
কুরআনী বিচার ব্যবস্থা হ’ল একটি ন্যায়ভিত্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ বিচার পদ্ধতি, যা মহান আল্লাহ প্রদত্ত আইন ও বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী আইন শুধুমাত্র অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার মৌলিক হাতিয়ার। কুরআনী বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ। এই বিচার ব্যবস্থা মহান রবের ন্যায়, সাম্য ও উদারনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে কুরআনী বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করা হ’ল-
১. আল্লাহর আইন : আল্লাহর আইনই কুরআনী বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করবে’ (মায়েদাহ ৫/৪৯)। এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয় যে, বিচারকার্যে আল্লাহর আইনই চূড়ান্ত মানদন্ড।
২. ন্যায়বিচার : কুরআনী বিচার ব্যবস্থা ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তিশীল, যা সামাজিক শান্তি ও ভারসাম্য পূর্ণভাবে বজায় রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন’ (নাহল ১৬/৯০)। তিনি বলেন, ‘আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়-নীতির সাথে করবে’ (নিসা ৪/৫৮)। ইসলামের স্বর্ণালী ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এই ন্যায়বিচারের বাস্তবতা কত অসাধারণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, যা বিশ্ব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
৩. সমতা : কুরআনী বিচার ব্যবস্থায় সকল মানুষ সমান। রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, শক্তিশালী-দুর্বল, নারী-পুরুষ সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়’ (নিসা, ৪/১৩৫)। জনৈকা উচ্চবংশীয়া মহিলার হাত না কাটার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে সুফারিশ আসলে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তাহ’লে আমি তার হাত কেটে দিতাম’ (বুখারী হা/৩৪৭৫)।
৪. বাদী ও অভিযুক্তের অধিকার রক্ষা : কুরআনী বিচার ব্যবস্থায় বাদী বা অভিযুক্তের অভিযোগ শোনা এবং তার প্রমাণ উপস্থাপনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়, যা ন্যায়বিচারের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় এতে বাদীর বক্তব্য যাচাই-বাছাইয়েরও ব্যবস্থা আছে, যাতে অন্যায়ভাবে কাউকে অভিযুক্ত না করা হয় এবং হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের না করা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকটে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা সেটা যাচাই কর’ (হুজুরাত ৪৯/৬)।
৫. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি : কুরআনী বিচারব্যবস্থায় প্রদত্ত অপরাধীর শাস্তি সমাজের জন্য দৃষ্টান্তমূলক হয়, যা ভবিষ্যতে যে কোন অপরাধীকে অপরাধের কঠোর পরিণাম সম্পর্কে চূড়ান্ত ভীতি প্রদর্শন করে। যেমন- (ক) হদ (সুনির্দিষ্ট শাস্তি) : কুরআনে কিছু মৌলিক অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন : চুরির শাস্তি হাত কাটা (মায়েদাহ ৫/৩৮), ব্যভিচারের শাস্তি রজম করা বা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা (নূর ২৪/২), ছিনতাই-রাহাজানির জন্য অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কঠোর শাস্তিবিধান (মায়েদা ৩৩) ইত্যাদি। এই শাস্তি অবধারিত, যা কেউ মওকূফ করতে পারবে না এবং শাস্তি জনসম্মুখে হয় বলে সম্ভাব্য অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যায়। (খ) ক্বিছাছ (প্রতিশোধ) : কুরআনে হদ্দের পাশাপাশি কিছু অপরাধের জন্য ক্বিছাছের বিধান দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে অপরাধীর উপর অপরাধের সমপরিমাণ শাস্তি বর্তায়। অর্থাৎ সে যদি কাউকে হত্যা করে, তবে তাকেও হত্যা করা হবে। যেমন : আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তাদের উপর বিধিবদ্ধ করেছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখম সমূহের বদলে যখম’ (মায়েদাহ ৫/৪৫)। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হ’ল, বাদী চাইলে অপরাধীর শাস্তি মওকূফ কিংবা লঘু করতে পারবে। (গ) দিয়ত (রক্তপণ) : কুরআনে হত্যার ক্ষেত্রে দিয়ত (রক্তপণ) এর বিধান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব যদি কোন মুমিন কোন মুমিনকে ভুলক্রমে হত্যা করে, তবে সে একজন মুমিন ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে এবং তার পরিবারের নিকট রক্তমূল্য সমর্পণ করবে’ (নিসা ৪/৯২)।
