অবশেষে বিশ্বের তুমুল চাপের মুখে এ যুগের নব্য হালাকু খান অথবা হিটলার নামে আখ্যায়িত মিয়ানমার সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং এবং জাতিগত নিধনের আরেক মহানায়ক কথিত গণতান্ত্রিক (?) নেত্রী সে দেশেরই স্টেট কাউন্সিলর অংসান সুচি বহির্বিশ্বের নিকট নাকানি-চুবানী খেয়ে বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা ফেরৎ চুক্তি করতে বাধ্য হ’ল। চুক্তি অনুযায়ী তারা আগামী দুই মাসের মধ্যে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিবে। দু’রাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত এই সমঝোতা চুক্তিতে তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২৩শে নভেম্বর’১৭ বৃহস্পতিবার দুপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দপ্তরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিকেলে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সমঝোতা স্বাক্ষরের বিষয়টি জানানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় বলা হয়, ২২শে নভেম্বর’১৭ সকালে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে উভয় দেশের কর্মকর্তারা খসড়া সমঝোতাটির বিষয়ে একমত হন। ২৩শে নভেম্বর বিকালে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের ইউনিয়ন মিনিস্টার চ টিন্ট সোয়ে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী গত ২৫শে নভেম্বর ঢাকাস্থ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, মিয়ানমারের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর বিষয়ে ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তি তারা (মিয়ানমার) অনুসরণ করতে চায়। সেভাবেই জিনিসটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া। এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, এটা নেই, সেটা নেই, এসব বলে লাভ নেই। অথচ ইতিপূর্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, ১৯৯২ সালের এই চুক্তি অনুসরণযোগ্য নয়।
জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালের ৯ই অক্টোবর সেনা অভিযানের মুখে প্রায় ৮৬ হাযারের বেশী রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। আর ২০১৭ সালের ২৫শে আগষ্টের পর সে দেশের সেনা ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লোমহর্ষক নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচানোর তাকীদে সোয়া ছয় লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী ৯ই অক্টোবর’১৬ ও ২৫শে আগষ্ট’১৭-এর পরের আশ্রয়গ্রহণকারী বাস্ত্তচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরৎ নিবে। মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্ধারিত কোন কোন সময়সীমা নেই (?)। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো টাইম ফ্রেম দেওয়া যায় না। প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার হ’ল এরকম কোনও টাইম ফ্রেম দিয়ে কোন লাভও নেই। মন্ত্রী জানান, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের আগে ফেরৎ পাঠানো হবে। আর এর আগে থেকে যারা আছে (প্রায় তিন লাখের মত) তাদের ফেরৎ পাঠানোর ব্যাপারে পরে বিবেচনা করা হবে। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে ফেরৎ নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের সাবেক আবাসস্থল বা পসন্দ অনুযায়ী কাছাকাছি কোন স্থানে পুনর্বাসিত করা হবে। এছাড়া যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে। তবে যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ার জটিলতা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৭৮ সালে দু’দেশ চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির অধীনে ২ লাখ ৪০ হাযার রোহিঙ্গা ৬ মাসের মধ্যে ফেরৎ গিয়েছিল। এরপর ১৯৯২ সালে দু’দেশের মধ্যে আরেকটি সমঝোতা হয়, যার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে ২ লাখ ৩৬ হাযার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরৎ যায়।
চুক্তির পরবর্তী প্রতিক্রিয়া : বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহল নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এর কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-
