[মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ আনওয়ার ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত ভারতের লাহোর যেলার পাট্টী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফায়ছালাবাদের সরকারী স্কুলে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। অতঃপর জামে‘আ সালাফিইয়ায় ভর্তি হন। এরপর তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহ বীরুওয়ালাবী প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল কুরআন ওয়াল হাদীছ’ মাদরাসা থেকে দরসে নিযামীর পাঠ শেষ করেন। শায়খুল হাদীছ হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী, মাওলানা আব্দুল গাফফার হাসান, প্রফেসর গোলাম আহমাদ হারীরী, মাওলানা হাফেয আহমাদুল্লাহ বড়হীমালাবী প্রমুখ তাঁর শিক্ষক। প্রথম থেকেই তিনি আহলেহাদীছ জামা‘আতের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি খুব ভালো আলোচক ও বক্তা। ৩০ বছর যাবৎ তিনি রহমানিয়া মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর আমীনপুর বাজারের আহলেহাদীছ জামে মসজিদে খতীব নিযুক্ত হন এবং অদ্যাবধি উক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ৪০ বছর যাবৎ রহমানিয়া মসজিদে আছরের পর দরসে হাদীছ পেশ করেন। কয়েক বছর তিনি সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৭-এর অধিক। তন্মধ্যে ওলামায়ে আহলেহাদীছ কী খিদমাতে হাদীছ, তাহরীকে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুঅত মেঁ আহলেহাদীছ কী খিদমাত, মিয়াঁ ফযলে হক কী জামা‘আতী ওয়া দ্বীনী খিদমাত অন্যতম। বর্তমানে তিনি মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ, পাকিস্তান-এর নায়েবে আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।[1]-অনুবাদক]

১৯৭৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু অমুসলিম আখ্যা দেওয়া হয়। এভাবে ৯০ বছর পর কাদিয়ানী ফিৎনা তাদের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। এজন্য বড় বড় আন্দোলন চালানো হয়। আল-হামদুলিল্লাহ, প্রত্যেক আন্দোলনে আহলেহাদীছ আলেমগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

মরহূম আগা সুরেশ কাশ্মীরী তাঁর জীবনের শেষ রচনা ‘তাহরীকে খতমে নবুঅত’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, আহলেহাদীছ আলেমে দ্বীন মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী ছিলেন সর্বপ্রথম মির্যা কাদিয়ানীকে নাস্তানুবাদকারী, যিনি সর্বত্র মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর পিছু নিয়ে তার ভ্রান্ত আক্বীদা ও দাবীগুলিকে বাতিল সাব্যস্ত করেন। তিনি তাঁর সম্মানিত শিক্ষক মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর খিদমতে হাযির হয়ে এমন ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী ব্যক্তির ব্যাপারে কুফুরীর ফৎওয়া লাভ করেন। অথচ তখনও অন্যান্য মাযহাবের মুসলমানরা চিন্তা-ভাবনা করছিল এবং এমন গোমরাহ আক্বীদাসমূহের ছোট-বড় নির্ণয়ে ব্যস্ত ছিল।

সে সময়েই নেতৃস্থানীয় আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) তো কাদিয়ানে গিয়ে মির্যাকে ধমক দেন। কিন্তু মাওলানা অমৃতসরীর মুখোমুখি হওয়ার মতো দুঃসাহস তার হয়নি। এ ব্যাপারে কাযী মুহাম্মাদ সুলায়মান মানছূরপুরী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটীর লিখিত ও মৌখিক অবদানকে কে পরিমাপ করতে পারে? দেশ বিভাগের পর ৫৩’র খতমে নবুঅত আন্দোলনে মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী রহিমাহুল্লাহ (যিনি ঐ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন), মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী, মাওলানা আব্দুল মজীদ সোহদারাভী, আল্লামা মুহাম্মাদ ইউসুফ কলকাত্তাবী (করাচী), মাওলানা হাকীম আব্দুর রহমান আযাদ (গুজরানওয়ালা), মাওলানা আব্দুর রশীদ ছিদ্দীকী (মুলতান), মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আহরার, হাফেয মুহাম্মাদ ইসমাঈল রোপড়ী, হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম কমীরপুরী, আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর, হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ী, মাওলানা মুঈনুদ্দীন লাক্ষাবী, মাওলানা আব্দুল্লাহ গুরুদাসপুরী প্রমুখ বহু প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেমের কীর্তি সর্বশীর্ষে ছিল। এঁদের মধ্যে অনেকে কয়েক মাস যাবৎ বন্দীত্ববরণের কষ্ট সহ্য করেছিলেন।

