প্রাচীনকাল থেকেই ভূমিকম্প নিয়ে মানব মনে নানা রকম অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার আসন গেড়ে বসে আছে। অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক শ্রেণীর মানুষের বিশ্বাস, পৃথিবীটা গরু বা মহিষের মত শিংওয়ালা বিশাল আকৃতির কোন প্রাণীর মাথার উপর অবস্থিত। যখন সেই জন্তুটি নড়াচড়া করে, তখন এই পৃথিবীটাও নড়ে উঠে এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। তবে এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের আদৌ কোন শারঈ বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হ’ল, পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন স্তরের শিলাখন্ডের স্থিতিস্থাপকীয় বিকৃতির ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আর শারঈ বিশ্লেষণ হ’ল, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা গযব। এক্ষেত্রে বাহ্যতঃ বিজ্ঞান ও শরী‘আতের মধ্যে ভিন্ন মত মনে হ’লেও প্রকৃতপক্ষে দু’টির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে চলমান রীতির ব্যত্যয় ভাল বা মন্দ কিছু করতে চাইলে, তার জন্য নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রথমে উক্ত কর্মের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নেন। উদাহরণ স্বরূপ আল্লাহ কোথাও বৃষ্টি বর্ষণ করতে ইচ্ছা করলে আগেই সেখানে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় মেঘের সমাগম ঘটান তথা বৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। যখন বৃষ্টির একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখনই যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আবহাওয়া দপ্তর তার পূর্বাভাস দিতে পারে এবং দিয়েও থাকে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত সে সম্পর্কে পৃথিবীর কারো পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব হয় না। অনুরূপ কোথাও যখন আল্লাহ ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে চান, তখন সেখানকার ভূগর্ভস্থ মাটি বা শিলা স্তরে আল্লাহ নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ভূমিকম্পের উপযোগী পরিবর্তন আনয়ন করেন। আর তখনি তা ভূতত্ত্ববিদদের নযর বা যন্ত্রে ধরা পড়ে। ফলে তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা ঐ পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সুতরাং ভূমিকম্প সংক্রান্ত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও শরী‘আতের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে তথ্যগত কোন বৈপরীত্য নেই।
পাপাচারী, নাফরমান, অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী বহু জাতিকে ধ্বংস করতে মহান আল্লাহ দুনিয়ায় নানা ধরনের গযব দিয়েছেন। কাউকে বন্যা-প্লাবনের মাধ্যমে, কাউকে ঘৃণ্য জন্তুতে যেমন বানর-শুকরে পরিণত করে, কোন জাতিকে ঝড়-তুফানের মাধ্যমে, কাউকে বিকট শব্দ বা গর্জনের মাধ্যমে, কাউকে সাগর বা নদীতে ডুবিয়ে, কাউকে পাথর নিক্ষেপ করে, কাউকে বজ্রপাত ইত্যাদির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর এলাহী গযবের মূল কারণ হ’ল, আল্লাহর নাফরমানী বা সীমালঙ্ঘন। এ বিষয়ে নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আনছার ও মুহাজিরের দল! তোমাদেরকে পাঁচটি ব্যাপারে পরীক্ষায় ফেলে কষ্ট দেওয়া হবে। ...তার পঞ্চমটি হ’ল وَمَالَمْ تَحْكُمْ اَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ وَيَتَخَيَّرُوْا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ إِلاَّ جَعَلَ اللهُ بَأَسَهُمْ بَيْنَهُمْ. ‘যখন আলেম ও শাসকগণ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন কাঠামো পরিচালনা করবে না; বরং আল্লাহর দেওয়া বিধানের উপর নিজ ইচ্ছা প্রয়োগ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, দুরবস্থা, দরিদ্রতা ও দুর্যোগ চাপিয়ে দিবেন’।[1]
আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এরকম একটি ভয়ানক গযব হ’ল ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবী সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত পাপাচারী, বিভ্রান্ত ও সীমালঙ্ঘনকারী বহু জাতিকে মহান আল্লাহ ভূমিকম্পের মত ভয়াবহ গযব দিয়ে ধ্বংস করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি মাদইয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শো‘আয়েবকে প্রেরণ করেছি। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, শেষ দিবসের আশা রাখ এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি কর না। কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলল, অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হ’ল এবং নিজেদের গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল’ (আনকাবূত ৩৯/৩৬-৩৭)। একই বর্ণনা এসেছে আ‘রাফের ৯১নং আয়াতেও।
মূসা (আঃ) যখন বনী ইসরাঈলকে আল্লাহর কিতাব তাওরাত দিলেন, তখন তারা তাতে সন্দেহ পোষণ করল। তারা বলল, আমরা কেমন করে বিশ্বাস করব যে, এটা আল্লাহর কিতাব? তখন আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আঃ) আপন সম্প্রদায় থেকে বাছাই করা সত্তর জন লোক নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী তারা সকলে আল্লাহর কথা শুনল। এর পরও তারা বলতে লাগল, কে জানে, এ শব্দ আল্লাহর না অন্য কারও। তাদের এহেন ছলচাতুরি, মূর্খতা ও হঠকারিতার জন্য আল্লাহ ভূমিকম্পের মাধ্যমে তাদেরকে মেরে ফেললেন। যদিও মূসা (আঃ)-এর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে আবারো জীবিত করা হয়েছিল’ (আ‘রাফ ৭/১৫৫)।
অনুরূপ ‘ছামূদ’ জাতির প্রতি নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন ছালেহ (আঃ)। যখন তিনি আপন সম্প্রদায়কে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, তখন তারা তাঁকে অস্বীকার করল এবং বলল, যদি তুমি এই পাহাড় থেকে একটি উষ্ট্রী বের করে দেখাতে পার, তবে আমরা তোমাকে নবী হিসাবে মানব। আল্লাহর অসীম কুদরতে ছালেহ (আঃ)-এর মু‘জেযা হিসাবে বিশাল এক প্রস্তরখন্ড বিদীর্ণ হয়ে তাদের বর্ণিত গুণাবলী সম্পন্ন এক উষ্ট্রী আত্মপ্রকাশ করল। তখন ছালেহ (আঃ) বললেন, ‘হে আমার জাতি! আল্লাহর এ উষ্ট্রীটি তোমাদের জন্য নিদর্শন। অতএব তাকে আল্লাহর যমীনে বিচরণ করে খেতে দাও এবং তাকে মন্দভাবে স্পর্শও করবে না। অন্যথা অতি সত্বর তোমাদেরকে আযাব পাকড়াও করবে। তবু তারা এর পা কেটে দিল। তখন ছালেহ (আঃ) বললেন, তোমরা নিজ গৃহে তিনটি দিন উপভোগ করে নাও। এ এমন ওয়াদা, যা মিথ্যা হবে না’ (হূদ ১১/৬৪-৬৫)। ‘অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করল এবং স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে ছালেহ! যদি তুমি রাসূল হয়ে থাক, তবে যার ভয় আমাদেরকে দেখাতে তা নিয়ে এসো। অতঃপর তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে সকাল বেলা নিজ গৃহে তারা উপুড় হয়ে পড়ে রইল’ (আ‘রাফ ৭/৭৭-৭৮)। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ছামূদ জাতিকে আল্লাহ ভূমিকম্পের মাধ্যমে ধ্বংস করেন।
এছাড়াও ভূমিকম্পের মাধ্যমে আর যেসব জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের মধ্যে লূত (আঃ)-এর জাতি অন্যতম। তারা কাফের তো ছিলই। তাছাড়াও তারা এমন এক জঘন্য ও লজ্জাজনক অনাচারে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে তাদের উপর নেমে এসেছিল এক অবর্ণনীয় গযব। তারা পুরুষে-পুরুষে যেনা তথা সমকামিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল, যা তাদের আগে পৃথিবীতে আর কোন জাতি করেনি। একপর্যায়ে ঐ জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা মহা প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভে বিলীন করে দেন। বর্তমান যুগেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেসব ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হচ্ছে, তারও মূল কারণ সীমাহীন পাপাচার। মানুষের পাপের কারণে যে ভূমিকম্প সদৃশ গযব হয় তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছ।
আবু মালিক আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার কিছু উম্মত মদ পান করবে এবং তার নাম রাখবে ভিন্ন। তাদের নেতাদেরকে গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সম্মান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভূমিকম্পের মাধ্যমে মাটিতেই ধসিয়ে দিবেন। আর তাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করবেন’।[2]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীছে রাসূল (ছাঃ) ক্বিয়ামতের পূর্ব লক্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে ১৬টি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে চতুর্থ বিষয় হ’ল وَتَكْثُرَ الزَّلاَزِلُ ‘ভূমিকম্প বেড়ে যাবে’।[3]
