
হিন্দুদের স্বার্থে তাদের ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তির ন্যায় মুসলমানদের স্বার্থে তাদের ‘ওয়াক্বফ’ সম্পত্তিও ১৯৯৫ সাল থেকে কেবল মুসলিম স্বার্থেই ব্যয়িত হয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৫ই এপ্রিল নতুন ওয়াক্বফ বিল পাস করা হয়। যেখানে সে দেশে বসবাসকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু ২০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অধিকার লংঘিত হয়েছে। এটা করতে গিয়ে ভারত সরকার তাদের সংবিধানের ১৪, ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩০ অনুচ্ছেদ লংঘন করেছে। উক্ত ওয়াক্বফ সম্পত্তিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। এখন বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছে। যেখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে ৪টি পিটিশন জমা পড়েছে। বর্তমান ওয়াক্বফ বিলে দু’জন হিন্দু সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দু’জন নারী সদস্য, যিনি বিধবা বিবাহ বিচ্ছিন্ন বা অনাথ হবেন। মুসলমান সদস্য কেবল তিনি হ’তে পারবেন, যিনি ৫ বছর ইসলাম পালন করেছেন, ওয়াক্বফে দানের অধিকার কেবল তারই থাকবে। অথচ হিন্দুদের ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তিতে মুসলমান সদস্য থাকার কোন অধিকার নেই। মোদী সরকার কেন মুসলমানদের ওয়াক্বফ সম্পত্তি দখলে এতটা উন্মুখ? প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে সারা দেশে ওয়াক্বফ সম্পত্তির বিরাট তালিকার মধ্যে। রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর সবচেয়ে বেশী স্থাবর সম্পত্তির মালিক ভারতীয় ‘ওয়াক্বফ বোর্ড’। আনুমানিক ৯ লাখ ৪০ হাযার একর জায়গা জুড়ে ৮ লাখ ৭০ হাযার সম্পত্তি রয়েছে তাদের হাতে। মোদী সরকার এই বিপুল সম্পত্তির দখল ও পরিচালনার ভার নিজের হাতে নিতে চায়। কংগ্রেসের এক নেতার কথায় মোদীর বিজেপিতে ন্যায়বিচারের কোন অংশ নেই। তারা টোটাল কন্ট্রোলে বিশ্বাসী। সেই কন্ট্রোল পেতে মুসলিম সমাজকে বশ করা যরূরী। প্রয়োজনে ভয় দেখিয়েও। যেমন জীবন ও সম্পত্তি হানির ভয় দেখাচ্ছে উত্তর প্রদেশের হিন্দু সরকারের ‘বুল ডোজার’ নীতি। ধর্মস্থান আইনের তোয়াক্কা না করে দাবী উঠছে মসজিদ খোড়ার। দেখা হচ্ছে সেটার নীচে কোনকালে মন্দির ছিল কি না। তাদের অভিন্ন দেওয়ানী বিধির একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদের কোনঠাসা করা।
আসাম ও ঝাড়খন্ডে জিগির উঠেছে ‘ল্যান্ড জিহাদে’র। মুসলমানরা নাকি যবরদস্তি করে হিন্দুদের জমি লিখে নিচ্ছে। মুসলমানরা নাকি শিক্ষিত ও সংগঠিত হচ্ছে সরকারী দখল নিতে। ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের চরিত্র বদল ও দ্বিখন্ডিত করণের উদ্দেশ্যও হিন্দু আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার আকাংখা। নতুন ওয়াক্বফ আইন এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলেরই আরেক অধ্যায়। মুসলিম স্বার্থের ঘোর বিরোধী এই বিলটি সে দেশের উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই পাস হয়েছে। লোকসভার ভোটাভুটিতে ২৮৮-২৩২ ভোটে বিলটি পাস হয়। কেবল সংখ্যার জোরে এটি পাস করা হয়েছে। কারণ গণতন্ত্র যুক্তিতে চলে না, চলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে। শাসক দল সেই জোরেই এই চরম অনৈতিক ওয়াক্বফ বিলকে পাস করে নিয়েছে। অথচ একই জিনিস হিন্দু বা জৈন এন্ডাওমেন্ট বোর্ডে অথবা শিখদের গুরু দোয়ারা প্রবন্ধক কমিটিতে করা হচ্ছে না। ফলে গোটা পদক্ষেপটাই অসাংবিধানিক ও মুসলিম স্বার্থ বিরোধী। অথচ ভারতের মুসলিমদের জন্য এই ওয়াক্বফ সম্পত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মসজিদ-মাদ্রাসা-ইয়াতীমখানা বা কবরস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহাসিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ভারতে বহু ভবন ও জমি-জমা এতকাল আইনগতভাবে বৈধ ওয়াক্বফ সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। সেগুলো হয়তো শুধু মুখের কথায় (ওরাল ডিক্লারেশন) বা সামাজিক রীতি-নীতি মেনে দান করা হয়েছিল। যেহেতু সেগুলো বহুদিন ধরে মুসলিম সমাজ ব্যবহার করে আসছে, তাই তাদের ওয়াক্বফ হিসাবে স্বীকৃতি পেতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখন নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোন সম্পত্তিকে ওয়াক্বফ বলে দাবী করতে হ’লে সংশ্লিষ্ট ওয়াক্বফ বোর্ডকে তার স্বপক্ষে বৈধ নথিপত্র জমা দিতে হবে। তাই নতুন ওয়াক্বফ আইনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হ’ল কোনটাকে ওয়াক্বফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেওয়া। বিতর্কিত কেসগুলিতে বিশেষ করে সেই জমিটা যদি সরকারী মালিকানাধীন খাস জমি বলে দাবী থাকে, সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের উপরেই ন্যস্ত থাকবে। দ্বিতীয়ত নতুন আইনে অমুসলিম ব্যক্তিরাও ওয়াক্বফ বোর্ড ও ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হ’তে পারবেন। তৃতীয়ত এতদিন ওয়াক্বফ সম্পত্তি নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে ওয়াক্বফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু নতুন আইনে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। যার অর্থ যেকোন পক্ষ চাইলে আদালতের শরণাপন্ন হ’তে পারবেন। এছাড়া নতুন আইনে দেশের সব ওয়াক্বফ সম্পত্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধন সিস্টেম গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটি বলবৎ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে সব বিদ্যমান ওয়াক্বফ সম্পত্তিকে ঐ রেজিষ্টারে নথিভুক্ত করাতে হবে। নতুন করে কোন সম্পত্তিকে যদি ওয়াক্বফ হিসাবে নথিভুক্ত করাতে হয়, তাহ’লে সেটার জন্য আবেদনও এই সিস্টেমের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট ওয়াক্বফ বোর্ডের কাছে পেশ করতে হবে। কোন ওয়াক্বফ সম্পত্তির সার্ভে বা সমীক্ষা করানোর দরকার হ’লে তাতেও সরকারের ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী থাকবে। বস্ত্তত তারা এ ক্ষেত্রে ওয়াক্বফ বোর্ডের চেয়েও বেশী ক্ষমতাশালী হবে।
এভাবে নতুন ওয়াক্বফ আইনকে সংস্কারের নামে এমন একটি জটিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার চূড়ান্তভাবে লংঘন করেছে। উক্ত আইন পাশের ফলে বহু মসজিদ ও মাদ্রাসার জমি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বেদখল হয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আমরা এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং আইনটি পুনর্বিবেচনার জন্য ভারত সরকারের প্রতি দাবী জানাচ্ছি। সাথে সাথে সে দেশের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ অর্থাৎ ২০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় ঐতিহ্য, অধিকার, সংস্কৃতি ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার আহবান জানাচ্ছি। যাতে মুসলমানদের ওয়াক্বফকৃত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান ও ইয়াতীমখানাগুলি রাষ্ট্রীয়ভাবে দখলের পথ খুলে দেয়া না হয়। আল্লাহ মুসলমানদের হেফাযত করুন- আমীন! (স.স.)।