ভূমিকা :
পরহেযগারিতা বা আল্লাহভীরুতা দ্বীনের ভিত্তিসমূহের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতা ছাড়া ঈমান কখনোই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। ঈমান হ’ল একটি বৃক্ষের ন্যায় আর পরহেযগারিতা হ’ল তার সৌন্দর্য। পানি যেমন কাপড় থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করে দেয়, পরহেযগারিতা তেমনি মানবাত্মাকে যাবতীয় মানবিক ব্যাধি হ’তে মুক্ত করে সুন্দর মানুষে পরিণত করে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে পরহেযগারিতার সংজ্ঞা, তা অবলম্বনের উপকারিতা এবং অর্জনের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
পরহেযগারিতার সংজ্ঞা :
আভিধানিক অর্থে বিরত থাকা, সংকোচ বোধ করা, হারাম থেকে বিরত থাকা, (বিশেষ অর্থে) হালাল ও মুবাহ বস্তু থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।[1]
পারিভাষিক অর্থে শরীফ জুরজানী বলেন, الورع: اجتناب الشبهات خوفًا من الوقوع في المحرمات ‘দ্বীনদারী হ’ল, হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ হ’তে বেঁচে থাকা’।[2]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘যে কাজ করলে আখেরাতে ক্ষতির আশংকা থাকে, তা পরিহার করাকে পরহেযগারিতা বলা হয়’।[3]
ইবরাহীম ইবনে আদহাম বলেন, ‘পরহেযগারিতা হ’ল- সকল প্রকার সন্দেহযুক্ত বস্তু, অনর্থক কর্মকান্ড ও অতিরঞ্জিত কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকা’।[4]
পরহেযগারিতার সংজ্ঞায় রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। যেমন তিনি বলেছেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيْهِ ‘ব্যক্তির ইসলামী সৌন্দর্য হ’ল, অনর্থক কর্মকান্ড পরিহার করা’।[5]
পরহেযগারিতার স্তর সমূহ :
রাগেব ইস্পাহানী পরহেযগারিতাকে তিনটি স্তরে বিন্যাস করেছেন।-
(১) ওয়াজিব : সকল প্রকার হারাম থেকে বেঁচে থাকা। এ প্রকারের পরহেযগারিতা অর্জন করা সকল মানুষের উপর ওয়াজিব।
(২) মুস্তাহাব : সন্দেহপূর্ণ বস্ত্তসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। মধ্যম স্তরের পরহেযগার ব্যক্তিদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।
(৩) মাফযূল : অনেক মুবাহ এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সমূহ থেকেও বিরত থাকা। নবী-রাসূল, শহীদগণ এবং ছালেহ বান্দাদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।[6]
পরহেযগারিতা অবলম্বনের গুরুত্ব ও মর্যাদা :
পরহেযগারিতা অবলম্বনের প্রভূত মর্যাদা সম্পর্কে বহু হাদীছে আলোকপাত করা হয়েছে। একদা রাসূল (ছাঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে পরহেযগারিতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, يَا أَبَا هُرَيْرَةَ كُنْ وَرِعًا تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ ‘হে আবু হুরায়রা! তুমি পরহেযগার হও, তাহ’লে তুমি সকল মানুষের চেয়ে বড় ইবাদতকারীতে পরিণত হবে’।[7]
সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُ دِيْنِكُمُ الْوَرَعُ ‘তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হ’ল পরহেযগারিতা’।[8]
রাসূল (ছাঃ) যেভাবে দ্বীনদারী অবলম্বনের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন, অনুরূপভাবে সালাফে ছালেহীনও দ্বীনদারী অবলম্বনের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁরা কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষকে তাক্বওয়া অর্জন ও দ্বীনদারী অবলম্বন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। যেমন- ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
إِنَّ الدِّينَ لَيْسَ بِالطَّنْطَنَةِ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ وَلَكِنَّ الدِّيْنَ الْوَرَعُ
‘শেষ রাতে নড়াচড়া করা অর্থাৎ তাহাজ্জুদ পড়া বা যিকির- আযকার করা প্রকৃত দ্বীন নয়, বরং দ্বীন হ’ল, পরহেযগারিতা অবলম্বন করা’।[9]
অর্থাৎ যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে। অথচ হারাম-হালালের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না, মানুষের হকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না, ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে কোন বাছ-বিচার করে না, তারা কখনোই দ্বীনদার নয়। ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে তাদের এরূপ আমল কোনই কাজে আসবে না।
