
আল্লাহ বলেন, মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে আল্লাহ যুগে যুগে নবীগণকে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সাথে সত্যসহকারে কিতাব নাযিল করেন, যাতে তার মাধ্যমে তারা লোকদের মধ্যকার বিবাদীয় বিষয় সমূহ ফায়ছালা করে দেন। অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনাদি এসে যাওয়ার পরেও তারা পারস্পরিক হঠকারিতাবশে উক্ত কিতাবে মতভেদ করল। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় আদেশক্রমে বিশ্বাসীগণকে তাদের বিবাদীয় বিষয়ে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সরল পথ দেখিয়ে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
উপরোক্ত আয়াতে মানব জাতির ঐক্য, তাদের পারস্পরিক মতানৈক্য ও মতভেদের কারণ, অতঃপর ঐক্যের পথ, সবকিছু বলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষণে বিশ্বমানবতার ঐক্য এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, সে বিষয়ে আমরা সংক্ষেপে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথমে বাংলাদেশের জনগণকে একটি বিষয়ে একমত হ’তে হবে যে, তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করেন কি-না। যদি আল্লাহতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেশী হয়, তবে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা আল্লাহকে কেবল সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মানেন, না সবকিছুর পরিচালক ও বিধানদাতা হিসাবে মানেন। যদি দ্বিতীয় মতের লোকের সংখ্যা বেশী হয়, তাহ’লে তাদেরকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আল্লাহর বিধান কি কেবল তাদের ব্যক্তি জীবনের জন্য, না সার্বিক জীবনের জন্য? এগুলি সবই মৌলিক প্রশ্ন। প্রয়োজনে এর উপরে জনমত যাচাই করা যেতে পারে।
আমরা মনে করি যে, বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় কিছু নাস্তিক বাদে সকল নাগরিকই আল্লাহতে বিশ্বাসী। এদেশের সকল মানুষ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে, বিধানদাতা হিসাবে, সবকিছুর ধারক ও পরিচালক হিসাবে, জীবন ও মৃত্যুদাতা হিসাবে বিশ্বাস করেন। গোল বাধবে একখানে গিয়ে। সেটি হ’ল এই যে, বিদেশী বস্ত্তবাদী মতবাদ সমূহের খপ্পরে পড়ে কিছু দুনিয়াপূজারী লোক তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে আল্লাহর বিধি-বিধান সমূহকে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা বৈষয়িক জীবনের বিস্তৃত ময়দান থেকে হটিয়ে কেবল গৃহকোণে আবদ্ধ করে রাখতে চাইবেন। তারা ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ ইত্যাদি ব্যক্তিগত ইবাদতে আল্লাহর বিধান মানতে রাযী হবেন, কিন্তু সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করতে রাযী হবেন না।
এক্ষণে এদের সাথে অন্যদের ঐক্যের পথ কি? বাহ্যতঃ ঐক্যের কোন পথ খোলা নেই। আমরা মনে করি যে, এর পরেও ঐক্যের পথ আছে। যেমন (১) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দল ও নেতৃবৃন্দকে যদি বুঝানো যায় যে, আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়ার মধ্যেই তাদের দুনিয়াবী কল্যাণ বেশী রয়েছে, তাহ’লে ঐ লোকগুলি দুনিয়াবী স্বার্থেই আল্লাহর বিধান মেনে নিবে। কেননা ওদের মূল লক্ষ্যই হ’ল দুনিয়া হাছিল করা। যেমন, সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী, চুরি-ডাকাতি-সন্ত্রাস ইত্যাদির দুনিয়াবী অপকারিতা বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে বুঝাতে হবে। অতঃপর তাকে আল্লাহর বিধানের স্থায়ী কল্যাণকারিতা এবং মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের মর্মান্তিক আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। আশা করি এতেই তাদের অধিকাংশের হিতজ্ঞান ফিরে আসবে এবং আল্লাহর দেওয়া চিরন্তন ও সার্বজনীন বিধান সমূহ তারা মেনে নিবেন। যদি বলেন, নেতাদের হেদায়াত হওয়া সুদূরপরাহত। তাহ’লে বর্তমানের আধুনিক মিডিয়া ব্যবহার করে সহজে জনমত যাচাই করে নিতে হবে। আশা করি অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়ার পক্ষে রায় দিবেন। তখন ঐসব দুনিয়াদার নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের সামনে মাথা নত করবেন। অথবা নেতৃত্ব থেকে তাদের হটে যেতে হবে।
আমরা মনে করি এমন কোন জ্ঞানী মানুষ নেই, যিনি উপরোক্ত অন্যায় কর্ম সমূহকে ন্যায় কর্ম মনে করেন। এভাবে অন্ততঃ সামাজিক শৃংখলা ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে বাংলাদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও দলমতের লোকদের মধ্যে ঐক্যমত সৃষ্টি হবে। যদি দেড় হাযার বছর পূর্বে মদীনার ইহূদী-নাছারা ও পৌত্তলিকগণ স্ব স্ব ধর্ম পরিত্যাগ না করেও ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ বিধান সমূহ কবুল করে নিতে পারে, তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নেতৃবৃন্দ সামাজিক কল্যাণের স্বার্থে কেন তা মেনে নিতে পারবেন না?
