গত ৩১শে জুলাই’১৭ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে দেশব্যাপী হৈ চৈ শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আমরা দেশের সংবিধানের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। ১৯৯৯ সালের ২৬শে জানুয়ারীতে প্রকাশিত ১৯২ পৃষ্ঠাব্যাপী সংবিধান, যা ২০০৫ সালের ১লা মার্চ পর্যন্ত সংশোধিত, তার পূর্ণ পর্যালোচনা এই ছোট্ট পরিসরে সম্ভব নয়। কেবল অসংগতিগুলোই তুলে ধরব, যা একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের নযরে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর এযাবৎ তাতে ১৬টি সংশোধনী এসেছে। কিছু বাতিল হয়েছে, আবার কিছু যুক্ত হয়েছে। যেমন ’৭২-য়ে গৃহীত বহুদলীয় সংসদীয় রাজনীতি ১৯৭৫-এর ২৫শে জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমানের সময় চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয় এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও একদলীয় ‘বাকশাল’ রাজনীতির প্রবর্তন হয়। এরপর জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর ৪টি মূলনীতি বাতিল করে ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ ও ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ যুক্ত হয় এবং বহুদলীয় রাজনীতি চালু হয়। সেই সাথে বিচারক অপসারণ বিষয় নিষ্পত্তির জন্য ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। জেনারেল এরশাদের সময় ১৯৮৮ সালের ৯ই জুন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে (পৃঃ ৩ : ধারা ২ক) ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার আমলে দ্বাদশ সংশোধনীতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২৮শে মার্চ খালেদা জিয়ার আমলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯০ দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। যেটি ২০১১ সালের ৩রা জুলাই আওয়ামী লীগের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল করা হয়। কিন্তু ফখরুদ্দীন সরকারের ৯০ দিনের অধিক (জানু’২০০৭ হ’তে জানু’২০০৯ পর্যন্ত) দু’বছর থাকার বিষয়টিকে প্রমার্জনা দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সহ ’৭২-এর ৪টি মূলনীতি পুনর্বহাল করা হয়। তবে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে রেখে দেওয়া হয়। একই সরকারের আনীত ২০১৪ সালের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয় এবং বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। যা ৩১শে জুলাই’১৭ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।
বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু বর্তমান সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ শিরোনামে বলা হয়েছে, (পৃঃ ১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’। এটি ১৯৭৯-তে গৃহীত পঞ্চম সংশোধনীর ফসল। অতঃপর বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। প্রস্তাবনার বক্তব্যসমূহ পরস্পর বিরোধী। যেমন আল্লাহর উপরে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস-এর সাথে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দু’টি নাস্তিক্যবাদী দর্শনকে মূলনীতি গণ্য করা হয়েছে। অধিকন্তু গণতন্ত্রে ব্যক্তি পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ নির্ধারিত এবং দু’টি পদ্ধতিতেই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় শোষণ অবধারিত। যার বাস্তবতা অত্যন্ত পরিষ্কার।
পৃঃ ২ : বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে’। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ অর্থ কি? এখানে রাজা কে? বা প্রজা কে? যদি বলা হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র, তাহ’লে তো ‘দলতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বলা উচিৎ। কেননা এমপি-রা তো সবাই দলীয় প্রতিনিধি। এরপরেও দীর্ঘ দিনের সামরিক শাসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকে কোন তন্ত্র বলা হবে? পৃঃ ৩ ধারা ৪ (১) : জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’...। অথচ এই গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী। কেননা এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন ১৯০৫ সালে বৃটিশ কৃত বঙ্গভঙ্গ রদ করে উভয় বাংলাকে এক করার জন্য।
পৃঃ ৪ : ৭ (১) ও (২) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’। ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে’। অথচ ১৪২ (১-ক ও আ) ধারায় বলা হয়েছে, সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান... সংশোধিত হইতে পারিবে’। যদি (আ) সেটি মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়’। এতে পরিষ্কার যে, এই সংবিধান সদা পরিবর্তনশীল। দ্বিতীয়তঃ এই সংবিধানের কোন ধারা ইসলামী বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হ’লে ইসলামী বিধান বাতিল হবে। এটি এদেশের জনগণের আক্বীদা ও অভিপ্রায়ের ঘোর বিরোধী। তৃতীয়তঃ এটি পৃঃ ৫ ধারা ৮ (১ক)-এর বিরোধী। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’। তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না’ (৮ (২)। প্রশ্ন হ’ল, যে নীতি বলবৎযোগ্য নয়, তা সংবিধানে যুক্ত করার প্রয়োজন কি?