হাসান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, সর্বোত্তম ইবাদত হ’ল, সর্বদা দ্বীনী চিন্তা-ভাবনা রাখা এবং পরহেযগারিতা অবলম্বন করা।[10]
অর্থাৎ যারা প্রতিটি কর্মে দ্বীনকে প্রাধান্য দেয় ও পরহেযগারিতা অবলম্বন করে, তাদের মধ্যে প্রকৃত মানবতা উদ্ভাসিত হয়। তখন তাদের মধ্যে আল্লাহর হক, মানুষের হক ও স্বীয় আত্মার হকের ব্যাপারে পূর্ণ দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়। মানুষের হক তারা নষ্ট করে না এবং আল্লাহ রাববুল আলামীনের হকও তারা যথাযথভাবে আদায় করে। তাদের দ্বারা কোন প্রকার অন্যায়-অত্যাচার সংঘটিত হয় না। সকল প্রকার হারাম থেকে তারা বিরত থাকে।
মুতাররিফ বিন শিখখীর বলেন, তোমরা দুইজন লোকের সাথে সাক্ষাৎ করলে দেখবে, একজন অনেক ছালাত ও ছিয়াম আদায় করে এবং বেশী বেশী আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর অপর ব্যক্তি যে বেশী ছালাত বা ছিয়াম আদায় করে না এবং বেশী বেশী ছাদাক্বাও করে না। সে তার থেকে উত্তম। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, তা কিভাবে সম্ভব? তখন তিনি বললেন, লোকটি তার অপর ভাইয়ের তুলনায় আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয় সমূহে অধিক সতর্ক ও পরহেযগার।[11]
এখানে একটি কথা স্পষ্ট হয়, শুধু ছালাত-ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বা দিয়ে দ্বীনদার হওয়া যায় না। দ্বীনদার হওয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। হারাম থেকে বেঁচে থাকা নফল ইবাদত-বন্দেগী হ’তে অধিক যরূরী।
পরহেযগারিতা অবলম্বনের উপকারিতা :
পরহেযগারিতা দুনিয়া ও আখেরাতে ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনে। ইহজগতে মহান রাববুল আলামীন মানুষের মধ্যে তার এমন গ্রহণযোগ্যতা দান করেন, যার মাধ্যমে সে মানুষের ভালবাসার পাত্রে পরিণত হয়, যদিও তার জ্ঞান-বুদ্ধির ঘাটতি থাকে। আর আখেরাতে তার জন্য মহাপুরস্কার অপেক্ষা করে। যার বাস্তবতা আমরা সর্বদাই দেখে থাকি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘অবশ্যই সে সাফল্য লাভ করবে, যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করবে’ (আ‘লা ৮৭/১৪)।
১. অল্প আমলে অধিক ছওয়াব লাভ
ইউসুফ বিন আসবাত বলেন, অধিক আমল করার চাইতে স্বল্প পরহেযগারিতা অর্জন করাই যথেষ্ট।[12]
এক ব্যক্তি আবু আব্দুর রহমান আল-আমেরীকে বলল, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। উত্তরে তিনি মাটি থেকে একটি প্রস্তরখন্ড উঠিয়ে নিয়ে বললেন, এ প্রস্তরখন্ড পরিমাণ তাক্বওয়া তোমার অন্তরে প্রবেশ করা সমগ্র যমীনবাসীর ছালাত হ’তেও উত্তম।[13]
অনেক মানুষ আছে যারা অধিক ইবাদত করে। কিন্তু তাদের ইবাদতে কোন খুলূছিয়াত নেই। তাদের এ ধরনের ইবাদত নিষ্ফল ও অকার্যকর। সুতরাং একথা স্মর্তব্য যে, শুধু অধিক ইবাদতই মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং পরহেযগার ব্যক্তির ইখলাছপূর্ণ স্বল্প আমলই পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট।
২. সন্দেহযুক্ত বস্তু হ’তে বিরত থাকার সক্ষমতা অর্জন
পরহেযগারিতা মানুষকে সন্দেহপূর্ণ বস্ত্তসমূহ থেকে বিরত রাখে। আবু আব্দুল্লাহ আল-ইনতাকী বলেন, যে ভয় করে সে ধৈর্য ধারণ করে। আর যে ধৈর্য ধারণ করে সে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে। আর যে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে সে সন্দেহজনক বস্ত্ত থেকে বিরত থাকে।[14]
৩. দো‘আ কবুল হওয়া
পরহেযগারিতা দো‘আ কবুলের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। মুহাম্মদ বিন ওয়াসে‘ বলেন, পরহেযগারিতার সাথে সামান্য দো‘আই যথেষ্ট। যেমন খাবারের সাথে সামান্য লবণই যথেষ্ট হয়। অর্থাৎ পরহেযগার ব্যক্তির সামান্য দো‘আই আল্লাহ তা‘আলা দ্রুত কবুল করেন।[15]
৪. ইলম অর্জনে বরকত
আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান কানৌজি (১৮৩২-১৮৯০ইং) বলেন, একজন আলেমের জন্য যরূরী হ’ল তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতা অবলম্বন করা। যখন কোন আলেমের মধ্যে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা থাকবে তখন তার ইলমের ফায়েদা ও উপকারিতা বেশী হবে।[16]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তাঁর উস্তাদ ওয়াকী‘ যে উপদেশ দেন, তা নিম্নরূপ :
شَكَوْتُ إلَى وَكِيعٍ سُوءَ حِفْظِي * فَأوْصَانِيْ إلَى تَرْكِ المعَاصِيْ فَإِنَّ العِلْمَ نُورٌ مِنْ إِلَهِى * وَنُوْرُ اللهِ لاَ يُعْطَي لِعَاصِيْ