৬. শাস্তি ও ক্ষমার মধ্যে ভারসাম্য : ইসলামী বিচারব্যবস্থায় কঠোরতা ও দয়া পরস্পর ভারসাম্যপূর্ণভাবে প্রয়োগ করা হয়। শাস্তি ও ক্ষমার এই ভারসাম্য পৃথিবীর কোন বিচারব্যবস্থায় পাওয়া যাবে না। এতে সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধের জন্য হদের মত কঠোর বিধান যেমন রয়েছে, তেমনি ক্বিছাছের ক্ষেত্রে ক্ষমা ও সংশোধনেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। যেমন ক্বিছাছের বিধান বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিহতদের বদলা গ্রহণের বিষয়টি তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হ’ল। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস ও নারীর বদলে নারী। এক্ষণে যদি তার (নিহত) ভাইয়ের পক্ষ হ’তে তাকে কিছু মাফ করা হয়, তবে তাকে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে তাগাদা করা হয় এবং সঙ্গতভাবে সেটি পরিশোধ করা হয় (বাক্বারাহ ২/১৭৮)।
কুরআনে বর্ণিত এই ক্বিছাছ আইন কতটা মানবতাপূর্ণ এবং বাস্তবতার সাথে সংগতিশীল, তা এই আয়াতেই সুস্পষ্ট। কারণ এখানে একদিকে বাদীর অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফলে বাদী বা বাদীর পরিবার চাইলে অপরাধীকে পূর্ণ শাস্তি প্রদান করা হবে, আর যদি বাদী অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয় বা শাস্তি লঘু করে দেয়, তাহ’লে বিচারকের সেখানে কিছুই বলার নেই। অন্যদিকে এখানে অপরাধীর অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ সে যদি নিজের ভুল বুঝতে পারে অথবা কোন কারণে অন্যায় বিচারের শিকার হয়, তবে বাদীর কাছে তার মাফ চেয়ে নেয়ার অধিকার রয়েছে। যদি সে বাদী বা বাদীর পরিবারকে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে কিংবা ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারে তবে তাতেও বিচারকের আপত্তি থাকে না। ফলে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পায়।
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্ট যে, কুরআনী বিচারব্যবস্থা কতটা ন্যায়বিচারপূর্ণ ও মানবিক। কেননা এ বিধান স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স রাজ্যের বিশবখ্যাত হার্ভার্ড বিশববিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৬৩৬ খৃ.)-এর আইন বিভাগের অমুসলিম প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারের প্রবেশদ্বারে পর্যন্ত ন্যায়বিচারের শ্রেষ্ঠ বাণী হিসাবে পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৩৫ নং আয়াতটি ইস্পাতের সাইনবোর্ডে খোদাই করে লিপিবদ্ধ রয়েছে (দৈনিক ইনকিলাব ৬ই জানুয়ারী ২০২০, পৃ. ৬)। নিঃসনেদহে এটি অমুসলিমদের নিকট কুরআনের শ্রেষ্ঠতেবর স্বীকৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমরা নিশ্চিত যে, যদি বাংলাদেশে উক্ত আইন চালু থাকত, তাহ’লে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাগুরার ৮ বছরের আছিয়া ধর্ষণ, রূপগঞ্জে ৭ বছরের শিশু নিপীড়ন, লালমণিরহাটের হাতীবান্ধায় সাড়ে ৭ বছরের শিশু ধর্ষণ, রংপুরের তারাগঞ্জে কিশোরী ধর্ষণ, বরিশালের মুলাদী উপযেলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে হাত-পা বেঁধে ২১ বছরের এক বাকপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ, সোনারগাঁওয়ে ৫ বছরের শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার মত জঘন্য অপরাধগুলো হওয়ার সুযোগ থাকত না। এগুলি মাত্র একদিনের দু’টি পত্রিকার হিসাব। এভাবে প্রতিদিন কত শত ধর্ষণ ও ব্যভিচার যে হচ্ছে তার হিসাব কোথায়? ইসলামে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের শাস্তি হ’ল ‘সঙ্গে সার’ অর্থাৎ কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে মাথায় পাথর মেরে প্রকাশ্যে হত্যা করা (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৫৫৫-৬২)। দেশে এই আইন বিদ্যমান থাকলে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের প্রবণতা একেবারেই কমে যেত। ইসলামে চুরির শাস্তি হাত কাটা, যে আইন থাকলে দেশ থেকে ব্যাংক লুট ও লক্ষ-কোটি টাকা পাচার হ’ত না। চোর/দূর্নীতিবাজদের জামাই আদর না করে হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগ করলে লুটপাট করার মানসিকতা বন্ধ হয়ে যেত। এ বিধান মানুষের স্বাভাবিক চাহিদার অনুকূলে এবং সকলের জন্য কল্যাণকর। অথচ দেশের প্রচলিত দীর্ঘসূত্রী বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। অতএব সমাজে প্রকৃত অর্থে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাইলে ইসলামের স্বর্ণযুগের এই বিচারব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। কেবল সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃংখলার স্বার্থেই নয় বরং মুসলিম হিসাবে ঈমান রক্ষার স্বার্থেও আমাদেরকে সরকারীভাবে এ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন- আমীন! (স.স.)।