নুযূলে কুরআনের অল্পদিন
পর আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের উদ্দেশ্যে নাযিল করেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও
যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। বস্ত্ততঃ তোমরা নিজেদের জন্য
যতটুকু সৎকর্ম অগ্রিম পাঠাবে, তোমরা তা আল্লাহর নিকটে পাবে। সেটাই হ’ল
উত্তম ও মহান পুরস্কার। আর তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়
আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। অতঃপর নুযূলে
কুরআনের শেষ দিকে তিনি বলেন, ‘কোন্ সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে,
অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী দিবেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহই রূযী
সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)।
মানুষ ঋণ পরিশোধ নাও করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ কেবল ঋণ পরিশোধ করেন না,
বরং আরও বেশী বেশী প্রদান করেন। মুমিনের দৈহিক ইবাদত ও আর্থিক ইবাদত সমূহ
যদি রিয়া ও শ্রুতিমুক্ত হয় এবং স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহ’লে
কেবল সেগুলিই ‘করযে হাসান’ বা উত্তম ঋণ হিসাবে আল্লাহ গ্রহণ করেন। নুযূলে
কুরআনের প্রথম দিকে ও শেষ দিকে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের প্রতি তাকে উত্তম ঋণ
প্রদানের আহবান জানিয়েছেন। তাছাড়া কুরআনের শুরুতেই মুত্তাক্বীদের ৬টি
গুণের ব্যাখ্যায় আল্লাহ বলেন, ‘যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে
এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে’... (বাক্বারাহ ৩)।
বস্ত্ততঃ বান্দাকে দেওয়া আল্লাহর সকল প্রকার নে‘মত তথা দৈহিক শক্তি,
রাজনৈতিক শক্তি, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা, বাকশক্তি, লেখনী শক্তি, আর্থিক
সক্ষমতা সবকিছুই আল্লাহর দেওয়া রিযিকের অন্তর্ভুক্ত। এসব অতুলনীয় রিযিক যদি
সংকল্পের সাথে আল্লাহর পথে ব্যয় হয়, তাহ’লে সেটি হবে আল্লাহকে দেওয়া উত্তম
ঋণ। ইসলামের খলীফাগণের অনেকে এবং বিগত বহু ধনশালী মুমিন এগুলির দৃষ্টান্ত
হয়ে আছেন। কারণ ধন-সম্পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষকে দ্রুত পথভ্রষ্ট করে।
অথচ এ দু’টি ক্ষমতা দিয়েই মানুষ সর্বাধিক ও দ্রুত পরকালীন পাথেয় সঞ্চয় করতে
পারে। সেদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং
নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সদাচরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ
সদাচরণকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ১৯৫)।
পৃথিবীর সর্বাধিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনেতা নবী সুলায়মান (আঃ) সৈন্যদল নিয়ে যাওয়ার পথে পিপীলিকা দলের নেতার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)। জিন-ইনসান, বায়ু ও পক্ষীকুল সবকিছুর উপরে তিনি একক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রনেতা ছিলেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর চাইতে অধিক শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রনেতা আর পৃথিবীতে আসবেন না (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)। অথচ ঐতিহাসিক বর্ণনামতে তিনি মাত্র ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। ১৩ বছর বয়সে রাজদন্ড হাতে নেন এবং ৪০ বছর রাজত্ব করেন (মাযহারী, কুরতুবী)। আল্লাহ বলেন, ‘যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের পাকড়াও করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর’ (নিসা ৪/৭৮)।