পৃঃ ৬ ধারা ১২ : ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ (বিলুপ্ত)। অথচ এটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় বহাল করা হয়েছে। আর মুখে বলুন বা না বলুন এটিই সব সরকারের বাস্তব নীতি। কারণ এদেশে ইসলামের হালাল-হারাম ও দন্ডবিধি এবং অন্যান্য বিধি সমূহ শুরু থেকেই চালু নেই। পৃঃ ৯ ধারা ১৭ (ক) : একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা’। এটি শ্রুতিমধুর কিন্তু অবাস্তব। কেননা মুসলিম ও অমুসলিমদের একই শিক্ষা ব্যবস্থা কখনোই সম্ভব নয়, বস্ত্তগত কিছু বিষয় ছাড়া। সেকারণ বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারী মিলে ১১-এর অধিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে চালু আছে।
পৃঃ ১১ ধারা ২২ : রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে’। অতঃপর পৃঃ ১০১ ধারা ১১৬-তে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিদের ও ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা বিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে’। এরপরেই ১১৬ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ব্যাপারে স্বাধীন থাকিবেন’। এর বিপরীতে পৃঃ ১৬৬-এর ১৫০ (৬) ধারায় বলা হয়েছে, অধস্তন আদালত সম্পর্কিত এই সংবিধানের ৬ষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের বিধানাবলী (পৃঃ ১০১) যথাশীঘ্র সম্ভব বাস্তবায়িত করা হইবে এবং তাহা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত পরিচ্ছেদে বর্ণিত বিষয়াদি এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যেরূপ নিয়ন্ত্রিত হইত, আইনের দ্বারা প্রণীত যেকোন বিধান সাপেক্ষে তাহা সেইরূপে নিয়ন্ত্রিত হইতে থাকিবে’। একেই বলে ‘বজ্র অাঁটুনি ফস্কা গিরো’। কেননা নিম্ন আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই রয়ে গেছে। ফলে এযাবৎ অধঃস্তন আদালতগুলি কখনোই স্বাধীন হয়নি এবং সেগুলি মূলতঃ সরকারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকার ও সরকারী দল সর্বদা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে ভয় পায় এবং তারাই সর্বদা এটি বাস্তবায়নে বাধা দিয়ে থাকে। যা অদ্যাবধি রয়েছে। অথচ উচ্চ আদালতের বিচারকদের চাইতে তাঁরা সংখ্যায় ১৫ গুণ বেশী, তাঁদের থেকে মামলা নিষ্পত্তি করেন অন্তত সাত গুণ বেশী। বস্ত্ততঃ নিম্ন আদালতই মূল বিচারিক আদালত হিসেবে স্বীকৃত। ৩১শে জুলাই’১৭ তারিখে সরকারের এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে সরকারী দল এই রায়ের বিরুদ্ধে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ।
পৃঃ ২৯, ৪৪, ৩০ : রাষ্ট্রপতি ৩৫ বছরের কমে এবং ৭২ বছরের অধিক বয়স্ক হইবেন না এবং দুই মেয়াদের বেশী থাকিবেন না’। পৃঃ ২৯ ধারা ৪৮ (৩) : প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতি অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করিবেন’। সংসদ অধিবেশনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কাজ করিবেন’ (পৃঃ ৫৮ ধারা ৭২ (১)। এর ফলে রাষ্ট্রপতি পদটি একটি ক্ষমতাহীন ও দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারিতা নিশ্চিত হয়। পৃঃ ৩০ ধারা ৪৯ : আদালত প্রদত্ত যেকোন দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে’। এটি ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কেননা এটি কেবল বিবাদীর দায়িত্ব। সেই সাথে ইসলামী বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। পৃঃ ৮৬ ধারা ৯৬ (২) : বিচারপতির বয়স সীমা ৬৫ বছর।
