
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের কম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদায়িনী মা তারা কোলের শিশুকে ভুলে যাবে, গর্ভবতীর গর্ভ খালাস হয়ে যাবে এবং মানুষকে তোমরা দেখবে মাতাল সদৃশ। অথচ তারা মাতাল নয়। বস্ত্ততঃ আল্লাহর শাস্তি অতীব কঠোর’ (হজ্জ ২২/১-২)। নিঃসন্দেহে গত ২৬শে ডিসেম্বর’০৪ রবিবারের সুনামি (Tsunami) কোন ক্বিয়ামত ছিল না। কিন্তু তা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সৃষ্টিকে লন্ডভন্ড করেছে, এমনকি আস্ত পৃথিবীকে একদিকে এক ইঞ্চি কাত করে দিয়েছে। তাতে আবহাওয়া ও প্রকৃতিতে আসতে শুরু করেছে ব্যাপক বিপর্যয়। অনেক জনপদ তলিয়ে গেছে সাগরের নীচে চিরদিনের মত। অনেক তলদেশ উপরে উঠে এসেছে। আজকের নিউজিল্যান্ড এককালে যেমন ছিল বিশাল সাগর। অনুরূপভাবে আজও যদি আস্ত ভারতবর্ষ তলিয়ে গিয়ে ভারত মহাসাগরে আরেকটি নতুন মহাদেশের সৃষ্টি হয়, তাতেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ প্রকৃতির নিয়ামক মানুষ নয়। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর হুকুমে। ভারত মহাসাগরের তলদেশে দু’টি টেকটোনিক প্লেট-এর উপর-নীচে সংঘর্ষে সৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্র চার সেকেন্ডের ধাক্কায় মহাসাগর ও ভূপৃষ্ঠে এমনকি মহাবিশ্বে যে আলোড়ন হয়েছে, সেটা কি আগামী দিনে পৃথিবী নিশ্চিহ্নকারী ক্বিয়ামতের আগাম সংকেত নয়? এটাই তো কুরআনে বর্ণিত ‘কুন ফাইয়াকূন’-এর বাস্তব রূপ। পথভোলা মানুষকে পথে ফিরানোর জন্য সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে এরূপ ধাক্কা ও পরীক্ষা নাযিল হয়ে থাকে। নবীগণ যুগে যুগে মানুষকে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। এবারের সুনামিতে একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে যে, পানি নাকি দেওয়ালের মত কোন কোন স্থানে ৩৩ ফুট ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। এই স্থির ঢেউ পরবর্তীতে তীব্র গতিতে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ঢেউয়ের পরবর্তী ঢেউ কখনো এক ঘণ্টার ব্যবধানে এসেছে। যার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার। এই ঘটনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় নীলনদের পানি দাঁড়িয়ে থাকার কথা। যে পানির দেওয়ালের মাঝ দিয়ে নবী মূসা (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলগণ নদী পার হয়ে যান ও পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাঊন ও তার সৈন্যদল সেখানে ডুবে মরে।
মূসা ও ফেরাঊনের যুগের কয়েক হাযার বছর পরে বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়ে গেছে। এখন ভূমিকম্প বা পানিকম্প পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সেকারণ সুনামি-র ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার অনেক আগেই মানুষ জেনে ফেলতে পারে এবং হুঁশিয়ার হয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। আধুনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে তা সারা বিশ্বে জানিয়েও দেওয়া যেতে পারে। তবুও কেন এত প্রাণহানি হ’ল? যেখানে পশু-পক্ষীরা তাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আগেই বুঝতে পেরে আত্মরক্ষা করতে পারল, সেখানে মানুষ কেন পারল না? এর জবাব যা জানা গেছে তা অতীব মর্মান্তিক, যা সুনামি-র ভয়াবহতার চাইতে ভয়াবহ। সেটা এই যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে Natinal Oceanic and Atmospheric Adminstration (NOAA) ‘নোয়া’ নামক যে সংস্থা রয়েছে, তার সদস্য সংখ্যা হ’ল ২৬টি দেশ। এই ২৬টি দেশের বাইরে তারা কাউকে সুনামি-র আগাম তথ্য প্রদান করে না। এবারের সুনামি উৎপন্ন হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যেই