ভূমিকম্প শুধু ক্বিয়ামতের পূর্ব লক্ষণই নয়, মহা প্রলয় তথা ক্বিয়ামতের দিন মহাবিশ্বের একমাত্র মহান অধিকর্তা পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস করে দিবেন এই ভূমিকম্পের মাধ্যমে। সেদিন পৃথিবী কঠিনভাবে প্রকম্পিত হবে। যার ফলে ভূগর্ভস্থ সবকিছু উপরে উঠে আসবে। এহেন চরম পরিস্থিতি দেখে মানুষেরা বলতে থাকবে এর কী হ’ল? সেদিন এই পৃথিবী প্রতিপালকের নির্দেশে তার সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করে দিবে। যে বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে সূরা যিলযালসহ অন্যান্য স্থানে।
মানব সভ্যতা সৃষ্টির পর খৃষ্টপূর্ব সাতশ’ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাযারটি প্রলংঙ্করী ভূমিকম্পের তথ্য পাওয়া যায়।[4] ৩৪২ সালে তুরস্কের আন্টাকিয়ায় এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ৪০০০ লোক। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ১৫৫৬ সালে চীনের চাংচি অঞ্চলে সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে। মৃতের সংখ্যা ছিল ৮ লক্ষের উপরে। তাছাড়া ১৯২০ সালে জাপানে সংঘটিত ভূমিকম্পে মারা যায় ২ লাখ মানুষ। তিন বছরের মাথায় ১৯২৩ সালে সেদেশে আরেক ভূমিকম্পে নিহত হন প্রায় দেড় লাখ মানুষ এবং ধ্বংস হয় প্রায় পাঁচ লাখেরও অধিক ঘরবাড়ি। ১৯৬৪ সালে ঐ জাপানের নিগটা অঞ্চলে আবারো ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ কারণে এক সময় জাপানকে ‘ভূমিকম্পের দেশ’ বলা হ’ত।
ভারতবর্ষেও ভূমিকম্প নেহায়েত কম হয়নি। এখানেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। যেমন ১৮০৩ সালে কুমায়ুনে, ১৯০৫ সালে হিমাচল প্রদেশের কাংড়ায়, ১৯২৪ সালে কাশ্মীরের শ্রীনগরে, ১৯৩৪ সালে বিহারের মুঙ্গেরে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। নিকট অতীতেও বিহারে (১৯৮৮), কাশীতে (১৯৯১), মহারাষ্ট্রে (১৯৯৩) ও জববলপুরে (১৯৯৭) ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। জববলপুরের ভূমিকম্পে প্রায় পঞ্চাশ হাযার লোকের মৃত্যু হয়।
আধুনিক বিশ্ব ভূমিকম্পের কারণ, উপৎত্তিস্থল, প্রকৃতি, মাত্রা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিভিন্নমুখী গবেষণা শুরু করেছে। ভূ-তত্ত্ববিদ মি. এইচ. এফ. রিড ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যখন শিলাস্তরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর অধিক চাপ সৃষ্টি হয়, তখনই সে শিলাস্তর সঞ্চিত চাপমুক্ত করতে শিলাচ্যুতির মাধ্যমে ভূ-আন্দোলনের সৃষ্টি করে এবং তখনই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। ভূমিকম্প উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হয়েছেন এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ভূমিকম্প মাপক যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের Epicentre (উপকেন্দ্র) নির্ণয় করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে এবং এর দ্বারা সম্ভাব্য ভূমিকম্পের স্থল বা বলয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে।
২০০১ সালের আগষ্টে আমেরিকার ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনে ভারত ও আমেরিকার কয়েকজন বিশিষ্ট ভূ-তত্ত্ববিদের যৌথ বরাতে ভূমিকম্পের উপরে একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত দু’শ বছরের মধ্যে হিমালয়ের শিলাস্তরের প্লেটের দু’টো সীমার মধ্যে কোন বিচ্যুতি ঘটেনি। তাদের বিশ্লেষণে নিকট ভবিষ্যতে হিমালয়ের শিলাস্তরের বিচ্যুতি ঘটবে। তখন প্রায় পাঁচ কোটি জনবসতি অঞ্চল জুড়ে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। রিপোর্টে ভারতীয় প্রতিনিধি প্রফেসর বিনোদ গোড় বিষয়টির প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন, This is not a prediction, it is an assessment based on logical assumptions and buttressed by arguments based on field data.
