্বাধীনতাও জাগছে মনে। মাত্র দ্বিতীয় বারের মত ইজতেমায় যোগদান করতে যাচ্ছি। আসার আগে তাবলীগী ইজতেমা নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনেছি অনেক। বাতাসে ভেসে বেড়ানো টক-ঝাল-মিষ্টি কথোপকথন, অপপ্রচার ইত্যাদি ভেবে বিষণ্ণ বোধ করতে থাকি। একটা সময় রাজশাহী রেলষ্টেশন পৌঁছে যাই।

রেলগেট পেরুতেই দৃশ্যমান তাবলীগী ইজতেমা ২০১৭ উপলক্ষে নির্মিত তোরণ। পরিচ্ছন্ন শহর ও সড়ক বিভাজনে সৌন্দর্যের প্রকল্পসমূহ পেরিয়ে আমচত্বর যখন পৌঁছলাম আশে-পাশের ফেস্টুনগুলো দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। যাক এখানে অন্ততঃ তাবলীগী ইজতেমার রেশ পাওয়া যাচ্ছে। যেহেতু ইজতেমা শুরুর একদিন পূর্বেই উপস্থিত হয়েছি। সেকারণ তখনও দায়িত্বশীল ও অল্পসংখ্যক কর্মী ভাইয়েরা ব্যতীত দূর-দূরান্তের মেহমানবৃন্দ সমবেত হননি। সময় পেরিয়ে মাগরিবের ছালাতের পরই ধীরে ধীরে মুখরিত হচ্ছে মারকায প্রাঙ্গন। বিভিন্ন যেলার দায়িত্বশীল ও ‘যুবসংঘে’র স্বেচ্ছাসেবক কর্মীবাহিনীর পদচারণায় প্রাণ ফিরে পেল মারকায।

রাত গড়িয়ে ফজর হ’ল। জামা‘আতে ফজরের ছালাত শেষে মারকায মসজিদে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের নছীহত উপস্থিত মুছল্লীদের ঈমানী সতেজতাকে বৃদ্ধি করেছে বলে মনে হ’ল। ছালাত শেষে আমীরে জামা‘আত সাথী ভাইদের নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে অগ্রসর হচ্ছেন দেখে আমিও পিছু নিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী বালিকা শাখায় প্রবেশ করলেন। প্রায় ১০বিঘা জায়গা নিয়ে উচু প্রাচীরে ঘেরা মহিলা মাদ্রাসা। সমতল মাঠের দু’পার্শ্বে মাদরাসার আবাসিক ও একাডেমিক কক্ষ সমূহের অবস্থান, প্যান্ডেলের পার্শ্ব ঘেষে পুকুর, পুকুরে ভাসমান লতা-গুল্মের গা ঘেঁষে ঘেঁষে রাজহাসের রাজকীয় বিচরণ।

তখনও মা-বোনদের আগমন শুরু হয়নি। আমীরে জামা‘আত মাদরাসার বিভিন্ন স্থান যেমন রান্নাঘর, খাবারের ব্যবস্থাপনা, গোসলখানা, টয়লেটসমূহ, প্যান্ডেলের সার্বিক কার্যক্রম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যেখানে ত্রুটি রয়েছে সেখানে দ্রুতই কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে চললেন মূল প্যান্ডেলের দিকে। ট্রাক টার্মিনাল ময়দান হচ্ছে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে প্যান্ডেল। প্রথমেই খাদ্যসামগ্রীর বিশাল সম্ভার চোখে পড়ল, বিভিন্ন ধরনের সব্জি, তৈল, চালসহ অন্যান্য দ্রব্য। আমীরে জামা‘আত ঘুরে ঘুরে দেখছেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন দায়িত্বশীলদের। খাবার ব্যবস্থাপনার বিশালতা দেখে মনে প্রশ্ন জাগল এই খাদ্যসামগ্রী কিভাবে সংগৃহীত হয়? দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানলাম, খাবার মূলতঃ ক্রয় করা হয়। আবার কোন কোন যেলা থেকে আগত কর্মী-দায়িত্বশীল এবং সংগঠনের শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই-বোনেরা তাদের নিজ নিজ উৎপাদিত শাক-সব্জি, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু ইত্যাদি কেউবা মাছ, গোশত, কেউবা তৈল-মসলাদি, কেউবা অর্থ দিয়ে এই খাতে সহায়তা করে থাকেন। অতঃপর বিভিন্ন যেলা থেকে আগত পূর্ব নির্ধারিত স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের মাধ্যমে খাবারের জন্য নির্মিত প্যান্ডেলে টোকেন দিয়ে সুশৃংখলভাবে খাবার সরবরাহ করা হয়। উল্লেখ্য যে, পুরুষ ও মহিলাদের অবস্থানের ভিন্নতা ও শারঈ পর্দার আবশ্যিকতার কারণে মহিলাদের খাবার ব্যবস্থাপনা মহিলা প্যান্ডেলেই করা হয় এবং মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকা দ্বারা সুচারুরূপে পরিবেশন করা হয়।

