ভূমিকা :

মানবতার মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে ইসলাম। যা পূর্ণাঙ্গ হয়েছে দেড় সহস্র বছর পূর্বে পবিত্র কুরআনের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার মাধ্যমে যে, اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيْناً ‘আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৩)

মুসলিম মাত্রেরই এই দৃঢ় বিশ্বাস অপরিহার্য যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত রিসালাতের দায়িত্বও তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। এই বিশ্বাসের কমবেশী হ’লে রাসূল (ছাঃ)-কে খেয়ানতকারী সাব্যস্ত করা হবে (নাঊযুবিল্লাহ)। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) করেননি, করতে বলেননি বা অনুমোদন প্রদান করেননি এমন কর্ম শরী‘আতে সংযোজিত হ’লে ধরে নেয়া হবে যে, রাসূল (ছাঃ) রিসালাতের এই অংশটি তাঁর উম্মাতকে না জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন। যার ফলে শত শত বছর পরে এসে এটি দ্বীন হিসাবে সমাজে চালু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, إِنَّ كُلَّ مَالَمْ يَكُنْ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ (ص) وَاَصْحَابِهِ دِيْنًا لَمْ يَكُنِ الْيَوْمَ دِيْنًا وَقَالَ مَنِ ابْتَدَعَ فِى الْاِسَلاَمِ بِدْعَةً فَرَاءَهَا حَسَنَةً فَقَدْ زَعَمَ اَنَّ مُحَمَّدًا (ص) قَدْ خَانَ الرِّسَالَهَ. ‘রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সময়ে যে সব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমান কালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না। যে ব্যক্তি ধর্মের নামে ইসলামে কোন নতুন প্রথা চালু করল, অতঃপর তাকে ভাল কাজ বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বলে রায় দিল, সে ধারণা করে নিল যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন’ (নাঊযুবিল্লাহ) (আবু বকর আল-জাযায়েরী, আন-ইনছাফ (কুয়েত : জমঈয়াতু এহইয়াইত তুরাছিল ইসলামী, তাবি), পৃঃ ৩২; গৃহীতঃ মাসিক আত-তাহরীক, মে’৯৯ সংখ্যা, পৃঃ ১৪)। মূলতঃ ইসলাম শাশ্বত দ্বীন। এর বিধানও অকাট্য। এই বিধান বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশ্বনবীর মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার জন্য নাযিলকৃত এক কল্যাণ বিধান। এখানে কমবেশী বা সংযোজন বিয়োজনের কোনই সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই করুণ। ইসলামকে যে যার মত ব্যবহার করে চলেছে। কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে, কখনো বা জাল-যঈফ হাদীছ ভিত্তিক আমল সমাজে চালু করে যার পর নাই বিশৃংখলা সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘পপুলার’ (Popular) ইসলামের ভিড়ে ‘পিওর’ (Pure) ইসলাম যেন বিদায় নিতে চলেছে। এমনি এক ক্রান্তি লগ্নে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাণী তথা ‘পিওর’ ইসলাম জাতিকে জানানোর দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করেছিল পাঠক নন্দিত গবেষণা পত্রিকা মাসিক ‘আত-তাহরীক’ফালিল্লা-হিল হাম্দ। ইতিমধ্যে আত-তাহরীক তার আত্মপ্রকাশের ১৪টি বছর অতিক্রম করেছে। শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, অনেক সংকট ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে। দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বের বাংলাভাষী পাঠকদের মনেও স্থান করে নিয়েছে ‘আত-তাহরীক’। আলোচ্য নিবন্ধে আত-তাহরীক এর বিগত ইতিহাস নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক কিছু লেখার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

‘আত-তাহরীক’ শব্দের অর্থ :

اَلتَّحْرِيْكُ (আত-তাহরীক) শব্দটি বাবে تفعيل এর মাছদার। এর আভিধানিক অর্থ- বিশেষ আন্দোলন। ইংরেজীতে যাকে বলা হয় The Movement অথবা That very Movement.

