
গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী’০৫ মঙ্গলবার থেকে দেশের হাতে গণা কয়েকটি ইসলামপন্থী পত্রিকা বাদে প্রায় সব ক’টি বাংলা ও ইংরেজী জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে কোনটায় ছবিসহ কোনটায় ছবি ছাড়া এমনকি বিদেশী বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং এ সংগঠনের মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে কথিত জঙ্গীবাদের সাথে জড়িয়ে যেসব সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তা যেমন মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত, তেমনি রীতিমত হাস্যকর। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যে কত নীচে নেমে গেছে, বর্তমানের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। এখন দেখার বিষয়, এইসব মিথ্যাচারের উপরে ভিত্তি করে দেশের সরকার কোন অন্যায় পদক্ষেপ নেন কি-না। এ ধরনের মুখরোচক শিরোনাম না দিলে ঐসব পত্রিকা বিক্রি হয় না। তাছাড়া এ ধরনের সাংবাদিকতা যে উদ্দেশ্যমূলক, তা সহজে বুঝা যায় এ কারণে যে, ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের অনুসারী পত্রিকাগুলিই কেবল এ সংবাদগুলি প্রায় একই সুরে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে লিখেছে। বুঝতে পারি না সাংবাদিকতার নীতিমালা কি তবে সুন্দরভাবে মিথ্যা বলা? ভিত্তিহীন বিষয়কে কল্পনার ফানুস দিয়ে অট্টালিকা বানানো? অথচ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, যা শোনা হয়, তাই-ই বর্ণনা করা।[1] কোনরূপ যাচাই-বাছাই ব্যতীত একজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা ও তার চরিত্র হনন করা যদি সাংবাদিকতার আওতাভুক্ত হয়, তবে বলা যায় যে, সাংবাদিকতার চাইতে জঘন্য পেশা বর্তমান যুগে আর কিছু নেই। বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক বর্তমানে গরু মেরে জুতা দানের নীতি অনুসরণ করছে। যেমন কারু বিরুদ্ধে নোংরা শিরোনাম দিয়ে অপপ্রচার করা হ’ল। অতঃপর গা বাঁচানোর জন্য কখনও ভিতরে বা নীচে ছোট্ট করে একটু প্রতিবাদ ছাপিয়ে দিল। এতেই তার সাংবাদিক সততার প্রমাণ দেওয়া হয়ে গেল। অনেক পত্রিকা ওটুকুও ছাপেনা। ছাপলেও ভিতরে এমন করে ছাপবে, যেন সহজে কারু নযরে না পড়ে। ধিক সাংবাদিক সমাজের প্রতি, যারা মিথ্যাকে তাদের পুঁজি হিসাবে গ্রহণ করেছে। সত্যকে বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করছে।
সাধারণ পাঠক এগুলিকে লুফে নেয় ও বিশ্বাস করে এবং সাথে সাথে মুখে মুখে সর্বত্র প্রচারিত হয়ে যায়। অথচ এই মিথ্যা প্রচারণায় জড়িত হয়ে যায় প্রধানতঃ তিন পর্যায়ের লোক। ১- যারা এই মিথ্যা পরিবেশন করে। ২- ঐ সাংবাদিক যিনি এটাকে মুখরোচক শিরোনাম দিয়ে ও রং চড়ানো ভাষা দিয়ে পত্রিকায় বা বেতার-টিভিতে প্রচার করেন। ৩- যারা এটা পড়ে বা শোনে এবং বিনা যাচাইয়ে প্রচার করে। এই তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আরও জড়িত হয় মুদ্রাকর, পিয়ন, হকার সহ অনেক মানুষ। দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটি মিথ্যা খবর শত শত লোককে পাপী করে ফেলছে। পৃথিবীতে প্রথম খুনী হ’ল আদমপুত্র ক্বাবীল। সেকারণ ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত খুনের ঘটনা ঘটবে, তার পাপের একটা অংশ ক্বাবীলের আমলনামায় যোগ হবে।[2] পাপের দিকে আহবানকারীদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামতের দিন ওরা পূর্ণ মাত্রায় বহন করবে নিজেদের পাপভার এবং ঐসব লোকদের পাপভার, যাদেরকে ওরা অজ্ঞতা হেতু বিপথগামী করে। সাবধান! খুবই নিকৃষ্ট বোঝা তারা বহন করে থাকে’ (নাহল ১৬/২৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ... যে ব্যক্তি মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান জানালো, তার উপরে ঐ পরিমাণ গোনাহ চাপানো হবে, যে পরিমাণ গোনাহ তার অনুসারীদের উপরে চাপবে। তাদেরকে তাদের গোনাহ থেকে এতটুকুও কম করা হবে না’।[3]
