পবিত্র রামাযান আসার অনধিক তিন সপ্তাহ পূর্বেই দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ক্লীনহার্ট’ (Operation Clean Heart) নামক এক অভিনব শুদ্ধি অভিযান। এ শুদ্ধি অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মূলতঃ সেনাবাহিনীর উপরে। উদ্দেশ্য সন্ত্রাস দমন। বর্তমান জোট সরকার আসার এক বছর পূর্তির ৬ দিন পরে গত ১৬ই অক্টোবর বুধবার দিবাগত রাত ১২-টার পর হঠাৎ করে আর্মী ক্র্যাকডাউন শুরু হয়। রাজধানী ঢাকা এবং ৬টি বিভাগীয় শহরসহ যেলা শহরগুলিতে একই সাথে ৪০ হাযার আর্মীকে অ্যাকশনে নামানো হয়। দেশব্যাপী বিস্তৃত ৪টি মোবাইল ফোন কোম্পানীর সাড়ে ৮ লাখ মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক রাত ১২-টা হ’তে সকাল ৬-টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বেসামরিক প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং অধিকতর সাফল্যের জন্য সম্পূরক হিসাবে কাজ করতেই সেনা ও নৌবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে’। আমরা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই ও এর সার্বিক সাফল্য কামনা করি।

‘অপারেশন ক্লীন হার্ট’ অর্থ অনেকে করেছেন ‘হৃদয় শুদ্ধি অভিযান’। আমরা মনে করি এর অর্থ হওয়া উচিত ‘শুদ্ধ হৃদয় অভিযান’। কেননা দেশের সেনাবাহিনী নির্দলীয় হিসাবে শুদ্ধ হৃদয়। তারা দলীয় সংকীর্ণতা দুষ্ট না হয়ে বরং শুদ্ধ হৃদয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষভাবে শুদ্ধি অভিযান চালাতে সক্ষম হবেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন পরে অভিযান শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি-র উপরতলার কিছু লোক বিষয়টি ফাঁস করে দিলে প্রধানমন্ত্রী দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং সেদিনই সন্ধ্যায় মন্ত্রী পরিষদের যরূরী সভা ডেকে আলোচনা করে রাত ১২-টা থেকেই অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন এর ফলে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সবাই ধরা পড়বে। কিন্তু তা হয়নি। তারা সময়মতই সংবাদ পেয়ে অপারেশন শুরুর দু’দিন আগেই কেবলমাত্র কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়েই নাকি সাড়ে তিন হাযারের মত সন্ত্রাসী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে বলে খবরে প্রকাশ। দেশের অন্যান্য সীমান্ত পথে কত হাযার সন্ত্রাসী পালিয়েছে তার হিসাব কে বলবে? ফলে এখন যারা ধরা পড়ছে তারা কেউ শীর্ষ সন্ত্রাসী নয় বরং তাদের সহযোগী দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির সন্ত্রাসী অথবা সাধারণ নেশাখোর-মাতাল বা ছিঁচকে নিশিকুটুম্ব।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অধিকাংশসহ বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রায় ৯০% নিশ্চিন্তে বসবাস করছে ভারতের বিভিন্ন শহরে ও বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলিকাতায়। সেখানকার যাকারিয়া স্ট্রীটের বিলাসবহুল হোটেলগুলিতেই তাদের অধিকাংশের আস্তানা। এমনকি অনেক ‘টপটেরর’ কলিকাতার অভিজাত এলাকা সল্ট লেকেও বাড়ী ভাড়া নিয়ে বা এপার্টমেন্ট কিনে বসবাস করছে। তাদের বাংলাদেশী দোসররা হর-হামেশাই সেখানে যাতায়াত করে। এমনকি ঐসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রায় সকলে ভারতীয় মোবাইল কোম্পানীর মোবাইল সংযোগ নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তারা সহজেই বাংলাদেশী সোর্স ও সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী ভারতীয় গ্রাম ও শহরগুলিতে অবস্থান করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অতি সহজে তারা তাদের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক অব্যাহত রেখেছে এবং বর্তমান সেনা তৎপরতার সব খবরাখবর জেনে নিয়ে নিত্য নতুন পলিসি নির্ধারণ করছে। যেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ হর-হামেশা বাংলাদেশ থেকে কথিত হরকাতুল জিহাদ ও তালেবান অনুপ্রবেশের ধুয়া তুলে আসছেন, যেখানে বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী পর্যটকদের ভারতের রাস্তা-ঘাট ও হোটেলগুলিতে সর্বদা তত্ত্ব-তালাশ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, সেখানে কোনরূপ বৈধতা ছাড়াই মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর সেদেশে বসবাস করছে এইসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। অথচ এ নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা নেই। নিঃসন্দেহে তাদের এই আচরণ রহস্যজনক। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং সেখানে গিয়ে যেন সন্ত্রাসীরা আশ্রয় না পায় তার যরূরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নইলে সরকারের শুভ পদক্ষেপ মাঠে মারা যাবে। বর্তমানের সেনা-পুলিশ যৌথ অভিযান শেষে পুনরায় পূর্ণোদ্যমে শুরু হবে সন্ত্রাস এবং সৃষ্টি হবে নতুন নতুন সহযোগী সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী।

