পার্শ্ববর্তী
আরাকান রাজ্যের বাঙ্গালী মুসলিম ভাই-বোনেরা আবারও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
মিয়ানমারের সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাখাইন মগ দস্যুরা এবং নাসাকা পুলিশ
বাহিনী সম্মিলিতভাবে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু
করেছে গত ৮ই জুন শুক্রবার থেকে। যুলুম ও অত্যাচারের এমন কোন দিক নেই, যা
এই নরপশুরা চালিয়ে যাচ্ছে না নিরীহ মযলূম মুসলমানদের উপরে। ফলে ১৯৪২, ১৯৭৮ ও
১৯৯২-য়ের মত ২০১২-তে এসে তারা আবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হ’ল। বিগত
দিনেও তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশ-এর টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছে।
এবারও স্বাভাবিকভাবে তারা এদেশমুখী হয়েছে। সর্বস্বহারা মানুষগুলো যখন
বাঁচার আশায় নৌকায় ভেসে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশী দ্বীপগুলোর দিকে ছুটছে, তখন
বর্বর বর্মী সেনাবাহিনী তাদেরকে নৌকাসহ ডুবিয়ে মারছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের
আধা সামরিক বাহিনী বিজিবি তাদেরকে ফিরিয়ে দিচ্ছে পুনরায় বধ্যভূমি আরাকানের
দিকে। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষগুলি এভাবেই সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে অথবা ডুবে
মরছে। সভ্য সমাজে এদৃশ্য কল্পনাতীত। বিগত দিনে বাংলাদেশ কখনো তাদের তাড়িয়ে
দেয়নি। বরং আশ্রয় দিয়েছে নিঃসন্দেহে মানবিক কারণে। কিন্তু এবার এ নিয়মের
ব্যতিক্রম হ’ল। তাই বলতে হয়, অসহায় ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোই প্রথম কাজ, না
তাকে নিয়ে রাজনীতি করাই প্রথম কাজ? পৃথিবীর সকল দেশ প্রতিবেশী দেশের
নির্যাতিত আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। আমাদের জনগণও বিগত দিনে ভারতে
এবং বর্তমান সময়ে ইরাক, লিবিয়া ও অন্যান্য হাঙ্গামাপূর্ণ দেশ থেকে
পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ আজ আমরা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের
ফিরিয়ে দিয়ে যে অমানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম, তাতে আমাদের বিপদের সময়
কেউ আশ্রয় দেবে কি-না সন্দেহ।
একটি বাম জাতীয় দৈনিকের কলামিষ্টের ভাষায় ‘সংসদে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমণি রোহিঙ্গা আন্দোলনের পিছনে জামায়াতে ইসলামীর উসকানি খুঁজে পেলেও ভাসমান মানুষের চোখের পানি দেখতে পাননি’। কথাটা অতীব সত্য। মিয়ানমারের যালেম সরকার ও শান্তিতে নোবেলজয়ী গণতন্ত্রী নেত্রী অং সান সুচি মযলূম রোহিঙ্গাদের প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, তাদেরকে যে ভাষায় তারা কটূক্তি ও অপদস্থ করে চলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় একই ভাষায় তাদের প্রতি তীর্যক মন্তব্য করেছেন। কথিত গণতন্ত্রী নেত্রী নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যা অং সান সুচির প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন? হাস্যোজ্জ্বল সুচি তখন বলে ওঠেন, রোহিঙ্গা! তারা আবার কারা? তিনি এখন এদেরকে Kala অর্থাৎ ‘বিদেশী’ বলছেন। সুচির দল এন,এল,ডি-র এক এম,পি গত এপ্রিলে তার সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রথম রোহিঙ্গাদের উপর লেলিয়ে দিয়ে দাঙ্গা বাঁধান। আর তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সমূহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে। অতঃপর ৮ই জুন থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। অথচ সুচি হয়ত ভুলে গেছেন যে, তার পিতা অন সানের অন্যতম প্রধান সহযোগী রাজনীতিক ছিলেন মুসলমানদের নেতা উ, রাযাক। শিক্ষা ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসাবে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ বার্মিজ সকলের নিকটে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক সহিংসতায় সুচির পিতার সাথে তিনিও নিহত হন। অথচ আজ সুচি তার পিতার বন্ধুকে চিনেন না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে, শান্তির মেডেলধারী সুচি তখন ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছেন। উচিত ছিল তার সব ফেলে ছুটে যাওয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে। হয়তবা তাতেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত।