পৃঃ ৩৭ : ধারা ৫৬ (১) (২) : প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন’। এরপরেও তিনি সংসদের এক দশমাংশ টেকনোক্রাট মন্ত্রী নিতে পারবেন। এছাড়াও থাকবেন উপদেষ্টাগণ। এগুলি স্রেফ দল পোষণ ও মাথাভারি প্রশাসন মাত্র। যা জনগণের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। অথচ পৃঃ ৪১ ধারা ৫৮ (গ)-তে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে মোট ১১ জন উপদেষ্টা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হইবে’ বলা হয়েছে। যারা ৯০ দিনের অতিরিক্ত জানুয়ারী ২০০৭ থেকে জানুয়ারী ২০০৯ পর্যন্ত দু’বছর দেশ চালিয়েছেন সাড়ে তিনশ’ এমপির চাইতে অনেক সুন্দরভাবে।
পৃঃ ৫০ ধারা ৬৫ (১) : প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে’। ৬৫ (৩) সদস্যগণ ‘সংসদ সদস্য’ বলিয়া অভিহিত হইবেন’। অথচ সংবিধান লংঘন করে সংসদ সদস্যদেরকে ‘সাংসদ’ বলা হচ্ছে। পৃঃ ৫১ ধারা ৬৬ : ২৫ বছর বয়সের যেকোন নাগরিক সংসদ সদস্য হইতে পারিবেন’। এখানে বয়সকেই যোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হয়েছে। তার আইন প্রণয়নের যোগ্যতা ও অন্যান্য সদগুণাবলী দেখা হয়নি। যেটা অন্যায়। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ও বিচারকদের জন্য বয়স ও দায়িত্বের মেয়াদ নির্ধারিত থাকলেও এমপি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে নেই। এটা দ্বিমুখী বিধান।
পৃঃ ৫৫ ধারা ৭০ (১) : সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন শূন্য হইবে’। এর ফলে দলীয় স্বৈরাচার অবশ্যম্ভাবী। যেটা সবেমাত্র (৩১.৭.২০১৭) সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করল। পৃঃ ৫৭ ধারা ৭১ (১) : কোন ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকায় সংসদ সদস্য হইবেন না’। এর বিপরীতে ৭১ (২) উপধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচনপ্রার্থী হওয়ায় এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় বর্ণিত কোন কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না’। ফলে দেখা গেছে যে, একই ব্যক্তি ৫টি এলাকা থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। দু’টি ধারা পরস্পরের বিপরীত। পৃঃ ৫৯ ধারা ৭২ (৩) : সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর’। এর ফলে এমপিরা মেয়াদের মধ্যে দুর্নীতিতে প্রলুব্ধ হন। পৃঃ ৬৭ ধারা ৭৮ (১) : সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। ৭৮ (৩) সংসদের কোন কমিটিতে কিছু বলা বা ভোট দানের জন্য কোন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোন আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না’। এর ফলে সংসদ সদস্যরা লাগামহীন হবেন। এমনকি তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বললেও তাদের কিছু বলা যাবে না।
পৃঃ ৮৭ ধারা ৯৬ (৩) : একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে। যাহা... বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাঁহাদের লইয়া গঠিত হইবে’। এটি ১৯৭৯-তে গৃহীত পঞ্চম সংশোধনীর ফসল। ২০০০ সালের ৭ই মে শেষ বৈঠকের পর হ’তে এটি ঘুমন্ত। ২০১৪ সালে আনা ষোড়শ সংশোধনীতে এ ধারাটি বাতিল করা হয় এবং বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ১৯৭৫-এর ৪র্থ সংশোধনী অনুযায়ী জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। যেটি ৩১.৭.