আলহামদুলিল্লাহ! খাবারের স্থান অতিক্রম করে সুবিশাল প্যান্ডেলের এ মাথা থেকে ওমাথা হাঁটছি। তখনও কিছু কিছু কাজ চলছিল। দ্রুত শেষ করার জন্য আমীরে জামা‘আত তাগাদা দিচ্ছেন। এতবিশাল প্যান্ডেল যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। প্যান্ডেলের পার্শ্বেই প্রয়োজনীয় পানির কল স্থাপন করা হয়েছে। মূল মঞ্চ থেকে খানিকদূরে নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী টয়লেট যাতে দুর্গন্ধের কারণে মেহমানদের কষ্ট না হয়।

অতঃপর সেখান থেকে মূল সড়কের পাশ ঘেঁষে মারকাযের দিকে হাঁটছি প্রায় ২০-২৫ জনের ছোট্ট দলটি। হাঁটার মাঝে মনের গভীরে বার বার উঁকি দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। এতবড় সম্মেলন। খরচ যোগান হয় কিভাবে? দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ট্রাক টার্মিনালের জায়গায় প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে ইজতেমার আয়োজন করা হয়।  এর জন্য কোন ফী দিতে হয় না। আর সার্বিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য ইজতেমার দু’মাস পূর্ব থেকে সারা দেশে যেলা দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে কুপন বিতরণ করা হয়। প্রত্যেক যেলার জন্য পৃথক কোটা নির্ধারণ করা হয়। আমীরে জামা‘আত থেকে শুরু করে সংগঠনের সকল স্তরের দায়িত্বশীল ও কর্মীবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া সংগঠনের প্রবাসী শাখাসমূহ এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। যার মাধ্যমে সম্মেলনের পুরো ব্যয়ভার বহন করা হয়। এরূপ নানা বিষয় জানার মধ্য দিয়ে আমীরে জামা‘আতের সাথে সমাপ্ত হ’ল প্রাতঃভ্রমণ।

সকালের নাশতা সেরে মাসিক আত-তাহরীক-এর গবেষণাগারে প্রবেশ করলাম। প্রচন্ড ব্যস্ততার ফাঁকে পরিচিত/অপরিচিত দায়িত্বশীল ভাইদের কাজের গতি দেখে দ্রুতই বেরিয়ে আসলাম, যাতে তাদের কাজে ব্যাঘাত না ঘটে। পূর্বের রাতেও এমন হয়েছিল। সালামের জবাব ছাড়া আর কিছু বলার ফুরসত-ই পাচ্ছেন না তারা!

উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক ঘন্টা কাটানোর পর ইজতেমা মাঠের দিকে রওয়ানা দিলাম। ইতিমধ্যে সড়কের পাশগুলোতে গাড়ি রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন যেলা থেকে কর্মী ও সুধীদের আগমন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরুষদের গন্তব্য ট্রাক টার্মিনাল এবং মহিলাদের গন্তব্য মহিলা মাদরাসা; অধিকাংশই হেঁটে যাচ্ছেন। কেউ কেউ যাচ্ছেন অটোগাড়িতে চড়ে। একটা অটোতে উঠে বসেছি। অটো চলামাত্রই এক ভাই কিছুটা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইজতেমা মাঠের দিকেই যাবে তো? বললাম, জ্বী। অটো চলছে। সহযাত্রীর দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, এই ভাইকে কোথায় যেন দেখেছি? বললাম, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি? মৃদু হেসে বললেন তাঁর নাম। নাম শুনেই বললাম, আরে আপনি! এখানে কি আলোচনা করবেন? না, মানে দেখতে ও শিখতে এসেছি। মাযহাব ও পীর বাণিজ্য ছেড়েছি। তাই শেখার ও সংশোধনের প্রয়োজন প্রতি পদক্ষেপে।