তাদেরকে ‘অপরাধপ্রবণ’ জাতি বলে কাঁটা ঘায়ে নূনের ছিটা দেওয়া হচ্ছে। অথচ ২০ লক্ষ মুসলিম অধ্যুষিত একটা জাতিকে ঢালাওভাবে ‘অপরাধপ্রবণ’ বলা যে কত বড় অপরাধ তা যে কেউ বুঝতে পারেন। বরং বর্মী জলদস্যুদের হামলায় এক সময়ে পর্যুদস্ত বাংলাদেশে আজও ‘বর্গী হামলা’ ও ‘মগের মুল্লুক’ বলে প্রবাদবাক্য চালু আছে। সে সময়ের লুটপাটকারী এইসব বর্মী দস্যুরা তাদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী আজও ‘রাখাইন’ নামে আরাকানী মুসলমানদের উপর সশস্ত্র দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। রখ-ইঙ্গ অর্থ রাক্ষস ভূমি। হ্যাঁ, এ নামে পরিচিত হ’তে তারা আদৌ লজ্জাবোধ করে না। কারণ আসলে তারা রাক্ষসই বটে। এইসব নর রাক্ষসদের খোরাক হ’ল শান্তিপ্রিয় মুসলিম বাঙ্গালী রোহিঙ্গা জাতি। বিগত পঞ্চাশের দশকে বার্মার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশী স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সকলে অস্ত্র হাতে নিলেও রোহিঙ্গারা তা করেনি। বরং তাদের নেতা উ, রাযাক সুচির পিতা অং সানের সাথে মিলে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাতে তিনি অং সানের সাথে নিহত হয়েছিলেন।
অপরাধপ্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত। যখন সে অপরাধ করে, তখন সে দায়ী হয়। কিন্তু কেউ অপরাধ করলে পুরা জাতিকে অপরাধী বলা যায় না। সম্প্রতি সঊদী আরবে ৮ জন বাংলাদেশীর এবং দুবাইয়ে দু’জন বাংলাদেশীর শিরোশ্ছেদ করা হয়েছে খুনের মত কঠিন অপরাধের কারণে। তাই বলে কি বাংলাদেশীরা সবাই খুনী? এর পরেও রোহিঙ্গারা সেদেশে যে নাগরিকত্বহীন মানবেতর জীবন যাপন করছে এবং আমাদের দেশে তাদের যারা শরণার্থী শিবিরে আছে, তারা কি স্বাভাবিক মানবাধিকার ভোগ করতে পারছে? তাই জীবনের তাকীদে তাদের কেউ যদি কোন অপরাধ করেই বসে, তাই বলে তাদের পুরা জাতিকে ‘অপরাধপ্রবণ’ বলে অভিহিত করা কারু জন্যই সমীচীন নয়। সবচেয়ে বড় কথা এদেশী যেসব পাপিষ্ঠ তাদেরকে নানা অপকর্মে বাধ্য ও প্ররোচিত করছে, সরকার তাদের কি বলে আখ্যায়িত করবে?
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস :
রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যের আদি বাসিন্দা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরবে যখন থেকে ইসলামের আবির্ভাব হয়, তখন থেকে চট্টগ্রামের ন্যায় এখানেও ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে (থিসিস পৃঃ ৪০৩)। অনেকে সূফীদের কথা বলেন। কিন্তু এটা ভুল। কেননা ইসলামের প্রাথমিক ও স্বর্ণযুগে কথিত সূফীবাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের বহু পরে তিববত হয়ে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ ঘটে। অতঃপর আরাকান হ’ল টেকনাফের পূর্বে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১০০ মাইল দীর্ঘ নাফ নদীর পূর্ব পাড়ে ৭২ মাইল দীর্ঘ দুর্লংঘ্য ও সুউচ্চ ইয়োমা (Yoma) পর্বতমালা বেষ্টিত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রায় ১৫ হাযার বর্গমাইল ব্যাপী একটি সমতল ভূমি। এটাকে প্রাচীন রাহমী (رهمي) রাজ্যভুক্ত এলাকা বলে ধারণা করা হয়। যাকে এখন ‘রামু’ বলা হয়। তৎকালীন রাহমী রাজা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য এক কলস আদা উপঢৌকন হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। যা তিনি ছাহাবীগণকে বণ্টন করে দেন (থিসিস, পৃঃ ৪২৫)। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, তখন থেকেই এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং স্থানীয় রাজাসহ সাধারণ অধিবাসীরা ইসলামকে সাদরে বরণ করেছে। জাহায ডুবির কারণেও বহু আরব এখানে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ে-শাদী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ইসলাম আগমনের বহু পরে ভারত থেকে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে বিতাড়িত হয়ে বৌদ্ধরা তাদের আদি বাসভূমি ভারত ছেড়ে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, তিববত, মিয়ানমার, চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে অভিবাসী হয়। ভারত এখন প্রায় বৌদ্ধশূন্য বলা চলে। অথচ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। মধ্যযুগে আরাকানের রাজধানীর নাম ছিল ম্রোহাং। সেটারই অপভ্রংশ হ’ল রোহাং বা রোসাঙ্গ এবং সেখানকার অধিবাসীরা হ’ল রোহিঙ্গা। