১৯৮৮ ও ১৯৯৮-এর দেশব্যাপী প্রলয়ংকরী বন্যার অর্ধযুগ পরে ২০০৪ সালে আবারো বন্যা এলো। এর মধ্যে ২০০১ সালে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা সহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬টি যেলা মারাত্মক বন্যায় দেড় মাস ডুবে ছিল। ১৯৮৮-এর বন্যা আড়াই মাস স্থায়ী ছিল। আক্রান্ত হয়েছিল ৩৭টি যেলা। এবারের বন্যা এক মাস অতিক্রম করল। আক্রান্ত হয়েছে ৫১টি যেলা। দেশের দুই তৃতীয়াংশ বন্যা প্লাবিত হয়েছে। ৪ঠা আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত সরকারী হিসাব মতে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪৭ হাযার ৫০৪ জন মানুষ বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৬৪০ জন। গবাদিপশু মারা গেছে ২০,৮০৫টি। ২৫ লাখ ৪১ হাযার ২৪৬ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ বা আংশিক বিনষ্ট হয়েছে। ৪০ লাখ ২৪ হাযার ৬৬৪টি বাড়ী আংশিক বা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ৫৬ হাযার ৯৪১ কি.মি. রাস্তা ধ্বংস হয়েছে এবং ৫৩৩৮টি ব্রীজ-কালভার্ট নষ্ট হয়েছে। ভেড়ি বাঁধ ধ্বংস হয়েছে ৩০১৬ কি.মি.। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে ২৪,৩০৪টি। টাকার অংকে এবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব মতে ৪২ হাযার কোটি টাকা বলা হ’লেও এই অংক আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোকের মধ্যে অন্ততঃ দেড় কোটি লোককে আগামী এক বছর রিলিফ দিয়ে যেতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে আবারও একটি বন্যার আশংকা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করেছেন। বিগত ৪৫ বছরে ১৫টি ব্যাপক বিধ্বংসী বন্যা হ’ল। শোনা যাচ্ছে, এখন থেকে নাকি শুকনা মওসুমেও বন্যা হবে। প্রশ্ন হ’ল : তাহ’লে এখন থেকে কি আমরা এভাবে ডুবতেই থাকব, আর মরতেই থাকব? এর কি কোন সমাধান নেই?

বন্যার কারণ : বাংলাদেশ নীচু ও ভাটির দেশ হওয়ার কারণে উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম তিন দিকের উঁচু ও উজানের দেশ নেপাল ও তিববত থেকে ভারতের উপর দিয়ে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা সহ ৫৪টি নদীর বিপুল পানিরাশি বাংলাদেশের বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বন্যার সময় কেবল পদ্মা ও যমুনা বেসিন দিয়েই প্রতি সেকেন্ডে ১ কোটি ৫০ লাখ কিউবিক একর পানি বয়ে যায়। এই বিপুল পানি ধারণ করার মত ক্ষমতা আমাদের নদ-নদীগুলির পূর্বেও ছিল না, আর এখনতো প্রশ্নই ওঠেনা। বর্তমানে বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের ছোট-বড় ৩০০০ নদীর মধ্যে ৫০০ নদী মরে গেছে। বাকীগুলো মরার অপেক্ষায় রয়েছে। স্রোতের অভাবে অধিকাংশ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে উজান থেকে আসা পানিরাশি ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। এরপরে যদি ভারত বিগত বাজপেয়ী সরকারের গৃহীত ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে এবং ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা সহ বড় বড় নদীতে বাঁধ দিয়ে সব পানি তাদের দেশে আটকে রাখে ও বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়, তাহ’লে তো উজানের দেশটি খুব সহজে আমাদেরকে ডুবিয়ে ও শুকিয়ে মারতে পারবে। যার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ : উঁচু দেশের পানি নীচু দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক স্রোতধারায় যখন বাধা সৃষ্টি করা হয় অথবা ধারণ ক্ষমতার বেশী পানি প্রবাহিত হয়, তখনই বন্যা দেখা দেয়। আর অতিরিক্ত পানি আসে অতিবৃষ্টির কারণে অথবা হিমালয় থেকে অতিরিক্ত বরফ গলার কারণে। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে বন্যার ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। মেজর রেনেলের ম্যাপ থেকে সূত্র গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক পরিসংখ্যানবিদ ড. আব্দুস সাত্তার প্রমাণ করেন যে, উল্লেখিত সময় পর্যন্ত পদ্মা ও যমুনা সম্পূর্ণ পৃথকভাবে প্রবাহিত হ’ত। সেকারণ তখন বন্যার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ঐ সময় সংঘটিত একটি ভূমিকম্পের ফলে গোয়ালন্দের নিকটে পদ্মা ও যমুনা মিলিত হয়ে যায়। তাতে গোটা দেশের পানি পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে উক্ত বৃহৎ নদী দু’টির গতিপথকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেবার জন্যে তিনি ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের নিকটে গঙ্গা বাঁধের প্রস্তাব পেশ করেন। সরকার প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উত্থাপন করে। জাতিসংঘ প্রস্তাবটি পসন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত সেদিকে না গিয়ে তারা WAPDA চালু করে, যা দেশের সর্বত্র বাঁধ দিয়ে কেবল পানি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং নদী-নালা সব মজিয়ে দেয়। ড. আব্দুস সাত্তার শুরুতেই এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে, শুধু বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং পানি নিষ্কাশনের গতি সহজ করার মাধ্যমেই কেবল বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দেখা গেল, এখন নদীতে পানির অভাবে ওয়াপদার প্রয়োজনই শেষ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে আইয়ূব খান গঙ্গা বাঁধ নির্মাণের জন্য ৮৬ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তখন তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে কিংবা ফুরানো হয়েছিল। তাই এক্ষেত্রে আমাদের ১নং পরামর্শ হ’ল : সেদিনের ৮৬ কোটির স্থলে তার শতগুণ বেশী টাকা খরচ করে হ’লেও গঙ্গা বাঁধ দিয়ে পদ্মা ও যমুনার স্রোত পৃথক করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করান। কেননা এটাই হ’ল বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী সমাধান।

