উক্ত সংগঠনের নামে গত ১২ই
মে রবিবার দেশের প্রথম সারির কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত
শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যদিও সংগঠনটির সভাপতি বাংলাদেশ
টেলিভিশনের মহাপরিচালক ও ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’র ব্যবস্থাপনা
পরিচালক পীযুষ বন্দোপাধ্যায় ১৬ই মে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। তিনি তার লিখিত
বক্তব্যে বলেন, ১২ মে দেশের বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় প্রচারিত বিজ্ঞাপনটির
সঙ্গে কোন পর্যায়েই আমাদের প্রিয় সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশে’র কোন
সংশ্লিষ্টতা নেই। ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাসী এবং সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সামাজিক সংগঠন। দেশবাসীকে
বিভ্রান্ত করতেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। তিনি
বলেন, ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অসাম্প্রদায়িক
জাতিসত্তার পক্ষে কাজ করে চলেছে’।
বিজ্ঞাপনটি নিম্নরূপ :
সন্দেহভাজন জঙ্গী সদস্য সনাক্তকরণের (রেডিক্যাল ইন্ডিকেটর) নিয়ামকসমূহ
১. বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্ররা জঙ্গী মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জঙ্গী হামলা ও টার্গেটেড কিলিং মিশনে অংশগ্রহণ করে শহীদের মর্যাদা প্রাপ্তির ভুল নেশায় ডুবে রয়েছে। এ রেডিক্যাল ইয়ুথ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে উচ্চ শিক্ষা/উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে রিক্রুটারদের মাধ্যমে কৌশলে ব্রেইন ওয়াশের শিকার হচ্ছে এবং পরবর্তীতে জঙ্গী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে ও বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে গমন করে (সিরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া, কাশ্মির প্রভৃতি) জঙ্গী আক্রমণের পরিকল্পনা ও আত্মঘাতী হামলায় অংশগ্রহণ করছে। এ সকল জঙ্গী সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ, নজরদারি, ব্যক্তিগত প্রোফাইল দীর্ঘদিন ধরে পর্যলোচনা ও বিশ্লেষণ করে নিম্নে উল্লেখিত রেডিক্যাল ইন্ডিকেটর সমূহ ১২ থেকে ৩৫ বৎসর বয়সী যুবকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় :
(ক) একাডেমিক পড়াশুনার প্রতি অমনোযোগিতা ও ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশুনা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি। (খ) আত্মকেন্দ্রিক (ইন্ট্রোভার্ট), অতি মাত্রায় চুপচাপ, গভীরভাবে চিন্তামগ্ন এবং ধর্মীয় উপদেশমূলক কথাবার্তা বলা। (গ) রুমের মধ্যে বেশির ভাগ সময় একাকী থাকা ও তার কার্যক্রমকে গোপন রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকা। (ঘ) ইন্টারনেটের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তি। (ঙ) ফেসবুকে ফেক আইডি ব্যবহার করে জঙ্গী সংগঠনগুলোর লোগো ব্যবহৃত ফ্রেন্ডলিষ্টে এ্যাড করা এবং জিহাদ সংশ্লিষ্ট পোষ্টে লাইক বা কমেন্ট করা ও নিজের জিহাদী মতামত ব্যক্ত করা। (চ) গণতন্ত্রকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করা। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, শরিয়া আইন এবং খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার জন্য অতিমাত্রায় আগ্রহ প্রকাশ। (ছ) ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর প্রকৃত নামে রেজিষ্ট্রেশন না করা।
(জ) হঠাৎ করেই অতিমাত্রায় ধর্ম চর্চার প্রতি ঝোঁক এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করা। (ঝ) হঠাৎ করে দাড়ি রাখা এবং টাখনুর উপর কাপড় পরিধান শুরু করা। (ঞ) সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন, গান-বাজনা সহ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে নিজেকে গুটিয়ে রাখা এবং শিরক/বেদাত বলে যুক্তি প্রদান করা। (ট) বাবা-মা সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের নিজের পরিবর্তিত মতাদর্শ বিশ্বাস করতে ও তা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করা। (ঠ) সুনির্দিষ্ট কিছু মসজিদ এবং ইমামের পিছনে নামাজ পড়ার প্রবণতা। (ড) কুরআন ও হাদীসের অরিজিনাল কপি না পড়ে অনলাইনে প্রাপ্ত রেফারেন্স ও একই মতাদর্শী নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির মতামতকে বেশি যৌক্তিক মনে করা এবং কোন ইমাম/জ্ঞানী ব্যক্তিদের পরামর্শ না নেয়া। (ঢ) জিহাদ সংক্রান্ত পড়াশুনা (গাজওয়াতুল হিন্দ/খোরাসান/শাম সংক্রান্ত বিভিন্ন রেফারেন্স, ইমাম মাহদী ও দাজ্জালের আগমন ইত্যাদি) ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে চলমান মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে অতিমাত্রায় উদ্বিঘ্ন থাকা। (ণ) দাওয়া/বিভিন্ন জিহাদী গোপন বৈঠকের (হালাকা) আয়োজন করা এবং বিভিন্ন স্থানের নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে পূর্ব নির্বাচিত স্থানে নিজেরাই পর্যায়ক্রমে আমির নির্বাচিত করে প্রপাগেটিভ বক্তা/শ্রোতা হওয়া। (ত) আনওয়ার আল-আওলাকী, তামীম আল-আদনানী, জসিম উদ্দিন রহমানী, আসিম ওমর প্রভৃতি জিহাদী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির অডিও/ভিডিও/লেকচার শোনা এবং জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন (দাবিক-আইএস, ইন্সপায়ার-একিউ ইত্যাদি), ই-বুক পড়তে শুরু করা। (থ) মিলাদ, শবেবরাত, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া সহ প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিবস সমূহে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা।
