নওদাপাড়া, রাজশাহী ১০ই এপ্রিল শনিবার : অদ্য বিকাল সাড়ে ৪-টায় ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে হাদীছ ফাউন্ডেশন গবেষণা কক্ষ থেকে ভার্চু্যয়াল লেখক সম্মেলন-২০২১ অনুষ্ঠিত হয়। মাসিক আত-তাহরীক-এর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আত-তাহরীক-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মন্ডলীর মাননীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। উক্ত সম্মেলনে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মুহিববুল্লাহ সিদ্দিকী এবং মাসিক আত-তাহরীক-এর সহকারী সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম।

প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, যেকোন লেখা মানসম্পন্ন হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। (১) ভাষা প্রাঞ্জল ও সাবলীল হওয়া। অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা সহজভাবে প্রকাশ করা। যাতে শ্রোতা শুনেই তা হৃদয়ঙ্গম করে নেয়। যেমন যদি বলা হয়, হে মাঝি! নৌকাটা দ্রুত ঘাটে আনো, তাহ’লে মাঝি সেটা বুঝবে। কিন্তু যদি বলা হয়, হে কর্ণধার! তরী ত্বরা তীরে ভিড়াও। তাহ’লে সে বুঝবে না। নৌকাও ঘাটে ভিড়বে না। (২) বক্তব্য সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার অর্থবোধক হ’তে হবে। যেন পাঠক তা শুনেই বুঝতে পারে। নইলে অর্থহীন বক্তব্য কখনো সাহিত্য হবে না। (৩) বানান ও ভাষা শুদ্ধ হ’তে হবে। নইলে শুরুতেই ভুল ধরা পড়লে পাঠক আর ভিতরে ঢুকতে চাইবে না। (৪) লেখা অলংকারপূর্ণ হ’তে হবে। দেহে অলংকার পরলে যেমন তার শোভা বৃদ্ধি পায়, ভাষায় অলংকার থাকলে তেমনি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। অলংকারহীন দেহের যেমন কোন আকর্ষণ থাকে না, অলংকারহীন ভাষারও তেমনি কোন আবেদন থাকে না। যেমন কোন ভাষণে যদি বলা হয়, হে নর ও মাদীগণ! এর দ্বারা হয়ত উদ্দেশ্য হাছিল হবে, কিন্তু সেটা অলংকারশূন্য হওয়ায় কেউ কথাটি গ্রহণ করবে না। বরং সেখানে অলংকার দিয়ে বলতে হবে, সম্মানিত ভদ্র মহোদয় ও মহিলাগণ! (৫) ভাষা মার্জিত ও সদুদ্দেশ্যপূর্ণ হ’তে হবে। যাতে পাঠকের সুকুমার বৃত্তিগুলি সচকিত হয়ে ওঠে। কেননা ‘সাহিত্য’ অর্থই হ’ল, ‘চিন্তাধারা ও কল্পনার সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত লিখিত রূপ’। মুখে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু লিখিতভাবে যাচ্ছেতাই বলা যায় না। বললে সেটা খিস্তিখেউড় হয়, সাহিত্য হয় না।

তিনি আরো বলেন, বাংলা ভাষাকে পৌত্তলিকতা মুক্ত করে তার আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা যেমন আমাদের জাতীয় কর্তব্য, তেমনি ইসলামের নামে শিরক ও বিদ‘আত যুক্ত সাহিত্য সৃষ্টি করা হ’তে বিরত থেকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক সাহিত্য রচনা করাও আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব নির্ভর করছে এর আদর্শিক তথা ইসলামী স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুন্ন রাখার উপরে এবং সাহিত্যের মাধ্যমে জনগণের ইসলামী চেতনাকে শাণিত রাখার উপরে। দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে আলেম সমাজকে স্ব স্ব মাতৃভাষায় পারদর্শী হ’তে হবে। তবেই দ্বীন বিজয় লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। মূলতঃ বাংলা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর তৈরী ভাষা নয়। এ ভাষা আল্লাহর সৃষ্টি। এ ভাষাতেই আমাদেরকে আল্লাহ্ প্রেরিত অহি-র বিধানের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে এবং ইলাহী সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মুহিববুল্লাহ সিদ্দিকী ‘কিভাবে গবেষণা মূলক লেখা প্রস্ত্তত করতে হয়?’ শীর্ষক আলোচনায় বলেন- তিনটি প্রশ্ন ও তিনটি উত্তর থাকলে তাকে গবেষণাপত্র বলা হবে। অর্থাৎ আমি কি করতে চাচ্ছি, কেন করতে চাচ্ছি এবং কিভাবে করতে চাচ্ছি। গবষেণাপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হ’ল, বিষয়বস্ত্ত নির্ধারণ করা (Selection of Title)। এটি সুন্দর হ’লে গবেষণা সুন্দর হবে। নইলে নয়। এক্ষেত্রে (ক) শিরোনাম স্পষ্ট ও সুন্দর হ’তে হবে। (খ) গবেষণার যৌক্তিকতা থাকতে হবে। (গ) সম সাহিত্য পর্যালোচনা। অর্থাৎ নিজের বিষয়বস্ত্তর নিকটবর্তী বিষয় সমূহে কোন গবেষণা হয়ে থাকলে সেগুলিকে যাচাই করে সেগুলির ত্রুটি নির্দেশ করে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বিষয় নিতে হবে। এক্ষেত্রে চুরি বেশী হয়ে থাকে। সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। (ঘ) প্রাইমারী সোর্স বা প্রাথমিক সোর্স অর্থাৎ নিজের দেখা বা সরাসরি সাক্ষাত। উল্লেখ্য, কুরআন-হাদীছ সর্বদা প্রাথমিক সোর্স। (ঙ) সেকেন্ডারী সোর্স। অর্থাৎ যখন প্রাথমিক সোর্স থেকে Modifid Version এসে যায়, তখন সেটি সেকেন্ডারী সোর্স হয়ে যায়। ইতিহাসের ক্ষেত্রে ইবনে বতুতার ইতিহাস প্রাথমিক সোর্স হিসাবে গণ্য। কেননা তিনি যা দেখেছেন, তাই লিখেছেন। (চ) উৎস থেকে তথ্য গ্রহণের জন্য একাধিক ভাষা জানতে হবে।