‘আমি আমার উস্তাদ ওয়াকী‘কে আমার দুর্বল মুখস্থ শক্তির বিষয়ে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে পাপ বর্জনের উপদেশ দিলেন এবং বললেন, দ্বীনী ইলম হ’ল আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোন গোনাহগারকে দেওয়া হয় না’।
কেননা ইলম মহান প্রভু প্রদত্ত এক অমূল্য নূর সদৃশ। আর পাপ হ’ল অন্ধকারের ন্যায়। অন্ধকার এবং আলো কখনোই একসাথে অবস্থান করতে পারে না। তাই যখনই বান্দা ছোট-বড় সকল ধরনের পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়, তখনই তার হৃদয়ে ইলমের নূর প্রবেশ করে। যা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয় এবং অন্যকে উপকৃত করতে সক্ষম হয়।
৫. হক কবুলের মানসিকতা সৃষ্টি
সুফিয়ান ছাওরী বলেন, আমি যখনই কোন মানুষের নফসের চাহিদার বিরোধিতা করি, তখনই তাকে দেখতে পাই সে আমার উপর বিরক্ত হয়। আসলে বর্তমানে আলেম ও পরহেযগার লোকের খুব অভাব দেখা দিয়েছে।[17]
প্রকৃত আলেম বা পরহেযগার ব্যক্তিগণ কখনোই তাদের মতের বিরোধিতাকারীর উপর বিরক্ত হন না। বরং তাদের যদি কেউ উপদেশ দেয়, তাতে তারা খুশী হন এবং উপদেশ গ্রহণ করেন।
৬. আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন
আত্মার সংশোধন অত্যন্ত যরূরী বিষয়। আত্মার সংশোধন ছাড়া মানুষ কখনোই পরহেযগার হ’তে পারে না। আর যখন মানুষ পরহেযগার হবে না, তখন তাকে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। তবে মানুষ যখন পরহেযগার হয়, তখন সে অন্যের সংশোধনের পূর্বে নিজের সংশোধনে অধিক সচেষ্ট হয়। একজন মানুষের পরহেযগারিতা তার নিজের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের কারণ হয়ে থাকে। মানুষ যখন পরহেযগার হয়, তার মধ্যে কোনরূপ হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার থাকে না। ইবরাহীম বিন দাঊদ বলেন,
وَالَمْرءُ إنْ كَانَ عَاقِلاً وَرِعاً * أَخْرَسَهُ عَنْ عُيُوْبِهِمْ وَرْعُهْ
كَمَا السَّقِيْمُ الْمَرِيْضُ يُشْغِلُهُ * عَنْ وَجَعِ الناَّسِ كُلِّهِمْ وَجَعُهْ
‘যদি কোন মানুষ জ্ঞানী ও মুত্তাক্বী হয়, তার তাক্বওয়া তাকে মানুষের দোষ-ত্রুটি নিয়ে মন্তব্য বা সমালোচনা করা হ’তে বোবা বানিয়ে দেয়। যেমন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তার ব্যথা-বেদনা অন্যান্য লোকের ব্যথা-বেদনা নিয়ে চিন্তা করা হ’তে বিরত রাখে।[18]
পরহেযগার ব্যক্তি সব সময় তার নিজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে চিন্তিত থাকে। নিজেকে সঠিক ও সৎ পথে পরিচালনার জন্য ব্যস্ত থাকে। ফলে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণের সুযোগ সে খুব কমই পেয়ে থাকে।
৭. চারিত্রিক মাধুর্য বৃদ্ধি :
উত্তম চরিত্র এক অমূল্য মানবীয় সম্পদ। উত্তম চরিত্র মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্ত মর্যাদা ও সফলতার দুয়ার খুলে দেয়। মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। মানুষ তাকে তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। আর এ গুণ অর্জনের জন্য পরহেযগারিতার কোন বিকল্প নেই।
আব্দুল করীম আল-জাযারী বলেন, একজন পরহেযগার ব্যক্তি কখনোই ঝগড়া-বিবাদ করে না। তারা মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করে।[19]
কোন সমাজে একজন পরহেযগার লোক থাকলে সে মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। লোকেরা তার কাছে বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য যায়। বিপদ-আপদে তার থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে। যাবতীয় গোপন বিষয় তার কাছে বলে। দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশার সময় তার কাছে এসে সান্ত্বনা পায়।
৮. দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জন
পরহেযগার ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জন করে। ফুযায়েল বিন আয়ায বলেন, পাঁচটি বিষয় সৌভাগ্য লাভের কারণ : অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বীনি ব্যাপারে পরহেযগারিতা, দুনিয়া বিমুখতা, লজ্জাশীলতা এবং জ্ঞান।[20]
পরহেযগারিতা অর্জনের পথ :
পরহেযগারিতা আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য নে‘মত। যিনি এ নে‘মতের অধিকারী হন, তার জন্য ইহকাল-পরকালের সফলতা নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য আমাদেরকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হবে। যা নিম্নরূপ :
(১) নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকা
পরহেযগারিতা অর্জনের প্রথম শর্ত হ’ল যেসব কাজ আল্লাহ তা‘আলা হারাম করেছেন, সেগুলো থেকে বিরত থাকা। নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হ’তে বিরত থাকা দ্বীনদারী অর্জনের প্রধান শর্ত। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, اجْتَنِبْ مَا حُرِّمَ عَلَيْكَ تَكُنْ مِنْ أَوْرَعِ النَّاسِ ‘যা কিছু তোমার জন্য হারাম করা হয়েছে, তা থেকে বিরত থাক। তাহ’লে তুমি বড় পরহেযগার হ’তে পারবে’।[21]
(২) সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ পরিহার করা
পরহেযগারিতা অর্জনের অন্যতম উপায় হ’ল যাবতীয় হারাম বস্তু ছাড়াও সন্দেহপূর্ণ বিষয়সমূহ হ’তে বিরত থাকা এবং যে ব্যাপারে মনে খটকা সৃষ্টি হয়, আত্মাকে অস্থির করে তোলে, তা পরিত্যাগ করা।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيْبُكَ ‘যা তোমাকে সন্দেহে ফেলে, তা ছেড়ে নিঃসন্দেহ বিষয়ের দিকে ধাবিত হও।’[22] অপর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, الْخَيْرُ طُمَأْنِيْنَةٌ وَالشَّرُّ رِيبَةٌ ‘সৎকর্ম সর্বদা প্রশান্তিদায়ক, কিন্তু অসৎকর্ম সর্বদা সন্দেহপূর্ণ’।[23]
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ الْحَلاَلَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيْنِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِى الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِى الْحَرَامِ كَالرَّاعِى يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيْهِ، أَلاَ وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلاَ وَإِنَّ حِمَى اللهِ مَحَارِمُهُ-
‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। উভয়ের মধ্যবর্তী কিছু অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে, অধিকাংশ মানুষ যা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি অস্পষ্ট বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে পূর্ণতা দান করবে। আর যে ব্যক্তি অস্পষ্ট বিষয় সমূহে পতিত হবে, সে হারামে পতিত হবে। যেমন একটি রাখাল ক্ষেতের সীমানায় ছাগল চরালে সে শস্য ক্ষেতে প্রবেশ করতে পারে। মনে রেখো, প্রত্যেক বাদশাহর একটি সীমানা রয়েছে। আর আল্লাহর সীমানা হচ্ছে তাঁর হারাম সমূহ’।[24]
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِىْ نَفْسِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ ‘সৎকর্ম হ’ল উত্তম চরিত্র। আর পাপকর্ম হ’ল যে কাজ তোমার মনে খটকা সৃষ্টি করে এবং তা অন্য কারো অবগত হওয়াকে তুমি অপসন্দ কর’।[25]
তাই পরহেযগারিতা অর্জনের জন্য অবশ্যই সকল প্রকার সন্দেহপূর্ণ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
(৩) আর্থিক লোভ-লালসা পরিহার করা
পরহেযগারিতা অর্জনের জন্য অর্থের লোভ পরিত্যাগ করে সর্বদা পরকালীন মুক্তি লাভকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট একজন লোক এসে কোন একটি বিষয়ে সাক্ষী দিলে তিনি বললেন, আমি তোমাকে চিনি না। আর আমার না চেনায় তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি একজন লোক নিয়ে আস যে তোমাকে চেনে। এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের একজন বলল, আমি তাকে চিনি। ওমর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কি হিসাবে চেন? সে বলল, ন্যায়পরায়ণ এবং মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসাবে।&ওমর (রাঃ) বললেন, সে কি তোমার নিকট প্রতিবেশী? তুমি কি তার রাত-দিন, গোপন-প্রকাশ্য সকল বিষয়ে অবগত? সে বলল, না। তুমি কি তার সাথে টাকা-পয়সার লেন-দেন করেছ, যা মানুষের পরহেযগারিতার প্রমাণ? লোকটি বলল, না। ওমর (রাঃ) বললেন, তুমি কি তার সাথে কখনোও সফরে সঙ্গী হয়েছিলে, যার মাধ্যমে চারিত্রিক মাধুর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়? লোকটি বলল, না। তখন তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে জান না। সুতরাং তুমি এমন একজন লোক নিয়ে আস, যে তোমার সম্পর্কে জানে।[26]
সুফিয়ান ছওরীকে দ্বীনদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে, উত্তরে তিনি বলেন,
إِنِّيْ وَجَدْتُ فَلا تَظُنُّوا غَيْرَهُ * هَذَا التَّوَرُّعُ عِنْدَ هَذَا الدِّرْهَمِ
فإذَِا قَدَرْتَ عَليْهِ ثُمَّ تَرَكْتَهُ * فَاعْلَمْ بِأَنَّ هُنَاكَ تَقْوَى المُسْلِمِ
‘মনে রেখো, আমি দিরহামের নিকট পরহেযগারিতাকে খুঁজে পেয়েছি। এর বাইরে তুমি অন্য কিছুকে ধারণা কর না’। ‘যখন তুমি দিরহাম অর্জনে সক্ষম হ’লে অতঃপর তা পরিত্যাগ করলে। জেনে রাখো! এখানেই একজন মুসলমানের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা (লুকিয়ে) রয়েছে।[27]