নামকরণের স্বার্থকতা :

যেকোন সংস্কারের জন্য প্রয়োজন আন্দোলন। আন্দোলন ব্যতীত কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা হওয়া কল্পনাতীত। শিরক-বিদ‘আতে নিমজ্জিত দিকভ্রান্ত মানবতাকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর পথে পরিচালনার জন্য তাই সর্বব্যাপী এক আন্দোলন প্রয়োজন ছিল। যে আন্দোলন হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গড়ার আন্দোলন, যে আন্দোলন হবে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-ভিত্তিক সমাজ গঠনের আন্দোলন, যে আন্দোলন হবে বিশ্ব মানবতার মুক্তি আন্দোলন। যে মানুষ নিজের জ্ঞানকে অহি-র জ্ঞানের সামনে বিনা দ্বিধায় সমর্পণ করে দিবে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত নির্দেশকে সানন্দে মাথা পেতে নিবে, দুনিয়ার চাইতে আখেরাতকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিবে ‘আত-তাহরীক’ মূলত তাদেরই মুখপত্র। আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলার ঘুমন্ত চেতনাগুলি আন্দোলিত করার লক্ষ্যে ‘আত-তাহরীক’-এর আত্মপ্রকাশ। ‘আত-তাহরীক’ তাই সর্বব্যাপী এক আন্দোলনের নাম। যে আন্দোলনের তীব্র ঝংকারে শিরক-বিদ‘আত সহ যাবতীয় কুসংস্কার সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নিবে। ‘আত-তাহরীক’ নামকরণের স্বার্থকতা এখানেই।

আত-তাহরীক প্রকাশের উদ্দেশ্য :

দেশে অসংখ্য ইসলামী পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও ‘আত-তাহরীক’ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা কি ছিল? এই প্রশ্নের জবাব মিলবে দেশে অসংখ্য ইসলামী দল থাকতে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নামে পৃথক সংগঠন করার প্রয়োজনীয়তার দিকে তাকালে। অসংখ্য সংগঠনের মাঝে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর যেমন প্রয়োজন, অসংখ্য পত্রিকার ভিড়ে ‘আত-তাহরীক’-এর তেমনি প্রয়োজন। শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অহী-র রাজপথের সন্ধান দানের নিমিত্তে জন্ম লাভ করেছে আত-তাহরীক। কেননা রাসূলুল্লাহ এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী জান্নাতী দল হবে মাত্র একটি। যার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বললেন, مَا اَنَا عَلَيْهِ وَاَصْحَابِيْ ‘আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যে পথের উপর আছি’ (কেবলমাত্র তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে)। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) এবং ছাহাবীগণের সনিষ্ট অনুসারীরাই কেবল জান্নাতে দাখিল হবে। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ أَبَى؟ قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى- ‘আমার সকল উম্মাতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ‘অসম্মত’। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘অসম্মত’ কারা হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! জবাবে তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা আমার অবাধ্যতা করবে তারাই হ’ল ‘অসম্মত’ (বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩)

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হ’লেও সত্য যে, বর্তমান সমাজে এই অবাধ্য শ্রেণীর সংখ্যাই বেশী। নবী প্রেমের মুখরোচক শ্লোগান আর মিছিলে মিছিলে মহানগরী মাত করে দিলেও তাদের অন্তর আসলে ফাঁকা। রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মানতে এরা রাযী নয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ছালাতের ক্ষেত্রেও ছহীহ হাদীছ মেনে বুকে হাত বাঁধা, রাফঊল ইয়াদায়েন, আমীন সরবে বলতে সম্মত নয়। বরং জাহেলী আরবের মত বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে এরা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকতে চায়। বাজারে যেসকল ইসলামী পত্রিকা আছে তার সবক’টিই প্রায় একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এরা ‘পিওর’ ইসলাম জাতির সামনে তুলে ধরে না। অথবা তুলে ধরার সাহস রাখে না। এমত পরিস্থিতিতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বক্তব্য নির্দ্বিধায় ও বলিষ্ঠভাবে জাতির সামনে তুলে ধরার হিম্মত ও অঙ্গীকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে মাসিক ‘আত-তাহরীকফালিল্লা-হিল হাম্দ

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর আত-তাহরীক :

১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশের পর হ’তে অদ্যাবধি আত-তাহরীক তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে সম্মুখ পানে এগিয়ে চলেছে। নিম্নে আত-তাহরীক -এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হ’ল।-

(ক) রেফারেন্সভিত্তিক লেখনী : আত-তাহরীক-এর প্রতিটি লেখা হয় পূর্ণ রেফারেন্স ভিত্তিক। যাতে যে কেউ যেকোন তথ্য যাচাই করতে পারে। সেই সাথে কুরআনের আয়াতেও সূরার নম্বর এবং হাদীছের ক্ষেত্রে পূর্ণ রেফারেন্স সহ হাদীছটির অবস্থা অর্থাৎ ছহীহ, হাসান ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। কোন অবস্থাতেই জাল ও যঈফ হাদীছ থেকে দলীল পেশ করা হয় না। কখনো অসাবধানতা বশতঃ কোন মওযূ বা যঈফ হাদীছ প্রকাশ হয়ে গেলে, জানার পর পরবর্তী সংখ্যায় এর সংশোধনী দেয়া হয়। যাতে পাঠক সাধারণ বিভ্রান্তিতে না পড়েন বা ভুল আমল করে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। রেফারেন্সের ত্রুটির কারণে অনেক লেখা প্রকাশের অনুপযোগী হয়ে যায়। সেকারণ অনেক নামী-দামী লেখককে আমরা বলতে শুনেছি যে, ‘আত-তাহরীকে লেখার যোগ্যতা আমাদের নেই’।