ইজতেমা ময়দানে পৌঁছতেই দেখি প্যান্ডেলের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের নির্ধারিত স্থান দখলে নিচ্ছেন বিভিন্ন যেলা থেকে আগত ভাইয়েরা। খানিকক্ষণ কথা-বার্তা ও মঞ্চ-প্যান্ডেল ঘুরে দেখার এক পর্যায়ে সংগঠনের দায়িত্বশীল ভাইদের সাথে প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের কথোপকথন কানে আসল। প্রশাসনের ভাইয়েরা (অন্য বিভাগ থেকে বদলির কারণে অবগত না থাকায়) সন্দিহান যে, এদেশে আহলেহাদীছরা আর কত? মাঠ কি পূর্ণ হবে? সংগঠনের ভাইয়েরা বলছেন, ইনশাআল্লাহ সময়েই দেখবেন। ময়দান থেকে আলোচকদের অবস্থানের কক্ষ মারকাযের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

মাদরাসায় আলোচকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে পৌঁছে দিয়ে একজন সম্মানিত নীতিনির্ধারককে একজন আলোচক ছাহেবের বিষয়ে অবগত করালাম। সম্ভব হ’লে বক্তব্যের সময় দেয়া যায় কি-না ভেবে দেখবেন। তিনি বললেন, ইজতেমার আলোচকদের কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শেষ করতে হয়। আর পূর্বেই সময় ভাগ করে শিডিউল তৈরী করা হয়েছে। তাই নতুন কাউকে সুযোগ দেয়া দুরূহ ব্যাপার।

যোহরের ছালাত মারকায মসজিদে আদায় শেষে ইজতেমা ময়দানের উদ্দেশ্যে ফটক পেরুতেই অনাবিল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল দেহ-মনে। একপা, দু’পা করে যতই সামনে এগুচ্ছি বিস্ময়ের ঘোর কাটছেই না! আমচত্বরের চারপাশের রাস্তা সমূহ বিভিন্ন বাহনে বিভিন্ন যেলা থেকে আগত মেহমানদের ভিড়ে জনারণ্য। সবার গন্তব্য ইজতেমা ময়দান ও মহিলা সালাফিয়া মাদ্রাসা। প্রশান্ত মনে ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করতেই দৃষ্টিগোচর হ’ল মাঠ প্রায়ই পূর্ণ, কিন্তু জনস্রোত আসছেই। জানতে পারলাম জনগণের উপস্থিতি বিগত সকল ইজতেমাকে ছাড়িয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।

বাদ আছর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মঞ্চে উঠলেন। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, অনুবাদ ও ইসলামী জাগরণী শেষে উদ্বোধনী বক্তব্য পেশ করার জন্য আমীরে জামা‘আতের নাম ঘোষণা করা হ’ল। আমীরে জামা‘আতের কন্ঠস্বর অবারিত হওয়ার সাথে সাথেই কোলাহলমুখর পরিবেশে পিনপতন নীরবতায় নেমে আসল। একেই বুঝি বলে জামা'আতবদ্ধ জীবনের বাস্তবরূপ। বিশাল মাঠ তখন আগত ভাইদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ফটকগুলো দিয়ে তখনও জনস্রোত আসছেই। স্থানাভাবে অধিকাংশই আলোচনা শ্রবণের জন্য যেখানে সুবিধা পাচ্ছেন সেখানেই অবস্থান নিচ্ছেন।

আমীরে জামা‘আতের ভাষণের মাধ্যমে ইজতেমার মূল আলোচনা শুরু হ’ল। আলোচকগণ পর্যায়ক্রমে নির্ধারিত বিষয়ের উপর ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য পেশ করেন। মাগরিবের ছালাতের পর পুনরায় বক্তব্য শুরু হয়েছে। গভীর মনোযোগের সাথে আগত মেহমানগণ বক্তৃতা শ্রবণ করছেন। মাঝে মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ বলে সাড়াও দিচ্ছেন।