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৫ খৃঃ পর্যন্ত সাড়ে তিনশ’ বছরের অধিক সময় আরাকানের রাজধানী ছিল রোসাঙ্গ। এখানকার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী মুসলমান। আর মুসলিমদের শতকরা ৯২ জন হ’ল রোহিঙ্গা। ১৪৩৪ থেকে ১৬৪৫ খৃঃ পর্যন্ত দু’শো বছরের অধিক কাল যাবৎ কলিমা শাহ, সুলতান শাহ, সিকান্দার শাহ, সলীম শাহ, হুসায়েন শাহ প্রমুখ ১৭ জন রাজা স্বাধীন আরাকান রাজ্য শাসন করেন। তাদের মুদ্রার এক পিঠে কালেমা ত্বাইয়িবা ও অন্য পিঠে রাজার নাম ও সাল ফারসীতে লেখা থাকত। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বাংলা ভাষার চরমোন্নতি সাধিত হয়। কবি আলাওল, দৌলত কাযী, মরদান শাহ প্রমুখ কবিগণ আরাকান রাজসভা অলংকৃত করেন। আজকে যেমন বাংলা ভাষার রাজধানী হ’ল ঢাকা, সেযুগে তেমনি বাংলা ভাষার রাজধানী ছিল রোসাঙ্গ। এক সময় আকিয়াবের চাউল বন্যা উপদ্রুত বাংলাদেশের খাদ্যাভাব মিটাতো। মগদস্যুদের দমনে শায়েস্তা খাঁকে তারাই সাহায্য করেছিল। যার ফলে মাত্র ৩৬ ঘণ্টায় তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম জয় করা ও মগমুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তাই রোহিঙ্গাদের নিকট বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের ঋণ অনেক বেশী। আজ তারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের নিকট আশ্রয়প্রার্থী। আমরা কি পারি না এই সুযোগে তাদের ঋণের কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে? প্রশ্ন জাগে, কোলকাতার বাঙ্গালীদের প্রতি সরকারের যতটা গলাগলি, আরাকানের বাঙ্গালীদের প্রতি তার বিপরীত কেন? তারা নির্যাতিত মুসলমান, সেজন্যেই কি?
রাজনৈতিক অবস্থান :
১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়ার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। তাছাড়া প্রাকৃতিক দিক দিয়ে দুর্গম ইয়োমা পর্বতমালা আরাকানকে বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সেকারণ নাফ নদীর তীরবর্তী টেকনাফ, বান্দরবন, কক্সবাজার ও সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানের সবচাইতে নিকটতম ও সুগম্য এলাকা। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন বৃটিশ ও ভারতীয় হিন্দু নেতারা কাশ্মীর, জুনাগড়, হায়দরাবাদ প্রভৃতি ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য সমূহের ন্যায় আরাকান রাজ্যকেও ১৯৩৭ সালে বার্মার সাথে জুড়ে দেয়। অথচ ধর্ম, ভাষা ও ভৌগলিক কারণে এটা বাংলাদেশেরই অংশ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে এখানে কাষ্মীরের ন্যায় স্থায়ীভাবে রক্ত ঝরানোর ব্যবস্থা করা হয়। দেখা গেল যে, ১৯৪২ সালের এক অন্ধকার রাতে ইয়োমা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে বর্মী শাসকদের উস্কানীতে নিরীহ আরাকানী মুসলমানদের উপর অতর্কিতে হামলা চালালো হিংস্র মগ দস্যুরা এবং মাসাধিককাল ব্যাপী হত্যাযজ্ঞে প্রায় এক লাখ মুসলমানকে তারা হত্যা করল। বিতাড়িত হ’ল কয়েক লাখ মুসলমান। এরপর ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী বৃটিশের কাছ থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হ’তে নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলে। তাদের জন্য বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ফলে তারা নিজ গৃহে পরবাসী হয়ে যায়। এইভাবে শত শত বছর ধরে মুসলিম ও বৌদ্ধ একত্রে বসবাসকারী নাগরিকদের স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকারে পরিণত করা হয়। বার্মিজ বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা আরাকানী বৌদ্ধ রাখাইনদের সাথে মিলে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করার মিশনে নেমে পড়ে। আদি ফিলিস্তীনীদের হটিয়ে যেমন সেখানে বাইরের ইহুদীদের এনে বসানো হচ্ছে, একইভাবে আদি রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে সেখানে রাখাইনদের এনে বসানো হচ্ছে। অথচ পৃথিবী নির্বিকার।
এক্ষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রধান দায়িত্ব হবে রোহিঙ্গাদের উপর বর্মী সন্ত্রাস বন্ধ করা এবং ১৯৪২ সালের পূর্বের ন্যায় তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা। অথবা তাদেরকে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। বাংলাদেশ আরাকানের নিকটতম প্রতিবেশী মুসলিম দেশ। