কুরআনী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা

পবিত্র কুরআন মানবজীবন পরিচালনার অব্যর্থ রূপরেখা দিয়েছে। মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন কিভাবে পরিচালনা করতে হবে, কুরআনে তার মৌলিক নীতিমালা বিধৃত হয়েছে। নিম্নে কুরআনের আলোকে একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তর ও কাঠামো কিভাবে গঠন করা যাবে তা উল্লেখ করা হ’ল।-

. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। জনগণের সার্বভৌমত্ব বলে যেটা বলা হয়, তারা অবশ্যই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য’ (ইউসুফ-মাক্কী ১২/৪০)। এতে বুঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহর আদেশ-নিষেধই মূল বিবেচ্য বিষয়। কুরআন ও সুন্নাহ হবে আইন ও নীতির ভিত্তি। আমীর যার ভিত্তিতে কাজ করবেন।

২. ইসলামী রাষ্ট্রে একটি শূরা বা পরামর্শ সভা থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর’ (আলে ইমরান-মাদানী ৩/১৫৯)। এতে বুঝা যায় যে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণের জন্য আমীর শূরার পরামর্শ গ্রহণ করবেন। যেখানে রাষ্ট্রের যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সদস্য মনোনীত হবেন।

৩. শাসন ও বিচার ব্যবস্থা নিরংকুশভাবে ইনছাফ ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনছাফ ও ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেন’ (নাহল-মাক্কী ১৬/৯০)

৪. আমীরের প্রধান গুণ ও বৈশিষ্ট্য হবে যোগ্যতা ও আমানতদারিতা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচেছন যে, তোমরা আমানত সমূহকে যথাস্থানে সমর্পণ কর’ (নিসা-মাদানী ৪/৫৮)। এতে বুঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা বংশানুক্রমিক বিষয় নয়; বরং মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যোগ্য নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে আমীর নির্বাচিত হবেন।

৫. শাসককে পুরুষ হ’তে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক’ (নিসা-মাদানী ৪/৩৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ঐ জাতি কখনই সফলকাম হয় না, যারা নারীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়’ (বুখারী হা/৪৪২৫; মিশকাত হা/৩৬৯৩)। এর মাধ্যমে নারীদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় গুরুদায়িত্ব থেকে নিরাপদে রাখা হয়েছে।

৬. দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত বিধি-বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারা কাফের, যালেম, ফাসেক’ (মায়েদাহ-মাদানী ৫/৪৪, ৪৫, ৪৭)। তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক, আল্লাহ তাদের সর্বাধিক শুভাকাংখী। অতএব ন্যায়বিচারে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখো আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (নিসা-মাদানী ৪/১৩৫)

৭. পুঁজিবাদ বা সমাজবাদ নয়, বরং ব্যক্তি মালিকানা অক্ষুন্ন রেখে আল্লাহ নির্ধারিত নীতি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টন এবং যাকাত ও ছাদাক্বা প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হ’ল ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা। আল্লাহ বলেন, ‘যাতে সম্পদ কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়’ (হাশর-মাদানী ৫৯/৭)। এই কাঠামোতে ধনীদের থেকে নিয়ে গরীবদের মধ্যে সম্পদ বন্টন করা হয়। যে কারণে ইসলামী অর্থনীতি হয় সম্পূর্ণ সূদমুক্ত (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২৭৫)

৮. ইসলামী রাষ্ট্রে সকল ধর্মের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই সুপথ ভ্রান্তপথ হ’তে স্পষ্ট হয়ে গেছে’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২৫৬)। এতদ্ব্যতীত বৈধ সকল বিষয়ে সকলের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। সেই সাথে ইসলামকে অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, আওলিয়াবাদ প্রভৃতি শিরকী দর্শন হ’তে মুক্ত রাখবে।

৯. কল্যাণমূলক শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা নিশ্চিত করা। আল্লাহ বলেন, ‘পড়! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (‘আলাক্ব-মাক্কী ৯৬/১)। এতে বুঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হ’ল সর্বস্তরের নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন করা। ধর্মীয় ও বৈষয়িক শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

১০. ইসলামী রাষ্ট্র দেশের শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং শত্রুর মোকাবিলার জন্য সর্বদা প্রস্ত্তত থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা কাফেরদের মোকাবিলায় সাধ্যমত শক্তি ও সুসজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো’ (আনফাল-মাদানী ৮/৬০)। এতে বুঝা যায় যে, রাষ্ট্রকে নাগরিকদের সুরক্ষা ও দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশাসনিক ও সামরিক প্রস্ত্ততি রাখতে হবে।

১১. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতির ক্ষেত্রে কুরআনের বিধান হ’ল পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না’...(মুমতাহিনা-মাদানী ৬০/৮)। এতে বুঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ন্যায়বিচার ও সহযোগিতা।

উপরোক্ত মূলনীতিগুলি থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, কুরআনী রাষ্ট্রব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বাধিক কল্যাণমুখী ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেখানে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণভাবে সংরক্ষিত থাকে। তাদের অর্থনৈতিক সাম্য ও সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত হয় এবং সমাজে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হ’ল ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে সমর্পিত করা। কোন অবস্থায় শিরক ও কুফর মিশ্রিত বাতিল আক্বীদা তথা পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র প্রভৃতি জাহেলী মতবাদকে সর্বতোভাবে বর্জন করে এক আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করা। পরিশেষে আসুন! আমরা কুরআনী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা অনুযায়ী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করি এবং জনমত গঠন করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন! (স.স.)






বুটের তলায় পিষ্ট মানবতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মূর্তি অপসারণ ও পুনঃস্থাপন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুছল্লী না সন্ত্রাসী? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী আইনের কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ কখনো জঙ্গী নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্দা নারীর অঙ্গভূষণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ঈদুল আযহা সমাগত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রসঙ্গ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মহত্যা করবেন না - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষা করুন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হিংসা ও অহংকার সকল পতনের মূল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.