হাল্কা খাবার গ্রহণ এবং আশপাশের পরিবেশ দেখার অভিপ্রায়ে মাঠ থেকে বেরুতেই অপার বিস্ময়! জনতার আধিক্যের কারণে বিস্মিত প্রশাসন। ইজতেমা মাঠ ও আমচত্বর সংলগ্ন সড়কগুলো বন্ধ করে বাহনসমূহকে বিকল্প রুটে চলার ব্যবস্থা করেছেন। অথচ দুপুর নাগাদ সন্দেহের দোলাচলে ছিলাম। মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেহমানদের একটা অংশ মারকাযের উভয় পার্শ্বের কক্ষগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। তবে অনেককে খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পার্শ্বেও অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

মূল প্যান্ডেলের পার্শ্বেই ছিল মাদরাসার ইয়াতীম ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তার জন্য স্থাপিত কক্ষ। সেখানে দৃশ্যমান ছিল এককালীন/ মাসিক দানের নিমিত্তে সম্মানিত দাতা ভাইদের ভিড়।

প্যান্ডেলের শেষপ্রান্ত পেরিয়ে অপর পার্শ্বে ছিল তাবলীগী ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ বুক স্টল। সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রকাশক ভাইগণ কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক নানা প্রকাশনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এসব স্টলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক বিশুদ্ধ আক্বীদার বইয়ের বিপুল সমারোহ থাকে। এখানে স্টল নেওয়ার জন্য বুকলিষ্ট জমা দিয়ে আগেই বরাদ্ধ নিতে হয়। কোন কোন স্টলে সম্মানিত আলোচকদের বক্তব্যসহ মোবাইলে, ল্যাপটপে, মেমোরী কার্ডে আপলোড করা হচ্ছে। সবসময় ভীড় লেগেই আছে সেগুলিতে।

‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ও ‘সোনামণি’-এর দায়িত্বশীল ও কর্মীরা সংগঠনের পরিচিতি, লিফলেট, বিভিন্ন অমীয় বাণী লেখা ফেস্টুন, তাবলীগী ইজতেমা ও সংগঠনের নাম লেখা গেঞ্জি, দেওয়াল পত্রিকা ইত্যাদি নিয়ে সংগঠনের ষ্টল। যেখানে দায়িত্বশীল অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মানুষের চাহিদামত জিনিস এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

এদিকে একের পর এক সম্মানিত আলোচকগণ গভীর রাত পর্যন্ত বক্তৃতা করছেন। শ্রোতাগণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বিষয়সমূহ অনুধাবনের নিরন্তর চেষ্টা করছেন। পাশ থেকে কোন ভাই কথা বললে বিনয়ের সাথে আলোচনা শ্রবণে ব্যাঘাত না ঘটানোর অনুরোধও করছেন।

ইজতেমার দ্বিতীয় দিন সকালে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মারকায মসজিদে এবং মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল ছাহেব ইজতেমা প্যান্ডেলে দরস পেশ করেন। মূল প্যান্ডেলে পুনরায় বিষয় ভিত্তিক বক্তব্য শুরু হয়। চলে ৯-টা পর্যন্ত। অতঃপর জুম‘আ পর্যন্ত বিরতি। জুম‘আর ছালাতে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার ও মাযহাবের ভাইগণ সন্তানদের সাথে নিয়ে সানন্দে ছুটেছেন ইজতেমা ময়দানের দিকে। যেখানেই স্থান পেয়েছেন বসে পড়ছেন। মনোযোগ সহকারে খুৎবা শ্রবণ করছেন। একটু পর জামা‘আত শুরু হ’ল। লাখো মানুষের কাতারবন্দী এক বিশাল জামা‘আত। তিল ধারণের ঠাই নেই। এক অভাবনীয় দৃশ্য।

জুম‘আর ছালাত শেষে খাবার বিরতি। তারপর বাদ আছর থেকে পুনরায় শুরু হ’ল আলোচনাপর্ব। পর্যায়ক্রমে সম্মানিত আলোচকবৃন্দের বক্তব্য চলতে থাকল। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে সুললিত কণ্ঠে আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠীর  সমাজসংস্কার মূলক ইসলামী জাগরণী। ইজতেমার বিভিন্ন বিভাগে ‘আন্দোলন’, ‘যুবসংঘ’ ‘সোনামণি’ ও ‘মহিলা সংস্থা’র স্বেচ্ছাসেবকগণের অক্লান্ত পরিশ্রম, নিরলস কর্মতৎপরতা আমাদেরকে ছাহাবীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে বিভিন্ন গেইটে এবং মঞ্চের আশে-পাশে দায়িত্ব পালন করছেন স্বেচ্ছাসেবকগণ।