জাতিসংঘ : রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরার মত পরিস্থিতি হয়নি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএন এইচ সি আর। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পরদিন উক্ত সংস্থা এ প্রতিক্রিয়া জানায়। ইউএন এইচ সিআর-এর মুখপাত্র আদ্রিয়ান এডওয়ার্ড গত ২৪শে নভেম্বর’১৭ জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঐ সম্মতিপত্রে কি আছে তা এখনও তারা দেখেননি। তবে সহিংসতার শিকার হওয়া মিয়ানমারের ঐ জনগোষ্ঠীর রাখাইনে ফেরার বিষয়টি যেন স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদ হয়। তিনি বলেন, সেখানে এখনকার পরিস্থিতি নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী নয়। শরণার্থীরা এখনও পালাচ্ছে, অনেকে সহিংসতা, ধর্ষণ সহ নানা রকম শারীরিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেকে তাদের আপনজন ও বন্ধুকে হারিয়েছে। অধিকাংশেরই ফিরে যাওয়ার জন্য নিজেদের বাড়ি-ঘর ও গ্রাম কিছুই নেই। তাঁর মতে, প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির আগে কাউকে পাঠানো ঠিক নয়। সমস্যার মূল, বিশেষ করে আনান কমিশনে তাদের নাগরিকত্বহীনতার যে বিষয়টি বলা হয়েছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
এইচ আর ডব্লিউর শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেরিক গত ২৪শে নভেম্বর’১৭ রয়টার্সকে বলেন, মিয়ানমার অস্ত্র হাতে রোহিঙ্গাদের পুড়ে যাওয়া বাড়িতে স্বাগত জানাবে, এমন ধারণাটা হাস্যকর। তাঁর মতে জনসমক্ষে চমকের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটা স্পষ্ট করতে হবে যে, নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া কাউকে ফেরৎ পাঠানো যাবে না। যারা ফিরবে তারা শিবিরে নয়, নিজেদের বাড়িতে ফিরবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন : এ চুক্তি বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ফেদরিকা মুখেরিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে বাজে মানবিক ও মানবাধিকার সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে ২৩শে নভেম্বর নেপিডোতে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম পদক্ষেপ। দু’পক্ষের এ চুক্তিতে তারা উৎসাহবোধ করছে। তবে রোহিঙ্গারা তাদের বাসভূমিতে নিরাপদে ফিরতে পারবে কি-না মিয়ানমার সরকারকে সে পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এ বিষয়টি ইইউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং তারাও কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বিপদজনক ও অসময়োচিত। এ সংস্থা বলেছে, মিয়ানমারে জাতিগত নিধন বন্ধ না হ’লে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানোর কথা অচিন্তনীয়। তারা এও বলেছেন যে, বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং বিভিন্ন কারণে তাদের উপর এখনও অত্যাচার চলছে। যে কারণে এখনও বাংলাদেশে শত শত রোহিঙ্গা পালিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, চুক্তির পর দিনই সেখান থেকে প্রায় ১২শ’ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এই সংস্থা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, বহু সংখ্যক মুসলমান যারা এখনও মিয়ানমারে রয়ে গেছে তাদের অবস্থা বন্দী শিবিরে (কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে) থাকার মত। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাজ্যের পরিচালক কেট অ্যালেন ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেন, বিদ্বেষ ব্যবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবর্তন শুধু বিপজ্জনকই নয়, বরং সম্পূর্ণ রূপে অসময়োচিতও বটে। তিনি বলেন, সেখানে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন অভিযান বন্ধ না করা পর্যন্ত সেখানে একজন রোহিঙ্গারও ফিরে যাওয়া উচিত হবে না।
১৯৯২ সালে চুক্তিতে কি আছে?
১৯৯২ সালের চুক্তিতে কি আছে তা আদৌ কেউ বলতে পারছে না, যতক্ষণ না তা প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত নেয়ার কথা জানিয়েছিল মিয়ানমার। এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যৌথ ঘোষণার চারটি প্রধান নীতি অনুযায়ী যাচাইয়ের পর রোহিঙ্গাদের ফেরত নিবে বলে জানিয়েছিল দেশটি। গত ৩০শে অক্টোবর’১৭ ব্যাংককে নির্বাসিত মিয়ানমারের কয়েকজন সাংবাদিক পরিচালিত সংবাদ মাধ্যমে ইরাবতি এ খবর জানিয়েছে।
মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মুইন্ট কিয়াইং বলেন, প্রতিদিন একটি চেক পয়েন্টে প্রায় ১৫০ জনকে যাচাই-বাছাই করতে পারব। এর আগে মিয়ানমার সরকার জানিয়েছিল, দু’টি চেক পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে। এই দু’টি চেক পয়েন্ট হ’ল টাউংপাইয়ো লেতই এবং নগা খুইয়া গ্রাম। এরপর তাদের মংডু শহরের দারগিইজার গ্রামে পুনর্বাসন করা হবে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে তাদের দু’টি সীমান্ত দিয়ে দেড়শ’ করে মোট ৩০০ রোহিঙ্গা ফেরৎ নেয়। সে হিসাবে ৯ অক্টোবর’১৬ থেকে ২৪শে আগষ্ট’১৭ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৭,১০,০০০ (প্রায়) রোহিঙ্গাকে ফেরৎ নিতে (বছরে ১,০৯,৫০০ জন হিসাবে) সময় লাগবে প্রায় ৭ বছর। আর পূর্বের শরণার্থী সহ বাংলাদেশে এখন ১০ লক্ষেরও অধিক রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিতে মোট সময় লাগবে দশ বছরের বেশী।
বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার একটি ক্যাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০-১৫০ জনকে ফেরৎ নিবে। সেটাও নানা সুবিধা-অসুবিধার ওযর, ছুটির দিন, কথিত হামলা-মামলার ওযর প্রভৃতি অজুহাতে তাল-বাহানা করে মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদেরকে ফেরৎ নিতে কমপক্ষে ৩০ বছর সময় লাগাবে। কেউ কেউ বলছেন, ৫০ বছরও লাগতে পারে। আর সেটাই যদি হয় তাহ’লে এই সমঝোতাচুক্তির প্রয়োজনীয়তা কি? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন এর দ্বারা বাংলাদেশকে খুশী রেখে আন্তর্জাতিক মহলকে আইওয়াশ করাই উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে স্থায়ী সচিব বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণায় কিছু অংশ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেন মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসাবে প্রমাণ হাযির করতে পারা রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরতে পারে। তবে যৌথ ঘোষণার চারটি মূলনীতিতে কোন পরিবর্তন করা হবে না। এই চার মূলনীতির মধ্যে রয়েছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে প্রমাণপত্র দিতে হবে, প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছামূলক, ক্যাম্পে জন্ম নেয়া শিশুদের অভিভাবককে অবশ্যই মিয়ানমারে বাস করা ব্যক্তি হ’তে হবে ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের আদালত কর্তৃক নিশ্চয়তা। এছাড়া চুক্তিতে আর কি আছে তা বিস্তারিত জানা যায়নি।
প্রকৃত অর্থে মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদেরকে আন্তরিকভাবে ফেরত নিতে চায় নতুন কোন আনুষ্ঠানিক চুক্তির দরকার হয় না। বাংলাদেশের নিবন্ধন দেখে মাত্র কয়েক মাসেই তাদেরকে ফেরত নিয়ে পুনর্বাসন করতে পারে। কিন্তু বর্বর সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সে দেশে মুসলমান থাকুক সেটা আদৌ চায় না।
পর্যালোচনা :
গত ২৫শে আগষ্ট’১৭ থেকে মিয়ানমান সেনা ও বৌদ্ধ ভিক্ষু কর্তৃক নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর শুরু হয় হত্যা-নির্যাতন, ধর্ষণ, আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারার লোমহর্ষক নির্যাতন। ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে মিয়ানমার সরকার এক বর্বর ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ‘আনান কমিশন’-এর সুফারিশ যেদিন ঘোষণা করা হবে, ঠিক তার একদিন পূর্বে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমার সেনারা কথিত সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে দুর্গম পথ-পাহাড়, বন-জঙ্গল, নদী-সাগর পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। প্রায় কয়েক হাযার নারী-শিশু ও পুরুষ নাফ নদী ও সাগরেই ডুবে মরেছে নৌকাতে পালিয়ে আসার সময়।
৯ই অক্টোবর’১৬ ও ২৫শে আগষ্ট’১৭-এর পর এ পর্যন্ত মোট ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এর পূর্বে ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজারের কুতুপালং, ল্যাদা, টেকনাফ ক্যাম্প সহ বিভিন্ন স্থানে এবং বর্তমানে তৈরীকৃত বালু ক্যাম্প এবং অন্যান্য ক্যাম্প মিলে সর্বমোট ১০ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। ছোট্ট একটি গরীব দেশ বাংলাদেশের মত এত বড় বোঝা বিশ্বে আর কোন দেশকে বইতে হচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত-বঞ্চিত এই জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। এজন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সবচেয়ে বেশী আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
বর্তমান সভ্যতার যুগে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে তা বিশ্ববাসী ভাবতেও পারেনি। মানুষের আস্থা ছিল গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা নোবেল বিজয়ী নেত্রী অংসান সুচি যখন ক্ষমতায় এলো, এবার বুঝি ‘মিয়ানমার’ ভাল হবে। ১৯৬২ সাল থেকে চলে আসা বর্বর সেনাশাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু না! হ’ল তার উল্টা। অংসান সুচি সেনাদের সেবাদাসে পরিণত হ’ল। শুরু করল রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন। অপরদিকে সেখানেই বৌদ্ধদের পুনর্বাসন করল। বৌদ্ধ ধর্মে আছে ‘জীব হত্যা মহাপাপ’! তবে মিয়ানমারে কোন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা আছে, যারা মানুষ হত্যাকেই বেছে নিয়েছে? জাতিসংঘ কর্তৃক এদেরকে ‘বৌদ্ধ জঙ্গী’ খেতাব দেয়া উচিত। সেনাকর্মকর্তা, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং যারা এ ঘৃণ্য কর্মে অংশ নিয়েছে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত।