(৪) ছোট-বড় সকল কর্মের হিসাব দেওয়ার ব্যাপারে সজাগ থাকা
আবুল আববাস ইবনু আত্বা বলেন, পরহেযগার লোকদের দ্বীনদারী সৃষ্টি হয় শস্যদানা ও অণু পরিমাণ পাপকে স্মরণ করার মাধ্যমে। তাকে স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের প্রতিটি ভাল ও মন্দ কর্মের হিসাব নিবেন। তিনি হিসাবের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছাড় দিবেন না। বরং কঠোরতা করবেন। তার চেয়ে আরও কঠিন ব্যাপার হ’ল যে, তিনি তাঁর বান্দাদের থেকে অণুকণা ও শস্যদানা সমপরিমাণ বিষয়েও হিসাব নিবেন।[28]
সুতরাং বান্দাকে অবশ্যই হিসাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং আমাদেরকে একদিন আল্লাহর সামনে হিসাবের জন্য দাঁড়াতে হবে এ কথা চিন্তা করে যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করতে হবে।
(৫) আল্লাহকে ভয় করা
আবু আব্দুল্লাহ আল-ইনতাকী বলেন, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হয়।[29] যার অন্তরে আল্লাহভীতি থাকে, সে কখনোই নিষিদ্ধ বিষয়ের ধারে-কাছে যায় না। আললাহভীতিই দ্বীনের মূল ভিত্তি। তাই এটি ব্যতীত প্রকৃত দ্বীনদারী অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়।
(৬) সর্বদা মৃত্যুর কথা চিন্তা করা
একদা রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল أَىُّ الْمُؤْمِنِيْنَ أَكْيَسُ ‘সর্বাধিক বিচক্ষণ মুমিন কে’? উত্তরে তিনি বললেন, أَكْثَرُهُمْ لِلْمَوْتِ ذِكْرًا وَأَحْسَنُهُمْ لِمَا بَعْدَهُ اسْتِعْدَادًا أُولَئِكَ الأَكْيَاسُ ‘যে মুমিন মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং পরবর্তী জীবনের জন্য সবচেয়ে সুন্দর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে’।[30]
ইয়াহইয়া ইবনু মু‘আয বলেন, তিনটি অভ্যাসের চর্চা দ্বারা দ্বীনদারী অর্জিত হয়- আত্মমর্যাদাবোধ, বিশুদ্ধ আক্বীদা এবং মৃত্যুর ভয়।[31]
আত্মমর্যাদাবোধ মানুষকে অনেক অপরাধমূলক কাজ হ’তে বিরত রাখে। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ মানহানিকর কোন কর্মে অগ্রসর হয় না। এছাড়া আক্বীদার বিশুদ্ধতা ব্যতীত মানুষের কোন আমলই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই বিশুদ্ধ আক্বীদাকে মানুষের যাবতীয় আমলের রূহ হিসাবে গণ্য করা হয়।
অতঃপর মৃত্যুর অপরিহার্যতা বিষয়ে সকলেই অবগত। তবে মানুষ যখন মৃত্যুর কথা বেশী বেশী চিন্তা করে তখন তার অন্তর নরম হয় এবং দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা দুর্বল হয়ে পড়ে। শতকষ্টেও সে আখেরাতের পুরস্কারের কথা ভেবে আনন্দিত হয়।
তাই মানুষ মৃত্যুকে যত বেশী স্মরণ করবে, ততই সে দুনিয়াবী লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকবে এবং প্রকৃত দ্বীনদারী অর্জনে সক্ষম হবে।
(৭) বিদ‘আত পরিত্যাগ করা
ইমাম আওযা‘ঈ (রহঃ) বলেন, আমরা আলোচনা করতাম যে, যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আতে লিপ্ত হয়, তখন তার তাক্বওয়া-পরহেযগারিতাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।[32]
(৮) ইলম অনুযায়ী আমল করা
ইলম অনুযায়ী আমল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাহ্ল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, যখন কোন মুমিন তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, তখন তার ইলম তাকে তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতার দিকে পথ প্রদর্শন করবে। আর যখন সে তাক্বওয়া অবলম্বন করবে, তখন তার অন্তর আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে যুক্ত হবে।[33]
ইলম অনুযায়ী আমল করা দ্বীনদারী অর্জনের পূর্ব শর্ত। যারা তাদের ইলম অনুযায়ী আমল করে আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদের জন্য হেদায়াতের পথ খুলে দেন।
(৯) দুনিয়া বিমুখ হওয়া
মানুষকে দুনিয়াতেই বেঁচে থাকতে হয় এবং দুনিয়াতে বেঁচে থেকে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব-কর্তব্য সমূহ পালন করেই তাকে আখেরাতের পাথেয় অর্জন করতে হয়। কারণ দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। এখানে মানুষ স্বল্প সময়ের জন্য বেঁচে থাকে। তারপর তাকে অবশ্যই তার আসল গন্তব্য আখেরাতের পথে পাড়ি দিতে হয়। দুনিয়াবী জীবন কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাতকে ভুলে যায় এবং দুনিয়া অর্জনের জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করে।
