১৯৫৫
সালের ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরের ১৭ই এপ্রিল
(মোতাবেক ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৩৬২) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দিনাজপুরের নওরোজ
সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উপর যে বক্তৃতা
দেন, যা এযাবৎ অগ্রন্থিত ছিল, সেটি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-
নওরোজ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতা
সমবেত সাহিত্যিক বন্ধুগণ,
আমার সশ্রদ্ধ তসলীমাত এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। বহু সাহিত্যসভায় ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছি। আমি পুরোনো হয়ে গেছি; আমার কথাও পুরোনো হয়ে গেছে। খোদা জানেন কবে আমার কথা ফুরিয়ে যাবে। তাই আজ আমি কিছু নতুন কথা, কিছু কাজের কথা বলতে চাই। আশা করি, সেগুলো একেবারে অরণ্যে রোদন হবে না।
পূর্ব বাংলায় ‘সাহিত্যসভা’ বিভিন্ন যেলায় আছে। এক ঢাকা শহরেই কয়েকটি আছে। আপনাদের এই সাহিত্যসভাও একটি সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গোটা পূর্ব পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি নেই। যখন আমরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই, তখন এই কেন্দ্রীয় সমিতির অভাব কি লজ্জা ও দুঃখের বিষয় নয়? অবশ্য এই কেন্দ্রীয় সমিতি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাতেই হবে। কিন্তু সেজন্য সব পূর্ববঙ্গবাসীর ঐকান্তিক আগ্রহ ও সহানুভূতি দরকার। ঢাকা শহরে উর্দূভাষী অল্পসংখ্যক ভাই আঞ্জুমানে তরক্কীতে উর্দূর পূর্ব পাকিস্তান শাখা স্থাপন করে ধুমধামের সঙ্গে তার কাজ চালাচ্ছেন। কিন্তু আমরা এমনই হামবড়া ও খোদগরজ যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকায় এ পর্যন্ত একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি গঠন করতে সক্ষম হইনি। দুই বছর আগে এই উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরে পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমিতি গঠন করা হয়েছিল। সেটি এখনো জীবিত আছে বটে; কিন্তু দলাদলি ও নিজ নিজ প্রাধান্যের ফলে সেটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি হতে পারছে না। আমি মনে করি, ঘরে ঘরে সাহিত্য সমিতি থাকতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি অবশ্য চাই, যার শাখা প্রতিটি যেলায় থাকবে। এই কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতির একটি স্থায়ী কার্যালয় ও একটি মুখপত্র থাকবে। মোটকথা, কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতো আমাদের এই কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি হওয়া চাই। পশ্চিমবঙ্গের আড়াই কোটি বাংলাভাষী যা করতে পারে, পূর্ববঙ্গের সাড়ে চার কোটি বাংলাভাষী কেন তা করতে পারবে না? গাছের কান্ড না থাকলে শাখা-প্রশাখা থাকতে পারে না। সাহিত্য মহিরুহের সেই কান্ড হবে কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি।
আমরা বাঙালী মুসলমান বড়ই বাক্যবাগীশ আর নেহাত কর্মবিমুখ। আমরা প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে আমাদের মাতৃভাষা আর সাহিত্যের ভাষা নিয়ে অনেক বিতন্ডা ও পরীক্ষা করে আসছি। বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক ভাষা, এমনকি হরফ ও বানান নিয়েও নানা বাগাড়ম্বর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খতিয়ান করে দেখলে আমরা বুঝব, আমরা পাঁয়তারাই করেছি, কোনো কাজের মতো কাজ করিনি।
‘বাঙ্গালা গদ্য সাহিত্যের উৎপত্তি’ প্রকৃত প্রস্তাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের স্থাপনকাল ১৮০০ খৃষ্টাব্দ থেকে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও হিন্দু ভাইয়েরা যে বিপুল সাহিত্য রচনা করেছেন, তার তুলনায় মুসলমান রচিত সাহিত্য সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের মতো। এ কলঙ্ক যদি আমরা আজাদ পাকিস্তান লাভের পরও ঘোচাতে না পারি, তাহলে আমাদের আজাদির মূল্য কী? আমাদের মনে রাখতে হবে জাতির স্থায়ী গৌরব তার সাহিত্যে। তার রাষ্ট্রীয় আয়তনে, জনবলে, ধনবলে বা অস্ত্রবলে নয়। সেই প্রাচীন গ্রীক কোথায়? কিন্তু হোমার, হেসিয়ড, আনাক্রিয়ন, সাফফো, ইউরিপাইদিস, সোফোক্লিস, হিরোডোটাস, যিনোফোন, প্লতার্থ, সক্রেটিস, এরিস্টটল, যেনো, ইউক্লিড, হিপোক্রেটিস, গালেন, মার্কস অরেলিউস, এপিকটেটাস প্রমুখকে সভ্য জগৎ চিরদিন সশ্রদ্ধ স্মরণ করবে। সেই প্রাচীন আর্য জাতি কোথায়? কিন্তু তাদের বেদ, উপনিষদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত, কালিদাস, ভবভূতি, মাঘ, শ্রীহর্ষ, ভারবি, জয়দেব, বানভট্ট, আর্যভট্ট, কহলন, পাণিনি, চরক, শুশ্রুত প্রমুখ চিরদিন সম্মান পাবেন। কাজেই আমরা যদি স্থায়ী গৌরব অর্জন করতে চাই, তাহলে আমাদের সমুন্নত সাহিত্য রচনা করতে হবে।
চলচ্চিত্তং চলদ্বিত্তং চলজ্জীবন যৌবনম্।
চলাচলং সবর্বমিদং কীর্তির্যস্যস জীবতি \