এ যাবত সন্ত্রাসী যারা ধরা পড়েছে বা গা ঢাকা গিয়েছে তাদের প্রায় সবাই সরকারী বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত। সেকারণ ইতিমধ্যেই অনেক শুভাকাংখী আশংকা ব্যক্ত করেছেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই শুভ উদ্যোগ যেকোন সময় বানচাল করে দিতে পারে দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা তার বন্ধুরূপী শত্রুরাই। ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা যদি সঠিক হয় তবে বলব, দেশের স্বার্থে পরিচালিত এই কঠোর অভিযান যেন দলের লোকদের মহববতে মাঝপথে বন্ধ না হয়ে যায়। যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শাসনকালে এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে সেনাবাহিনী নামিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই আওয়ামী সন্ত্রাসীরা একের পর এক পাকড়াও হ’তে থাকলো, তখনই তিনি দ্রুত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। বলা চলে যে, এই আধাখেঁচড়া সেনা অভিযানে সাপের লেজে পা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ফলেই তাঁর পতন ত্বরান্বিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পিছনের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে ভাল হবে বলে মনে করি।

এ বিষয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ন্যায়বিচারের একটি দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ‘কুরায়েশ বংশের অন্যতম সম্ভ্রান্ত শাখা বনু মাখযূম গোত্রের ফাতেমা বিনতে আসওয়াদ নাম্নী জনৈকা মহিলা যখন চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হ’ল, তখন উক্ত গোত্রের নেতারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে তার শাস্তি মওকূফের সুফারিশ করার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর সন্তানবৎ প্রিয় তরুণ উসামা বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উসামাকে বললেন, তুমি কি আমাকে আল্লাহ প্রদত্ত দন্ডবিধির বিষয়ে সুফারিশ করছ? অতঃপর তিনি সকলকে মসজিদে ডেকে নিয়ে ভাষণের এক পর্যায়ে বললেন, তোমাদের পূর্বেকার উম্মত এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার সম্ভ্রান্ত লোকেরা চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত। আর দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমা আজকে চুরি করত, তাহ’লে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে ফেলতাম’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহর দেওয়া দন্ডবিধিসমূহ কার্যকর কর। চাই সে ব্যক্তি নিকটের হৌক বা দূরের হৌক। এ ব্যাপারে তোমরা কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদকে ভয় করো না’।[2] মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতের নাড়ীর যোগ ছিন্ন করতে? আমরা দো‘আ করি যেকোন মূল্যে সন্ত্রাস নির্মূলের ওয়াদার উপরে টিকে থাকার জন্য আল্লাহ পাক আমাদের সরকারকে তাওফীক দিন- আমীন!