২০১৭ তারিখে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেন। পৃঃ ১৩২ ধারা ১৪৯ : সকল প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা অব্যাহত থাকিবে। তবে সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে’। তাহ’লে কি এদেশে প্রচলিত ইসলামী আইন সমূহ সংশোধিত বা রহিত হ’তে পারবে? ধারাটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। পৃঃ ১৩২ ধারা ১৫০ ও ১৫১ : পরস্পর বিরোধী। এভাবে বলা চলে যে, যখন যিনি ক্ষমতায় এসেছেন, তখন তিনি তার মত করে সংশোধনী যোগ করেছেন। প্রকাশিত সংবিধানটি সেই সব সংশোধনীগুলির পরস্পর বিরোধী সংকলন মাত্র। যাকে সম্মান করা যায়। কিন্তু বাস্তবায়িত করা যায় না।
পৃঃ ১৪৬ তৃতীয় তফসিল ১৪৮ অনুচ্ছেদ : শপথ ও ঘোষণা (রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীগণ)। আমি .... সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী .... পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব। আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব’। প্রশ্ন হ’ল, কার নামে সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করা হচ্ছে, তা কিছু বলা নেই। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফরী করল ও শিরক করল’ (তিরমিযী হা/১৫৩৫)। তাছাড়া অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে নিরপেক্ষ প্রশাসন বিগত দলীয় সরকারগুলির সময় কেউ দেখতে পেয়েছে কি?
এর
বিপরীতে ইসলামী খেলাফতে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। তাঁর প্রতিটি
বিধানই চূড়ান্তভাবে সত্য ও কল্যাণময় এবং তা অপরিবর্তনীয়। জনগণের দায়িত্ব
কেবল সেটিকে মেনে নেওয়া ও বাস্তবায়িত করা। এতে যারা বিশ্বাসী তারা মুসলমান।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল ইসলাম এবং এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিক
মুসলমান। অথচ এ যাবত যারাই বাংলাদেশে সরকারী ক্ষমতায় গিয়েছেন, তারাই জনগণের
আকাংখা ও অভিপ্রায়ের সাথে অবিচার করেছেন। ফলে বিগত ৭০ বছরের প্রত্যেক
নেতাকে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট কৈফিয়তের সম্মুখীন হ’তে হবে। আইনের উৎস
হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ। যা আল্লাহ প্রেরিত এবং সকল মিথ্যা ও অকল্যাণ হ’তে
মুক্ত। সকল মতভেদ এ দু’য়ের মাধ্যমে দূর করতে হবে। বাকী সবই অগ্রাহ্য ও
চাকচিক্য সর্বস্ব। জাতীয় তাক্বলীদ তথা মাযহাবী অন্ধত্ব এবং বিজাতীয়
তাক্বলীদ তথা প্রগতির নামে বিজাতীয় সকল মতবাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ছেড়ে
সরাসরি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর আমল করতে হবে। দেশের নেতা
নির্বাচিত হবেন দল ও প্রার্থীবিহীন নীতিতে জ্ঞানী-গুণীদের পারস্পরিক সুষ্ঠু
ও শান্তিপূর্ণ পরামর্শের মাধ্যমে, কোনরূপ হুজুগের মাধ্যমে নয়। অতঃপর যতদিন
তিনি আল্লাহর বিধান মতে দেশ চালাবেন, ততদিন তিনি ঐ পদে থাকবেন। এর ফলে
মেয়াদ ভিত্তিক ক্ষমতার লড়াই থাকবে না। দেশে শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।
অর্থনীতির মূল হবে আল্লাহকৃত হালাল-হারাম মেনে চলা। যা খুবই স্পষ্ট। আর
যেটা অস্পষ্ট, সেটা থেকে দূরে থাকতে হবে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ দু’টিই
মানবতার দুশমন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে আপোষহীন। অথচ
পুঁজিবাদীরাই যুগ যুগ ধরে শাসন ও শোষণ করছে। ভোট প্রথার ফাঁদে ফেলে তারাই
সর্বদা নেতৃত্বে বসছে। এ মন্দ রীতির আশু অবসান কাম্য। অতএব দেশের সংবিধান
হৌক ‘ইসলাম’। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।