তুরস্কের
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, ২০২০ সাল বিশ্বের অনেক দাম্ভিক
নেতার জন্য দুঃসময়। ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত ও অপদস্থ। ইসরায়েলের
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুর্নীতির মামলায় পদ হারানোর ঝুঁকিতে।
ভারতের নরেন্দ্র মোদি কিংবা ব্রাজিলের বলসোনারো ভেতর-বাইরের সমস্যায়
জর্জরিত।
এত সব ধূসর কাহিনীর মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের গল্পটা সত্যিই সোনালী। ট্রাম্পের মতো নেতার গর্বের বেলুন চুপসে গেলেও এরদোয়ানের বুকের পাটা ফুলেই চলেছে। গত কয়েক বছরে যতগুলো ফ্রন্ট তিনি খুলেছিলেন, সব ক’টি থেকে বিজয়ের ফসল ঘরে তুলেছেন তিনি এই ২০২০ সালেই। সিরীয় ফ্রন্টে কুর্দ, আইএস ও আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে তুরস্ক বড় বিজয় পেয়েছে। সিরীয় রণাঙ্গনে রুশ-তুর্কি মৈত্রীরত মহড়াই কাজে লেগেছে আযারবাইজানের হয়ে লড়া যুদ্ধে। সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো আযারবাইজানেও সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে যাচ্ছে তুরস্ক। আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানের ঐতিহাসিক জয় এবং নাগন্যো-কারাবাখ মুক্ত করার অন্যতম কারিগরও তুরস্ক এবং তার প্রধান দুই অস্ত্র এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষ ও তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত ড্রোনের ভেলকি। এ ঘটনা তুরস্কের সামরিক সম্মান অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এ মাসেই চালু হয়েছে পাকিস্তান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলমুখী ট্রেন।
তুর্কি খেলাফতের আমলের আর্মেনীয় গণহত্যার সময় থেকেই আর্মেনিয়ার সঙ্গে তুরস্কের শত্রুতা। পুরোনো শত্রুতা এবারের নাগন্যো-কারাবাখের যুদ্ধে তুরস্ককে আযারবাইজানের পক্ষে ঝুঁকি নিতে প্ররোচিত করেছে নিশ্চয়ই। তাতে এক ঢিলে আহত হয়েছে দুই পাখি আর্মেনিয়া ও ফ্রান্স। লিবিয়ার মতো এখানেও তুরস্কের বিপক্ষে ছিল প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ফ্রান্স। অনেকে একে ইসলাম ধর্ম নিয়ে মাখোঁর কটূক্তির জবাব হিসাবে দেখছেন।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক বিজয়ের আরেকটা ময়দান হ’ল তুর্কি সাইপ্রাস। ১৯৭৪ সালে তুরস্ক সাইপ্রাসের কিছু এলাকা দখল করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে। যদিও এর কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। গত মাসে তুর্কি সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এরদোয়ানপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা এরসিন তাতার। তাতার ওছমানীয় সাম্রাজ্যের সময়ের মতো তুরস্কের সঙ্গে একীকরণ চান।
একের পর এক ফ্রন্ট খোলার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জড়িয়ে পড়েছেন নতুন ‘গ্রেট গেমে’; যার নাম ট্রান্সককেশিয়া বা ইউরেশিয়া জোট। এই জোট এখনো হয়নি, কিন্তু হওয়ার পথে। আর তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে তুরস্ক। আযারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়াকে ঘিরে এই গ্রেট গেম পুরানো আরেকটা গ্রেট গেমের জের বয়ে চলছে। এর কথা প্রথম বলেছিলেন বাংলা দখলকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেফটেন্যান্ট আর্থার কনোলি। পরে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর কিম উপন্যাসের মাধ্যমে একে ব্রিটেনের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ ম্যাকাইন্ডার চমৎকারভাবে এই অঞ্চলের গুরুত্বের সমীকরণটা করেন; যে পূর্ব ইউরোপ শাসন করবে, সে শাসন করবে মূল ইউরোপ। যে ইউরোপ-এশিয়া শাসন করবে, সে শাসন করবে বিশ্বকে।
