
দেশের প্রতিরক্ষা খাত ও মাদরাসা শিক্ষা খাতে বাজেট হ্রাসের প্রস্তাব এসেছে এদেশেরই কিছু বুদ্ধিজীবী ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সরকারী পদক্ষেপ শুরু হয়েছে অনেক আগে খানিকটা অঘোষিতভাবেই। ১৯৯৭ সাল থেকে ২৫১টি মাদরাসার এমপিওভুক্তি বাতিল করা হয়েছে। আর এখন যোগ হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ হ্রাসের সুফারিশ। শোনা যাচ্ছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাগার কলিকাতা আলিয়া মাদরাসাটিও বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। ওদিকে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় কমানোর জন্য যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে, আমরা বিশ্বের ৪র্থ সমরশক্তির অধিকারী ভারতবেষ্টিত একটি ছোট্ট দুর্বল দেশ। ভারতের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করে টিকে থাকার প্রশ্নই ওঠেনা। অতএব সামরিক বা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি স্রেফ অপচয় ছাড়া কিছু নয়। যদি সেনাবাহিনী রাখতেই হয়, তাহলে ছোট আকারে রাখলেই চলে। যারা বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগকালীন সময়ে জাতির সেবা করবে’...। বিশ্বের অভুক্ত মানুষের অর্ধেকেরই বসবাস যে ভারতে, সেই দরিদ্রতম দেশটির নেতারা যখন নিজেদের জনগণকে অভুক্ত রেখে এবারের প্রতিরক্ষা বাজেট ২৮% বৃদ্ধি করেছে, তখন আমাদের নেতারা প্রতিরক্ষা বাজেট হ্রাসের চিন্তায় ব্যাকুল। চার্চিলের ভাষায় ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত থাকাই হ’ল শান্তিতে বসবাসের অন্যতম গ্যারান্টি’। ভারত বড় সমরশক্তি বলে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে তাদের করুণা ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হবে, এরূপ চিন্তা যারা করেন, তাদের জানা উচিত যে বদ্ধ ঘরে একটি বিড়ালকে আক্রমণ করলেও সে তীব্রভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে জয়ী হয়। ভারত তার চারপাশে শত্রুবেষ্টিত। পাকিস্তান, নেপাল, মহাচীন, মায়ানমার ছাড়াও তার ঘরেই রয়েছে কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত বোন রাজ্য সমূহে স্বাধীনতার তৎপরতা। এসবের জন্য সে সদা সন্ত্রস্ত। এরপরে আবার বাংলাদেশকে গ্রাস করার দুঃসাহস সে পাবে কোথায়? তবে হ্যাঁ, যদি আমাদের শক্তিশালী সামরিক অবকাঠামো না থাকে, তাহ’লে সে হায়দরাবাদ, জুনাগড়, মানভাদর ও সিকিম দখলের মত ভীতি সৃষ্টিকারী কূটনীতির মাধ্যমে যেকোন সময়ে বাংলাদেশকে গ্রাস করে নিতে পারে। বলা বাহুল্য এই পলিসিই সে শুরুতে নিয়েছিল যুক্তিযুদ্ধকালীন গোপন সাতদফা চুক্তির মাধ্যমে। তৎকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে গোপনে ২৫ বছরের এই গোলামী চুক্তি প্রণয়ন করেন। যাতে স্বাক্ষর দিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ চুক্তির ধারায় বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না। মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে। যারা আভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষা করবে। আর পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে চলবে। এই ধরনের অধীনতামূলক চুক্তির কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার প্রতিরক্ষা নীতি আজও গড়ে তুলতে পারেনি।
আমরা বলতে চাই যে, বাংলাদেশকে তার ভৌগলিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইনে থাকবে সুপ্রশিক্ষিত বিডিআর, আনছার, কোস্টগার্ড ইত্যাদি বাহিনী। তৃতীয়তঃ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্তদেরকে রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে তালিকাভুক্ত করে তাদের মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এরপরেও থাকবে ক্যাডেট, এনসিসি, জুডো-কারাতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং সর্বোপরি ঈমানী চেতনা বৃদ্ধি ও জিহাদী জাযবা সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে সদা সচেতন ও সুদক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে হামলা এলেই ব্যাপক জনযুদ্ধের মুখে শত্রু লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়। যেভাবে পালিয়েছে ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকা এবং আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তাই নিজ দেশের সীমান্ত রক্ষার সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিজয়ের কৌশলও অবলম্বন করতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হ’ল মাদরাসা শিক্ষার বাজেট হ্রাস প্রস্তাব। কিন্তু কারণ কি? এর প্রস্তাবক কারা? প্রস্তাবক হ’ল প্রশিকা, এডাব, সমন্বয় নামক চিহ্নিত কতগুলি এনজিও এবং ঐ অনুষ্ঠানে যোগদানকারী কয়েকজন সংসদ সদস্য। অর্থমন্ত্রীর