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীন মুখে কুলুপ এটে মজা দেখছে। এমতাবস্থায় যদি আমরা এই মহা বিপদে তাদের সাহায্য করি, তাহ’লে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। বিশ্বসভায় আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এমনকি আগামী দিনে রোহিঙ্গারাই হতে পারে আমাদের ব্যবসায়িক সহযোগী ও পূর্বমুখী কূটনীতির সেফ গার্ড। অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যদি আমরা আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে পুনর্বাসন করে দিই, তাহ’লে বিগত দিনে তারা যেভাবে পাহাড়-জঙ্গল কেটে আরাকানকে সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করেছিল, সেভাবে তারা আমাদের পার্বত্য অঞ্চলকে আবাদ করে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া পার্বত্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এবং দেশের এক দশমাংশের বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন দমনে এরাই হতে পারে সরকারের শক্তিশালী হাতিয়ার।
আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, জাতিসংঘ সহ বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার জন্য। অথচ অত্যাচারীদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে না। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দাবাড়ুদের ইঙ্গিতেই মিয়ানমার সরকার এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে অবশ্যই ঈমানী শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে বিপন্ন ভাই-বোনদের পাশে। ইনশাআল্লাহ তাতে আল্লাহর গায়েবী মদদ নেমে আসবে বাংলাদেশে। ১৯৬০ সালে গবর্ণর যাকির হোসায়েনের দৃঢ় ভূমিকায় ভীত হয়ে অত্যাচারী জেনারেল নে উইন যেমন তার ঠেলে দেওয়া বিশ হাযার রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত্তকে ফিরিয়ে নিতে ও তাদের বাড়ীঘরে সম্মানজনক পুনর্বাসনে বাধ্য হয়েছিল, আজকে আমাদের সরকার তেমনি শক্ত ভূমিকা নিলে মিয়ানমার সরকার প্রমাদ গণতে বাধ্য হবে। তাই প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হিসাবে আমাদেরই দায়িত্ব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়া।
আগামী ১৫ই জুলাই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাঁর সামনে সর্বাগ্রে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কি হ’ল যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না? অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা প্রার্থনা করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই অত্যাচারী জনপদ হ’তে মুক্ত কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে অভিভাবক প্রদান কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে সাহায্যকারী প্রেরণ কর’ (নিসা ৪/৭৫)। আল্লাহর এই একান্ত আহবান অবিশ্বাসী-কাফের সুচি-সোনিয়া-হুজিনতাওদের প্রতি নয়, বরং এ আহবান ইসলামে বিশ্বাসী শেখ হাসিনাদের প্রতি। যাদের হাতে বর্তমানে আল্লাহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করেছেন। এক্ষণে যদি আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করি, তাহ’লে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাব। যে গযবের হাত থেকে ফেরাঊন-নমরূদরা বাঁচতে পারেনি। তাই শুধু আমরাই নই, বিশ্বের যে প্রান্তে যে মুসলমান বসবাস করছে, বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রনেতাগণ ও মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরগণ এবং অর্থ-সম্পদের অধিকারী দেশের ব্যবসায়ী ও ধনিকশ্রেণী ও মানবতাবাদী সকল মানুষকে সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানাই। সেই সাথে আমাদের সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের একান্ত আহবান, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করুন!
সকালে রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ নযর পড়ল শত শত কাকের সমস্বরে কা কা ডাকের প্রতি। দেখলাম নীচে পড়ে আছে একটা আহত কাক। ঠিকভাবে চলতে পারছে না। আমাদের একজন কাকটাকে ধরে উড়িয়ে দিল। অতঃপর কাকের দল সব চলে গেল। স্থানটি ফাঁকা হয়ে গেল। দেখলাম, কাকের মধ্যে পরস্পরে ভালবাসা ও মমত্ববোধ। সেই সাথে পারস্পরিক ঐক্য ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য। আমরা কি তাহ’লে কাকের চাইতেও অধম? ১৯৭৮ সালে নিজে গিয়েছি সাথীদের নিয়ে। শরণার্থী শিবিরে তাদের দুঃখ-কষ্টের সাথী হয়েছি। ১২ দিন বর্ষা-কাদায় ভিজে তাদের সেবা-শুশ্রুষা করেছি। ১৯৯২-য়ে সাথীদের পাঠিয়েছি। অথচ ২০১২-তে কিছুই করতে পারছি না। তাই নির্যাতিত রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের জন্য প্রাণ খুলে দো‘আ করছি, ‘হে আল্লাহ! তুমি যালেমকে পাকড়াও কর ও মযলূমকে সাহায্য কর- আমীন! (স.স.)।