বিশ্বব্যাপী ইসলামী
আন্দোলন সমূহ ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নাস্তিক ও সেক্যুলারদের মুকাবিলা
করার নামে ও ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ইসলামী নেতারা একে একে যেসব কৌশল
নিচ্ছেন, তাতে ইসলামের কল্যাণের চাইতে অকল্যাণ বেশী হচ্ছে। সেই সাথে সাধারণ
মুসলমানদের দুর্ভোগ বাড়ছে ও ইসলাম সম্পর্কে বিরোধীদের অপপ্রচারের সুযোগ
মিলে যাচ্ছে।
‘শত্রু যে পথে হামলা করবে সে পথেই তাকে প্রতিহত করতে হবে’ এই যুক্তিতে ইসলামী নেতারা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ধোঁকা প্রচলিত গণতন্ত্রের মুকাবিলা গণতন্ত্রের মাধ্যমে করতে গেলেন। দেখা গেল, সাধারণ গণতন্ত্রীদের চাইতে তারা এক কাটা বেড়ে গেলেন তথাকথিত হেকমতের নামে। বাহ্যিক পোষাকটুকুর পার্থক্যও ঘুuঁচ গেল। দাড়িও প্রায় হারিয়ে গেল। এমনকি ফরয ইবাদত ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ-যাকাত ‘মুবাহে’ পরিণত হ’ল। কারণ ‘বড় ইবাদত’ হুকুমত অর্থাৎ শাসনক্ষমতা দখল এখনও সম্ভব হয়নি। তিউনিসিয়া ও মিসরে আরব বসন্তের নামে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখল করলে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রপন্থী ইসলামী নেতারা খুশীতে বলতে লাগলেন এ শতাব্দী ইসলামের শতাব্দী। এক বছরও যায়নি মিসর ও তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থী সরকারগুলির পতন হয়েছে। ব্যালট হৌক বুলেট হৌক ‘শাসনক্ষমতা দখল করা ব্যতীত ইসলাম কায়েম হবে না’ দ্বীন কায়েমের এই ভুল ব্যাখ্যার কারণেই দেশে দেশে ইসলামের নামে জঙ্গী তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিছু ব্যক্তি জিহাদের নামে তরুণদের সশস্ত্র যুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। এর পিছনে শত্রুদের যেমন ইন্ধন রয়েছে, তেমনি ইসলামী নেতাদের ভুল ব্যাখ্যাও কাজ করছে। মিসর ও পাকিস্তানের প্রভাবশালী দুই ইসলামী নেতা তো তাদের সমস্ত লেখনী ও সাংগঠনিক তৎপরতা এর পিছনেই ব্যয় করেছেন। তাঁদের অনুসারীরা বিভিন্ন দেশে তাদের ভুল আক্বীদার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং শাসনক্ষমতা দখলের জন্য সব রকম হীন তৎপরতা চালাচ্ছে ইসলামের নামে। সিরিয়াতে তাদের অনুসারীরা প্রতিপক্ষের কলিজা বের করে চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ফৎওয়া অনুযায়ী সিরিয়া ও মিসরের ইসলামপন্থী যোদ্ধা ও দলীয় ক্যাডারদের তৃপ্তির জন্য ‘যৌন জিহাদে’ পাঠাচ্ছে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিয়ে ইসলামের নামে (নাঊযুবিল্লাহ)। বনু ইস্রাঈলের প্রসিদ্ধ আলেম বাল‘আম বাঊরা যেভাবে মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখলকারী আমালেক্বা নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিল তাদের সুন্দরী মেয়েদের পাঠিয়ে বনু ইস্রাঈলীদের কাবু করার জন্য। ফলে সে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়েছিল। যার প্রসঙ্গে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৭৫)। অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রে স্বীকৃত বৈধ পন্থার নামে হরতাল, গাড়ী ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, প্রতিপক্ষকে হত্যা, যখম ইত্যাদি চালানো হচ্ছে ইসলামের নামে এবং ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাযী’ মন্ত্র শুনিয়ে। এভাবে তাদের শহীদের তালিকা প্রকাশ করছে ইন্টারনেটে ও তাদের ডায়েরীতে।