এ কথা আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের মহববত কখনোই একত্রে অবস্থান করতে পারে না। যার অন্তর দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্থ, তার অন্তর থেকে আখেরাতের পাথেয় অর্জনের চিন্তা দূর হয়ে যায়। আর যার অন্তরে আখেরাতের মহববত থাকে, তার অন্তরে দুনিয়াবী লোভ-লালসা বিস্তার লাভ করতে পারে না।
আবু জাফর আল-মিখওয়ালী বলেন, যে অন্তর দুনিয়াকে তার সাথী বানিয়েছে সে অন্তরে তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা বসবাস করা হারাম হয়ে যায়।[34]
(১০) ক্রোধ দমন করা
ক্রোধ মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি মানুষের জীবনে অনেক বিপদ ডেকে আনে। আবু আব্দুল্লাহ আস-সাজী (রহঃ) বলেন, যখন কোন অন্তরে ক্রোধ প্রবেশ করে, তখন তার অন্তর থেকে তাক্বওয়া দূর হয়ে যায়। মানুষ যখন ক্রুদ্ধ হয়, তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলে। ফলে তার মধ্যে পরহেযগারিতা অবশিষ্ট থাকে না।[35]
(১১) কম খাওয়া এবং প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা
মাত্রাতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ মানুষের জন্য বহু অকল্যাণ বয়ে আনে। অধিক খাদ্যগ্রহণের ফলে মানুষকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হয়। আক্রান্ত হ’তে হয় বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধিতে। ইবাদত-বন্দেগীতে অলসতা আসে। প্রবৃত্তির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তাই প্রকৃত দ্বীনদারী অর্জনের জন্য অবশ্যই মাত্রাতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ইমাম গাযযালী বলেন, দ্বীনদারী ও তাক্বওয়ার চাবিকাঠি হ’ল, কম খাওয়া এবং প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা।[36]
(১২) আশা-আকাংখাকে সীমিত করা
আশা-আকাংখার মাঝেই মানুষ বেঁচে থাকে। এটাই মানুষকে কর্মের দিকে ধাবিত করে। দীর্ঘ দিন বাঁচার আশায় মানুষ সঞ্চয় করে এবং ধন-সম্পদ হাছিলের অবিরাম চেষ্টা চালায়। মানুষ এত দীর্ঘ আশা করে থাকে যা তার জীবনকালের চেয়েও দীর্ঘ। কিন্তু এই দীর্ঘ আশা ইহকাল-পরকালে মানুষের জন্য কখনোই কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। সুতরাং আকাংখাকে সীমিত করতে হবে। প্রতিটি দিনকেই জীবনের শেষ দিন হিসাবে গণ্য করতে হবে। ইবরাহীম বিন আদহাম বলেন, স্বল্প লোভ ও আশা-আকাংখা মানুষের মধ্যে সততা ও দ্বীনদারী সৃষ্টি করে।[37]
(১৩) বাক সংযত হওয়া
যবানকে হেফাযত করা অতীব গুরুত্বগূর্ণ একটি বিষয়। একজন মানুষের জন্য কঠিনতম ও কষ্টকর কাজ হ’ল, যবানের হেফাযত করা। সেকারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্ত্ত (জিহবা) এবং দুই রানের মধ্যবর্তী বস্ত্ত (লজ্জাস্থান)-এর যামিন হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব’।[38] হাসান ইবনু ছালেহ বলেন, আমরা দ্বীনদারী অনুসন্ধান করে দেখতে পাই যে, যবান ছাড়া আর কোন কিছুতে তা এত দুর্বল নয়’।
ফুযায়েল ইবনু আয়ায বলেন, সবচেয়ে কঠিন পরহেযগারিতা হ’ল, মানুষের যবান। যার যবান ঠিক থাকবে তার বাকি সবকিছু ঠিক থাকবে। তাই পরহেযগারিতা অর্জনের জন্য বাক সংযম একান্ত যরূরী।
(১৪) কথা কম বলা
কথা কম বলা মানুষের একটি বিশেষ গুণ। যারা কথা কম বলে তারা অনেক ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিরাপদ থাকে এবং মানুষ তাদের ভালবাসে। আর যে ব্যক্তি কথা বেশী বলে, তার মধ্যে বাড়িয়ে বলার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তার দোষ-ত্রুটি মানুষের সামনে অধিকহারে প্রকাশ পায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে’।[39] একদিন তিনি আবু যর গেফারী (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি উত্তম চরিত্রবান হও এবং দীর্ঘ সময় চুপ থাক।[40]
আব্দুল্লাহ ইবনু আবি যাকারিয়া বলেন, যার কথা বেশী হবে, তার ভুল-ভ্রান্তি বেশী হবে, আর যার ভুল-ভ্রান্তি বেশী হবে, তার তাক্বওয়া হ্রাস পাবে, আর যার তাক্বওয়া কমে যাবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরকে নিষ্প্রাণ বানিয়ে দিবেন।[41]
(১৫) ঝগড়া পরিহার করা
ঝগড়া-বিবাদ মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ ‘আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে অপসন্দনীয় হ’ল সেই ব্যক্তি, যে অধিক ঝগড়াটে ও বিবাদকারী’।[42] আওযাঈ হাকাম ইবনু গায়লান আল-কাইসীর নিকট লিখিত চিঠিতে বলেন, তুমি ঝগড়া-বিবাদ ছেড়ে দাও, যা তোমার অন্তরকে কলুষিত করে, দুর্বলতা তৈরি করে, হৃদয়জগতকে শুকিয়ে দেয় এবং কথা ও কাজের মধ্যে তাক্বওয়া অবশিষ্ট রাখে না।[43]