আর্মেনিয়াকে পরাস্ত করা এবং আযারবাইজানকে পক্ষপুটে নেওয়ার পর বসে থাকেনি তুরস্ক। বাংলাদেশ ঘুরে গত ২৫শে ডিসেম্বর ইউক্রেন সফর করেন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আযারবাইজানের কারাবাখ বিজয়ের পর ইউক্রেনও তলে তলে রাশিয়ার কবজা থেকে তার ক্রিমিয়া অঞ্চল পুনরুদ্ধারে উৎসাহী। তাই তুর্কি ড্রোন তারও দরকার। ইউক্রেনের এলিট মহল তুরস্ককে বিশেষ প্রীতির চোখে দেখছে। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ৫০টি যৌথ সামরিক প্রকল্প, রয়েছে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি। তুরস্ক রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের স্বীকৃতি যে দেয়নি, এটাই ইউক্রেনকে তুরস্কের কাছে নিয়ে গেছে। ইউক্রেন অনেকগুলো সামরিক প্রযুক্তির বিষয়ে তুরস্কের মূল অংশীদার। সোভিয়েত আমল থেকে ইউক্রেন সমরাস্ত্র প্রযুক্তিতে এগিয়ে। তুরস্কের যা দরকার, তা দেওয়ার ক্ষমতা ইউক্রেনের আছে বলে তুরস্ক দেশটির সামরিক গবেষণায়ও তহবিল জোগাচ্ছে।
ক্রিমিয়ার তাতার জনগোষ্ঠী তুর্কি রাজনীতিতে প্রভাবশালী। আর তুরস্কও চায় পূর্ব ইউরোপজুড়ে বিরাজ করা তুর্কি প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি আরও বাড়াতে। একসময় বলকান ও ককেশীয় অঞ্চল ওছমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই এই অঞ্চল তার হাতছাড়া হ’তে থাকে। ফলে নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হন তুর্কিভাষী মুসলমানরা। স্বাভাবিকভাবেই তুরস্কের প্রতি তাদের মমত্ব থাকবে, যেমনটা দেখা যায় আযারবাইজানে।
এভাবে রাশিয়ার দোরগোড়ায় যে তুরস্ক পৌঁছে যাচ্ছে, তা কি পুতিন-এরদোয়ানের বন্ধুত্বে চিড় ধরাবে? মনে হয় না। কারণ তুরস্ক তার সীমাটা জানে। রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া নয়, দর-কষাকষি করাই তার উদ্দেশ্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা একা রাশিয়ার দ্বারা পূরণ হওয়ার নয়। পুতিন এটা জানেন ও মানেন। নইলে আযারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধে প্রকারান্তরে আযারবাইজানের পক্ষে তাঁর থাকার কথা ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে যে কারণে রাশিয়া ও তুরস্ক মৈত্রীমূলক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, ককেশীয় গ্রেট গেমে সে কারণেই তুরস্ককে কিছুটা জায়গা দিচ্ছে তারা। উদ্দেশ্য, তুরস্ককে ন্যাটোর বলয় থেকে চীন-রাশিয়ার বলয়ে আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। মার্কিন বিরোধিতা সত্ত্বেও রুশ এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুরস্ককে দেওয়ার উদ্দেশ্যও সেটাই।
ককেশীয় অঞ্চলের যে দিকটায় কৃষ্ণসাগর, সেই সাগরের পারেই রয়েছে তুরস্ক। যদি তুরস্ক কৃষ্ণসাগরের তেল-গ্যাস তুলে ধনী হ’তে চায়, তবে দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হবেই। ইতিমধ্যে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক উপভোগ করছে তুরস্ক। এই পটভূমিতে দেখলে ককেশীয় গ্রেট গেমে তুরস্কের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলই মনে হয়। এতগুলো ফ্রন্টে এতভাবে সদা জাগ্রত থাকার জন্যই বলা হয়, ‘নতুন তুর্কি সুলতান কখনো ঘুমান না’।
ফারুক ওয়াসিফ
\ সংকলিত \