সে সময় মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী (রহঃ) দীর্ঘ দিন পর্যন্ত কারাগারে থাকার কারণে মুলতানে অনুষ্ঠিত ৫৪’র কেন্দ্রীয় কনফারেন্সেও অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এই আন্দোলনের সময় ফায়ছালাবাদ শহরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কাছারী বাজারে একটি বড় সম্মেলনের পরে মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক, মাওলানা আহমাদুদ্দীন গোখড়াবী, মাওলানা আলী মুহাম্মাদ ছিমছাম, মাওলানা ইবরাহীম খাদেম তান্দলিয়ান ওয়ালা, আমার মরহূম পিতা হাজী আব্দুর রহমান পাট্টাবী (রহঃ) এবং অল্পবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এই প্রবন্ধ লেখার কারণ ১৯৭৪ সালের ‘খতমে নবুঅত আন্দোলন’ (তাহরীকে খতমে নবুঅত)। যে উপলক্ষে প্রত্যেক বছর আমাদের বন্ধুরা ৭ই সেপ্টেম্বরকে বিজয়ের দিন হিসাবে পালন করে থাকে এবং বক্তব্য ও লেখনীতে অত্যন্ত জোরালোভাবে তা তুলে ধরে। কিন্তু সংকীর্ণতা বলুন বা না জানার ভান বলুন, তারা আন্দোলনের সূচনা ও প্রেক্ষাপট এবং আন্দোলনকারীদের নাম পর্যন্ত নেয় না। কেননা তাতে আহলেহাদীছ আলেমদের অবদান সবচেয়ে বেশী এবং শীর্ষস্থানীয়। এ প্রেক্ষিতে আমি যরূরী মনে করেছি যে, ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকার পাঠকবৃন্দ এবং নতুন প্রজন্মের জ্ঞানভান্ডার বৃদ্ধি করার জন্য প্রকৃত অবস্থা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার।

নিঃসন্দেহে ৭৪-এর খতমে নবুঅত আন্দোলন অতীতের সকল আন্দোলনের বিচারে সবচেয়ে বড় ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছিল। অর্থাৎ কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু অমুসলিম আখ্যা দেয়া হয়েছিল। এই আন্দোলন ২৯শে মে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। ঐদিন রাবওয়ার কাদিয়ানী জামা‘আতের গুপ্ত বাহিনী ‘আল-আহমাদিয়াহ’-এর গুন্ডারা চেন্নাবনগর রেলওয়ে স্টেশন (সাবেক রাবওয়াহ)-এর নিকট অবস্থিত নিশতার মেডিকেল কলেজ মুলতানের মুসলিম ছাত্রদের উপর হামলা করে, যারা শিক্ষা সফর থেকে চেন্নাব এক্সপ্রেস যোগে ফিরছিল। তাদের অপরাধ শুধু এটা ছিল যে, তারা ‘খতমে নবুঅত যিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়েছিল। ছাত্রদেরকে মেরে আধমরা এবং কঠিনভাবে আহত করা হয়। গাড়ী যখন ফায়ছালাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে, তখন আহত অজ্ঞান ছাত্রদেরকে গাড়ি থেকে বের করে সোল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইতিমধ্যে কাদিয়ানীদের এই গুন্ডাগিরির খবর শহরে পৌঁছে যায়। শহরের আলেম মুফতী যয়নুল আবেদীন, মাওলানা তাজ মাহমূদ, মাওলানা আব্দুর রহীম আশরাফ, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক চীমা (রহঃ) এবং লেখক দ্রুত স্টেশনে পৌঁছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নগরবাসীও রেলওয়ে প্লাটফর্মে উপস্থিত ছিল। উপরোক্ত আলেমগণ তাদের আবেগময় অগ্নিঝরা বক্তব্যের মাধ্যমে বিক্ষুব্ধ জনতা ও ছাত্রদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, আহত ছাত্রদের রক্ত বৃথা যেতে দেয়া হবে না। এই ঘটনার প্রতিবাদে দ্রুত সংবাদ সম্মেলন করে শাসকগোষ্ঠী ও সাংবাদিকদেরকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা হয়। উপরন্তু পরের দিন হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়। এই হরতাল এতটাই সার্থক ছিল যে, শহরের বাজারগুলো ছাড়াও মহল্লা ও শহরতলীর কলোনীগুলোর অলি-গলির দোকানপাট এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। দেশের অন্যত্র খবর পৌঁছলে সারা দেশের ওলামায়ে কেরাম ফায়ছালাবাদের ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, তারা তাদের এক ডাকেই সাড়া দিতে প্রস্ত্তত রয়েছেন এবং যেকোন ধরনের আত্মত্যাগ করতে তারা পিছপা হবেন না।