চীনের হুবেই প্রদেশের জনবহুল রাজধানী উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়। তার পর থেকে মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভাইরাসটি দ্রুত বিশ্বের ১৬৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ২৬.০৩.২০২০-এর মধ্যে আক্রান্তের দিক দিয়ে চীনকে ডিঙ্গিয়ে আমেরিকা প্রথম অবস্থানে চলে আসে। সেই সময় চীনের পর তৃতীয় স্থানে থাকা ইতালীর প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে হতাশ হয়ে বলেছিলেন, আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। এখন আমাদের কি করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশে’...। একই সময়ে ইতালীর বিশ্বখ্যাত কলোরেক্টাল সার্জন ডা. এন্টোনিও লঙ্গু তার এক বাংলাদেশী চিকিৎসক বন্ধুকে লেখেন, This virus teaches humanity that we are not the masters of the world. I hope we learn that we are animals like others and we live by the grace of god. In Bangladesh you have the advantage that many women protect by Burka. ‘এই ভাইরাস মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে যে, আমরা এই পৃথিবীর মালিক নই। আমি আশা করি, আমরা এটা শিক্ষা পেয়েছি যে, আমরা অন্যান্য প্রাণীদের মত একটি প্রাণী মাত্র এবং আমরা এখানে বসবাস করি আল্লাহর অনুগ্রহে। বাংলাদেশে আপনাদের জন্য একটি সুবিধা রয়েছে যে, সেখানে বহু মহিলা বোরকার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করে থাকে’ (২৪.০৩.২০২০ মঙ্গলবার)।
ইতালীর প্রধানমন্ত্রী বা ডা. লঙ্গু হতাশ হয়ে কিছু নিরেট সত্য কথা বলেছেন। তারা ইসলামের বিধান জানলে আরও নিশ্চিত হ’তেন যে, মুসলমান সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসাকারী এক কর্মোচ্ছ্বল জাতি। তাদের রাসূলের শিক্ষা হ’ল, ‘যখন তোমরা কোন স্থানে মহামারির কথা শুনবে, সেখানে যেয়ো না। আর মহামারি এসে পড়লে তুমি সেখান থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেয়ো না’ (বুখারী হা/৫৭২৯)। তিনি বলেন, ‘কারু ক্ষতি করোনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়োনা’ (ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০; ছহীহাহ হা/২৫০)। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন মুমিন সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘যে সবচেয়ে চরিত্রবান’। বলা হ’ল, কে সবচাইতে বিচক্ষণ? তিনি বললেন, ‘যে মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণকারী এবং তার পরবর্তী জীবনের জন্য সর্বাধিক সুন্দর প্রস্ত্ততি গ্রহণকারী। তারাই হ’ল বিচক্ষণ’ (ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯; ছহীহাহ হা/১৩৮৪)। তাই মুসলমান সর্বদা পরপারে যাত্রার জন্য প্রস্ত্তত থাকে এবং আল্লাহর দীদার লাভে উন্মূখ থাকে। ফলে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয়ে কর্মোচ্ছ্বল থাকে। কোন কিছুর ভয়, অলসতা বা কৃপণতা তাকে স্পর্শ করেনা। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কৃপণতা থেকে বাঁচল, সে সফলকাম হ’ল’। ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য সেটি বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন ও তোমাদের ক্ষমা করবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ গুণগ্রাহী ও সহনশীল’ (তাগাবুন ৬৪/১৬-১৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা জনৈক আনছার ব্যক্তির জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় তিনি বলেন, ‘তোমরা কবর আযাব হ’তে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও’।... অতঃপর তিনি মুসলিম ও অমুসলিম মৃতের অবস্থা বর্ণনা করেন এবং বলেন, মুমিন তিনটি প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিবে। অতঃপর আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দিবেন যে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও ও তার দিকে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও। অতঃপর সেটি খুলে দেওয়া হবে। ফলে তার দিকে জান্নাতের সুবাতাস ও সুগন্ধি আসতে থাকবে। আর ঐ দরজাটি তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রসারিত করা হবে’। পক্ষান্তরে অমুসলিম মৃত ব্যক্তি উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। ফলে আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দিয়ে বলবেন, সে মিথ্যা বলেছে। অতএব তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জাহান্নামের পোষাক পরিয়ে দাও এবং তার জন্য জাহান্নামের দিকের একটি দরজা খুলে দাও। অতঃপর সেখান থেকে প্রচন্ড গরম হাওয়া তার কবরে প্রবাহিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তার কবরকে তার উপর এমন সংকীর্ণ করা হবে যে, প্রচন্ড চাপে একদিকের পাঁজর অন্যদিকে প্রবেশ করবে। অতঃপর তার জন্য একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে লোহার বড় হাতুড়ি সহ নিযুক্ত করা হবে। যদি ঐ হাতুড়ি পাহাড়ের উপরে মারা হ’ত, তাহ’লে তা গুঁড়িয়ে মাটি হয়ে যেত। অতঃপর সে তাকে মারতে থাকবে। এসময় তার বিকট চিৎকার জিন ও ইনসান ব্যতীত পূর্ব ও পশ্চিমের সকল প্রাণীজগত শুনতে পাবে। অতঃপর সে মাটি হয়ে যাবে, আবার তাতে রূহ ফিরিয়ে আনা হবে’ (আবুদাঊদ হা/৪৭৫৩; মিশকাত হা/১৩১)।
অতঃপর মাইয়েতের সৎকর্ম ও দুষ্কর্ম সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিন বান্দার নিকট একজন লোক আসবে সুন্দর চেহারার, সুন্দর পোষাক পরিহিত ও উত্তম সুগন্ধিযুক্ত। সে বলবে, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর ঐ বিষয়ের, যা তোমাকে খুশী করবে। আজ সেই দিন, যেদিনের প্রতিশ্রুতি তোমাকে দেওয়া হয়েছিল। সে বলবে, তুমি কে? তোমার চেহারাটি এমন যা কেবল কল্যাণ বয়ে আনে। সে বলবে, আমি তোমার সৎকর্ম। তখন মুমিন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি পুনরুত্থান ঘটাও। যাতে আমি আমার পরিবার ও সম্পদের নিকট ফিরে যেতে পারি’। ‘অন্যদিকে অবিশ্বাসী কাফিরের নিকট একজন লোক আসবে কুৎসিত চেহারার, মন্দ পোষাকে ও দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায়। সে বলবে, ঐ বস্ত্তর সুসংবাদ গ্রহণ কর, যা তোমাকে মন্দ করেছে। আজ তোমার সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি তোমাকে দেওয়া হয়েছিল। তখন কাফের বলবে, তুমি কে? তোমার চেহারাটি এমন যা কেবল মন্দ বয়ে আনে। সে বলবে, আমি তোমার মন্দকর্ম। তখন কাফের বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি পুনরুত্থান ঘটিয়ো না’ (আহমাদ হা/১৮৫৫৭, সনদ ছহীহ)। তিনি আরও বলেন, ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে তার যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় বেড়ী পরানো হবে। সাপটি তার মুখের দুই চোয়াল চেপে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ধন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তেলাওয়াত করেন, ...‘আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে কিছু দান করেছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন এটাকে তাদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। যেসব মালে তারা কৃপণতা করে, সেগুলিকে ক্বিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী হিসাবে পরানো হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্বাধিকারী আল্লাহ। অতএব (গোপনে ও প্রকাশ্যে) তোমরা যা কিছু কর, সবই আল্লাহ খবর রাখেন (আলে ইমরান ৩/১৮০)’ (বুখারী হা/১৪০৩; মিশকাত হা/১৭৭৪)। বস্ত্ততঃ মুনাফিক ও কাফের সকলের জন্য এরূপ শাস্তি নির্ধারিত (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/১২৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘বান্দা যেটি দান করে, সেটিই তার সঞ্চয়। বাকী সবই চলে যায় এবং সে লোকদের জন্য ছেড়ে যায়’ (মুসলিম হা/২৯৫৯; মিশকাত হা/৫১৬৬)। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় ছাদাক্বা কবরের উত্তাপ নিভিয়ে দেয় এবং ক্বিয়ামতের দিন মুমিন তার ছাদাক্বার ছায়াতলে আশ্রয় পাবে’ (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৮৮; ছহীহাহ হা/৩৪৮৪)। অতএব মৃত্যুর পূর্বেই যাকে আল্লাহ যে রিযিক দান করেছেন, তা থেকে যথাসম্ভব ব্যয় করুন ও নিজের কবরের উত্তাপ নিভানোর চেষ্টা করুন! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।