২০১৩ সাল থেকে স্কুল-কলেজে এবং ২০১৪ সাল থেকে আলিয়া মাদ্রাসাগুলির সিলেবাসে ডারউইনের নাস্তিক্যবাদী ‘বিবর্তনবাদ’ অনুসরণে মানুষকে বানরের পরিবর্তিত রূপ হিসাবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জনগণের আক্বীদা বিরোধী এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের পুরস্কার স্বরূপ ভারতের ‘ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস’ ২০১৭ সালের ২৩-২৪শে নভেম্বর মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত তাদের ষষ্ঠ বিশ্ব সম্মেলনে বাংলাদেশের তৎকালীন বামপন্থী শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকে ‘পরিবর্তনের অগ্রদূত’ আখ্যায়িত করে ‘World Education Congress Global Award for outstanding contribution to Education’ পদকে ভূষিত করে। এতেই বুঝা যায় যে, আমাদের দেশের শিক্ষামন্ত্রীরা কাদের উদ্দেশ্য হাছিলে কাজ করেন। দেশের আলেম-ওলামা, শিক্ষক-অভিভাবক সহ সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ উপেক্ষা করে দেশ স্বাধীন হওয়ার বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম সিলেবাস উপহার দিয়েছেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী।
ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক, নাস্তিক্যবাদী ডারউইন তত্ত্ব, নগ্ন ছবির ছড়াছড়ি, মুসলিম শাসকদের অবজ্ঞা, অন্যের লেখা চুরি, ভুল তথ্য পরিবেশন, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে অধিক গুরুত্ব প্রদান ইত্যাদিতে পূর্ণ বর্তমান সিলেবাসের নতুন বই সমূহ। যেমন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সমাজ’ বইয়ে বলা হয়েছে, বখতিয়ার খিলজী অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ও লাইব্রেরী ধ্বংস করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ ও সপ্তম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ ও ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিতুমীরের মুহাম্মাদী আন্দোলন, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়েযী আন্দোলন, বালাকোটের জিহাদ আন্দোলন, আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের খেলাফত আন্দোলন প্রভৃতি ভারত ও বাংলা ব্যাপী আন্দোলন সমূহের ভূমিকা বাদ দিয়ে সূর্যসেন, প্রীতিলতা, খুদিরাম, বাঘা যতিন প্রমুখদের স্থানিক ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হয়েছে। এসব বইয়ে বাংলাদেশের সুলতানী আমলের উজ্জ্বল শাসন ব্যবস্থাকে হীনভাবে দেখিয়ে তারা কীভাবে এদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল সেগুলি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বর্ণভেদে জর্জরিত হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও শোষণ এমনকি কুখ্যাত ইংরেজ শাসন ও শোষণের কথা যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়নি। রক্তচোষা জমিদারী প্রথাকে প্রকারান্তরে গুণগানই করা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী’ বইয়ের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল, আর সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ ডারউইন নিজেও তার এই তত্ত্বের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। যেমন তিনি স্বীয় পৌত্রকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যদিও এমন একটি ঘটনাও আমি প্রমাণ করতে পারব না, তথাপি আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি’। ফলে তখন থেকেই তাঁর বিবর্তন-অনুকল্প (Hypothesis) তথা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তর মতবাদটি বিজ্ঞানীদের নিকট সমালোচনার বস্ত্ত হয়ে দাঁড়ায়। ...মজার কথা হ’ল, এর প্রধান মৌলিক সমস্যাগুলি চিহ্নিত করেছেন খোদ ডারউইন নিজেই। ...ফলে ডারউইন তত্ত্বের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে’ (বিবর্তন তত্ত্ব ৩-৪ পৃ.; দ্র. লেখকের ‘বিবর্তনবাদ’ বই)।