(খ) গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিভাগের সমাহার : আত-তাহরীক-এর নিয়মিত কিছু বিভাগ, যেগুলো পত্রিকাটির গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যেমন দরসে কুরআন, দরসে হাদীছ, নবীদের কাহিনী, ছাহাবা চরিত, মনীষী চরিত, সাময়িক প্রসঙ্গ, মহিলাদের পাতা, অর্থনীতির পাতা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এছাড়াও ছোটদের জন্য এতে রয়েছে সোনামণিদের পাতা, হাদীছের গল্প ও গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান। আছে দলীলভিত্তিক ৪০টি প্রশ্নের উত্তর। স্বদেশ-বিদেশ ও মুসলিম জাহানের গুরুত্বপূর্ণ খবর, কবিতা, ক্ষেত-খামার, চিকিৎসা জগতও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এক কথায় সর্বমহলের পাঠকের জন্য আত-তাহরীক এক অনন্য গবেষণা পত্রিকা।

(গ) সময়োপযোগী বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় : সম্পাদকীয় হচ্ছে একটি পত্রিকার হৃৎপিন্ড। সম্পাদকীয় পাঠেই জানা যায় সে পত্রিকার নীতি-আদর্শ। জানা যায় পত্রিকাটির মান ও বলিষ্ঠতা। আত-তাহরীক-এর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। সম্মানিত পাঠকগণই বিচার করবেন এক্ষেত্রে আত-তাহরীকের ভূমিকা সম্পর্কে। দ্বীনী বিষয় সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আত-তাহরীক নির্দ্বিধায় তার বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরে থাকে। এ বিষয়ে নিন্দুকের নিন্দাবাদকে বা কোন সমালোচকের সমালোচনাকে অথবা সম্ভাব্য কোন বিপদকে সে কখনোই তোয়াক্কা করেনি। এমনকি আদর্শিক কোন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আপোষে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আত-তাহরীক দ্বিধাহীনভাবে সঠিক বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরে। আহলেহাদীছ আন্দোলনকে আদর্শচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আত-তাহরীক-এর আপোষহীন বলিষ্ঠ ভূমিকাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(ঘ) কুরআন ও হাদীছ ভিত্তিক ফৎওয়া প্রদান : মানুষের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, দ্বীনী বিষয়ে ফৎওয়া দানের জন্য হেদায়া, শরহে বেকায়া, কুদূরী, আলমগীরী ইত্যাদি ফৎওয়ার কিতাবগুলি অপরিহার্য। ফৎওয়ার কিতাব ছাড়া ফৎওয়া দান একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আত-তাহরীক প্রমাণ করেছে যে, ফৎওয়ার কিতাব নয়, বরং ফৎওয়া দানের জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে একজন বিদগ্ধ পাঠকের মন্তব্য ছিল, ‘ফৎওয়ার কিতাব ব্যতীত শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীছ থেকে ফৎওয়া দেওয়া যায় তা আমাদের জানা ছিল না। আত-তাহরীক এক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব সৃষ্টি করেছে’। অনেক সময় পাঠকরা দেশের অন্যান্য ইসলামী পত্রিকায় প্রকাশিত ভুল ফৎওয়া উল্লেখ করে আত-তাহরীকে প্রশ্ন পাঠিয়ে থাকেন। যার জওয়াব আত-তাহরীকে দলীল ভিত্তিক প্রকাশিত হয়। ফলে ব্যক্তি ভুল আমল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। কেননা আমল যত সুন্দরই হৌক না কেন তা যদি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক না হয় তাহ’লে তা নিষ্ফল হবে। ক্বিয়ামতের দিন শূন্য হাতে উত্থিত হ’তে হবে (কাহফ ১০৩-১০৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যাতে আমার নির্দেশ নেই তা বাতিল’ (মুসলিম হা/১৭১৮)

সেকারণ মাসিক আত-তাহরীক মানুষকে আল্লাহর গ্রহণযোগ্য আমলের সন্ধান দেয়। মনগড়া সব আমলের বিপরীতে ছহীহ হাদীছভিত্তিক আমল অকপটে জানিয়ে দেয়।

