মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। আর মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে এ পৃথিবী এবং এর সবকিছু। আল্লাহর মালিকানাধীন এ পৃথিবীর যেখানে খুশী তার বান্দারা বসবাস করবে। সবারই ফিৎরাত ও স্বভাবধর্ম এক। সবারই জৈবিক ও মানবিক চাহিদা এক। সবারই মধ্যে কুপ্রবৃত্তি, বিবেকশক্তি ও প্রশান্ত হৃদয় রয়েছে। পার্থক্য সূচিত হয় কুপ্রবৃত্তির দমনে ও লালনে। যারা স্ব স্ব প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে, তারাই সত্যিকারের মানুষ। আর যারা তাকে দমন না করে লালন করে, তারা মনুষ্যত্বের সীমানা পেরিয়ে যায়। আর তখনই মানুষের সমাজে শুরু হয় বিপত্তি ও অশান্তি। কুপ্রবৃত্তিকে দমনের জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে জাহান্নামের ভীতি ও জান্নাতের পুরস্কার লাভের সংবাদ দিয়ে যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণ আগমন করেছেন। যারা আল্লাহ প্রেরিত সেইসব হেদায়াত মেনে চলে, তারাই হ’ল মুমিন ও মুসলিম। আর যারা সেগুলি প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে প্রবৃত্তির ও বহুত্বের দাসত্ব করে, তারা হয় কাফের-মুশরিক ও মুনাফিক। আর ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি হবে আল্লাহর অহি, কুরআন ও সুন্নাহ। যার ভিত্তিতে অন্যায়কারী শাস্তি পাবে এবং ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি পুরস্কৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এসেছিলেন বিশ্ববাসীকে সৃষ্টির দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনতে এবং অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে।

দীর্ঘ ২৩ বছরের বিপদ সংকুল নবুঅতী জীবন শেষে বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেন, ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু।... তিনি বলেন, ‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগা। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’ (অতএব মাটির কোন অহংকার নেই)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেন, ‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তিনি সবকিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩; তিরমিযী হা/৩২৭০ প্রভৃতি; ছহীহাহ হা/২৭০০)

প্রশ্ন ওঠে সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায়? এর অর্থ যদি নির্দিষ্ট ধর্মীয় দলীয়তা হয়, তাহ’লে মুসলমান সহ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে ভূগর্ভে চলে যেতে হবে। আর যদি সাম্প্রদায়িকতা বলতে রাজনৈতিক দলীয়তা বুঝানো হয়, তাহ’লে তথাকথিত গণতন্ত্রের জয়গান বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ গণতন্ত্রের নামে সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সমাজ রসাতলে যেতে বসেছে। আর যদি এর দ্বারা অর্থনৈতিক দলীয়তা বুঝানো হয়, তাহ’লে সাম্যবাদী নামধারীদের গাড়ীর ড্রাইভার ও বাড়ীর সুইপার খুঁজে পাওয়া যাবে না। পূঁজিবাদী আমেরিকা ও তাদের দোসর রাষ্ট্রগুলি এবং সাম্যবাদ বা কম্যুনিজমের স্বর্গভূমি রাশিয়া, চীন ও তাদের সমগোত্রীয় রাষ্ট্রগুলিতে আজ মানবতা কিভাবে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা কেবল তারাই। ফলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে প্রচলিত দলতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র ছোবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ এখন অন্যত্র পথ খুঁজছে।