মাওলানা হাকীম আব্দুর রহীম আশরাফ (রহঃ)-এর জিন্নাহ কলোনীর বাড়ীতে পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাওয়ালপিন্ডিতে মাওলানা গোলামুল্লাহ খান (রহঃ)-এর জামে মসজিদ রাজা বাজারে প্রতিনিধি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশগ্রহণের জন্য ফায়ছালাবাদ থেকে আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। উক্ত প্রতিনিধি দলে মুফতী যয়নুল আবেদীন, মাওলানা আব্দুর রহীম আশরাফ, মাওলানা তাজ মাহমূদ, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক চীমা, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক, মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফ আশরাফ এবং লেখক শামিল ছিলেন। চেন্নাব এক্সপ্রেস যোগে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার জন্য ১ম শ্রেণীর সাতটি টিকেট ক্রয় করা হয়। স্টেশনে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে মাওলানা ইসহাক চীমা বলেন যে, আমাদের সাতজনের ট্রেনে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ হয়ত রাস্তাতেও গ্রেফতার করা হ’তে পারে। এজন্য কতিপয় আলেমের সড়ক পথে যাওয়া ভাল হবে। এই প্রস্তাবের আলোকে মুফতী যয়নুল আবেদীন, মাওলানা আব্দুর রহীম আশরাফ, মাওলানা তাজ মাহমূদ ও মাওলানা ইসহাক চীমা ট্রেনযোগে এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক, মাওলানা শরীফ আশরাফ এবং লেখক কারযোগে রাওয়ালপিন্ডি যাত্রা করেন।

মাওলানা চীমার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং অনুমান দু’টিই সঠিক প্রমাণিত হয়। চারজন বুযর্গকে লালা মূসা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু সড়ক পথে যাওয়া আমরা তিনজন রাওয়ালপিন্ডিতে পৌঁছে যাই। অন্যান্য শহর থেকে আগমনকারী কয়েকজন আলেমের সাথে অনুরূপই আচরণ করা হয়। যাহোক, সকল দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম এই অন্তর্বর্তীকালীন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি আলোচনা-পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা পেশের পর ‘খতমে নবুঅত আন্দোলন’-এর কর্মপরিষদ গঠিত হয়। মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ বিন্নূরীকে (করাচী) যার সভাপতি বানানো হয় এবং অর্থকড়ি যোগানের জন্য মিয়াঁ ফযলে হক (সেক্রেটারী জেনারেল, মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ, পাকিস্তান) অর্থ সম্পাদক নিযুক্ত হন।

ফায়ছালাবাদ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছোট-বড় প্রত্যেক শহরে প্রত্যেক দিন সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সব জায়গায় যৌথ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন ও আন্দোলনকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে আহলেহাদীছ আলেমগণ সামনের সারিতে ছিলেন। তন্মধ্যে আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর, হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ী, হাফেয আব্দুল হক ছিদ্দীকী, মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন শেখুপুরী, মাওলানা রফীক মদনপুরী উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আমাদের ফায়ছালাবাদ শহরে মিয়াঁ তুফাইল আহমাদ কর্মপরিষদ সভাপতি ও লেখক সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন। মোটকথা সকল দল-মতের আলেম-ওলামা, ছাত্র এবং যুবকরা দিন-রাত আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখে। ওলামায়ে কেরাম এমন প্ল্যান এবং বিচক্ষণতার সাথে এই আন্দোলন পরিচালনা করেন যে, গোটা দেশের আপামর জনগণ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সরকার হামদানী কমিশন গঠন করেন। যারা রাবওয়াহ স্টেশন ও অন্যান্য জায়গার ঘটনাসমূহ তদন্ত করেন। কিন্তু অবস্থা এমন দিকে মোড় নেয় যে, জাতীয় সংসদ তদন্ত কমিটিতে পরিবর্তন আনে এবং মির্যা লাহোরী পার্টির প্রধানের সমালোচনা করা হয়। এরপর ৭দিন পর্যন্ত কাদিয়ানী গ্রুপের প্রধান মির্যা নাছির বেগ-এর সমালোচনা চলতে থাকে।

জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দের মধ্য থেকে মাওলানা মুফতী মাহমূদ এবং মাওলানা শাহ আহমাদ নূরানী বিশেষভাবে আলোচনায় অগ্রগামী ছিলেন। যেসব বক্তৃতা রাওয়ালপিন্ডিতে আহলেহাদীছ আলেম হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম কমীরপুরী এবং মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ ইসমাঈল যবীহ প্রস্ত্তত করে দিতেন এবং মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর মূল রচনাগুলি তাদেরকে সরবরাহ করতেন। (উল্লেখ্য যে, কাদিয়ানীরা মির্যার অধিকাংশ লেখনীতে কম-বেশী করে দিয়েছে)। এই বইগুলি পরবর্তী দিন দু’জন সম্মানিত সংসদ সদস্য সূত্রসহ সংসদে দেখাতেন।

একদিন মুফতী মাহমূদ মির্যা নাছির আহমাদকে সম্বোধন করে বলেন যে, কাদিয়ানে মির্যা গোলাম আহমাদের সামনে একজন কবি তার প্রশংসা করতে গিয়ে এতদূর পর্যন্ত বলেছে-

محمد  پهر   اتر   آئے  ہىں قاديان  مىں + اور  پہلے سے بڑھ كر ہىں اپنى شان مىں

‘মুহাম্মাদ পুনরায় কাদিয়ানে আবির্ভূত হয়েছেন এবং প্রথমজনের চেয়ে স্বীয় মর্যাদায় অগ্রগামী’।

মির্যা নাছির এ বর্ণনাকে মিথ্যা আখ্যা দেন এবং বরাত তলব করেন। মুফতী ছাহেবের নিকট কোন প্রমাণ ছিল না। এক দু’দিনের মধ্যে হাওয়ালা দেখানোর ওয়াদা করেন। এই বরাতের জন্য হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম কমীরপুরী (রহঃ) ছাড়া অন্য কোন দলের আলেমে দ্বীন বা নেতার কাছে মূল কপি ছিল না। পাক-ভারত ভাগের পূর্বে কাদিয়ান থেকে সাপ্তাহিক ‘আল-বদর’ প্রকাশিত হ’ত। যার প্রথম পৃষ্ঠায় এই কবিতাটি ছাপা হ’ত। এটি মুফতী ছাহেবকে দেয়া হয় এবং তিনি সংসদে তা পাঠ করে শুনান। যার ফলে মির্যা নাছির এবং তার বশংবদদের  অত্যন্ত লাঞ্ছনার শিকার হ’তে হয়।

এখানে আরো একটি ঐতিহাসিক সত্য স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ৫৩’র খতমে নবুঅত আন্দোলনের সময় মাওলানা মওদূদী (রহঃ) ‘কাদিয়ানী মাসআলাহ’ নামে একটি প্রচারপত্র লিখে গোটা দেশে বিতরণ করেন। এতেও মির্যার ইলহাম ও দাবীগুলিকে অন্য কিতাবের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছিল। এজন্য মার্শাল ল’ আদালতের পক্ষ থেকে মাওলানা মওদূদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ শুনানো হয়েছিল। ব্যাপারটা যখন তদন্ত কমিশনের নিকটে উত্থাপিত হয়, তখন আদালত মূল গ্রন্থ সমূহের সূত্র তলব করে। হাফেয মুহাম্মাদ কমীরপুরী মূল গ্রন্থগুলি মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (রহঃ)-কে সরবরাহ করেন। তিনি মামলায় একজন অভিজ্ঞ উকিলের চেয়েও অগ্রগামী ছিলেন।[2] তিনি যখন আদালতে মির্যার রচনাবলী পেশ করেন, তখন মাওলানা মওদূদীর সাজা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে পরিবর্তন করে কয়েক মাস পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।

কথা হচ্ছিল জাতীয় সংসদে মির্যা নাছির আহমাদ-এর সমালোচনা প্রসঙ্গে। এ ব্যাপারে নিবেদন হল যে, অবশেষে একটি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে মির্যা নাছির আহমাদ বলেন, ‘যে ব্যক্তি মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না সে কাফের’। আল্লামা ইকবাল তো সেজন্যই বলেছেন-

