বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু আত্মগর্বী, হিংসুক ও ঝগড়াটে ব্যক্তি সর্বত্র ‘আহলেহাদীছ’-এর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর দেখিয়ে তারা আহলেহাদীছকে পিষে মারতে চান। আহলেহাদীছকে ‘বাতিল’ আখ্যায়িত করে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে অশালীন ভাষায় লিখিত বিভিন্ন লিফলেট ও বই-পুস্তিকা তারা বাজারে ছড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আহলেহাদীছকে টার্গেট করে বক্তব্য রাখা হচ্ছে ও জনগণকে ক্রমেই তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে। কোন কোন স্থানে তাদের মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে মারপিট করা হচ্ছে এবং মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে। কেউ নতুন আহলেহাদীছ হ’লে তার বিরুদ্ধে রীতিমত অত্যাচার ও সমাজিক বয়কট শুরু করা হচ্ছে। এমনকি আহলেহাদীছ পাঠাগারে আগুন লাগিয়ে কুরআন-হাদীছ সহ কিতাবপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ শত শত লোক খ্রিষ্টান হয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য নেই। হাতে গণা কয়টি মাত্র ধর্মীয় বা ইসলামপন্থী পত্রিকার যেন বড় লক্ষ্য হয়েছে আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা। আজকাল অনুরূপ একটি মাসিকের পক্ষ থেকে ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে দেওয়াল লিখন দেখা যাচ্ছে। যেখানে তাদের মতানুযায়ী ফৎওয়া সমূহ লিখে তারা প্রচার করছেন বহু অর্থ ব্যয় করে। যার অধিকাংশ বক্তব্য কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্পষ্ট বিরোধী। তাদের এইসব দেওয়াল লিখন পড়ে বহু লোক যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছে, তেমনি আপোষে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমরা অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এসব করে কেবল কিছু মানুষকে সাময়িকভাবে ‘হক’ থেকে দূরে রাখা যাবে, কিন্তু হক-এর দাওয়াতকে স্তব্ধ করা যাবে না। আল্লাহর পসন্দনীয় কোন না কোন বান্দার মাধ্যমে হক যাহির হয়ে যাবেই এবং তা কবুল করার জন্য তাঁরই নির্বাচিত বান্দারা ছুটে আসবেন চুম্বকের মত। কম থাক বেশী থাক ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ দল থাকবেই। নিন্দুকদের নিন্দাবাদকে তারা পরোয়া করবে না। ‘তারা সর্বদা হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে...’।[1] হাদীছে বিজয়ী বলতে আখেরাতে বিজয়ী বুঝানো হয়েছে। নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা (আঃ) কেউই দুনিয়াবী দিক দিয়ে বিজয়ী ছিলেন না। তথাপি তাঁরাই ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী, হকপন্থী ও মানবতার আদর্শ পুরুষ।

উক্ত হকপন্থী ও মুক্তিপ্রাপ্ত দল কারা? এর জবাবে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী (রহঃ) বলেন, তারা হ’ল ‘আহলুল হাদীছ জামা‘আত’। চার ইমামের অন্যতম ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, ‘তারা যদি আহলুল হাদীছ না হয়, তাহ’লে আমি জানিনা তারা কারা’? ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘আহলুলহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’। ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ‘নাজী’ দল হিসাবে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বর্ণনা দেওয়ার পর বলেন, ‘তাদের কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’। অতঃপর তিনি বলেন, বিদ‘আতীদের লক্ষণ হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে সম্বোধন করা। এগুলো সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় যিদ ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়’। ইবনু হাযম আন্দালুসী বলেন, আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যাদেরকে আমরা হকপন্থী বলেছি, তারা হ’লেন, (১) ছাহাবা (২) তাবেঈন (৩) আহলুল হাদীছগণ (৪) ফক্বীহগণের মধ্যে যারা তাদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত এবং (৫) প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন’। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, শুধুমাত্র মুহাদ্দিছগণ নন, বরং তাঁদের নীতির অনুসারী আম জনসাধারণও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে সকল যুগে কথিত হ’তেন এবং আজও হয়ে থাকেন।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে এবং তা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই এসেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ৬০১ হিজরী মোতাবেক ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলাদেশে সামরিক বিজয়ের অনেক পূর্বে এদেশে ইসলাম এসেছিল, যা ছিল কুরআন ও হাদীছ ভিত্তিক মূল আরবীয় ইসলাম। যার প্রভাব ছিল মুসলমানদের সার্বিক জীবনে। আজও কোন কিছুর সন্ধান না পাওয়া গেলে বলা হয় ‘বিষয়টির হদিস মিলছে না’। এ থেকে অনুমান করা চলে যে, এদেশের মুসলিম সমাজ জীবনে এক সময় ছিল হাদীছের ব্যাপক প্রভাব। কিন্তু তুর্কী বিজয়ের ফলে মধ্য এশিয়া থেকে আগত সাধক-দরবেশদের মাধ্যমে ও রাজশক্তির ছত্রছায়ায় পরবর্তীতে বাংলাদেশে যে ইসলাম প্রচারিত হয়, তা ছিল মূল আরবীয় ইসলাম থেকে বহুলাংশে পৃথক।

ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন ইমামের মাযহাবের তাক্বলীদের উপর সংঘবদ্ধ ছিল না’। তিনি দুঃখ করে বলেন, বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত হ’তে খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার নিকটে প্রেরণ করা হয়েছে’। সুলায়মান নাদভী বলেন, ‘আহলেহাদীছ’-এর নামে উপমহাদেশে যে আন্দোলন চলছে, বাস্তবে তা নূতন কোন বিষয় নয়। বরং পুরানো পদচিহ্নের অনুসরণ মাত্র’। তিনি বলেন, এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ফলাফল এই যে, ইত্তেবায়ে নববীর যে জাযবা হারিয়ে গিয়েছিল, তা পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। জিহাদের যে আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, তা আবার জ্বলে উঠেছে’। আব্দুল মওদূদ বলেন, কালচক্রে বাঙ্গালী জেহাদীরা আহলেহাদীছ, লা-মাযহাবী, মওয়াহেদ, মুহম্মদী, গায়ের মুকাল্লিদ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত হয়েছিল’। দরগাহ ও খানক্বাহর বিলাসী পীর-ফকীরেরা সেদিন বৃটিশ-ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ ফৎওয়া দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই পরিষ্কারভাবে ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’কে ব্রিটিশ রাজত্বে মুসলমানদের ‘প্রথম মুক্তি সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভারতবর্ষের জিহাদ আন্দোলন মূলতঃ আহলেহাদীছগণের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল এবং ওয়াহ্হাবী ও আহলেহাদীছকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ অর্থে বুঝানো হ’ত। মাওলানা মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালভী (মৃঃ ১৯২০) নিরীহ আহলেহাদীছগণকে ইংরেজের জেল-যুলুমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিজস্ব প্রচেষ্টায় ‘ওয়াহ্হাবী ও আহলেহাদীছ এক নয়’- সেকথা ইংরেজ সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। একারণে সমস্ত আহলেহাদীছ জামা‘আতকে ইংরেজের অনুগত প্রমাণ করার জন্য কোন কোন মহল থেকে ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়, তা ঐতিহাসিকভাবে ভুল প্রমাণিত।

অতএব বালাকোট, বাঁশের কেল্লা, মুল্কা, সিত্তানা, পাঞ্জতার, আম্বেলা, চামারকান্দ, আস্তমাস্ত ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতি সমূহ, জেল-যুলুম, ফাঁসি, সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও কালাপানির অবর্ণনীয় নির্যাতনে পোড়া নিখাদ তাওহীদবাদী বাংলাদেশের অন্যূন আড়াই কোটি আহলেহাদীছ সহ উপমহাদেশের বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি আহলেহাদীছ জনগণ সেই জিহাদী উত্তরাধিকারের নাম। যেকোন মূল্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার চিরন্তন শহীদী কাফেলার নাম। ইংরেজের কুফরী হুকুমত উৎখাতের পর ১৯৪৭ থেকে যা এখন সমাজ সংস্কারের জিহাদে রূপলাভ করেছে।

কেবল শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধেই আহলেহাদীছদের জিহাদ ছিল না, বরং শিরক ও বিদ‘আত মিশ্রিত প্রচলিত লৌকিক ইসলামকে পরিশুদ্ধ করে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মূল ইসলামের প্রচলন ঘটানোর জন্য কথা, কলম ও সাংগঠনিক জিহাদ ছিল আপোষহীন। যা তাদেরকে বিরোধীদের চক্ষুশূলে পরিণত করেছিল। আজও সেই বিদ্রূপবান ও অত্যাচার তাদেরকে প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হচ্ছে। তাই আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা সকল যুলুম বরদাশত করব, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘হক’ ছাড়তে প্রস্ত্তত নই।

উল্লেখ্য যে, আহলেহাদীছের প্রকৃত পরিচয় তার নির্ভেজাল আক্বীদা, আমল ও ইখলাছের মধ্যে নিহিত। তার পিতৃ পরিচয়, বিদ্যা-বুদ্ধি ও সামাজিক পদমর্যাদার মধ্যে নয়। অতএব ‘হে অকল্যাণের নিশাচররা পিছিয়ে যাও! হে কল্যাণের অভিযাত্রীরা এগিয়ে চল’! জান্নাতের সুগন্ধি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পরিশেষে দেশের বিবেকবান জনগণের নিকটে বিষয়গুলি ভেবে দেখার ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন![2]


[1]. মুসলিম হা/১৯২০; মিশকাত হা/৫৫০৭।

[2]. ৭ম বর্ষ ৮ম সংখ্যা মে ২০০৪।






বিষয়সমূহ: সংগঠন
কুরআনী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হাদীছ অস্বীকারের ফিৎনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উপযেলা নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাওহীদ দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মশুদ্ধির মাস রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দর্শনীয় স্থানগুলি শিক্ষণীয় স্থান রূপে গড়ে তুলুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হিংসা ও অহংকার সকল পতনের মূল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ক্বিয়ামতের গুজব ও বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বায়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে আল্লাহ! সৎ ও সাহসী নেতা দাও - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মে‘রাজুন্নবী (ছাঃ) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.