২০২৪ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। নির্বাচন হচ্ছে ৭০টির বেশী দেশে। এক বছরে এতগুলো দেশে নির্বাচনের নযীর ইতিপূর্বে নেই। বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ এ বছর ভোটের আওতায় থাকছে। এমন এক সময়ে এই নির্বাচনগুলো হচ্ছে, যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মান ক্রমশ নীচের দিকে নামছে। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের ২০২৩ সালের পর্যবেক্ষণ বলছে, বিশ্বের অর্ধেক দেশে টানা ছয় বছর ধরে গণতন্ত্রের ক্ষয় চলছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড মনে করেন, প্রতিটি সময়ের একটি আবেদন থাকে এবং এই সময়টা গণতন্ত্রের নয়। আবার বিশ্বরাজনীতিও এখন বেশ টালমাটাল। যুদ্ধ-সংঘাত, গোলযোগ ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অনেক অঞ্চল। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে চলছে নানামুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মৈত্রীর সম্পর্ক।
এ বছরের শুরুর চার মাসে যে দেশগুলোতে নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের ৭ই জানুয়ারীর নির্বাচনও রয়েছে। বলা যায়, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বিশ্বে শুরু হয়েছে নির্বাচনের বছর। এ সময়ে আরও নির্বাচন হয়েছে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, বেলারুশ, আযারবাইজান, সেনেগাল, এল সালভাদর, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের মতো বেশ কিছু দেশে। জনসংখ্যার হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় গণতন্ত্রে’র দেশ ভারতে এখন নির্বাচন চলছে। যে দেশগুলোতে এরই মধ্যে নির্বাচন হয়েছে এবং বছরের বাকী সময়ে যে দেশগুলোতে নির্বাচন হবে, সেখানে নানা মানের গণতন্ত্র রয়েছে। এখন ভোটাভুটি কেবল নিয়ম রক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ভোটারশূন্য থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দেশে গণতন্ত্রের এই করুণ দশা কেন? সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের প্রধান ও কোস্টারিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন কাসাস-জামোরা এর কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র সামাজিক চাহিদার প্রতি দ্রুত সাড়া দিতে পারে না, এমন একটি ধারণা তৈরী হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিকে উপেক্ষা করার একটি মনোভাব জনমনে তৈরী হয়েছে। তৃতীয়ত, সামাজিক ক্ষেত্রে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বের প্রতি মানুষের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা তৈরী হয়েছে। চতুর্থত, ইরাক আক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে পশ্চিমের নৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল করে দিয়েছে’।
বিশ্বে যে দেশগুলোতে (নট ফ্রি ও পার্টলি ফ্রি) স্বৈরশাসক বা আধা স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় আছেন, সেই নির্বাচনগুলোর ফলাফল কী হবে, তা আগেই জানা থাকে। গত চার মাসে হয়ে যাওয়া নির্বাচনগুলোতে তার প্রমাণ রয়েছে। সামনে যে নির্বাচনগুলো হ’তে যাচ্ছে, সেখানে এর উল্টা কিছু ঘটবে, এমনটা আশা করা কঠিন। আবার যে কয়েকটি দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হ’তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানেও কারচুপি ও অনিয়মের ঝুঁকি আছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে উপযেলা নির্বাচন হচ্ছে তাতে ভোটের হার : ২০২৪- ৩০-৪০%; ২০১৩- ৪০-২২%; ২০১৪- ৬১%; ২০০৯- ৬৮-৩২% (৯ই মে বৃহস্পতিবার, প্রথম আলো, ১ম পৃ.)। এতে দেখা যাচ্ছে যে, ভোটের হার দিন দিন কমছে। এর পরেও যারা ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে, তারা কি স্বেচ্ছায় যাচ্ছে? এ বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলেন, অধিকাংশ যায় এমন লোক যারা ভয়ে বা টাকার লোভে বা লোক দেখানোর জন্য। আর যায় ক্যাডার নামধারী ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী যারা ব্যালট বাক্স ভরে দেবার জন্য যায়। নোবেল জয়ী প্রেসিডেন্ট ওবামার ১ম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) ভোট পড়েছিল ৫৪%। তার মধ্যে একজন ছিলেন ১০৯ বছরের হুঁশ-বুদ্ধিহীন এক বুড়ী। ট্রাম্পের সময় (২০১৭-২০২১) তাদের হিসাব অনুযায়ী প্রত্যেক ভোটারকে গড়ে ১০ ডলার করে ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে মোদির জোয়ারের সময়েও ভারতে মাত্র ৩৮% ভোট পড়েছিল। এখন ইইউ পার্লামেন্ট ও ইউরোপের দেশগুলো, যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে ধরে নেওয়া হয়, সেখানকার ফলাফলে যদি ডানপন্থীদের উত্থান ঘটে এবং সব শেষে আগামী ৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যদি ট্রাম্পের (৭৮) বিজয় নিশ্চিত হয়, তবে গণতন্ত্রের পতনের ষোলকলা পূর্ণ হবে। যিনি তার পূর্বের মেয়াদে ৯০ মিনিটের এক ভাষণে ২০টি মিথ্যা এবং ৩ বছরে ১৬ হাযার বার মিথ্যা বলেছিলেন। যার বিরুদ্ধে বর্তমানে এক নারীকে ধর্ষণের মামলা চলছে।
বস্ত্তত ২০২৪ সাল বিশ্বে গণতন্ত্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার বছর। গণতন্ত্রের এই ক্ষয় নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, তাতে গণতন্ত্র এখন একটি খারাপ সময় পার করছে। আর এটাই বাস্তব যে, কোন দেশেই কখনো ১০০% ভোটার ভোট দিতে যায় না। কারণ তো একটাই যে, এইসব ভোটে কেবল মাথা গণা হয়। মগয যাচাই হয় না। ফলে যোগ্য মানুষদের কোন মূল্যায়ন হয় না। মানীর মান থাকে না। বরং ভোটাভুটির প্রথাটাই মানুষের স্বভাব বিরুদ্ধ। বরং পরামর্শমূলক সিদ্ধান্তই হ’ল স্বভাবজাত।
প্রশ্ন হ’ল গণতন্ত্রের পরে কি? মানুষ তার স্বভাবজাত বিধানের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। সেটা কি? মানুষ সুশাসন চায়। অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি চায়। সৎকর্মীর পুরস্কার ও দুষ্কর্মীর দ্রুত শাস্তি চায়। কিন্তু গণতন্ত্রে এসবই সোনার হরিণ। অথচ আইন-আদালত সবই আছে। বিগত যুগে সবল শ্রেণীর কেউ অন্যায় করলে পার পেয়ে যেত। আর দুর্বল শ্রেণীর কেউ অন্যায় করলে তাকে দন্ড দেওয়া হ’ত। এ যুগেও সেটি চলছে নিয়মিতভাবে। এমনকি নির্দোষ মানুষকে ধরে এনে ডজন খানেক মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর জেল খাটানো হচ্ছে। অথবা গুম-খুন ও অপহরণ করা হচ্ছে। তাহ’লে ফেলে আসা জাহেলী যুগের সাথে আধুনিক যুগের পার্থক্য কোথায়?