পারস্পরিক পরিচিতির উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায় আল্লাহরই সৃষ্টি (হুজুরাত ৪৯/১৩)। কিন্তু মানুষ হিসাবে সকলের অধিকার সমান। মর্যাদার মানদন্ড হ’ল স্রেফ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। কেননা আল্লাহভীতিই হ’ল মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার একমাত্র হাতিয়ার। তাই অসাম্প্রদায়িক বলতে যদি সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বনু আদমের প্রতি সমান ব্যবহার ও ন্যায়বিচার বুঝায়, তবে তা কেবল আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান নিঃশর্তভাবে মেনে চলার মাধ্যমেই সম্ভব। আল্লাহ সৃষ্ট আলো-বাতাস যেমন সবার জন্য মঙ্গলময়, আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান তেমনি সবার জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ সৃষ্ট প্রাকৃতিক ও জৈবিক বিধান আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মেনে চলছি। কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকায় আমরা তাঁর প্রেরিত অহি-র বিধান আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছি। আর সেকারণেই মানুষের জীবনে নেমে আসছে ক্রমাগতভাবে অশান্তির দাবানল। সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িকের অবান্তর বিতর্ক। আমরা কি আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকল মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে পারি না? আমরা কি পারিনা সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে ভাই হিসাবে বুকে টেনে নিতে? আল্লাহভীরু সৎ মানুষগুলোই কি সমাজের স্তম্ভ নয়? হৌক সে মুসলিম বা অমুসলিম, হৌক সে বাঙ্গালী বা অবাঙ্গালী। এই দর্শনই কেবল মানব সমাজের ভেদাভেদ দূর করতে পারে, অন্য কোন দর্শন নয়।

সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় ও রাজ্যসভায় National Register of Citizens (NRC) এবং Citizenship Amendment Bill (CAB) পাস হয়েছে। এ আইন দু’টি মূলতঃ সেদেশ থেকে মুসলিম বিতাড়নের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে। যার বিরুদ্ধে সেদেশের জনমত উত্তাল হয়ে উঠেছে। এমনকি মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে অমুসলিমরাও বিক্ষোভ করছে। ইতিমধ্যে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। সে দেশের আতঙ্কিত বহু মুসলিম বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। অন্যেরা ঢোকার অপেক্ষায় সীমান্তে ভিড় করছে। কেন জানিনা এই বিব্রতকর অবস্থায় বাংলাদেশে হঠাৎ রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক গণ অসন্তোষ। যা পূর্ব থেকে চলে আসা স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির বিভেদাত্মক তৎপরতার উপর ঘৃতাহুতি দানের শামিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পরেও কি এইসব বিভেদ জিইয়ে রাখতে হবে? তারা বা তাদের সন্তানরা কি কখনো দেশপ্রেমিক হ’তে পারবে না? জাতি কি কোনভাবেই ঐক্যবদ্ধ হ’তে পারবে না?

নেপথ্য শক্তি যারা কলকাঠি নাড়ছে, তারা অবশ্যই দেশে শান্তি ও অগ্রগতি চায় না। ভাইয়ে ভাইয়ে মিলিতভাবে বসবাসকারী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুন্দর একটি দেশকে সর্বদা অশান্তিময় করে তোলে ক্ষমতান্ধ কিছু রাজনৈতিক অপশক্তি। উদার ও মানবতাবাদী মানুষ কখনোই মানুষে মানুষে বিভেদ চায় না। তারা চায় পরস্পরকে ভালবাসতে ও ক্ষমা করতে। কারণ প্রকৃত ন্যায়বিচার তো কেবল আল্লাহই করতে পারেন। যে বিচার হয় সূক্ষ্ম ও যথার্থ। যার ফলাফল হয় দুনিয়া ও আখেরাতে অত্যন্ত কঠিন। অতএব আসুন! আমরা পরস্পরকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করি। বিভেদ বৃদ্ধির চেষ্টা বন্ধ করে মহববত বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)






ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শাসন ব্যবস্থায় আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ রাখুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিধ্বস্ত ফিলিস্তীন ও আমরা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কসোভোয় মুসলিম নির্যাতন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যেরুসালেমকে ইস্রাঈলের রাজধানী ঘোষণা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ কখনো জঙ্গী নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রাষ্ট্র দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উত্তরাঞ্চলকে বাঁচান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চাই লক্ষ্য নির্ধারণ ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কারা সংস্কারে আমাদের প্রস্তাব সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নিঃশ্বাসের কৈফিয়ত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত-তাহরীক : যাত্রা হ’ল শুরু (৩য় সংখ্যা)
আরও
আরও
.