সত্য সেটাই যা আল্লাহ
প্রেরিত। আর মিথ্যা সেটাই যা আল্লাহ বিরোধী এবং যাতে প্রবৃত্তির রং
মিশ্রিত। সত্য সর্বদা বিজয়ী এবং মিথ্যা সর্বদা পরাজিত। আল্লাহ বলেন, তিনিই
তার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত
দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬১/৯)।
অত্র আয়াতে ‘হেদায়াত’ ও ‘সত্যদ্বীন’ বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে এবং ‘সকল দ্বীন’ বলতে ইসলামের বাইরে যুগে যুগে প্রচলিত সকল দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘বিজয়’ বলতে আদর্শিক ও রাজনৈতিক উভয় বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। রাজনৈতিক বিজয় সর্বত্র সর্বদা না থাকাই স্বাভাবিক। তবে আদর্শিক বিজয় সর্বদা রয়েছে এবং থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে আদর্শিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে ইসলাম অন্য সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী ছিল। ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে ইমাম মাহদীর আগমনে পুনরায় বিশ্বব্যাপী সে বিজয় আসবে বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তবে ইমাম মাহদী আসার আগ পর্যন্ত ইসলাম সর্বদা কুফরী শাসনের অধীনে থাকবে এটা নয়। আল্লাহ বলেন, কাফেররা চায় আল্লাহর নূরকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ চান তার নূরকে পূর্ণ করতে। আর আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’ (ছফ ৮)। এর দ্বারা বুঝা যায় মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য চেষ্টিত থাকতে হবে। নইলে তারা যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যার পরিণাম হবে জাহান্নাম। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিজয়ের পথ হবে নবীগণের গৃহীত পথ, অন্য কোন পথ নয়। তাছাড়া আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিজয়কে পৃথক করে দেখার কোন অবকাশ নেই। দু’টিই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। হাত ও পা পৃথক হলেও তা যেমন একই দেহের অঙ্গ। তেমনি ধর্ম ও রাজনীতি বাহ্যতঃ পৃথক হ’লেও তা মানুষের জীবনের দু’টি দিক মাত্র। একটির দ্বারা অপরটি প্রভাবিত।
মুমিনের সার্বিক জীবন তাওহীদের চেতনায় পরিচালিত হয়। জীবনের কোন একটি দিক ও বিভাগে আল্লাহ ব্যতীত সে অন্য কারু দাসত্ব করে না। আর সেই দাসত্বের বিধান সমূহ বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে। যে মুমিন উক্ত দুই উৎসের আলোকে জীবন পরিচালনা করেন, তিনি ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত। ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই এটি তাদের বৈশিষ্ট্যগত নাম। তারাই মাত্র ফের্কা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। কিয়ামতের প্রাক্কাল অবধি এই দলের বিজয়ী কাফেলা পৃথিবীর সর্বত্র থাকবে। বিরোধীরা বা পরিত্যাগকারীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না’ (বুখারী, মুসলিম)।
আদর্শিক বা রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল তিনটি। ১. লক্ষ্যের স্বচ্ছতা। ২. উপলক্ষ্যের পবিত্রতা। ৩. দৃঢ় নৈতিকতা।
আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার এবং তাতে কোন খাদ নেই। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার আহবান নিয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ময়দানে কাজ করে যাচ্ছে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং পরকালে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে। এই লক্ষ্যে ব্যয়িত প্রতিটি মুহূর্তকে আমরা আখেরাতে মুক্তির অসীলা মনে করি। অতঃপর আমাদের উপলক্ষ্যে এবং উপায়-উপকরণে প্রচলিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নষ্টামির কোন সংশ্রব নেই। সমাজে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী কোন পন্থা আমরা অবলম্বন করি না। আমরা বাতিলের সঙ্গে আপোষ করে হক প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্ন দেখিনা। নবীগণ স্ব স্ব যুগে প্রচলিত বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেননি। আমরাও তা করি না। পার্থিব জয়-পরাজয় আমাদের নিকট মুখ্য নয়। পরকালীন মুক্তিই মুখ্য। আর সেটাই হ’ল শ্রেষ্ঠ বিজয়। তবে বাতিলপন্থীরা সর্বদা হকপন্থীদের শত্রু। সেকারণ তাদের হাতে চিরকাল হকপন্থীরা লাঞ্ছিত হয়েছেন। আমরাও হয়েছি। ইতিমধ্যে যারা বাতিল ছেড়ে হক কবুল করে ‘আহলেহাদীছ’ হচ্ছেন, তাদের উপরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাতিলের হামলা হচ্ছে। এগুলি বাতিলপন্থীদের অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ এবং আদর্শিক পরাজয়ের লক্ষণ। একদিন তাদের রাজনৈতিক পরাজয়ও ঘটবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আদর্শিক বিজয়ের সাথে সাথে আসে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিজয়, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন।
সবশেষে দৃঢ় নৈতিকতা। আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কর্মীদের অধিকাংশ এ ব্যাপারে উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমাদের উপর যখন ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার ও বর্বরতম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল, তখনও আমাদের কর্মীরা লক্ষ্য হারায়নি বা নীতিচ্যুত হয়নি। যদিও তৎকালীন সরকারের লেজুড় পার্টি করার জন্য সব ধরনের টোপ ও চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। ভীরু ও দুর্বলচেতা এবং ‘আন্দোলন’ সম্পর্কে অজ্ঞ বা আধা অজ্ঞ কিছু কর্মী তাতে বিভ্রান্ত হয়ে চলে গিয়েছিল তুচ্ছ দুনিয়াবী স্বার্থে। এজন্য আমরা দুঃখিত এবং তাদের হেদায়াত কামনা করি। কিন্তু এতে আমরা বিস্মিত নই। কারণ এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। তাছাড়া হক আন্দোলনের জন্য যোগ্য কর্মী আল্লাহ নিজে থেকেই বাছাই করেন। পবিত্র থেকে অপবিত্রদের পৃথক না করা পর্যন্ত আল্লাহ হকপন্থী মুমিনদের ছাড়বেন না বলে নিজেই ওয়াদা করেছেন (আলে ইমরান ১৭৯)।
উপরে বর্ণিত তিনটি শর্ত যদি আমরা অক্ষুণ্ণ রেখে শান্তিপূর্ণ পথে দাওয়াত ও সংগঠন চালিয়ে যেতে পারি, তাহ’লে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের ধর্মভীরু অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে ‘আহলেহাদীছ’ হবেন অথবা তাদের সমর্থক হবেন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তাই এ মুহূর্তে প্রয়োজন ইমারতের অধীনে নিঃস্বার্থ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ দাওয়াত। সমাজ পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে শহরে-গ্রামে, দেশে ও প্রবাসে সর্বত্র সচেতন কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠা আবশ্যক। যাত্রাপথে বাধা থাকবে সেটা ভেবে নিয়েই ধৈর্য্যের সাথে দাওয়াত দিয়ে যেতে হবে। ভরসা স্রেফ আল্লাহর উপরে, ফলাফলও তাঁর হাতে। নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাৎহুন ক্বারীব (স.স.)।