(ঙ) ভুল সংশোধনী : আত-তাহরীক-এর আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, ফৎওয়া বা যেকোন লেখায় অসাবধানতা বশত কোন ভুল হয়ে গেলে পরবর্তী সংখ্যায় এর সংশোধনী প্রকাশ করা। তাহরীক কখনো নিজের সিদ্ধান্তের উপরে যিদ করে না। বরং দলীলের কাছে মাথা নত করে।

(চ) কাউকে কটাক্ষ না করা : মাসিক আত-তাহরীকের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে কাউকে কটাক্ষ করে কিছু না লেখা। কারো বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য মূলকভাবে কিছু বলা আত-তাহরীকের লক্ষ্য নয়। বরং নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য। আর হক কথা সকলের নিকট পসন্দনীয় হয় না এটাই স্বাভাবিক। সেকারণ কেউ কেউ আত-তাহরীকের বিরুদ্ধাচরণেও প্রবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু তাতে ফল উল্টা হয়েছে। যেখানে আত-তাহরীক বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেখানেই দ্রুত এর গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি কোন কোন মাদরাসার খবর আমাদের জানা আছে, যেখানে আত-তাহরীক গেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তাহরীক পড়লে ছাত্রদের শায়েস্তা করার চূড়ান্ত হুমকি দেওয়া হয়, এতদসত্ত্বেও ছাত্ররা গোপনে এমনকি স্ব স্ব কিতাবের মলাটের ভিতরে লুকিয়ে রেখে আত-তাহরীক পাঠ করেছে।

(ছ) লেখক ও গবেষক সৃষ্টিতে আত-তাহরীক-এর ভূমিকা : আত-তাহরীক কেবলমাত্র পাঠকদের জন্যই উপকারী পত্রিকা নয়। বরং এটি নতুন নতুন লেখক সৃষ্টিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে আত-তাহরীক শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে আসছে। যারা এক সময় লিখতে জানতেন না আত-তাহরীক-এর বদৌলতে তারা এখন ভাল লেখক হয়েছেন। যারা গবেষণা কি তা বুঝতেন না, তারা এখন ভাল গবেষক হয়েছেন। যারা বক্তৃতা দিতে পারতেন না, তারাও এখন আত-তাহরীক-এর অবদানে বেশ ভাল বক্তা হয়েছেন। অতএব আত-তাহরীক এর অবদান অনস্বীকার্য।

(জ) ওয়েবসাইটে আত-তাহরীক : আত-তাহরীক তার হক দাওয়াত সর্বমহলে পৌঁছানোর নিমিত্তে আধুনিক প্রচার মাধ্যম থেকে পিছিয়ে নেই। ৮ম বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর’০৪ থেকে আত-তাহরীক তার নিজস্ব ওয়েবসাইট চালু করেছে। যার ঠিকানা www.at-tahreek.com. এর মাধ্যমে পত্রিকা বের হবার সাথে সাথে বিশ্বের যেকোন স্থান থেকে যেকেউ পড়তে পারেন। সেই সাথে উক্ত ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় আত-তাহরীক-এর বিগত সংখ্যা, ছালাতুর রাসূল, নবীদের কাহিনী সহ ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বই, আমীরে জামা‘আত সহ অন্যান্য বক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য এবং আমীরে জামা‘আতের ধারাবাহিক জুম‘আর খুৎবা সমূহ।

(ঝ) স্বতন্ত্র বানান রীতি : বাংলা ভাষা মূলতঃ কয়েকটি ভাষার সমন্বয়। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত অনেক বাংলা শব্দ আরবী, উর্দূ ও ফারসী ভাষা থেকে গৃহীত। সেকারণ আত-তাহরীক মূল আরবী, উর্দূ বা ফারসী বর্ণমালার সাথে মিল রেখে এবং ধ্বনি তত্ত্বের দিকে খেয়াল রেখে স্বতন্ত্র বানান রীতি অনুসরণ করে চলে, যাতে বাংলা ভাষার ইসলামী স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ থাকে। সাথে সাথে ঢাকার বাংলা যাতে নিজস্ব ঐতিহ্যে দীপ্যমান থাকে এবং অন্যের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে, সেদিকেও আত-তাহরীক সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে চলে।

আত-তাহরীক-এর প্রথম দিনগুলো :