মানুষের জানমাল ও ইযযত পরস্পরের জন্য হারাম। অথচ হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে সেই ইযযত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। একজন সম্মানী ব্যক্তির সম্মান ক্ষুণ্ণ করা কিংবা বিনষ্ট করাই যেন এই সব সাংবাদিকতার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিনিময়ে তারা দুনিয়ায় কিছু হাছিল করলেও আখেরাত যে হারাচ্ছেন, এটা সুনিশ্চিত।
তথ্য সন্ত্রাসের এই যুগে একটি মিথ্যাকে শতকণ্ঠে বলিয়ে গোয়েবল্সীয় কায়দায় সত্য বলে প্রমাণিত করার যে কোশেশ চলছে, তার দ্বারা পাঠক সমাজ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হবে ও সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হবে। কিন্তু দেরীতে হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে সত্যই জয়লাভ করবে। এটাই স্বাভাবিক ও চিরন্তন সত্য। সমাজ সংস্কারকগণের জীবনে চিরকাল আমরা এটাই দেখে এসেছি।
বর্তমান সময়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সমাজ সংস্কারের দূরদর্শী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাতে বাধা আসা স্বাভাবিক। একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মিডিয়া সমূহের প্রত্যক্ষ হামলা, অন্যদিকে ইসলামী নামের শিরক ও বিদ‘আতপন্থী পত্রিকা ও মিডিয়া সমূহের নিশ্চুপ ভূমিকা অথবা পরোক্ষ ও তীর্ষক হামলা- দু’য়ের মুকাবিলা করেই আমাদেরকে সামনে এগোতে হচ্ছে। তাই আজ জঙ্গীবাদের যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এবং যেসব অপরিণামদর্শী তরুণকে জিহাদের প্রস্ত্ততির সুড়সুড়ি দিয়ে একাজে লাগানো হচ্ছে, তারা যে বিদেশী প্রভুদের ক্রীড়নক, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যেসব সংবাদপত্র নির্দোষ ইসলামী নেতাদের কলংকিত করার চেষ্টায় নিরত আছে, তারাও যে মহল বিশেষের দ্বারা পরিচালিত নয়, তা হলফ করে বলার উপায় নেই। তারা দেশের সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য এবং বিদেশের নিকট বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অতএব আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, ইসলামের স্বচ্ছ-সুন্দর ও আদিরূপ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ যেমন কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে তাদের জিহাদী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তেমনি দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সর্বদা দেশের সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা সাংবাদিকতার পেশাকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে সাংবাদিকতায় জড়িত বন্ধুদের সত্যসেবী হবার এবং অন্যের চরিত্র হননে কালি-কলম ব্যয় না করার আহবান জানাচ্ছি। নইলে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন সাংবাদিকদেরকে ডাষ্টবিনের নোংরা ময়লার মত মানুষ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। মিথ্যাচার ও সাংবাদিকতা সমার্থক হিসাবে গণ্য হবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সকলকে গীবত-তোহমতের পরকালীন মর্মান্তিক পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন![4]
[এ সম্পাদকীয় লেখার পরপরই ২২শে ফেব্রুয়ারী’০৫ মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত তিনজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ গ্রেফতার হন। অতঃপর ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন কারাভোগের পর ২৮.০৮.২০০৮ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি বগুড়া যেলা কারাগার হ’তে যামিনে মুক্তি পান। -প্রকাশক।]
[1]. মুসলিম হা/৫; মিশকাত হা/১৫৬ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[2]. বুখারী হা/৩৩৩৫; মুসলিম হা/১৬৭৭; মিশকাত হা/২১১ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[3]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[4]. ৮ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা মার্চ ২০০৫।