বাকী রইল ইসলামী নেতাদের মাঝে ঐক্য। এটি খুবই সহজ, আবার খুবই কঠিন বিষয়। সহজ এজন্য যে, মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইচ্ছা করলে ইসলামের নামে সহজেই এক প্লাটফরমে আসতে পারেন ও যেকোন বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। পক্ষান্তরে এটা খুবই কঠিন ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার কতগুলি কারণে যেমন, (১) এঁরা ধর্মীয়ভাবে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকায় বিভক্ত (২) বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ‘হানাফী’ মাযহাবের হ’লেও তাদের মধ্যে রয়েছে পরস্পরে বিস্তর ধর্মীয় মতভেদ। ১৯৮১ সালের সরকারী হিসাব মতে এদেশে রয়েছে ২ লক্ষ ৯৮ হাযার পীর। নিঃসন্দেহে এক পীরের সাথে আরেক পীরের মিল নেই। মিল নেই একে অপরের মুরীদদের সাথেও। এদের বাইরে রয়েছে মাওলানা মওদূদীর অনুসারী ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও মাওলানা ইলিয়াস দেউবন্দীর অনুসারী ‘তাবলীগ জামা‘আত’। এদের পরস্পরে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এক্ষণে এদের মধ্যে ঐক্যের পথগুলি আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব। যেমন (১) ১৪ কোটি নাগরিকের মধ্যে অন্যদের বাদ দিয়ে যদি এদেশে ১২ কোটি মুসলমানের বাস হয়, তবে তার মধ্যে অন্যূন ২ কোটি ‘আহলেহাদীছ’ বাদ দিলে ১০ কোটি ‘হানাফী’ মুসলমান বসবাস করেন। পাকিস্তানের শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্বের বিপরীতে বাংলাদেশের একটি প্লাস পয়েন্ট এই যে, এখানে শী‘আ মুসলমানের সংখ্যা খুবই নগণ্য, একেবারে হাতে গণা বললেও চলে। ফলে এখানকার সকল মুসলমান ‘সুন্নী’। এদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হিসাব মত খুবই সহজ হওয়ার কথা। এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব সমূহ নিম্নরূপ :
(১) সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে হবে। হানাফী ভাইগণ যে ইমামের অনুসারী হওয়ার দাবী করেন, সেই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর স্পষ্ট বক্তব্য হ’ল এই যে, ‘কোন বিষয়ে ছহীহ হাদীছ পেলে জেনো যে, সেটাই আমার মাযহাব’। আহলেহাদীছগণের দাবীও সেটাই। অতএব এক্ষেত্রে হানাফী আহলেহাদীছ সকলে এক প্লাটফরমে আসতে পারেন। এরপরেও ব্যাখ্যাগত মতভেদ যদি থাকে এবং সেটা যদি ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য করার পর্যায়ে না যায়, তবে সেক্ষেত্রে স্ব স্ব আমল পৃথক রেখেই পারস্পরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। (২) যদি সকলে স্ব স্ব দলীয় প্যাড ও ব্যানার অক্ষুণ্ণ রাখতে চান, তবুও পারস্পরিক ভ্রাতৃসুলভ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্লাটফরম সৃষ্টি করা খুবই সহজ। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এটা এখন একান্তই সময়ের দাবী। জনগণের প্রাণের দাবীও এটা।
উপরোক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যরূরী বিষয়গুলি হল :
(১) পারস্পরিক গীবত-তোহমত ও অশালীন বক্তব্য সমূহ পরিহার করা। বিশেষ করে বই ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে পরস্পরের বিরুদ্ধে স্থায়ী গীবত বর্জন করা। কেননা এগুলির গোনাহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে এবং গীবতকারী ব্যক্তির ও ব্যক্তিসমষ্টির আমলনামায় তা লিপিবদ্ধ হবে (২) নিজ মতের উপরে এবং অনৈক্যের উপরে যিদ না করা (৩) বিভিন্ন দলের মধ্যে উপদল সৃষ্টির মাধ্যমে ভাঙ্গন সৃষ্টি রোধের জন্য প্রার্থিতা ও ক্যানভাসিং-এর বর্তমান ভোট পদ্ধতির বাইরে সর্বাধুনিক স্বচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে জনমত যাচাই করে একক দলীয় নেতা বা আমীর নির্বাচন করা ও শূরা পদ্ধতির মাধ্যমে দল পরিচালনা করা (৪) দুনিয়াবী স্বার্থের উপরে দ্বীনী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া (৫) সর্বোপরি মুসলিম ঐক্য ও জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প থাকা এবং উক্ত বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। আহলেহাদীছদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের একই প্রস্তাব রইল। আমরা মনে করি ইসলামী আইন বাস্তবায়নের ব্যাপারে দেশে একটি ব্যাপকভিত্তিক Consensus বা ‘জাতীয় ঐক্যমত’ সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১১তম সংখ্যা, আগস্ট ২০০৩।