(ক) প্রকাশের ধারাবাহিকতা : আজ থেকে সাড়ে ১৪ বৎসর পূর্বে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক শুভ ক্ষণে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুখপত্র হিসাবে মাসিক আত-তাহরীক-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম সংখ্যা দুই হাযার কপি ছাপা হয়। সে সময় রাজশাহীতে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর দ্বি-বার্ষিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কর্মীদের ব্যাপক চাহিদার কারণে কর্মী সম্মেলনেই দুই হাযার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে উক্ত সংখ্যাটি আরও দুই হাযার কপি ছাপিয়ে পাঠকদের চাহিদা পূরণ করা হয়। এরপর থেকে চলতে থাকে আত-তাহরীকের অব্যাহত অগ্রযাত্রা। ৪০ পৃষ্ঠা এবং ৬টি বিভাগ নিয়ে আত-তাহরীক তার যাত্রা শুরু করেছিল। বিভাগ ৬টি ছিল- ১. দরসে কুরআন ২. দরসে হাদীছ ৩. প্রবন্ধ ৪. মহিলাদের পাতা ৫. কবিতা ও ৬. প্রশ্নোত্তর। এ সংখ্যায় মাত্র ৩টি প্রশ্নোত্তর স্থান পেয়েছিল।

প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর পাঠক মহলের ব্যাপক সাড়া এবং চাহিদা বিবেচনা করে ২য় সংখ্যায় ৬টির স্থলে ১৪টি বিভাগ, ৩টির স্থলে ১০টি প্রশ্নোত্তর এবং প্রথম সংখ্যার দ্বিগুণ অর্থাৎ চার হাযার কপি ছাপা হয়। অতঃপর ৩য় সংখ্যা নভেম্বর’৯৭ প্রকাশের পূর্বে ‘আত-তাহরীক’-এর সরকারী রেজিষ্ট্রেশন পাওয়া যায়। ফলে ৩য় সংখ্যা থেকে আরো এক ফরমা বৃদ্ধি করে ৪৮ পৃঃ এবং বিভাগ ১টি বৃদ্ধি করে ১৫টি করা হয়। এভাবে চলতে থাকে ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত। অতঃপর ১ম বর্ষ ৮ম সংখ্যা এপ্রিল’৯৮ থেকে আত-তাহরীকে আরেক দফা পরিবর্তন আসে। বৃদ্ধি করা হয় আরও ১টি ফরমা। অর্থাৎ ৪৮ থেকে পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৬ করা হয় এবং প্রশ্নোত্তর ৫টি বৃদ্ধি করে ১৫টি করা হয়। পরবর্তীতে পাঠকদের চাহিদার কারণে প্রশ্নোত্তর সংখ্যা কয়েক দফা বাড়ানো হয়। ২য় বর্ষ ৯ম সংখ্যা জুন’৯৯ থেকে ২৫, ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর’৯৯ হ’তে ৩০, ৪র্থ বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর ২০০০ সংখ্যা হ’তে ৩৫ এবং ৬ষ্ঠ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জানু’০৩ হ’তে ৪০টি করে প্রশ্নোত্তর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। প্রথমদিকে আত-তাহরীকে এক রঙা প্রচ্ছদ ছাপা হ’ত। অতঃপর ৩য় বর্ষ ৪র্থ ও ৫ম সংখ্যা জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০০০ (যৌথ বিশেষ সংখ্যা) থেকে চার রঙ্গের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে আত-তাহরীক প্রকাশ হ’তে থাকে। সেই থেকে অদ্যাবধি পত্রিকাটি যথাসাধ্য তার অঙ্গসজ্জা বজায় রেখে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। বরং পূর্বের তুলনায় বর্তমানে আরও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে বের হচ্ছে। শুরু থেকে জুন’০৩ পর্যন্ত প্রচ্ছদে ‘তাওহীদ ট্রাস্ট (রেজিঃ)-এর সৌজন্যে নির্মিত দেশের বিভিন্ন এলাকার আহলেহাদীছ জামে মসজিদের ছবি এবং এর পর থেকে প্রতি সংখ্যাতে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা ও ঐতিহাসিক মসজিদ সমূহের ছবি স্থান পাচ্ছে। যাতে প্রতি সংখ্যায় একটি নতুন মসজিদের সাথে পাঠকদের পরিচিতি ঘটছে।