মিয়ানমার সরকারের এই বর্বরতাকে কোন সচেতন নাগরিক, তিনি যে কোন ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষ হন না কেন মানতে পারেন না। অনেকে আরাকানে তাদের ফেরত পাঠানোকে ‘হিংস্র বাঘের কাছে শিকার ছেড়ে দেয়ার’ সংগে তুলনা করেছেন। জাতিসংঘ, ইইউ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সঊদী আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স সহ পৃথিবীর সকল দেশ ও সংস্থা তাদের এই অসভ্যতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও নিন্দা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের আহবানে বিশ্ব সম্প্রদায়ও সাড়া দিয়েছে। কেবল চীন, ভারত ও রাশিয়া স্বৈরাচারী সেনা শাসকদের সমর্থন দিয়ে বিতর্কিত হয়েছে। তবুও আন্তর্জাতিক মহলের চাপে মিয়ানমার অনেকটা দুর্বল হয়ে এসেছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যেকার এই সমঝোতা চুক্তি নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যেহেতু রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক ইস্যু এবং এর সাথে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা, আনান কমিশন সহ অনেক সংস্থা জড়িত, সেহেতু প্রশ্ন উঠেছে এই চুক্তি দ্বি-পাক্ষিক না হয়ে বহুপাক্ষিক তথা জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে সম্পৃক্ত করা হ’ল না কেন? বাস্তবতা হ’ল- মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকারকে তোয়াক্কা করবে না, যেমন অতীতেও করেনি। যা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে শুধু বিশ্বসম্প্রদায় কেন খোদ রোহিঙ্গাদেরও আশংকা যে, সেখানে গেলে তাদের ওপর আবার ভিন্ন আঙ্গিকে যুলুম-নির্যাতন শুরু হবে। তাই তারা বলছে, শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি না পেলে আমরা সেদেশে যেতে রাযী নই। বাংলাদেশেই আমরা একপ্রকার
ভাল আছি। অন্তত আমরা বেঁচে তো আছি।
এ বিষয়ে টেকনাফের লেদা-র অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আব্দুল মতলেব বলেন, এর আগেও অনেকবার তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিল মিয়ানমার। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার তাদের কবে ফিরিয়ে নিবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। লেদার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসাইন বলেন, মিয়ানমারে ফেরত গেলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করা হবে না, সবার আগে তারা এই নিশ্চয়তা চান। নির্যাতনের কারণে ১৯৯২ সালে প্রথম দেশ ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তিনি। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হ’লে তারা মিয়ানমারে ফিরে যান। দেশে তাদের ৮৩ একর জমি ছিল। কিন্তু ফিরে গিয়ে জমি ফেরত পাননি। এরপর নির্যাতনের মুখে ২০১২ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয় বারের মত বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে যাওয়ার আগে জমি-জমা ফেরতের নিশ্চয়তা চাই।
আনান কমিশনের রিপোর্টে ছিল- রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে হবে। তাদেরকে সে দেশে স্বাধীনভাবে চলাচল, কাজ-কর্ম করা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার সহ মৌলিক অধিকারগুলো প্রদান করতে হবে। কিন্তু বর্তমান চুক্তিতে সেটাও আসেনি। কত দিনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে তারও উল্লেখ নেই।
অভিজ্ঞজনদের মতে, রোহিঙ্গা ইস্যু এমন একটা পর্যায়ে এসেছিল যে, মিয়ানমার স্বৈরশাসক, সেনাশাসক, সুচি এবং সংশ্লিষ্ট সকল অফিসারদের যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত সে দাবী বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিতও হয়েছিল, সেটাও এ চুক্তির কারণে ভেস্তে গেল।
অতএব বলা যায় যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এককভাবে মিয়ানমার সরকারের সাথে কূটনৈতিক খেলায় কোন দিনও বিজয়ী হ’তে পারবে না। বরং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোর অনুপস্থিতে এই সমঝোতা চুক্তি যেন মিয়ানমার সরকারের পক্ষেই গেল। মিয়ানমার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা হয়তো ফেরত নেবে। কিন্তু তা মোটেও দশ লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নেবার মত নয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা চুক্তি একটি দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতা এবং তা কখনো পুরোপুরি আলোর মুখ দেখবে না বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
পরিশেষে বলব, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব সহ স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার যে সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সেই অধিকার তারা যদি ফিরে না পায় তাহ’লে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তারা আরো সংকটে পড়বে। সুতরাং চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা ও রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করে প্রত্যাবাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আর চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যথা এ চুক্তি হবে অসার অকার্যকর। আল্লাহ নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের হেফাযত করুন-আমীন!