বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সম্প্রতি যে ১০টি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে রেল ট্রানজিট। এটি বাস্তবায়ন হ’লে বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ব্যবহার করে রেলযোগে দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশে সরাসরি নিজেদের পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে ভারত।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে পণ্য ও মালামাল আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয় ভারতকে। মাঝখানে বাংলাদেশ থাকায় দেশের অন্য অংশের সাথে রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহন বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সেই কারণেই বাংলাদেশের কাছে পণ্য ট্রানজিট সুবিধা চেয়ে আসছিল ভারত। কয়েক বছর আগে ট্রানজিট দেয়া হ’লেও নতুন চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারত এখন সরাসরি নিজেদের পণ্য ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা পাবে।
কিন্তু ভারতকে এই ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ কি পাবে? ভারত বা বাংলাদেশ কোন সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ট্রানজিট চুক্তি শর্ত, মাশুল, অর্থায়ন কিংবা অন্য কোন বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তারাও বলতে রাজি নন।
তবে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য এবং ট্রানজিটের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের লাভের বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী হ’তে পারছেন না বিশ্লেষকরা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, এযাবৎ যা অভিজ্ঞতা তাতে বলা যায় যে, নতুন এই চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ তেমন কিছু পাবে না।
২০১০ সালে ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, বছরে প্রায় পাঁচ শ’ মিলিয়ন ডলারের মতো লাভ হবে। কিন্তু পরে আদৌ কী কোন মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে? কারণ সব মিলিয়ে প্রতি টনে বাংলাদেশ মাশুল পায় মাত্র ৩০০ টাকার মতো।
তবে এব্যাপারে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আশা দিয়ে বলেন, অতীতে না পারলেও নতুন চুক্তির মাধ্যমে মাশুলের হার বাড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগের ফলে আগের তুলনায় ভারতের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক কমে আসবে। কাজেই তাদের যত টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে একটি বেনিফিট শেয়ারিংয়ের ফর্মূলায় বাংলাদেশ যেতে পারে’। তিনি বলেন, নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। কিন্তু ভারতের ভূ-খন্ড ব্যবহার করার অনুমোদন না পাওয়ায় সেটি খুব একটা কার্যকর হয়নি। ভারতের কাছ থেকে সেই সুযোগ আদায়ের ক্ষেত্রেও নতুন এই চুক্তিটি একটি বার্গেনিং চিপ হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এছাড়া ট্রানজিট দেশের নিরাপত্তার জন্য কোন হুমকি হ’তে পারে কি-না সে ব্যাপারে তৌহিদ হোসেন বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেসব রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেসব অভিযানে ভারত হয়তো এই রেলপথ ব্যবহার করতে চাইবে। এসব রাজ্যে অতীতে ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতও হ’তে দেখা গেছে। অন্যদিকে চীন-ভারত সীমান্তেও বিভিন্ন সময় সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হ’তে দেখা গেছে। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ভারত অবশ্যই এসব ট্রানজিট রুট ব্যবহার করতে চাইবে এবং সেটিই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে ভারতে এ ধরনের ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি চীন কিভাবে নেয়, সেটির উপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এতদিন ভারত ও চীন উভয়ের সাথে একটা ব্যালান্স সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। এখন ভারতকে সরাসরি ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার বিষয়টি চীন যদি ভালোভাবে না নেয়, তাহ’লে অনেক কিছুই হ’তে পারে।