(১৬) অন্যের চর্চা ছেড়ে দিয়ে নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে নযর দেওয়া
পরহেযগারিতা অর্জনের জন্য অন্যের দোষান্বেষণ থেকে বিরত হ’তে হবে। অধিকাংশ মানুষ অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু নিজের দোষ খুঁজে দেখে না। কোন মানুষই দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, সে কথা স্মরণে রেখে নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং এজন্য পরম করুণাময় আল্লাহর নিকটে একাগ্রচিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ইবরাহীম বিন আদহামকে কিভাবে তাক্বওয়া পূর্ণতা লাভ করবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, তুমি তোমার গুনাহের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে চিন্তা কর এবং তোমার প্রভুর নিকট তওবা কর, তাতে তোমার অন্তরে তাক্বওয়া বা দ্বীনদারী প্রতিষ্ঠিত হবে।[44]
(১৭) অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করা হ’তে বিরত থাকা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ব্যক্তির ইসলামী সৌন্দর্য্য হ’ল, অনর্থক কর্মকান্ড পরিহার করা’।[45] যেসব কাজ ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ইহকাল ও পরকালে কোন সুফল বয়ে আনে না, সেরূপ অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য একান্ত যরূরী।
সাহ্ল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়, সে পরহেযগারিতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়’।[46]
(১৮) লজ্জাশীল হওয়া
লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَلْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ ‘লজ্জাশীলতা ঈমানেরই অংশ’।[47] তিনি আরো বলেন, الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِى إِلاَّ بِخَيْرٍ ‘লজ্জাশীলতা কল্যাণ বৈ কিছুই আনয়ন করে না’।[48] লজ্জাশীলতা মানুষকে অধিকাংশ অনৈতিক কাজকর্ম থেকে বিরত রাখে। লজ্জাবোধের অভাবে মানুষের অধিকাংশ অপকর্ম সংঘটিত হয়। সুতরাং লজ্জাশীলতা পরহেযগারিতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ সোপান।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, যার লজ্জা কম হয়, তার তাক্বওয়াও কম হয়। আর যার তাক্বওয়া কম হয়, তার অন্তর মারা যায়।[49]
উপসংহার :
বস্ত্ততঃ পরহযেগারিতার বিষয়টি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করে। পরহেযগারিতা অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে ইসলামী শরী‘আত প্রদত্ত সকল ফরয ও ওয়াজিবসমূহ পালন করতে হয় এবং নিষিদ্ধ ও সংশয়পূর্ণ কাজ সমূহ থেকে বিরত থাকতে হয়। উপরন্তু তাকে এমন সব বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে হয়, যেগুলোর বিষয়ে শরী‘আতে সরাসরি আদেশ বা নিষেধ না থাকলেও তার সাথে মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ জড়িত থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, পরহেযগারিতা মানুষকে ইহকালে যাবতীয় হতাশা, দুশ্চিন্তা থেকে এবং যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়। সাথে সাথে আখেরাতে অনাবিল শান্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য করে। তাই প্রত্যেক মুসলিম ভাই-বোনের জন্য পরহেযগারিতা অবলম্বন করা একান্ত যরূরী। মহান আল্লাহ দুনিয়াবী জীবনের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমাদেরকে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বিরত থেকে তাক্বওয়া-পরহেযগারিতার সাথে আমল করার তাওফীক দান করুন। আর বিনিময়ে পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য করুন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الدُّنْيَا أَضَرَّ بِالْآخِرَةِ، وَمَنْ طَلَبَ الْآخِرَةَ أَضَرَّ بِالدُّنْيَا- فَأَضِرُّوْا بِالْفَانِي لِلْبَاقِيْ- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার (ভোগ-বিলাস) অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, আখেরাতকে সে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর যে আখেরাতের পাথেয় অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, সে দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব তোমরা চিরস্থায়ী আখেরাতের জন্য ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত কর।[50] আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!