অথচ পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম মুসলিম দেশের শিক্ষা সিলেবাসে ডারউইনের সেই মৃত মতবাদকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। আর এজন্য জাতির মেরুদন্ড ছাত্রসমাজকে ধ্বংস করার আত্মঘাতি পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। কে না জানে যে, আন্তর্জাতিক ইহূদী-খৃষ্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র কখনোই তাওহীদ-রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আপোষহীন স্বাধীন সত্তার বিপুল জনমানসকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা বরদাশত করে না। আর এজন্যই তো গত বছরের জুন মাসে দেশের শিক্ষা খাতে ৪২৩ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)’। আর বছর না যেতেই ২০২৩ সালের শিক্ষানীতিতে পড়েছে পশ্চিমাদের এই বিরাট অনুদানের কুপ্রভাব।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা’ এই ৯টি বিষয়ের মধ্যে নাস্তিক্যবাদী বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে নগ্ন নারী মূর্তি, তিন শতাধিক পর্দাহীন মেয়ের ছবি, মেয়েদের ফুটবল খেলা ও শারীরিক কসরত, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, খেলাধুলা, মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ দান, অশ্লীল ছবি প্রভৃতি ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। ‘ইংরেজী’ বইয়ে ১২টি কুকুর ও ১৪টি নেকড়ে বাঘের ছবি দেওয়া হয়েছে। যা ইউরোপীয় কুকুর সংস্কৃতিরই অংশ বিশেষ। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন, সমকামিতা ও লিঙ্গ পরিবর্তনের মত অস্বাভাবিক ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক হিসাবে কিশোর-কিশোরীদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েক ডজন মন্দিরের ছবি থাকলেও মসজিদের ছবি রয়েছে মাত্র ৩টি। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় মূর্তি ও মন্দির সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক থেকে টুপি, পায়জামা, হিজাব ও সালামকে বিদায় করা হয়েছে।
৯টি বইয়ে যে সব মানুষের নাম ব্যবহৃত হয়েছে একটি মুসলিম দেশে সেগুলি নিতান্তই আপত্তিকর। যেমন : অনিকা, মিনা, লিটল র্যাড, প্লাবন, রতন, মেধা, দীপক, স্কট, রুপা, নন্দিনী, এস্তি, মিসেল, মিতা, রন, শেলী, নিনা, জয়া, সুবর্ণা, রায়, মনিকা চাকমা, রিনা গোমেজ, রাতুল, রমা, রবিন, শিশির, ডেবিড, প্রিয়াঙ্কা, অরবিন্দু চাকমা, মন্দিরা, শিশু, মিলি, সুনীল, মিনু চিনুক ইত্যাদি।
সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু চুরি আর অনুবাদ করে ব্যবহার করার দায় স্বীকার করেছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হাসিনা খান (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ১৯শে জানুয়ারী ২০২৩)। বড় কথা হ’ল, ২০১৬ সাল থেকে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকদের যুক্তিসঙ্গত দাবি উপেক্ষা করে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার পাঠ্যপুস্তক ভারত থেকে ছাপিয়ে আনার উদ্দেশ্য কি?