খ. আর্থিক দৈন্য : যেকোন পত্রিকার ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন হ’ল আয়ের একটি প্রধান খাত। শুধুমাত্র পত্রিকা বিক্রির আয় দিয়ে পত্রিকা চালানো দুঃসাধ্য। আত-তাহরীকের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি প্রকট আকারে দেখা দেয়। মাসিক পত্রিকায় কেউ বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। এতে সরকারী কাগজের কোটা বা সরকারী কোন বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। নতুন পত্রিকার কারণে বিজ্ঞাপনের স্বল্পতা, তার উপর বাছাইতে অধিকাংশ বিজ্ঞাপন অননুমোদিত হওয়ায় প্রথমদিকে প্রায় বিজ্ঞাপন শূন্য অবস্থায়ই পত্রিকা প্রকাশ হ’ত। উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞাপন হ’ল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রচার মাত্র। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই বা কোন দায়বদ্ধতাও নেই। কিন্তু আত-তাহরীকের পাঠকগণ এখানেও অত্যন্ত সজাগ। পান থেকে চুন খসলেই আত-তাহরীক পরিবারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছাড়ে। একবার একটি মিষ্টির দোকানের বিজ্ঞাপনে ‘জন্মদিনের কেক-এর অর্ডার নেওয়া হয়’ মর্মে প্রচার হওয়ায় বিজ্ঞ পাঠকগণ এর প্রতিবাদ করেন। এদিকে পত্রিকার অন্য কোন আয় না থাকায় রীতিমত আর্থিক দীনতার মধ্যেই আত-তাহরীকের প্রাথমিক দিকের বছরগুলি অতিক্রান্ত হয়।

গ. জনবল : আত-তাহরীক-এর প্রথম দিকের জনবল বলতে তেমন কিছুই ছিল না। বলতে গেলে মাননীয় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব একাই সবকিছু করতেন। সাথে আমি তাঁর সহযোগী হিসাবে এবং কম্পোজের জন্য একজন অপারেটর ও সার্কুলেশনের জন্য একজন সার্কুলেশন ম্যানেজার ছিল। উল্লেখ্য যে, আত-তাহরীক-এর ২য় সংখ্যা অক্টোবর’৯৭ থেকে (১৪ অক্টোবর’৯৭) আমি আত-তাহরীকে যোগদান করি। সে সময়ে বসার মত তেমন কোন জায়গা ছিল না। আমীরে জামা‘আতের বাসা সংলগ্ন কম্পিউটার রুমেই তাহরীকের কাজ হ’ত। ফ্লোরে বসে একটি ছোট ডেস্ক-এর উপর কাজ করতাম। আমীরে জামা‘আত দীর্ঘ সময় নিজে কম্পিউটারের সামনে বসে কারেকশন বলে দিতেন আর আমি সংশোধন করতাম। এভাবে দিন-রাতের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আত-তাহরীক বের হ’ত। প্রচন্ড কাজের ভিড়ে অনেক রাত বিনিদ্র কেটে যেত। কম্পিউটার টেবিলে বসে অনেক সময় তন্দ্রা আসলে আমীরে জামা‘আত কিছুসময় হেটে আসতে বলতেন এবং ঐ সময় তিনি নিজেই কুরআনের আয়াত ও হাদীছের হরকতগুলো কী বোর্ড চেপে চেপে আস্তে আস্তে দিতে থাকতেন। ঘুম তাড়িয়ে পুনরায় এসে কাজে বসতাম। এভাবেই প্রথমদিকে আত-তাহরীক প্রকাশ পেত।

বাধাসঙ্কুল পরিবেশের মোকাবেলায় আত-তাহরীক :

হক-এর পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং কন্টকাকীর্ণ। আত-তাহরীক তার প্রকাশনার শুরু থেকে নানা প্রতিকূলতা ও চক্রান্ত দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে এসেছে এবং সফলতা লাভে ধন্য হয়েছে। প্রকাশের পর থেকেই আত-তাহরীককে আমীরে জামা‘আতের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করতে থাকে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ একটি চক্র। বারবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর উঠে পড়ে লাগে আত-তাহরীকের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে উক্ত চক্রের দোসর যারা আত-তাহরীকের এজেন্ট ছিল তারা এক যোগে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং আত-তাহরীকের পাওনা টাকা আত্মসাৎ করে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিকভাবে আত-তাহরীক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আল্লাহ পাকের অপার অনুগ্রহে অল্পদিনের মধ্যেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। যেসকল এজেন্ট পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল, সেখানে নতুন এজেন্ট সৃষ্টি হয় এবং সাময়িক বিঘ্ন সৃষ্টি হ’লেও গ্রাহকরা পুনরায় পত্রিকা পেতে শুরু করে।

এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই পর্বত সম বিপদ নিয়ে হাযির হয় ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারীর কালো রাত। সবকিছুকেই যেন স্তব্ধ করে দেয় এই ঘোর অমানিশা। আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার, ইজতেমা বাতিল, চারিদিকে গ্রেফতার আতঙ্ক, পত্র-পত্রিকায় একচেটিয়া মিথ্যা রিপোর্ট আমাদেরকে যারপর নেই শঙ্কিত ও স্তম্ভিত করে দেয়। অবাক বিস্ময়ে সবকিছু অবলোকন করা ছাড়া আমাদের করার তেমন কিছুই ছিল না। আমরা যেন একেবারে মুষড়ে পড়েছিলাম। আমরা নির্বাক দৃষ্টিতে পত্রিকার পাতায় দেখলাম যে, রাজশাহীর সাংবাদিকরা বৈঠক করে ‘আত-তাহরীক’ বন্ধের জন্য রাজশাহী যেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। এছাড়াও এরা আত-তাহরীকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একাধিক মিথ্যা রিপোর্ট প্রকাশ করে আত-তাহরীক-এর প্রকাশনাকে চিরতরে স্তব্ধ করার অপচেষ্টা চালাতে থাকে। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় আমরা শঙ্কিত হ’লেও সাহস হারাইনি। উক্ত স্মারকলিপি প্রদানের একদিন পরেই আমরা কয়েকজন মাননীয় যেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। সাক্ষাৎ করে সাংবাদিকদের স্মারকলিপির কথা তুলে ধরে যখন সমাজ সংস্কারে এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত-তাহরীক-এর ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে লাগলাম, তখন যেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি শুনেছি সাংবাদিকরা একটি স্মারকলিপি দিয়েছে। যে কেউ যেকোন বিষয়ে স্মারকলিপি দিতে পারে। সেটা আপনাদের ভাববার বিষয় নয়। আপনারা আপনাদের কাজ করে যান। আমি নিজেও তো আত-তাহরীক পড়ি’। যেলা প্রশাসকের এই ইতিবাচক বক্তব্য ঐ চরম মুহূর্তে আমাদের জন্য ছিল বিশাল সান্ত্বনা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নওদাপাড়ায় ফিরে এলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় পত্রিকা বন্ধে সাংবাদিকদের চক্রান্ত ব্যর্থ হ’ল।

কিন্তু তারপরও চারিদিকে আতঙ্ক। আত-তাহরীক-এর সম্পাদক মন্ডলীর মাননীয় সভাপতি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব কারান্তরীণ। পাঠকরা আত-তাহরীক রাখতে ভয় পেতে লাগলো। না জানি আত-তাহরীক রাখার অপরাধে গ্রেফতার হ’তে হয় এই ভয়ে সে সময়ে অনেকে আত-তাহরীক রাখা বন্ধ করে দিল। এমনকি অনেকে বাসায় রক্ষিত পুরাতন তাহরীকগুলোও আগুনে পুড়িয়ে দিল অথবা স্থানান্তরিত করে হাফ ছেড়ে বাঁচল। শুধু পাঠকই নয়, লেখকদের ক্ষেত্রেও এমন নযীর রয়েছে। এমন দু’একজন লেখক আছেন, যারা তখন থেকে অদ্যাবধি আর আত-তাহরীকে লিখেননি। আল্লাহ তাদের হিম্মত ফিরিয়ে দিন- আমীন!

এই ধাক্কায় আত-তাহরীকের প্রচার সংখ্যা সাড়ে তের হাযার থেকে কমে আট হাযারে নেমে আসে। তবে আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে এক সংখ্যার জন্যও আত-তাহরীক বন্ধ হয়নি। ফালিল্লা-হিল হাম্দ

অতঃপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে থাকে। ১৬ মাস কারাভোগের পর আমীরে জামা‘আত ব্যতীত বাকী ৩ জন মুক্তি লাভ করেন। শুরু হ’ল আরেক ষড়যন্ত্র। এবার শুধু আত-তাহরীক নয়। বিগত ত্রিশ বৎসর যাবত তিলে তিলে গড়ে ওঠা সংগঠনকে একেবারে লক্ষ্যচ্যুত ও আদর্শচ্যুত করার ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের বীজ প্রোথিত ছিল অত্যন্ত গভীরে । ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। আমীরে জামা‘আতকে জেলখানায় রেখে তার নামে মিথ্যাচার করে কর্মীদের ভুলিয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনকে’ প্রচলিত শিরকী রাজনীতির নোংরা ড্রেনে নিক্ষেপের ষড়যন্ত্র। কিন্তু আত-তাহরীক-এর আপোষহীন ভূমিকার কারণে এখানেও চক্রান্তকারীরা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। তাদের জনসভার ও সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষণার বিপরীতে আত-তাহরীক তার আদর্শিক দৃঢ়তা বজায় রেখে অকপটে হক কথা জাতিকে জানিয়ে দেয়। ফলে নিজ গৃহেই এরা মুখ থুবড়ে পড়ে। আর এর ঝাল মিটায় সম্পাদককে দু’দুটি মিথ্যা শোকজ নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে। এমনকি শেষতক গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে। তারা চেয়েছিল যেকোন উপায়ে সম্পাদককে তাড়াতে পারলে আত-তাহরীক কব্জা করে তাদের কাংখিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। ফলে তাদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অপরদিকে আত-তাহরীক তার আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে বিজয় পতাকা উড্ডীন করে টিকে আছে ময়দানে আল্লাহর রহমতে।