[শায়খ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ রচিত الورعবই অবলম্বনে]।
[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, পৃঃ ১০২৫; লিসানুল ‘আরাব ৮/৩৮৮।
[2]. শরীফ জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৮৮) পৃঃ ২৫২।
[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৭৩), পৃঃ ১১৮ ।
[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারেজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৯৬), ২/২৪।
[5]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৮৩৯, সনদ ছহীহ।
[6]. রাগেব ইস্পাহানী, আয-যারী‘আহ ইলা মাকারিমিশ শারী‘আহ (কায়রো : দারুস সালাম, ২০০৭), পৃঃ ২২৭।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭, সনদ ছহীহ।
[8]. হাকেম, আলবানী, ছহীহ আত-তারগীব হা/৬৮।
[9]. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, যুহুদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৯৯), পৃঃ ১০৪।
[10]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ (কুয়েত: দারুস সালাফিয়াহ, ১৯৮৮), পৃঃ ৩৭।
[11]. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, আয-যুহ্দ, পৃঃ ১০৪; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৩৬৬৪০।
[12]. আবু নাঈম ইস্পাহানী, হিলয়াতুল আউলিয়া (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৭৪), ৮/২৪৩।
[13]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/২৮৮।
[14]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৯০।
[15]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১১৪৯।
[16]. শু‘আবুল ঈমান হা/১১৪৯।
[17]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/১৯।
[18]. আল-ওয়ারঊ হা/২১৮, পৃঃ ১২৩।
[19]. শু‘আবুল ঈমান হা/৮১২৯।
[20]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২১৬।
[21]. শু‘আবুল ঈমান হা/১৯৭।
[22]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬২।
[23]. ইবনু হিববান হা/৭২২, সনদ ছহীহ।
[24]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬২।
[25]. মুসলিম হা/২৫৫৩, মিশকাত হা/২৭৬২।
[26]. বায়হাক্বী হা/২০১৮৭, আলবানী, সনদ ছহীহ।
[27]. আবুল কাশেম কাযবীনী, মুখতাছার শু‘আবুল ঈমান (দামেশক: দারু ইবনে কাছীর, ১৪০৫) পৃঃ ১/৮৬)।
[28]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/২৮৩।
[29]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৯০।
[30]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯; ছহীহাহ হা/১৩৮৪।
[31]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/৬৮।
[32]. আব্দুর রহমান ‘আজালী, আহাদীছ ফী যাম্মিল কালাম (রিয়াদ: দারু আতলাস, ১৯৯৬) ৫/১২৭।
[33]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫।
[34]. খতীব বাগদাদী, তারীখু দিমাশক (বৈরূত: দারুল গারব, ২০০২) ১৬/৫৯১।
[35]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/৩১৭।
[36]. গাযযালী, মা‘আরেজুল কুদস (বৈরূত: দারুল আফাক, ১৯৭৩) পৃঃ ৮১।
[37]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/৩৫।
[38]. বুখারী হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২।
[39]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৪৩।
[40]. মুসনাদ আবু ইয়া‘লা, মিশকাত হা/৪৮৬৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৩৮ সনদ হাসান।
[41]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৫/১৪৯।
[42]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৭৬২।
[43]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/১৪১।
[44]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/১৬।
[45]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৮৩৯ সনদ ছহীহ।
[46]. শু‘আবুল ঈমান হা/৪৭০৩, ৭/৮৬।
[47]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৭০।
[48]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৭১।
[49]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/২২৫৯, বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৪৬৪০।
[50]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫১৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৮৭।