আল্লাহ মানব জাতিকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যেখানে পরস্পরের মধ্যে মেধা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব গুণের পার্থক্য থাকে। আর নেতৃত্ব ছাড়া সমাজ এক পা চলতে পারে না। তবে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া যায় না। তাই সমাজের যোগ্য ব্যক্তিরাই যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করেন। অতঃপর নেতা যাতে স্বেচ্ছাচারী না হন, সেজন্য থাকে কিছু নৈতিক বিধান। যা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত। যার বিপরীত করলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অহি নাযিলের মাধ্যমে সেই গাইড লাইনগুলি আল্লাহ পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেগুলি মেনে চললে বান্দা লাভবান হবে। নারীর পর্দা ফরয এবং পুরুষ জাতি নারী জাতির অভিভাবক। যার বিপরীত করলে সমাজের শৃংখলা ভেঙ্গে পড়বে। বস্ত্তবাদী সমাজে যা ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং যার তিক্ত ফল তারা ভোগ করছে।
শিক্ষায় ও প্রশাসনে, সরকারে ও আদালতে যদি নৈতিকতা ও মানবিকতা গৌণ হয় অথবা হাওয়া হয়ে যায়, তাহ’লে মানব সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে না। সূদী অর্থনীতি পূজিবাদের হাতিয়ার। যা কখনই দারিদ্র্য বিমোচন করবে না। ট্রান্সজেন্ডারের সিলেবাস কখনই সুন্দর মানুষ তৈরী করবে না। ভোটাভুটির রাজনীতি কখনই সমাজে হানাহানি দূর করবে না। তাই শান্তির জন্য মানুষকে ফিরে আসতে হবে তার স্বভাবধর্ম ইসলামের দিকে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের দিকে। যার ভিত্তিতে সমাজ ও প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। দুনিয়া হ’ল কর্মের জগত এবং আখেরাত হ’ল কর্মফলের জগত।
তাই পরকালে জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অবশ্যই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সৎকর্ম করবে এবং নেকীর উদ্দেশ্যে নেতার আনুগত্য করবে। এভাবে সর্বত্র আখেরাতের চেতনা সৃষ্টি হওয়া ব্যতীত সমাজ পরিবর্তনের অন্য কোন পথ নেই।
গণতন্ত্রে হুজুগই বড় কথা। ‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেইন’ হুজুগ দিয়ে এবং হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিয়ে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি (জন্ম ১৯৫০) ক্ষমতায় আসেন। ফলে সেদেশের ২৫ কোটি মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা চরম আতংকে ও নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কে না জানে যে, ঢেউ কখনো একভাবে থাকেনা। ফলে মোদির ঢেউ এখন মিলিয়ে যাওয়ার পথে। গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। চাই সেটা ভাল হৌক বা মন্দ হৌক। এখানে সত্য-মিথ্যার কোন স্থায়ী মানদন্ড নেই। এর বিপরীতে ইসলামে আল্লাহ সার্বভোম ক্ষমতার মালিক এবং অহি-র বিধানই চূড়ান্ত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের অধীনে থাকবে। আর আল্লাহ্র বিধান অপরিবর্তনীয় যা সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। মানুষ কখনো আল্লাহ্র বিধানকে পরিবর্তন করতে পারবে না। সত্য চিরদিন সত্য। ভোট দিয়ে তাকে মিথ্যা বানানো যায় না। অতএব গণতন্ত্রের পতন আসন্ন। অতঃপর বিশ্ববাসীকে ফিরে আসতে হবে ইসলামের দিকে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে এমন কোন মাটির ঘর বা পশমের ঘর (অর্থাৎ তাঁবু) বাকী থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছাবেন না, সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে অথবা অসম্মানীর ঘরে অসম্মানের সাথে। এক্ষণে আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করবেন, তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের যোগ্য করে দিবেন। আর যাদেরকে তিনি অসম্মানিত করবেন, তারা (জিযিয়া দানের মাধ্যমে) ইসলামের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে’ (ছহীহাহ হা/৩)। অতএব মুসলিম রাষ্ট্রগুলি যদি ইসলামী বিধান মতে পরিচালিত হয়, তবে সেটাই হবে মানবতার মুক্তির জন্য সত্যিকারের রোল মডেল। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)।