যেকোন সম্মেলনেই বড় অংকের খরচ হয় আলোচকদের পিছনে। কিন্তু ইজতেমায় এসে শুনলাম ভিন্ন কথা। আলোচকগণ এখানে স্বপ্রণোদিত হয়েই বক্তব্য প্রদান করেন। তাদের যাওয়া-আসা বা কোন সম্মানীর ব্যবস্থা থাকে না। বরং অনেক আলোচক সম্মেলনের খরচ বহনে নিজে অংশগ্রহণ করেন। ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার নির্ধারিত দিনের অনেক পূর্বেই আলোচকদের বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। নতুন আলোচকদের রেকর্ডকৃত আলোচনা যাচাই বাছাই করে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আরো জেনে বিস্মিত হ’লাম যে, ২৭ বছর যাবৎ চলমান এই ইজতেমায় এখন পর্যন্ত কোন আলোচক কখনো পাথেয় দাবী করেছেন বলে আয়োজকদের জানা নেই। সারা রাতব্যাপী চললো মনমুগ্ধকর বিষয় ভিত্তিক দালীলিক আলোচনা।

অতঃপর বাদ ফজর মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের বিদায়ী নছীহত ও অনুপস্থিত ভাই-বোনদের মাঝে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বার্তা পৌঁছে দেয়ার আবেগঘন দিক-নির্দেশনা ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত শ্রোতাদের মাঝে ইজতেমা ভাংগনের হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করে। অবশেষে বৈঠক ভঙ্গের এবং বিদায়ী দো‘আ পাঠের মাধ্যমে ২ দিনব্যাপী তাবলীগী ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটলো। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

অতঃপর ভগ্ন হৃদয়ে রাস্তায় এসে হাযারো মানুষের বিদায়ী যাত্রার সঙ্গী হ’লাম। মানুষের আধিক্যে আম চত্বরে আসতে অনেক সময় লেগে গেল।

নিজ গন্তব্যের পথে এগিয়ে চলা ভাই/বোন নব প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ সংস্কারের ব্রত নিয়ে নিজ গন্তব্যে ফিরে চলেছেন। কিন্তু একটা মানুষ যার হৃদয়ে লাখো স্বজনের চলে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, ছলছল তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখের বিদায়ী চাহনী, সুস্থ শরীরে গন্তব্যে সাথীদের পৌঁছানো পর্যন্ত উৎকন্ঠিত একটা দেহের পায়চারী আর যেলাভিত্তিক ফোন পাওয়ার প্রতীক্ষা। তিনি আমীরে জামা‘আত। হয়তো আমরা কেউ তাঁর হৃদয়ের আকুতি বুঝতে পারি। আবার হয়তো কেউ বুঝতে পারি না। যারা বুঝতে পারি, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে ভালোবাসি। যারা পারি না তারা হয়তো গীবত-তোহমত আর সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাই। হয়ত এটাই দুনিয়ার নিয়ম। তারপরও মানুষ হিসাবে মুসলমান হিসাবে দুনিয়াবী স্বার্থের হিংসা-বিদ্বেষকে ভুলে ভাই-ভাই হয়ে যাওয়াটাই কাম্য।

আগত বছরের ইজতেমায় হয়তো এই বছরের উপস্থিত কোন ভাই/বোন ইহজগতের মায়া কাটিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাবেন, কেউবা অসুস্থতা বা কোন ব্যস্ততায় উপস্থিত থাকতে পারবেন না। মহান আল্লাহর রহমতে পুরনোদের সাথে নতুন কোন ভাই/বোন আসবেন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার প্রত্যয়ে। শুধুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, ইনশাআল্লাহ হাযারো ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে নিজের মূল্যবান সময় ও অর্থকে দ্বীনের পথে ব্যয় করবেন পরকালে জান্নাত প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।

আলহামদুলিল্লাহ! জনগণের হৃদয়ের তাড়না দেখে আমার কেবল মনে হয়েছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে আহবান তা রোধ করার সামর্থ্য কারো নেই। মহান আল্লাহই সর্বোত্তম কৌশলী। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাবলীগী ইজতেমার মহান আহবানকে বুকে ধারণ করে নিজেকে জান্নাতী মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা এবং অপরকে সে পথে আহবান জানানোর তাওফীক দান করুন- আমীন!







আরও
আরও
.