পারমাণবিক শক্তিধর একমাত্র মুসলিম দেশ পাকিস্তান এখন সামরিক শাসনের অধীনে। প্রতিবেশী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতে যখন নতুন সরকারের অভিষেকের আয়োজন চলে, পাকিস্তানে তখন ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন কারগিল বিজয়ের পুরস্কার ঘরে তুলেন অর্থাৎ তৃতীয় বারের মত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন, ঠিক তার প্রাক্কালেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়ায শরীফের অপমানজনক পদচ্যুতি ঘটে। ১২ই অক্টোবর’৯৯ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল পারভেয মোশাররফকে আকস্মিকভাবে বরখাস্ত করার পর এই অভ্যুত্থান ঘটে। জানা গেছে, মাত্র দু’সপ্তাহ আগে নতুন মেয়াদে সেনাপ্রধান পদে নিযুক্তি দেয়ার পর বিনা কারণেই প্রধানমন্ত্রী নওয়ায শরীফ জেনারেল পারভেয মোশাররফকে বরখাস্ত করেছিলেন এবং একই পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন অন্য একজন বিশ্বস্ত জেনারেলকে। অভিযোগ রয়েছে যে, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর নওয়ায শরীফ সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে একনায়কসুলভ শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র আড়াই বছরের শাসনামলে তিনি একজন প্রেসিডেন্ট, একজন প্রধান বিচারপতি, দু’জন নৌবাহিনী প্রধান, সিন্ধুর সরকার এবং দু’জন সেনাবাহিনী প্রধানকে বরখাস্ত করেন। সর্বোপরি সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেয মোশাররফকে বরখাস্ত ও হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের সুযোগ তৈরী করে দেন। অতঃপর তিন দিন কার্যতঃ সরকারবিহীন চলার পর ১৫ই অক্টোবর শুক্রবার সারা দেশে যরূরী অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল পারভেয মোশাররফ প্রধান নির্বাহী হিসাবে দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সংবিধান ও পার্লামেন্ট স্থগিত করা হয়। তবে প্রেসিডেন্ট রফীক তারার স্বপদে বহাল থাকেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর বিগত ৫২ বছরের মধ্যে প্রায় ২৪ বছরই পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সামরিক শাসনের সূচনা করেন। ১৯৬৯ সালে প্রবল গণরোষে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন জেনারেল ইয়াহ্ইয়া খানের কাছে। অতঃপর স্বাধীনতার ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় আসেন যুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৭ সালে জেনারেল যিয়াউল হক ভুট্টোকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৮ সালে এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত না হওয়া পর্যন্ত যিয়াউল হক-এর সামরিক শাসন বহাল থাকে। এর আগে ১৯৮৫ সালে তিনি সামরিক শাসন তুলে নিলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয় নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অভিযাত্রা।
পাকিস্তানের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর ইতিহাস আরো জঘন্য, আরো কলংকিত। বিগত ১১ বছরে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ও আখের গোছানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। ক্ষমতাসীন দল মাত্রই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে। নির্বাচিত সাংবিধানিক সরকারগুলোর সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অসহনশীলতা প্রভৃতি কারণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। উক্ত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যখন বিরোধী দলে অবস্থান নিয়েছে, তখন ঐ দল আবার বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ চিত্র শুধু পাকিস্তানের নয়। বাংলাদেশ ও ভারত সহ তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহের প্রায় সবগুলোরই একই অবস্থা। নির্বাচনের পূর্বে ভাল মানুষী আচরণ এবং ক্ষমতাসীন হয়ে বিমাতাসুলভ আচরণ, বিরোধী মত ও প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, সর্বোপরি ক্ষমতা স্থায়ী করতে যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ আজকের বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহের জন্য রূঢ় বাস্তবতা।
এর কারণ হিসাবে বলা চলে যে, গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে জনগণের নামে স্বল্পসংখ্যক রাজনীতিকের হাতে। দলের নেতা উক্ত ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। ফলে তিনি একসময় অহংকারী হয়ে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হন। গণতন্ত্রে গুণ ও যোগ্যতার চেয়ে সংখ্যার গুরুত্ব বেশী। সেকারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও সরকার প্রধানের স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রতিরোধ করার কেউ থাকে না। পাকিস্তানের নওয়ায শরীফ দুই তৃতীয়াংশের অধিক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সামরিক সরকারের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়াটা আরও স্বাভাবিক ব্যাপার। এক্ষণে এ দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ আমাদের তালাশ করতে হবে। যেখানে সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে থাকবে না। থাকবে আল্লাহর হাতে। হালাল-হারাম ও ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি মানুষ নির্ণয় করবে না, করবেন আল্লাহ। কোন সিদ্ধান্ত এককভাবে নয়, হবে যোগ্য ও গুণীজনের পরামর্শভিত্তিক এবং তা হবে আল্লাহর আইনের অধীন। যেখানে সংখ্যা নয়, বরং মেধা ও যোগ্যতা হবে নেতৃত্বের মাপকাঠি। সেই শূরা পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থাই হ’ল ইসলামী সরকার ব্যবস্থা। আমরা সেই ইলাহী শাসন ব্যবস্থাই মনে-প্রাণে কামনা করি। নইলে বর্তমান বিশ্বের গণতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের মধ্যে চরিত্রগত কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!