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশেও বেশ ঘন ঘন মৃদু ভূমিকম্প সংঘটিত হচ্ছে, যা খুব একটা ভাল লক্ষণ নয়। বরং দেশের জন্য চরম অশনি সংকেত। কারণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বিচারে বাংলাদেশ মারাত্মক ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেকোন মুহূর্তে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হ’লে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরে ১ কোটিরও বেশি মানুষের প্রাণহানি এবং ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হ’তে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। অতিসম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকটি মৃদুভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। রিক্টার স্কেলে যার সর্বোচ্চ মাত্রা ৪.৮ বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানান হয়েছে। যার ফলে দু’একটি ভবনে ফাটল ছাড়া কোথাও তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আগামী দু’এক বছরের মধ্যে এখানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হ’তে পারে। বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, রিক্টার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হ’লেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বড় বড় শহরের প্রায় সব ভবনই পুরোপুরি ধ্বসে পড়তে পারে। এ ভূমিকম্পে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হ’তে পারে তা কল্পনাতীত। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা শহর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ‘দ্যা ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকা ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী বিশ্বের দ্বিতীয় শহর হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশই বন্যা, সাইক্লোন, নদী ভাঙ্গন, ভূমি ধ্বসসহ নানা প্রাকৃতিক ঝুঁকির মুখে অবস্থান করছে। অস্বাভাবিক হারে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির ফলে দেশে প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ঘটছে সিডর, আইলার মত মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তাছাড়া পাহাড় ধ্বসের ঘটনা তো আছেই। পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে রূপান্তর করার ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বে ভূমিকম্পপ্রবণ যে তিনটি এলাকা রয়েছে তার মধ্যে ‘মেডিটেরিনিয়েন ট্রান্স এশিয়াটিক আর্থকোয়েক বেল্ট’ একটি। এটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করেছে। সেই হিসাবে প্রায় দেড় কোটি অধিবাসীর ঢাকা মহানগর ভূমিকম্প নামক টাইম বোমাতঙ্কে গণমৃত্যুর কিনারে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
গত ১০ই সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের ভূমিকম্পটি ঢাকার বিপন্নতাকে আবারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। ৪ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্প ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক পূর্বাভাস তথা এলাহী হুঁশিয়ারি। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভূমিকম্প ও সুনামি প্রস্ত্ততি বিষয়ক প্রকল্পের জাতীয় বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর মাকসুদ কামাল বলেন, ‘দেশে ছোট ছোট যে ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে, এগুলো বড় ভূমিকম্পের পূর্ব সংকেত’। শুধু বিজ্ঞানী বা ভূতত্ত্ববিদরা নয়, মহান আল্লাহ পনেরশ’ বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি তাদেরকে অবশ্যই গুরু শাস্তির পূর্বে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদা ৩১/২১)। সুতরাং বাংলার মুসলমান সাবধান!