‘সামাজিক প্রেক্ষাপটের বদল হলে ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা বদলায়’ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২ খৃ.; পায়রাবন্দ, রংপুর) ‘অবরোধবাসিনী’ বইয়ের কয়েকটি উদ্ভট গল্প পরিবেশন করা হয়েছে। যেমন (১) এক বাড়ীতে আগুন লেগেছিল। গৃহিণী বুদ্ধি করে সব গয়না একটি বাক্সে ভরে ঘর থেকে বের হ’লেন। কিন্তু দরজায় এসে দেখলেন, পুরুষেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। ফলে তিনি ঘরের মধ্যে ফিরে গিয়ে খাটের নীচে লুকালেন। এমতাবস্থায় তিনি আগুনে পুড়ে মরলেন। কিন্তু পুরুষ আছে বলে বাইরে বের হ’লেন না। (২) এক ভদ্র মহিলা বোরকা জড়িয়ে ট্রেন আর প্লাটফরমের মাঝখানে পড়ে গেলেন। লোকেরা তাকে উঠাতে গেলে তার গৃহপরিচারিকা বলল, খবরদার! বিবি ছাহেবার গায়ে হাত দিবেন না। আধা ঘন্টা চেষ্টা করেও পরিচারিকা তাকে উঠাতে পারল না। ফলে ট্রেন ছেড়ে দিল এবং ভদ্র মহিলা ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করল। (৩) মোটা কাপড়ের বোরকা পরা বিশ/পঁচিশ জন হজ্জ যাত্রী মহিলা কলকাতা স্টেশনে এলেন। কিন্তু স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসলে লোকেরা দেখবে, সেই ভয়ে প্লাটফরমে উপুড়মুখী করে বসিয়ে তাদেরকে ভারী শতরঞ্জি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হ’ল। সঙ্গে থাকা হাজী ছাহেব দূরে দাঁড়িয়ে তাদের পাহারা দিতে লাগলেন। এভাবে কয়েক ঘণ্টা থাকার পর ট্রেন আসার সময় হ’ল। রেলের একজন কর্মচারী হাজী ছাহেবকে তার আসবাব-পত্র সরিয়ে নিতে বললেন। হাজী ছাহেব বললেন, ওগুলি আসবাব-পত্র নয়, বাড়ীর মেয়েরা। কর্মচারীটি ব্যস্ত হয়ে পুনরায় আসবাব-পত্র সরাতে বলল ও বস্তা মনে করে তাতে লাথি মারল। কিন্তু ভিতরে থাকা মহিলারা লাথি খেয়েও টুঁ-শব্দটি করেনি। (৪) একবার এক লেডিস কনফারেন্সে বেগম রোকেয়া আলীগড় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, তিনি একবার বোরকা পরে এক বিয়ে বাড়ীতে গিয়েছিলেন। ছেলে-মেয়েরা তাকে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আরেকবার তিনি কলকাতায় এসে কয়েকজন বোরকা পরা মহিলা সহ একটি খোলা মোটরগাড়ীতে বের হয়েছিলেন। তখন কলকাতার ছেলেরা তাদের ভূত মনে করে ছুটে পালিয়েছিল’ (সপ্তম শ্রেণী, ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী’ বই ১২০-১২২ পৃ.)।
আমরা বলব, এগুলো যদি সত্যি সত্যি বেগম রোকেয়ার লেখনী হয়, তবে তা অবশ্যই বাতিলযোগ্য। কারণ বাংলাদেশী মুসলমানদের পারিবারিক ও সামাজিক চেহারা কখনোই এরূপ ছিল না এবং আজও নয়। সর্বোপরি এগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে নগ্ন হামলা। জানা আবশ্যক যে, আজকাল বহু প্রকাশক, সম্পাদক বা সম্পাদনা পরিষদের লোকেরা অনেক প্রাচীন লেখকের বই নিজেদের মত করে প্রকাশ করে থাকেন। যার প্রমাণ আমাদের সামনে আছে।
বেগম রোকেয়া নিজে বোরকা পরতেন এবং তিনি ইসলামের পর্দা বিধান মেনে চলতেন, তার প্রমাণ তার নিজের লেখনীতেই রয়েছে। যেমন তিনি লিখেছেন, (১) ‘আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে, আমাদের ‘জঘন্য অবরোধপ্রথা’ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়।... তাহলে জেলেনী, চামারিনী, ডুমিনী প্রভৃতি স্ত্রী লোকেরা কি আমাদের চাইতে অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে? (২) আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন সহ (বোরকা) মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। (৩)পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় নাই। এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব। এই অভাবটি পূরণ হইলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল-কলেজ হইলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চশিক্ষা লাভ হইতে পারে। (৪) কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। (৫) সভ্যতার সহিত অবরোধ প্রথার কোনই বিরোধ নাই (বোরকা, মতিচূর, ১ম খন্ড রোকেয়া রচনাবলী ৫৯-৬১ পৃ.)।
আমরা বর্তমান সিলেবাস অনতিবিলম্বে বাতিল করে বিগত কোন একটি ‘নাস্তিক্যবাদ’ বিহীন সিলেবাস পুনর্বহালের আবেদন জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)।