پنجاب كے ارباب نبوت كى شريعت + كہتى ہے كہ يہ مومن ہے پارينہ كافر

‘পাঞ্জাবের নবীর শরী‘আত বলে যে, এই মুমিন পুরনো কাফের’।

এরপর জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে বিল পাশ করে। যার ভিত্তিতে ১৯৭৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ ভুট্টো আইন সংশোধন করে কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু অমুসলিম আখ্যা দেন এবং রাবওয়াহকে উন্মুক্ত শহরে পরিণত করা হয়। এভাবে ৯০ বছর পর কাদিয়ানী ফিৎনা তাদের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। কিন্তু এই আইনী সংশোধনকে অর্ডিন্যান্সে পরিণত করা হয়নি। কারণ খতমে নবুঅত আন্দোলন এতটা সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ ছিল যে, মাত্র ৩ মাস ১০ দিনের মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলা তাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

অতঃপর ১৯৪৮ সালে ‘মজলিসে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুঅত (খতমে নবুঅত সংরক্ষণ পরিষদ)-এর পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল যিয়াউল হক ১৯৮৪ সালের ২৬শে এপ্রিল কাদিয়ানী মতবাদ নিষিদ্ধকরণ অর্ডিন্যান্স[3] জারী করে কাদিয়ানী মতবাদের প্রচার, প্রকাশনা, নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দেয়া এবং ইসলামী পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করাকে অপরাধ আখ্যা দেন। যার শাস্তি তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। এই অর্ডিন্যান্স জারির পর কাদিয়ানী নেতা মির্যা তাহের রাতের পর রাত বেশ বদল করে পালিয়ে লন্ডন পৌঁছে যায়। কবির ভাষায়-

پہنچى   وہيں  پہ  خاك  جہاں  كا  خمير  تها

‘যেখানকার মাটি মূল ছিল সেখানে পৌঁছেছে’।[4]

মির্যা তাহের স্বীয় প্রভু ইংরেজ সরকারের নিকট আশ্রয় লাভ করে। সাথে সাথে স্বীয় প্রধান দপ্তর চেন্নাবনগর (রাবওয়াহ) থেকে লন্ডনে স্থানান্তর করে নেয়। কয়েক বছর পর ফায়ছালাবাদের আলেমদের প্রচেষ্টাতেই ১৯৯৮ সালে পাঞ্জাব এ্যাসেম্বলী সর্বসম্মতিক্রমে রাবওয়ার নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এভাবে নতুন নাম ‘চেন্নাবনগর’ রাখা হয়।

এটাও একটা মজার বিষয় যে, দীর্ঘদিন থেকে ‘মজলিসে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুঅত’ একটি নির্দিষ্ট দলের কব্জায় রয়েছে। অথচ প্রথম দিন থেকে এ সংগঠনে সব দলেরই অংশগ্রহণ ও অবদান রয়েছে। এ সম্পর্কেও একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা এই যে, অবিভক্ত ভারতে ‘মজলিসে আহরার’ কাদিয়ানী মতবাদের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে কয়েক জায়গায় মজলিসে আহরার-এর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হ’ত। সেকারণ তাদের সকল প্রোগ্রাম এবং কাদিয়ানী প্রতিরোধ আন্দোলন ভেস্তে যায়।

একবার শিয়ালকোটে মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী (রহঃ)-এর বাসগৃহে আহরার নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। যেখানে মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (যিনি সে সময় মজলিসে আহরার-এর সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন), মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মাস্টার তাজুদ্দীন আনছারী, মাওলানা কাযী ইহসান আহমাদ সুজাবাদী, ছাহেবযাদা ফায়যুল হাসান (রহঃ) এবং অন্যান্য নেতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন মজলিসে আহরার-এর রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রসঙ্গে প্রস্তাব পেশ করেন যে, কাদিয়ানী মতবাদ খন্ডনের জন্য নিখাদ দ্বীনী ভিত্তির উপর একটি সংগঠন হওয়া উচিত। যখন এই সংগঠনের নামের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা হয় তখন মাওলানা ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী ‘মজলিসে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুঅত’ প্রস্তাব করেন। যেটা বৈঠকে উপস্থিত সবাই পসন্দ করে এবং দেখতে দেখতেই তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। মোটকথা খতমে নবুঅত আন্দোলনে আহলেহাদীছরা সর্বদা অগ্রগামী ছিল। ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ ‘এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন’ (মায়েদাহ ৫/৫৪)