রাজধানী ঢাকা যতটা না প্রাকৃতিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মানবসৃষ্ট কারণে। দুর্বল স্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা; এক কথায় ভবন নির্মাণে সর্বমুখী দায়িত্বহীনতার জন্যই ঢাকা মহানগর এত বিপন্ন। আবাসন ব্যবসায়ীরা বিল-ঝিল, নদী-নালা, জলাশয় ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে অধিক মুনাফার আশায় কম খরচে ভবন নির্মাণ করে এই বিপন্নতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবছর বিশ্বে বড় দু’টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে গেল। একটি হাইতিতে, অন্যটি চিলিতে। জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সাথে সাথে পার্লামেন্ট ভবন, সরকারী ব্যাংক ভবন, হোটেলসহ সরকারী-বেসরকারী অন্যান্য অফিস ভবন নিমিষে ভূমিসাৎ হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পরে চিলিতে হাইতির চেয়েও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। অথচ সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা মাত্র এক হাযার। কারণ চিলিতে ইমারত নির্মাণে নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।
বাস্তবতা এই যে, নিকট অতীতে বিশ্বে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় এই চিলিতে, ১৯৬০ সালে। এরপর থেকে মাত্র ৫০ বছরে চিলি খুবই আধুনিক ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে। যার ফলে এবছর হাইতির চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার পরও চিলিতে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম। অপরদিকে হাইতিতে কোন ইমারত নির্মাণ বিধিমালাই নেই এবং সেখানকার ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধক করেও নির্মাণ করা হয়নি। যে কারণে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এত বেশি হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থা হাইতির চেয়ে কোন অংশে উন্নত নয়। অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্প সহনীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর উপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের একটি সংস্থা আইএসডিআর বলেছে, ঢাকার বৃহৎ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসরণ করা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচীর (সিডিএমপি) পক্ষ থেকে ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখ ভবনকেই ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। এমত পরিস্থিতিতে দেশে বড় মাত্রার কোন ভূমিকম্প হ’লে ঢাকা যে দ্বিতীয় হাইতিতে পরিণত হবে, এতে কোনই সন্দেহ নেই।
দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য মূলতঃ আমরাই দায়ী। আমরা নিজ হাতে আমাদের বিপদ ডেকে এনেছি। ঢাকায় যেভাবে নিম্ন জলাভূমি ভরাট করে বিরাট বিরাট সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোই তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একই মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার মাটিতে যে তীব্রতা অনুভূত হবে, ঐসব নরম মাটিতে তা অপেক্ষা বেশি অনুভূত হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। এ বিষয়ে সকল বিশেষজ্ঞ একমত যে, ভূমিকম্পে ঢাকার সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ ভরাট করা জমিতে নিম্ন মানের ভবন তৈরি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আরজুমান্দ হাবীব বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ঝুঁকির চেয়ে ঢাকার বড় বিপদের কারণ হবে মানুষের সৃষ্ট ঝুঁকি। যেখানে-সেখানে খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ভরাট করে যেসব বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো তো বড় কোন ভূমিকম্পে টিকবে না।
এমত পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? আমরা যেহেতু মুসলমান, সেহেতু একথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ছোট হোক বড় হোক, সকল ভূমিকম্পই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা গযব। সেকারণ আমাদের সার্বিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সর্বশক্তিমান রাজাধিরাজ আল্লাহ প্রেরিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করাই হবে ভুমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূল প্রতিকার। অতঃপর সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হ’ল ভূমিকম্পের বিষয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। তার জন্য প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারীভাবে নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। অতঃপর বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহের আদলে ভূমিকম্প সহনীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন করা এবং তা বাস্তবায়নের বাস্তবসম্মত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বর্তমানে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে সেগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে সেগুলো অপসারণ বা মেরামতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাথে সাথে ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে। এতে অন্তত প্রাণহানির পরিমাণ কিছুটা হ’লেও কমবে। অপরদিকে ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সর্বদা প্রস্ত্তত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই এ সকল সেক্টর সক্রিয় ও শক্তিশালী করা একান্ত যরূরী।
ঢাকা মহানগরের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে মনে পড়ে গ্রিক উপকথার অন্ধ জ্ঞানী তাইরেসিয়াসের অসহায় পরিস্থিতির কথা, যিনি বিপদের আভাস পান, কিন্তু প্রতিকারের ক্ষমতা তার নেই। জেনেশুনে লাখ লাখ মানুষকে ভয়াবহ মৃত্যুর মুখে ফেলে রাখার চেয়ে বড় দায়িত্বহীনতা আর কী হ’তে পারে? তাই জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তা অপসারণ অথবা সংস্কার করা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করণ এবং দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সংগ্রহ, দক্ষ জনবল সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যাপক গণসচেতনতামূলক কর্মসূচীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সর্বোপরি সমস্ত পাপাচার ও ঘৃণ্য কর্ম হ’তে বিরত থেকে মহান আল্লাহর হুকুম মত যিন্দেগী যাপন করতে হবে, তাহ’লে ইনশাল্লাহ আমরা ভূমিকম্পের মত মহা দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা পেতে পারি। আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র হেফাযতকারী!!
আবু ছালেহ
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯, হাদীছ হাসান।
[2]. বুখারী, ইবনু মাজাহ, হা/ ৪০২০।
[3]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/৫৪১০।
[4]. আফতাব চৌধুরী, ‘ভূমিকম্প পূর্বাভাস এবং করণীয়’, দৈনিক ইনকিলাব, ৩১ জুলাই, ২০১০, পৃঃ ৮।