Methodology বা গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সামাজিক বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস গবেষণা পদ্ধতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য Source-কে সম্পূরক বা পরিপূরক সোর্স সমূহের মাধ্যমে নিজের মধ্যে তৈরী করতে হবে। অর্থাৎ Hypothesis-কে Synthesis করে Thesis-এ পরিণত করতে হবে। থিসিসে একই তথ্যসূত্র পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। একই থিসিসে একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করা যাবে না। এর জন্য শিকাগো ফরমেটটাই অধিকাংশের নিকট গ্রহণযোগ্য। তবে এ ব্যাপারে প্রত্যেকে স্বাধীন। বানানরীতির ক্ষেত্রেও একই রীতির অনুসরণ করতে হবে।

আত-তাহরীক-এর সহকারী সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম ‘লেখালেখির খুঁটিনাটি’ বিষয়ে বলতে গিয়ে একটি সুন্দর, কার্যকর ও পাঠকনন্দিত লেখা তৈরীর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর লক্ষ্য রাখতে লেখকদের প্রতি আহবান জানান।- ১. যে কোন বিষয়ে লেখার জন্য সে বিষয়ে বিস্তর লেখা-পড়া করে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে লিখতে হবে। ২. ভাল লেখার জন্য পান্ডুলিপি তৈরী করে রিভিশন দেওয়া বা বার বার পড়তে হবে। যেন লেখাটি নির্ভুল হয়। ৩. লেখার মাঝে কোন অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা থাকলে তা দূর করতে হবে। কারণ লেখক নিজে কোন বিষয়ে না বুঝলে তা পাঠকের বুঝতে কঠিন হবে। ৪. লেখাতে সঠিক শব্দের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা লেখাকে প্রাঞ্জল, সাবলীল ও শ্রুতিমধুর করে তোলে। ৫. লেখায় বিরাম চিহ্ন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। ৬. লেখার শিরোনামের সাথে আলোচ্য বিষয়ের মিল থাকা যরূরী। অন্যথা লেখা পড়তে পাঠকের মাঝে বিরক্তি আসবে এবং তা অগ্রহণীয় হবে। ৭. লেখায় বিদেশী কোন ভাষা উল্লেখ করা হ’লে তার সঠিক অনুবাদ উল্লেখ করতে হবে, যাতে পাঠকের বুঝতে কোন সমস্যা না হয়। ৮. গবেষণামূলক লেখার ক্ষেত্রে মূল উৎস থেকে সূত্র উল্লেখ করতে হবে। ৯. লেখা তৈরীর ক্ষেত্রে কোন লেখককে অনুসরণ করা যায়, কিন্তু তার লেখা হ’তে হুবহু তুলে দেওয়া যাবে না। ১০. যে কোন লেখার শুরু ও শেষ সুন্দর হওয়া উচিত। যাতে পাঠক লেখা পড়তে গিয়ে ভূমিকা পড়েই ঐ লেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে। তেমনি উপসংহার পড়ে যেন লেখার সারবস্ত্ত সংক্ষেপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। সর্বোপরি একটি ভাল লেখা উপহার দেওয়ার জন্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, যাতে লেখাটা সবার উপকারে আসে এবং তা পড়ে পাঠক আনন্দ পায়।

সভাপতির ভাষণে ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন ৪ঠা নভেম্বর ২০১৬ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ায় মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। উল্লেখ্য, সেবার সম্মেলন হয়েছিল সরাসরি। আর এবার হচ্ছে ভার্চু্যয়াল। তিনি লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, লেখালেখি হ’তে হবে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে। অন্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং নিজের দায়িত্ববোধ থেকে রিয়ামুক্ত হয়ে লিখতে হবে। তিনি বলেন, ভাল লেখক হ’তে হ’লে অবশ্যই ভাল পাঠক হ’তে হবে। নিজের লেখার পাঠক আগে নিজেকেই হ’তে হবে। সেই সাথে হ’তে হবে চিন্তাশীল। তিনি মাননীয় অতিথিবৃন্দ, আলোচকবৃন্দ ও অনলাইনে যোগদানকারী সম্মানিত লেখকগণকে ধন্যবাদ জানান।

উল্লেখ্য যে, উক্ত সম্মেলনটি অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় এবং তা ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানটি দু’টি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বে বাদ আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত অতিথিগণের বক্তব্য এবং বাদ মাগরিব থেকে রাত্রি ৮-টা পর্যন্ত ‘জুম এ্যাপে’র মাধ্যমে লেখকদের সাথে মতবিনিময় সভা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন হাদীছ ফাউন্ডেশন গবেষণা বিভাগ-এর পরিচালক ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব।






আরও
আরও
.