নবী-রাসূলগণের যুগে এলাহী বিধান প্রতিষ্ঠায় যেমন পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র এই চার ধরনের বাধা ছিল। বর্তমান সময়েও হক্ব প্রতিষ্ঠায় এই চার ধরনের বাধা বিরাজমান। বাংলাদেশে প্রচলিত বাপ-দাদার লালিত মাযহাব পরিত্যাগ করে আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে বিভিন্ন যেলায় চলছে নির্যাতন-নিপীড়ন। তৃণমূল পর্যায়ে ঘটে যাওয়া অনেক কথাই আমরা জানতে পারি না। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এরকম দু’টি ঘটনা। নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) গত ১০ই নভেম্বর মঙ্গলবার টাঙ্গাইল যেলায় সফর সমাপ্ত করে রাজশাহী ফেরার পথে যমুনা সেতু পূর্ব পাড় রেল স্টেশনে দেখা পেলাম ডাঃ রফীকুল ইসলামের। তাঁর বাড়ি ভুয়াপুর থানার ৬নং নিকরাইল ইউনিয়নের চরপাতালকান্দি গ্রামে। ২০১০ সালে তাঁর বন্ধু ইব্রাহীমসহ এলাকার দশ-বার জন্য যুবক হক্বের সন্ধান পেয়ে আহলেহাদীছ হন। তারপর তারা দাওয়াতী কাজে তৎপর হন। ডাঃ রফীকুল নিজে শতাধিক কপি ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বই কিনে বিতরণ করেন এবং ২০ কপি মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকা নিয়মিত বিতরণ করতেন। তাদের দাওয়াত ও প্রচারের ফলে এলাকায় প্রায় ত্রিশ জনের মত যুবক হক পথের সন্ধান পান।

স্বভাবতই এলাকায় তাদের এই পরিবর্তন আলোচনার বিষয়বস্ত্ত হয়ে পড়ে। জনৈক মুফতী তাদের দাওয়াতী কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান। তিনি এলাকায় ‘আহলেহাদীছ’ বিরোধী জনমত গড়ে তোলেন। জনগণ ইউ.পি চেয়ারম্যানের নিকট তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দায়ের করে। চেয়ারম্যান তাদের ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। চড়-থাপ্পড় মারেন। কান ধরে উঠা-বসা করিয়ে ওয়াদাবদ্ধ করান যে, আর আহলেহাদীছদের মত আমল করবে না। যদি তা করে জনপ্রতি ৫০ হাযার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এক পর্যায়ে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। কারো কারো বাড়ীর সামনের রাস্তা বাঁশের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়। যেন বাড়ী থেকে বের হ’তে না পারে। তাদেরকে মাসিক আত-তাহরীক সহ সকল প্রকার বই-পুস্তক বাড়ী থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করে। তাদেরকে বলা হয় যে, বাইরে থেকে কোন মেহমান এলে গায়ের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলে অপদস্ত করা হবে।

ডাঃ রফীকুল ইসলামের ভাষ্য মতে, তারা এখন আর আত-তাহরীক পত্রিকা নিতে পারছেন না। দাওয়াতী কাজ করা তাদের জন্য খুব বিপদজনক হয়ে উঠেছে। থানার ওসিকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

(২) গত ১৮ই নভেম্বর ২০২০ তারিখ সকাল সাড়ে ৯-টায় ফরিদপুর যেলার সালথা থানাধীন ডাঙ্গা কামদিয়া গ্রামে আহলেহাদীছ মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ও জুম‘আ আদায় করা হ’ত। মাদ্রাসায় আবাসিক ও অনাবাসিক ৪০ জন শিক্ষার্থী  অধ্যয়ন করত, যাদের বয়স ১০ বছরের নীচে।

মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছহীহ হাদীছের দুশমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও একশ্রেণীর ধর্মনেতা প্রশাসনের কাছে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিল। আহলেহাদীছের মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙ্গে দিয়ে এলাকা হ’তে তাদের উৎখাত করা হবে মর্মে হুমকি দিচ্ছিল মাঝে মধ্যেই। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ই নভেম্বর সকাল ৮-টার পর থেকে ‘ওলামা পরিষদ ও তাওহীদী জনতার’ ব্যানারে ‘আহলেহাদীছের আস্তানা, সালথা থানায় থাকবে না’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করে লাঠি হাতে নিয়ে প্রায় সাত শত লোক একযোগে বর্বরোচিত এ হামলা চালায়। হামলাকারীরা মসজিদ-মাদ্রাসায় রক্ষিত পবিত্র কুরআন ও বুখারী-মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ পানিতে ফেলে দেয়। তারা মাদ্রাসার টিনশেড দু’টি ঘর, শ্রেণীকক্ষে ব্যবহৃত আসবাবপত্র,  খাট, টেবিল, বেঞ্চ, স্টীলের ট্রাংক ভাংচুর করে। ১৪টি সিলিং ফ্যান ও ১টি সোলার প্যানেল খুলে নিয়ে যায়। প্রধান শিক্ষক মাওলানা আব্দুল্লাহ মীযানের রুম থেকে ব্রিফকেসে থাকা নগদ টাকাও লুট করে নিয়ে যায়। এ সময়ে মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়।

সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ২৮শে নভেম্বর শনিবার আমরা উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদ ও মাদ্রাসা সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য কামদিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম। মাদ্রাসার পরিচালক ইলিয়াস ভাই আমাদের পেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণেই পৃথকভাবে মসজিদ-মাদ্রাসা করতে বাধ্য হয়েছি। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার এক সাথী ভাই সালথা বাযার মসজিদে জোরে আমীন বলেছিল। সে কারণে তাকে জুতা দিয়ে পিটিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। আমার মেয়ে তাদের মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছিলাম। তার ছালাত আদায়ের পদ্ধতি দেখে তাকে অশালীন ভাষায় কটূক্তি করা হয়। ফলে তাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হই। এখন পৃথক মসজিদ মাদ্রাসা করেও এদের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পেলাম না। এদের বর্বরতা জাহেলী আরবকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হ’ল, এত বড় অপরাধ করার পরও অপরাধীদের কোন অনুশোচনা নেই। বরং উল্টো বাগাড়ম্বর। মসজিদ ভেঙ্গে তারা নাকি ছওয়াবের কাজ করেছে ও জিহাদের সমতুল্য আমল করেছে। আলেম নামের কলংক ঐসব লুটেরারা এমন সব মন্তব্য করছে। এরা এমন অপপ্রচারও চালাচ্ছে যে, ‘ওটা মসজিদ ছিল না। মাইকে আযান হ’ত না। মসজিদের মেহরাব ও মিম্বর ছিল না। ওটা সাধারণ বাড়ী-ঘর ছিল, তাই তারা ভাংচুর করেছে। এমনিভাবে জঘন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে প্রশাসন ও মিডিয়াকে নিজেদের পক্ষে রাখার কৌশল অবলম্বন করেছে।

পরিশেষে বলব, হক কখনো উৎখাত হয় না; বরং বাতিলই উৎখাত হয়। সালথা থানায়ও একই ফলাফল আসবে ইনশাআল্লাহ। তবে প্রয়োজন সর্বোচ্চ ছবর ও হেকমত অবলম্বন করা। আমরা মহান আল্লাহর নিকটে বিদ‘আতীদের হিদায়াত কামনা করছি এবং ছহীহ সুন্নাহ আমল করার তাওফীক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ সকলকে হকের উপরে টিকে থাকার তাওফীক দিন।- আমীন!

মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ

কেন্দ্রীয় দাঈ, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ।






আরও
আরও
.