শামসুদ্দীন জুয়েল (২৫)। মৃত্যুর দিকে দ্রুত ধাবমান ডুবন্ত এক তরতাযা যুবক। চাঁদাবাজ পুলিশের তাড়া খেয়ে সচ্ছল ঘরের শিক্ষিত এই নিরপরাধ যুবকটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পড়ে যায় ড্রেনে। তার সাথী কিরণের পকেট থেকে পুলিশ পঞ্চাশ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তার পকেটে কিছু না পেয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। এতে ভয় পেয়ে সে দৌড় দেয়। অবশেষে নোংরা নর্দমার গভীরতায় সে ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকে। ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ বলে আর্তচীৎকার করতে থাকে সে। দু’হাত জোড় করে অনুরোধ করতে থাকে সে সকলের কাছে করুণ কণ্ঠে। উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘জনগণের বন্ধু’ পুলিশগুলি হো হো করে হাসতে থাকে জুয়েলের কাতর আর্তির জবাবে। এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যায়। মাতৃস্নেহে উদ্বেলিত জনৈকা মহিলা নিজের শাড়ী ঝুলিয়ে দেন, যেন তা ধরে ছেলেটা বাঁচতে পারে। কিন্তু না। কারু পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। ঐ পুলিশ নামধারী নিষ্ঠুর হায়েনাদের বাধার জন্য। অবশেষে... হ্যাঁ অবশেষে এক সময় বৃদ্ধ পিতা-মাতার নয়নের মণি, তাদের ভবিষ্যৎ রঙিন স্বপ্নের রূপকার, অতি আদরের কলিজার টুকরা সন্তান শামসুদ্দীন জুয়েল তলিয়ে গেল চিরদিনের মত ড্রেনের নোংরা পানিতে। হারিয়ে গেল চিরতরে সভ্য মানুষের গড়া এ পৃথিবী থেকে। রেখে গেল একরাশ প্রশ্ন : এই কি মানবতা, এই কি আইনের শাসন! ১৮ই নভেম্বর’৯৯ খবর বের হ’ল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। রাজধানীর মুগদাপাড়া এলাকার শোকার্ত সাধারণ মানুষ মিছিল করে তাদের আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। পুলিশের ফাঁসি দাবী করলো। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এর বেশী তাদের আর কি-ইবা করার আছে? যাদের করার ছিল, তারা অত্যন্ত সুচতুরভাবে পুলিশ তিনটাকে ক্লোজ করে নিয়ে জনগণের ক্ষোভ থেকে বাঁচিয়ে নিল। এরপর শুরু হয়েছে মিথ্যা ও প্রতারণার জাল ফেলা। দু’পাঁচ বছর পরে যখন বিচারের রায় বেরোবে, তখন হয়ত বলা হবে যে, ছেলেটি ছিল সন্ত্রাসী কিংবা অপ্রকৃতিস্থ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যথারীতি আইন প্রয়োগ করতে যাওয়ার কারণে সে প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে ড্রেনে ডুবে মরেছে। পুলিশের সেখানে কিছুই করার ছিল না। অতএব পুলিশ বেকসুর খালাস (!)
দেশের সর্বত্র প্রতিদিন এমনিভাবে চলছে চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষণ, অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মহোৎসব। পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে বেরিয়ে আসছে খুলনার ত্রাস এরশাদ শিকদারের লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের ঘটনাবলী। জীবন্ত মানুষকে হাত-পা বেঁধে ডোবায় পোষা রাক্ষুসী মাগুর মাছ দিয়ে খাইয়ে দেওয়া, বস্তায় ভরে ইট ঝুলিয়ে নদীতে ফেলে হত্যা করা এসবই ছিল তার নিয়মিত ঘটনা। ভৈরবের তলদেশ থেকে এখন বেরিয়ে আসছে তার নিষ্ঠুরতার মর্মান্তিক সাক্ষ্যসমূহ। ওদিকে তাকে ডিঙিয়ে শিরোনাম দখল করতে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এলাকার ত্রাস লাল্টু বাহিনীর পৈশাচিক হত্যাকান্ডের খবর সমূহ। জীবন্ত মানুষকে বস্তায় ভরে জ্বলন্ত ইট ভাটায় ছুঁড়ে ফেলে জাহান্নামের শাস্তির মহড়া দেখিয়ে সে ইতিমধ্যে নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অথচ খুলনার ন্যায় সেখানেও পুলিশের ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের হেফাযতেও খুন হচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত। এমনকি খোদ রাজধানীতে ডিবি হেড কোয়ার্টারে রুবেল হত্যা, জালাল হত্যা সচেতন মানুষকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে। যেগুলির কোন বিচার আজও হয়নি। কখনো হবে বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন না। খোদ সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রকাশ্য দিনের বেলায় শত শত মানুষের সামনে যুবক খুন হ’ল। অতঃপর সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে বুক ফুলিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেল। অথচ কিছুই হ’ল না। তাহ’লে মানুষ যাবে কোথায়? দেশে এই ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণ কি? বিচারক আছেন। বিচারালয় আছে। দল আছে, নেতা আছেন। নির্বাচন আছে, ভোটাভুটি আছে, গণতন্ত্র আছে। আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এর কারণ কি?