কাছে তাদের একটি প্রতিনিধিদল গিয়ে নাকি সরাসরি প্রস্তাবও দিয়ে এসেছেন। শুধু এ সরকার নয়, বিগত সরকারের আমলেও আমরা এ ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। কেন জানি সরকারী লোকেরা মাদরাসা শিক্ষাকে ‘জাল’ বলতে আনন্দ পান। এটার মধ্য দিয়ে ১৯৩৬ সালে লর্ড মেকলের সেই বক্তব্যের বাস্তব প্রমাণ মেলে। যেখানে তিনি বলেছিলেন, We must at present do our best to form a class, who may be interpreters between us and millions, whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in openion, in morals and intellect. অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের সর্বাধিক চেষ্টা করতে হবে, যাতে এমন একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করা যায়, যারা আমাদের ও আমাদের লক্ষ লক্ষ প্রজার মধ্যে দূত হিসাবে কাজ করতে পারে। এরা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়। কিন্তু মেযাজে, মতামতে, নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃদ্ধিতে হবে ইংরেজ’। বৃটিশ মন্ত্রী গ্লাডস্টোন স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, So long as the Muslims have the Quran, We shall be unable to dominate them. We must either take it from them or make them lose their love at it. অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানেরা কুরআনকে অাঁকড়ে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে দমানো বা পরাভূত করা সম্ভব হবে না। তাই হয় তাদের থেকে কুরআনকে কেড়ে নিতে হবে, না হয় তাদের হৃদয় থেকে কুরআনের প্রতি ভালোবাসাকে মুছে দিতে হবে’।
মুসলমানের ঈমানী শক্তির মূল উৎস তারা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তাদের বশংবদ গোলাম বানানোর ও জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার জন্য ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা নামে তারা দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। যা আজও এদেশে চালু আছে। সেই সঙ্গে সমাজকল্যাণের নামে গরীব জনসাধারণকে ঋণের জালে আটকিয়ে ও ঋণদানের টোপ দিয়ে তাদেরকে খ্রিষ্টান বানানোর দূরদর্শী পরিকল্পনা বেশ সফলভাবেই এগিয়ে চলেছে। বলা আবশ্যক যে, মুসলমানের ঈমানী শক্তিকে উজ্জীবিত রাখার কেন্দ্র হ’ল মাদরাসা সমূহ। আর একারণেই ইসলাম বিরোধীদের টার্গেট হ’ল ‘মাদরাসা’। দেশের স্বাধীনতার গ্যারান্টি হ’ল ঈমানী শক্তি। আর সেই শক্তিকেন্দ্রকে ধ্বংস করার অর্থই হ’ল দেশের স্বাধীনতা যারা চায়না, তাদের হাতকে শক্তিশালী করা।
দেশের নেতাদের পিছনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কামাল পাশা যখন আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা নিয়ে বিব্রত, সেই অবস্থায় বৃটিশ নেতা লর্ড কার্জন প্রস্তাব করেন, ‘যদি তুরষ্ক নিজ হাতে ইসলামের সাথে তার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সমস্ত মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়, তবেই তারা আমাদের সাথে যথার্থভাবে একাত্ম হবে... এবং এরপরে তারা যা চায় তাই-ই পাবে’। মোস্তফা কামাল তাতেই সায় দিলেন। লর্ড কার্জন খুশীতে গদগদ হয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘আসল কথা হ’ল তুর্কীরা আর কোনদিনও তাদের আগের শক্তি ফিরে পাবে না। কেননা তাদেরকে আমরা ভিতর থেকে হত্যা করেছি’। যে ওছমানী খেলাফত (১৩০০-১৯২৪ খৃঃ) সোয়া ছয়শত বছর ক্ষমতায় থেকে ভিয়েনা পর্যন্ত দখল করে ইউরোপের অন্তঃস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল, সেই মহাশক্তিধর একটি শাসনশক্তিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষ দিয়ে চিরদিনের মত ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছিল ইংরেজরা কোনরূপ সামরিক শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই নামধারী মুসলিম নেতা মোস্তফা কামালের মাধ্যমে। এই ব্যক্তিকেই আবার উপাধি দেওয়া হ’ল ‘আতাতুর্ক’ বলে। যার অর্থ ‘তুর্কী জাতির পিতা’। অথচ তিনি ছিলেন তুর্কী খেলাফত ধ্বংসকারী ব্যক্তি। আমাদের সেই ফেলে আসা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।
পরিশেষে বলব, ভৌগলিক প্রতিরক্ষার জন্য যেমন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রয়োজন, জাতির ঈমানী চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য তেমনি প্রয়োজন উন্নত মাদরাসা শিক্ষার। সেই সাথে প্রয়োজন কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সমন্বিত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা। আল্লাহ আমাদের ঈমানী চেতনা ও ভৌগলিক স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখুন- আমীন![1]
[1]. ৩য় বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০০০।