উর্দু, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, নেপালি, মৈথিলি প্রভৃতি পাক-ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাই প্রাচীনতম। তার কারণ খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে দক্ষিণবঙ্গে নাথ পন্থার উৎপত্তি। কালু পা, ধাম পা, ভুসুকু, কুক্কুরী পা, চোম্বী পা প্রমুখ নাথ সিদ্ধাচার্য প্রাচীন বাংলা ভাষায় তাঁদের চর্যাগীতি রচনা করেছিলেন। তারপর মধ্যযুগে গৌড়ের সুলতান ও রাজপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি এবং উন্নতি হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের দান হিন্দুর অপেক্ষা ন্যূন নয়, বরং এক বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। এই যুগের সাহিত্যে মুসলমানরাই লৌকিক বা মানবীয় বিষয়বস্ত্ত আমদানি করে। আধুনিক যুগে ইংরেজী ভাষার সংস্রবে এক বিরাট সমুন্নত সাহিত্য বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়ার সব ভাষার সব লেখকের মধ্যে একমাত্র বাঙালী রবীন্দ্রনাথই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এক বিষয়ে বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত দরিদ্র। সেটি হচ্ছে মুসলিম সাহিত্য। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বইয়ের বড়ই অভাব। আমাদের সেই অভাব পূরণ করতে হলে সর্বপ্রথম আরবী, ফারসী ও উর্দূ থেকে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিবিষয়ক মূল্যবান পুস্তকগুলোর অনুবাদ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। এই বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য দ্য ওরিয়েন্টাল পাবলিকেশন কো-অপারেটিভ সোসাইটি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, জনসাধারণের সহানুভূতির অভাবে এই সমিতি এ পর্যন্ত কোনো অনুবাদ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়নি।
কেবল সাহিত্য রচনা বা অনুবাদ নিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না। আমি ১৩২৫ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্রে প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় যা লিখেছিলাম, এই দীর্ঘকাল পর প্রয়োজনবোধে সেই কথা আবার উদ্ধৃত করছি- ‘বাংলায় কত পীরের আস্তানা, কত ভগ্নস্তূপ, কত প্রাচীন বংশপ্রবাদ, কত লৌকিক কিংবদন্তী, কত প্রাচীন পুঁথি, তার অতীত কাহিনী বলতে গেলে উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। কিন্তু শ্রোতা কোথায়? আমরা চাই সেসব কাহিনী শুনতে ও শোনাতে’।
তারপর লোকসাহিত্য সংগ্রহ। পরলোকগত শ্রদ্ধেয় দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয়ের প্রচেষ্টায় এই পূর্ববঙ্গ থেকে ৫৪টা গাথা সংগৃহীত হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই মুসলমানের রচনা। সন্ধান করলে আরও অনেক গাথা আবিষ্কৃত হতে পারে। তারপর ছড়া, মুর্শেদী গান, মেয়েলী গান, জারিগান, বারোমাসি কবিতা, প্রবাদ বাক্য, উপকথা- কত না লোকসাহিত্য দেশের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কালের কর্মনাশা বাংলাতে সেগুলো লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সেগুলো সংগ্রহ করে আমাদের প্রকাশ করতে হবে।
সবচেয়ে যরূরী কাজ হচ্ছে, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ। গৃহদাহ, কৃমিকীট, জলপাবন প্রভৃতি দুর্ঘটনায় এবং অযত্নে অনেক মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো যেগুলো আছে, সেগুলো অবিলম্বে আমাদের সংগ্রহ করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতির কাজ হবে এসব সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। প্রতি যেলার সাহিত্য সমিতি অনায়াসে এ কাজে হাত দিতে পারে। বিশেষ করে ‘নওরোজ সাহিত্য সমিতি’র কর্তব্য হচ্ছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি অষ্টাদশ শতাব্দীর হায়াত মামুদের গ্রন্থাবলী সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।
সাহিত্যিক বন্ধুরা, আমি কয়েকটি কাজের কথা বললাম। জানি না আমি আমার জীবদ্দশায় এসব কাজের কোনো সূচনা দেখতে পাব কি না। একটি সরকারী বাংলা একাডেমী থাকলে এসব কাজ অনায়াসে হতো। কিন্তু কবে তা সম্ভব হবে কে জানে? তবে আমি এ কথা নিশ্চিত জানি যে বাংলা ভাষা কখনো পূর্ব পাকিস্তান থেকে লুপ্ত হবে না। আমি আরও বিশ্বাস করি, পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা জনবহুল এবং স্বাস্থ্যবান পূর্ববঙ্গ সাহিত্যক্ষেত্রে একদিন অগ্রণী হবেই হবে।
(সংকলিত)
[আল্লাহ বলেন, অধিকাংশ মানুষই ঝগড়াপ্রিয় (কাহফ-মাক্কী ১৮/৫৪)। মুসলমানদের মধ্যে এর প্রবণতা যেন অন্যের চাইতে একটু বেশী। তার কারণ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯ খৃ.) নিজেই বলেছেন যে, তারা হ’ল ‘হামবড়া ও খোদগরজ’ অর্থাৎ দাম্ভিক ও স্বার্থপর। তাঁর মত একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে পেয়েও এদেশের সাহিত্যিকরা ঐক্যবদ্ধ হ’তে পারেননি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিষয়টি শিক্ষণীয় বটে! উল্লেখ্য যে, ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গে’র পর বাংলা একাডেমীর বর্তমান ভবন নির্মিত হয়। যা ১৯১৯ সাল থেকে ‘বর্ধমান হাউজ’ হিসাবে পরিচিত হয় (স.স.)।]