বাংলাদেশে ইসলামী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা গণনা করা দুঃসাধ্য। বর্তমানে তো বড় বড় পীরদের একেকটি রাজনৈতিক দল। তারা মাঝে-মধ্যে যিকিরের সাথে রাজধানীতে এসে বিরাট বিরাট শোডাউন করেন ও নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে কিছু ইসলামী দাবী নিয়ে কিছু অরাজনৈতিক আলেম কঠিন রাজনৈতিক কায়দায় উত্থান করে ঢাকায় লাখো মানুষের ভিড় জমিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক। ফলাফল হয়েছে শূন্য। এদেশের মানুষ ইসলামপ্রিয়, একথা সবাই জানেন। গুটিকতক ‘গণজাগরণী’ ও নাস্তিক্যবাদীরাও তা ভালোভাবে জানে। কিন্তু তার জন্য শোডাউন, হরতাল বা অবরোধের কি প্রয়োজন? মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলিম তরুণদের সশস্ত্র যুদ্ধের উস্কানী দেওয়া কি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নয়? ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতি করার হিম্মত এদেশে কার আছে? কিন্তু সমস্যা হ’ল একখানে। আর তা হ’ল নেতৃত্ব আমার হ’তে হবে। ক্ষমতা দখলের এই অন্ধ নেশাই দুধে গো-চেনা ঢেলে দিচ্ছে। ফলে আদর্শের লড়াই পরিণত হয়েছে ক্ষমতার লড়াইয়ে। এই লড়াইয়ে কোন মুসলিম ‘শহীদ’ বা ‘গাযী’ হবে না। কারণ এ লড়াইয়ের লক্ষ্য হ’ল ‘দুনিয়া’।
প্রশ্ন হ’ল, ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দ্বীন কায়েম হবে, না জনগণের হৃদয়ে দ্বীন কায়েম হওয়ার পর ক্ষমতা দখল হবে? প্রথম পন্থাটি হ’ল বর্তমানে কথিত ইসলামী রাজনীতির দাবীদারদের। আর দ্বিতীয়টি হ’ল নবীগণের তরীকা। নবীগণের তরীকায় একজন মানুষ ইসলাম কবুল করলে তার পুরো জীবনটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ব্যবসা করলে সূদ-ঘুষ-মওজুদদারী থেকে বিরত হয়। পারিবারিক জীবনে সে হয় একজন আল্লাহভীরু ও সুন্দর চরিত্রের মানুষ। রাজনীতি করলে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করে। এজন্য ইসলামী রাজনীতির নামে আলাদা পরিভাষা চালু করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হ’ল মানুষকে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপটা বুঝানো। অধিকাংশ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ ধারণা রাখে না। তাওহীদ ও শিরকের পার্থক্য বুঝে না। ইসলামী নেতাদের কর্তব্য ছিল সবার আগে মানুষকে ইসলামী চেতনাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা। চেতনাহীন ও আদর্শহীন মুসলিমের ভোট নিয়ে ইসলামী আইন চালু করতে গেলে ঐসব ভোটাররাই একদিন বিরুদ্ধে চলে যাবে। তাই দলবৃদ্ধির উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে জনগণের ঈমানবৃদ্ধির চেষ্টা করা আবশ্যক। তবেই ‘শ্রেষ্ঠ উম্মত’ হিসাবে মুসলমান তার হৃত মর্যাদা ফিরে পাবে। আর শ্রেষ্ঠ উম্মতের দায়িত্ব হিসাবে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। আর মা‘রূফ ও মুনকার তথা ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। যার বুঝ হ’তে হবে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী। পরবর্তী যুগের কোন চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও পীর-মাশায়েখের বুঝ অনুযায়ী নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ইসলামপন্থী উভয় দলের মুসলিম নেতাদের তাই সর্বাগ্রে ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে। অতঃপর তার আলোকে নিজেদের আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। ধর্ম-বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসতে হবে। মানুষের অন্তরকে ঈমানের আলোকে আলোকিত করতে হবে। তাদের মধ্যে আখেরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। কোন আদম সন্তান যেন জাহান্নামের আগুনে পুড়ে শাস্তি না পায়, সেই দরদ নিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে হবে। এভাবে ব্যক্তির মধ্যে ইসলাম কায়েম হলে রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম হবে। তখন যদি ক্ষমতায় অন্য কেউ থাকে, তবুও তারা মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকারকে সম্মান করবে এবং তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এমনকি নাজাশীর মত নিজেরাই ইসলাম কবুল করবে। ইসলামের এই শান্ত-সুনিবিড় ও সুন্দর তরীকা ছেড়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে জীবনপাত করা কোন ইসলামী পথ নয়। নবীগণের পথও নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামের সোনালী ভবিষ্যৎ নবীগণের পথেই নিহিত। অন্যপথে নয়। আমরা মানুষকে সেপথেই আহবান করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন (স.স.)।