বাতিলের ভিত কাপিয়ে দিয়েছে আত-তাহরীক :

‘সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, নিঃসন্দেহে মিথ্যা অপসৃয়মান’ (বণী ইসরাঈল ৮১)। হকের সিংহগর্জনে বাতিলের প্রাসাদ কেঁপে ওঠবে এটিই স্বাভাবিক। আত-তাহরীক বাতিলপন্থীদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। নির্দ্বিধায় হক কথা বলার কারণে জাতি সঠিক ইসলাম জানতে পারছে। ফলে দেশের সর্ববৃহৎ শিরকের আড্ডাখানা ফীরিদপুরের আটরশি, মাযারের নগরী চট্টগ্রাম ও সিলেটেও ঝংকার তুলেছে আত-তাহরীক। বিদ‘আতীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আত-তাহরীকের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেও ব্যর্থ হয়েছে। আটরশির দীর্ঘ ৫০ বৎসরের খাদেম ও তার সন্তান আহলেহাদীছ হয়ে গেছে। আটরশির একেবারে সন্নিকটে নিজেরা পৃথক আহলেহাদীছ জামে মসজিদ স্থাপন করেছে। সেখানে জুম‘আ সহ নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত মাইকে আযান সহ জামা‘আতের সাথে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আহলেহাদীছদের এই উত্থান দেখে এরা ভীত হয়ে পড়ে এবং নানাভাবে প্রতিরোধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। অবশেষে এরাই ব্যর্থ হয়। এরকম জানা-অজানা অসংখ্য ঘটনা আছে যা বিদ‘আতীদের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে আত-তাহরীক :

নানাবিধ বাধা-বিপত্তি ও চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আত-তাহরীক শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৪ বৎসর পূর্বে ২০০০ কপি দিয়ে শুরু হওয়া তাহরীক বর্তমানে সাড়ে ১৮ হাযার কপি প্রকাশিত হচ্ছে (ফেব্রুয়ারী’১২)। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের ১৩টি দেশে নিয়মিত আত-তাহরীক যাচ্ছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ইন্টারনেট পাঠকও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্র চার জন দিয়ে শুরু হওয়া আত-তাহরীক স্টাফ বর্তমানে ১৬ সদস্যের এক বড় পরিবার। সে অনুযায়ী বসবাসের জায়গাও হয়েছে পর্যাপ্ত। একাধিক কক্ষ সম্বলিত আত-তাহরীক অফিস বর্তমানে একটি জমজমাট অফিস। সেই সাথে যোগ হয়েছে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বই বিক্রয় বিভাগ’। সব মিলিয়ে একটি ব্যস্ততম অফিস হচ্ছে মাসিক আত-তাহরীক অফিস। দেশ-বিদেশের ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে আত-তাহরীক। প্রতিনিয়ত এর প্রচার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহার :

পরিশেষে বলব, দীর্ঘ সাড়ে চৌদ্দ বছরের ফসল আত-তাহরীক-এর বর্তমান অবস্থা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। হক ও বাতিল চিহ্নিত করণের ক্ষেত্রে আত-তাহরীকের ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের হৃদয়ে আত-তাহরীক এমনভাবে স্থান করে নিয়েছে যে, মাসআলাগত কোন সমস্যায় মানুষ দিনের পর দিন তাহরীক পানে চেয়ে থাকে অপলক নেত্রে। অবশেষে তাহরীকের সিদ্ধান্ত পেয়ে আপ্লুত মনে তা বাস্তবায়নে প্রবৃত্ত হয়। অতএব মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকটে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো নিবেদন তিনি যেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই দাওয়াত অব্যাহত রাখেন এবং এর কর্মকর্তা-কর্মচারী, লেখক-লেখিকা, পাঠক-পাঠিকা, গ্রাহক-এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতা সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জাযায়ে খায়ের দান করেন- আমীন!!






বিষয়সমূহ: সংগঠন
আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
এপ্রিল ফুল্স - আত-তাহরীক ডেস্ক
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৫ম কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
অতি ধনীর সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে কেন? - আলী রিয়ায, প্রফেসর, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
সম্মিলিত মুনাজাত কী ইজতিহাদী মাসআলা? - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইয়াতীম প্রতিপালন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরও
আরও
.