অতীত স্মৃতি রোমন্থন এবং লেখা শেষ করার পূর্বে নে‘মতের কথা প্রকাশ করার স্বার্থে এটাও উল্লেখ করছি যে, ফায়ছালাবাদ থেকে শুরু হওয়া উক্ত আন্দোলন সফল হওয়া উপলক্ষে দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় স্বভাবতই ফায়ছালাবাদ শহর এবং যেলায় বেশী আনন্দ প্রকাশ করা হয়। জামে‘আ রিযভিয়াহ ঝাঙ্গ বাজারে ছাহেবযাদা ফযলে রাসূল-এর সভাপতিত্বে এক বিশাল জালসা অনুষ্ঠিত হয়। লেখক স্টেজ সেক্রেটারী ছিলেন। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ যেমন মাওলানা আব্দুর রহীম আশরাফ, ছাহেবযাদা ইখতিখারুল হাসান, মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফ আশরাফ, মাওলানা মুহাম্মাদ রফীক মদনপুরী, মাওলানা আশরাফ হামাদানী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাইল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরূপ জ্বালাময়ী বক্তব্য পেশ করেন এবং জালসা শেষ হওয়ার পর শ্রোতাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শহর ও যেলাময় উৎসবের আমেজ ছিল। এ ব্যাপারে আরো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হ’ল, ফায়ছালাবাদের মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ-এর খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ছূফী আহমাদুদ্দীন ও হাজী বশীর আহমাদ এবং হাজী নাযীর আহমাদ যারা সে সময় ময়দা, সুজি ও চিনির বিশাল ব্যবসা করতেন, তারা আন্দোলনের ব্যাপক সফলতা উপলক্ষে সুজি ও চিনির দুই এবং পাঁচ কিলোর বহু প্যাকেট তৈরি করে সবার মাঝে ফ্রি বিতরণ করেন। এভাবে কয়েক দিন পর্যন্ত প্রত্যেক ঘরে মিষ্টি খাওয়ার সাথে সাথে ব্যাপক আনন্দ প্রকাশ করা হয়।

কাছারী বাজারের প্রসিদ্ধ জাহাঙ্গীর পোলাও-এর মালিক মরহূম ভায়ী ফাতাহ মুহাম্মাদ (যিনি লেখকের জুম‘আর মুছল্লী ছিলেন) বহু ডেকচি পোলাও রান্না করে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আলেম-ওলামা ও কর্মীদের বাড়ীতে বণ্টন করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হবে যে, আহলেহাদীছ আলেমদের পাশাপাশি আমাদের আহলেহাদীছ ব্যবসায়ীরাও খতমে নবুঅত আন্দোলনে অগ্রগামী ছিলেন।

[সৌজন্যে : সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’, লাহোর, পাকিস্তান, বর্ষ ৪৭, সংখ্যা ৪৪, ১১-১৭ই নভেম্বর ২০১৬, পৃঃ ১৬-১৭ ও ১২]


[1]. মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, চামানিস্তানে হাদীছ (লাহোর : মাকতাবা কুদ্দূসিয়াহ, ২০১৫), পৃঃ ৫৭৩-৭৭

[2]. মাওলানা গযনভীর আলোচনায় প্রভাবিত হয়ে একদা বিচারপতি মুহাম্মাদ রুস্তম কিয়ানী তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি আমার ক্ষমতা থাকত তাহলে আপনাকে ওকালতি করার লাইসেন্স দিয়ে দিতাম’ (মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা, অনুবাদ : নূরুল ইসলাম, পৃঃ ৯৮।-অনুবাদক

[3]. উক্ত অর্ডিন্যান্সের শিরোনাম ছিল- Anti-Islamic Activities  of Quadiani Group, Lohori Grour and Ahamadis (Prohibition and Punishment) Ordinance.-অনুবাদক।

[4]. এজন্যই আরবী প্রবাদে বলা হয়, كل شيء يرجع إلى أصله ‘প্রত্যেক জিনিস তার মূলের দিকে ফিরে যায়’।-অনুবাদক।






ইসলামী বিচার ব্যবস্থার কল্যাণকামিতা - শেখ মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, পাইকগাছা সরকারী কলেজ, খুলনা
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
পাপ মোচনকারী আমল সমূহ - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
ইয়াতীম প্রতিপালন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৪র্থ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
মুমিন কিভাবে দিন অতিবাহিত করবে - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার - মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
শারঈ মানদন্ডে ঈদে মীলাদুন্নবী - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কর্তব্য (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পাপাচার থেকে পরিত্রাণের উপায় সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.