(দ) প্রচলিত মাযহাবকে ভুল প্রমাণের প্রবণতা এবং তথাকথিত আহলেহাদীস/সালাফী/ওয়াহাবী মতাদর্শের প্রতি আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়া ও নিজেকে লা মাযহাব দাবি করা। (ধ) ধর্ম চর্চার পাশাপাশি শরীর চর্চা ও ক্যাম্পিং এত মতো বিষয়ে আগ্রহী হওয়া।
২. রেডিক্যালাইজেশনের ৪টি ধাপে নিম্নরূপে নিজেকে সম্পৃক্ত করা :
(ক) ১ম ধাপ- Pre Realization : তাওহীদ, শিরক, বেদাত, ঈমান, আকীদা, সালাত, ইসলামের মূলনীতি, দাওয়া/হালাকা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা। (খ) ২য় ধাপ- Conversion and Identification with Radical Islam : মাযহাব হতে লা মাযহাব, ইসলাম ও গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বর্জন, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, স্মৃতিসৌধ, সরকার তাগুত/কাফির, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব। (গ) ৩য় ধাপ- Indoctrination and Increased Group Bonding : হিজরত/প্রশিক্ষণ গ্রহণ, জিহাদী অডিও/ভিডিও দেখা, টার্গেট রেকি করার পদ্ধতি, গোপন যোগাযোগ (এ্যাপস) ব্যবহার। (ঘ) ৪র্থ ধাপ- Actual Acts of Terrorism or planned plots : টার্গেটেড কিলিং, জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা/অংশগ্রহণ, অর্থ/অস্ত্র/গোলাবারুদ সংগ্রহ ব্যবহার। আপনার পরিবারে বা আশেপাশে কারো মধ্যে এ লক্ষণসমূহ দেখা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিন’।
বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হওয়ার পর শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। জঙ্গী সদস্য শনাক্তকরণের কয়েকটি নিয়ামকের সাথে অনেকে একমত পোষণ করলেও অধিকাংশ নিয়ামক সমূহ বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান আছে বলে তারা মনে করেন। পাশাপাশি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। তারা এই বিজ্ঞাপনের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
আমাদের বক্তব্য :
বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ১৯+৪ মোট ২৩টি পয়েন্টের মধ্যে ৬টি বিষয়ে আমাদের তীব্র আপত্তি রয়েছে। সেগুলি হ’ল ১/চ, ঝ, ঞ, ট, থ, দ। কারণ এগুলি বিশুদ্ধ ইসলামের সাথে সম্পর্কিত। ইসলাম তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে দীপ্যমান। যুগে যুগে প্রচলিত কুফরী আদর্শ, শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজের সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনই সম্পর্ক নেই। তাই জাতিকে বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে আহবান করা ও সেদিকে সমাজকে পরিচালিত করা যেকোন নিষ্ঠাবান ও সচেতন মুসলমানের উপর অপরিহার্য কর্তব্য। তাই সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হ’ল জনগণকে প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা দেওয়া এবং তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা অনুযায়ী গড়ে তোলা। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে মাত্র। এর অর্থ এটা নয় যে, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে তারা সমর্থন করে। কারণ এগুলির সাথে বিশুদ্ধ ইসলামের কোনই সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’ (খ) ‘প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে’।
বস্ত্ততঃ উগ্রপন্থার সাথে প্রকৃত সালাফীদের কোন সম্পর্ক পূর্বেও ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। প্রকৃত আহলেহাদীছগণ ইসলামের ব্যাপারে যেমন কোনরূপ শৈথিল্যবাদকে প্রশ্রয় দেন না, তেমনি কোনরূপ চরমপন্থা অবলম্বনকে সমর্থন করেন না। তারা সর্বদা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে থাকেন। নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের বিরোধিতা করা, বাহ্যিকভাবে ছালাতে রাফউল ইয়াদায়েন করা, ছালাত ও ছালাতের বাইরে টাখনুর উপরে কাপড় রাখা এবং যুবকদের দাড়ি-টুপি দেখে বা নারীদের বোরকা-নেকাব দেখে যেন কেউ ধোঁকা না খান। কারণ এগুলি বিশুদ্ধ ইসলামের নিদর্শন। বরং এটাই সত্য যে, জঙ্গীবাদীরা হ’ল খারেজী মতবাদের অনুসারী। যারা কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের ‘কাফের’ বলে ও তাদের রক্ত হালাল মনে করে। সেকারণ বহুবিধ ইসলাম পরিপন্থী কর্মকান্ডের জন্য তারা সরকারকে ‘তাগূত’ বলে এবং সরকারের প্রতি সর্বদা আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে থাকে। অতএব এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ইসলামের বিশুদ্ধ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসাবে প্রকৃত আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে নানাভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। উপরোক্ত বিজ্ঞাপনটি তারই একটি অংশ মাত্র। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
আমরা মনে করি বহু অর্থ ব্যয়ে উক্ত বিজ্ঞাপন প্রচারের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের হাত রয়েছে। সরকারের কর্তব্য হবে তাদের খুঁজে বের করে দেশকে অশান্ত করার চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেওয়া এবং কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কর্মকান্ড সমূহ হ’তে বিরত থাকা। নইলে সরকারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।