আমরা মনে করি কেবল সেনা অভিযান যথেষ্ট নয়, বরং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি হ্রাস করার জন্য একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম যরূরী। যেসকল উৎস থেকে দুর্নীতি হয়, সে সকল উৎসে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। নইলে বাঁধের একটি ছিদ্রপথ বন্ধ করলে অন্য ছিদ্রপথ দিয়ে তীব্র বেগে দুর্নীতির নোংরা স্রোতে নালা বন্ধ হয়ে যাবে। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে বলব, (১) দল ও প্রশাসনের সকল স্তর থেকে দুর্নীতিবাজদের বহিষ্কার করুন ও তাদের আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন যাবতীয় সম্পদ বাযেয়াফত করে সরকারী কোষাগারে জমা করুন (২) ইসলামী ফৌজদারী আইন সর্বত্র কঠোরভাবে বলবৎ করুন এবং শুধু ৬টি ক্ষেত্রে নয়, ক্রমে সকল ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার আইন কার্যকর করুন। সাথে সাথে নির্দলীয় তাক্বওয়াশীল ও যোগ্য লোকদেরকে বাছাই করে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন করুন (৩) আইনমন্ত্রীর ভাষ্যমতে দেশের ফৌজদারী মামলা সমূহের শতকরা ৭৫ ভাগ হ’ল জমিজমা সংক্রান্ত। এইসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রতি উপযেলাতে পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠা করুন। যারা সরেযমীনে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নিবেন। অনুরূপভাবে পারিবারিক শালিশী আদালত গঠন করুন। আর এইসব আদালতে দ্বীনদার ও সম্মানী লোকদের নিয়ে ‘বিচার সহায়ক কমিটি’ গঠন করুন। তাহ’লেই বিচারকগণ প্রকৃত আসামী শনাক্ত করতে সক্ষম হবেন (৪) শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করুন (৫) অশ্লীল ও মারদাঙ্গা ছায়াছবি প্রদর্শন, পর্ণো সাহিত্য, সিনেমার নগ্ন পোস্টারিং, ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের আমদানী ও সহজলভ্যতা কঠোর হস্তে দমন করুন।

পরিশেষে বলব, রামাযান আসছে। ‘ক্লীনহার্ট’ বা হৃদয় শুদ্ধির প্রকৃত সুযোগ এ মাসেই রয়েছে। তাই নুযূলে কুরআনের এই পবিত্র মাসকে মর্যাদা দিন। এ মাসের সম্মানে সব হালাল জিনিসের মূল্য হ্রাস করার ব্যবস্থা নিন। এ মাসে কোন অন্যায় কাজের শাস্তি অন্য মাসের তুলনায় দ্বিগুণ করুন। অফিসে-আদালতে, যানবাহনে সর্বত্র যাতে ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি হয় এবং রামাযানের পবিত্রতা বজায় থাকে, সেদিকে তীব্র দৃষ্টি রাখুন। শুধু সেনাবাহিনী নয়, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সর্বত্র সকলে যেন ‘ক্লীনহার্ট’ বা শুদ্ধহৃদয় হন, আমরা আল্লাহ পাকের নিকটে সেই প্রর্থনা করি। আল্লাহ দেশে শান্তি দিন- আমীন![3] 


[1]. বুখারী হা/৩৪৭৫; মুসলিম হা/১৬৮৮; মিশকাত হা/৩৬১০।

[2]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪০, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৩৫৮৭।

[3]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর ২০০২।






বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
কল্যাণের অভিযাত্রী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সিলেবাস থেকে বিবর্তনবাদ ছাঁটাই করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নির্বাচনী দ্বন্দ্ব নিরসনে আমাদের প্রস্তাব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিজয়ের মাস ও পার্বত্য চুক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রসঙ্গ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের তরুণ সমাজ বিদেশমুখী হচ্ছে কেন? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আমেরিকার নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রামাযান ও বর্ষবরণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রক্তঝরা কাশ্মীর, নিষ্পিষ্ট গুজরাট ও জেনিন : মুসলিম বিশ্বের নীরবতা ও অমুসলিম বিশ্বের কপটতার মাঝখানে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সার্বভৌমত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মূল্যস্ফীতি : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হানাহানি কাম্য নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.