আমরা মনে করি যে, একটি মানবিক সমাজ গড়তে গেলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নৈতিকতার উজ্জীবন ও মানবতার অনুশীলন। প্রয়োজন নীতিবান ও আদর্শবান নেতৃত্ব। স্বাধীন ও সহজ বিচার ব্যবস্থা, আইনের সফল ও সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা। বলা চলে যে, বাংলাদেশে বর্তমানে উপরোক্ত গুলির কোনটিই পুরোপুরিভাবে নেই। নৈতিকতার উজ্জীবন নয় বরং অপনোদনের প্রতিযোগিতা সর্বত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নীতিবান ও আদর্শবান নয় বরং নীতিহীন ও আদর্শহীন নেতৃত্ব জাতির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে। দু’দিন আগেও যাকে স্বৈরাচার বলা হয়েছে, আজ আবার তাকেই বরণ করে নেওয়া হচ্ছে ফুলের তোড়া দিয়ে। সরকারে থাকলে স্বৈরাচার আর বিরোধী দলে থাকলে জনগণের বন্ধু- এটাই হ’ল এদেশের রাজনৈতিক কালচার। এদেশের বিচার বিভাগ প্রশাসন বিভাগ থেকে স্বাধীন নয়। এরপরেও রয়েছে বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রিতা। কথায় বলে Justice delayed, Justice denied. ‘বিলম্বিত বিচার এক প্রকার অবিচার’। ফলে সন্ত্রাসীরা লাই পেয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
অতঃপর নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা। সেটাও এদেশে নেই। কারণ এদেশে গণতন্ত্রের নামে চলছে দলতন্ত্র। যদিও সংবিধানে রয়েছে যে দলই ক্ষমতাসীন হৌক না কেন সরকার থাকবে নিরপেক্ষ। কিন্তু বাস্তবে সেটা নেই এবং তা সম্ভবও নয়। কেননা যিনি দলীয় প্রধান, তিনিই হবেন সরকার প্রধান। তাহ’লে কিভাবে তিনি নিরপেক্ষ হবেন? ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। দলীয় স্বৈরাচার, দলীয় শাসন-শোষণ ও অত্যাচারে দেশবাসীর নাভিশ্বাস উঠছে। মানবতা নিভৃতে কাঁদছে। শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য এরশাদ শিকদার, কাঙালী যাকির ও লাল্টু বাহিনী সৃষ্টি হচ্ছে। রুবেল, জুয়েল, জালাল, আহাদ, ডাঃ হুমায়ুন নিঃশব্দে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের বুকফাটা আর্তনাদ ও হৃদয় ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলছে। জানিনা কখন আল্লাহর ফায়ছালা নেমে আসবে। জিহাদী হুংকার দিয়ে গর্জে উঠবে মানবতা। ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যাবে বাতিলের তখত-তাঊস। স্বপ্নঘোর কেটে যাবে রঙিন সুরার নীল জৌলুসে হাবুডুবু খাওয়া রাঘব বোয়ালগুলোর।
এরি মধ্যে বছর ঘুরে এল রামাযান। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। স্বাগত জানাই তার উদাত্ত আহবানকে- ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী এগিয়ে চল! হে অকল্যাণের অভিসারী বিরত হও’।[1] রামাযানের রাত্রিতে আল্লাহর পক্ষ হ’তে এই অদৃশ্য আহবান ধ্বনি কি সন্ত্রাসীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে? তাদের জানা উচিত অন্যায় ও সন্ত্রাসের পতন অবশ্যম্ভাবী এবং ন্যায় ও সত্যের জয় সুনিশ্চিত। সত্যসেবী ও ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন। অতএব হে অকল্যাণের অভিসারীরা! রামাযানের এই পবিত্র মাসে এসো তওবা করি। নীরবে-নিভৃতে অনুতপ্ত হয়ে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা ভিক্ষা করি ও তাঁর দিকেই ফিরে চলি। পশুত্বের পতন হৌক। মানবতা জয়লাভ করুক! আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন![2]
[1]. তিরমিযী হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৪২; মিশকাত হা/১৯৬০।