মহাকাশ পরিভ্রমণরত মার্কিন উপগ্রহে তা ধরা পড়ে বলে সংস্থার নেতা চার্লস ম্যাকরিনি বলেন এবং তার ৩ ঘণ্টা পরে সেটি এশীয় দেশগুলির উপকূলে আঘাত হানে। এই মার্কিন সংস্থাটি তাদের সদস্য দেশগুলিকে এ খবর সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়, যাদের সুনামি আঘাত হানার সম্ভাবনাই ছিল না। অথচ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা মার্কিনীরা এশীয় দেশগুলিকে আগাম জানালে লাখ লাখ বনু আদমের অমূল্য জীবন রক্ষা পেত। এখন তারা ঘটা করে যখন ত্রাণ সাহায্যের ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানেও দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৩৫ কোটি ডলার এবং বৃটেন মাত্র ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ মার্কিন সরকার গত ৬৫৬ দিনে ইরাক ধ্বংসে ব্যয় করেছে ১৪,৮০০ কোটি ডলার এবং বৃটেন ব্যয় করেছে ১১৫০ কোটি ডলার। দেখা যাচ্ছে, সুনামিতে মার্কিনের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ইরাক যুদ্ধে তাদের মাত্র দেড় দিনের ব্যয়ের সমান। এরপরেও তারা সাহায্যের বিনিময়ে সেখানে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে ‘ইন্দোনেশীয় ওলামা পরিষদ’ অভিযোগ তুলেছে। এমনকি এই সুযোগে তারা ঐসব দেশে স্থায়ী সেনাঘাঁটি বানাবার পাঁয়তারা করছে। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চাইতে এখন মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ই অধিক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নমরূদ ও ফেরাঊনরা চিরদিন এটা করে গেছে, আজও করে চলেছে। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, ‘ভূমিতে ও পানিতে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু কিছু স্বাদ আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)।
উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষের বাড়াবাড়ি চরমে উঠে গেলে মাঝে-মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারী সংকেত নেমে আসে গযবের আকারে। এ গযব কখনো সরাসরি ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপরে আসে, যেমন ফেরাঊন ও তার লোক-লষ্করের উপরে এসেছিল। কখনো অন্যের উপরে আসে অত্যাচারীদের সাবধান করার জন্য। এর মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিতে চান যে, এ পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা সবই আল্লাহর হাতে। যেমন তিনি বলেন, ‘তাঁর নিদর্শন সমূহের অন্যতম এই যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত আছে। অতঃপর তিনি যখন ডাক দিবেন, তখন তোমরা সবাই মৃত্তিকা থেকে উঠে আসবে’। ‘নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ’ (রূম ৩০/২৫-২৬)।
আজ পৃথিবী এক ইঞ্চি কাত হয়ে গেছে। যার ফলে হিমালয়ের বরফ গলে প্লাবিত হ’তে পারে তার পাদদেশের অঞ্চলগুলি। ভারত ও চীনে দেখা দিতে পারে প্রচন্ড খরা। বাংলাদেশ ক্রমে সরে যাচ্ছে উত্তর-পূর্বদিকে। ইতিমধ্যে যমুনা নদীর তলদেশে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। দু’দিনের মধ্যেই নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে নাকালিয়া পয়েন্টে। অতঃপর পৃথিবী যদি আরেকটু কাত হয়ে যায় ও দিক পরিবর্তিত হয়ে সূর্য পূর্বদিকের বদলে পশ্চিম দিকে ওঠে, তবে সেটাই হবে ক্বিয়ামতের প্রথম আলামত,[1] যা পৃথিবীকে চূড়ান্ত ধ্বংসে নিক্ষেপ করবে। অতএব হে মানুষ! সুনামি থেকে শিক্ষা নাও। আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়-অত্যাচার থেকে বিরত হও। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন আমীন![2]
[1]. মুসলিম হা/২৯৪১; মিশকাত হা/৫৪৬৬ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়।
[2]. ৮ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৫।