আমাদের ২য় পরামর্শ হ’ল : চীন সরকারকে অনুরোধ করা এই মর্মে যে, তারা যেন তিববতের সাং-পো নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেন। কেননা ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসস্থল হ’ল তিববতের উক্ত নদী, যা তিববতের মধ্যেই ১৪৪৩ কি.মি. প্রবাহিত এবং যমুনা নদী মূলতঃ ব্রহ্মপুত্রেরই স্রোতধারা। তৃতীয়তঃ ভারত ও নেপাল সরকারের সাথে পরামর্শক্রমে উজানে পানির আধার সৃষ্টি করা এবং সেখান থেকে তিন দেশের সমন্বিত তদারকিতে সুষ্ঠু পানি পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

উল্লেখ্য যে, ফারাক্কা বাঁধে ভারত যে লাভবান হতে চেয়েছিল, এখন তা তাদের লোকসানের খাতে চলে গেছে। পশ্চিম বঙ্গের নদী-নালা মজে গেছে। ফলে বন্যায় ও খরায় তারাও আমাদের মত ডুবছে ও শুকাচ্ছে। সম্ভবতঃ এতদিনে তাদের হুঁশ ফিরেছে এবং হয়তবা সেকারণেই গত ২৯শে জুলাই ব্যাংককে অনুষ্ঠিত Bay of Bengal Initiatives Multi Sectoral Tecnical & Economic Co-operation সংক্ষেপে ‘বিমসটেক’ (BIMSTEC) সম্মেলনে ভারত আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনায় সম্মত হয়েছে। চতুর্থতঃ শহর-গ্রাম ও খাল-বিলের যাবতীয় ভরাট কাজ বন্ধ করা হৌক। বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য মহানগরীর আশপাশের পানির উৎসগুলির নাব্যতা অক্ষুণ্ণ রাখা হৌক। প্রেসিডেন্ট যিয়াউর রহমানের স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা কর্মসূচী পুনরায় চালু করা হৌক। পঞ্চমতঃ রেল ও সড়ক পথসমূহ উঁচু করা হৌক ও সেখানে দীর্ঘ ব্রীজ ও কালভার্টসমূহ নির্মাণ করা হৌক। মাছের ঘেরের ভেড়িগুলি পরিকল্পিতভাবে হৌক, যাতে পানি প্রবাহে কোনরূপ বাধা সৃষ্টি না হয়। ষষ্ঠতঃ হিমালয়ের ঢালুতে দুর্বৃত্তরা বনাঞ্চল উজাড় করে দিচ্ছে। ফলে গাছের শিকড়ের সাহায্যে যত পানি নীচে শোষিত হ’ত, তা এখন হচ্ছে না। ঐ পানি বন্যা আকারে ভাটিতে ধেয়ে আসছে। এদিকে বাংলাদেশী দুর্বৃত্তরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনের গাছ কেটে সাবাড় করছে। ফলে যেমন পাহাড় ভাঙছে ও পাহাড়িয়া ঢল বাড়ছে, তেমনি সুন্দরবনের মাটি ভাঙছে ও ঝড় ধেয়ে আসছে ভিতরে বিনা বাধায়। ওদিকে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমে গ্রাস করছে তামাম ফসলী জমিকে। তাই যেকোন মূল্যে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। সপ্তমতঃ হিমালয় শীর্ষে জমে থাকা বরফমালার উপরে বিমান থেকে রাসায়নিক পদার্থ ফেলে বরফ গলার পরিমাণ প্রয়োজনমত কমবেশী করার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সাধারণতঃ প্রতি ১১ বছর অন্তর পৃথিবীতে পতিত অধিক সূর্যতাপে হিমালয়ের বরফ গলার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। উক্ত পর্বতমালা এখন ভারত ও চীনের দখলে। তাই উক্ত দুই দেশের সম্মতি ও সহযোগিতা আবশ্যক।

পরিশেষে বলব, হিংসা ও জিঘাংসার রাজনীতি পরিহার করতে হবে এবং চীন ও তিববতকে সাথে নিয়ে ভারত ও নেপালের সহযোগিতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে । এটা উপমহাদেশের সকল দেশের স্বার্থেই যরূরী। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ঐ জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (রা‘দ ১৩/১১)। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন![1]


[1]. ৭ম বর্ষ ১১তম সংখ্যা আগস্ট ২০০৪






বিষয়সমূহ: বিবিধ
মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিদায় হজ্জের ভাষণ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আসামে মুসলিম নিধন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ক্বিয়ামতের গুজব ও বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মশুদ্ধির মাস রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংবিধান পর্যালোচনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে সন্ত্রাসী! আল্লাহকে ভয় কর - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরামর্শ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত
ইসলামী আইনের কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাবলীগী ইজতেমা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানবতা ভাসছে নাফ নদীতে! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.