ফেইসবুক লাইভে এসে নিজের হতাশার বহিঃপ্রকাশ অতঃপর আত্মহত্যা। ছেলেবেলায় জন্মানোর পর প্রত্যেক শিশুই বড় হবার স্বপ্ন দেখে। বড় হয়ে কত কী না করার পরিকল্পনা তার। শিশুর সরল মনে তার চারপাশের অবস্থা দাগ কেটে যায়। একসময় সে বড় হয়, সব অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জীবনে হয় সফল বা ব্যর্থ। তারপর একসময় অতীত হয় তার অস্তিত্ব। গতানুগতিক এই জীবনধারার ছন্দপতন ঘটে নানা অঘটনে। আজ তেমনই একটি বিষয় আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলতে চাই, যা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
আত্মহত্যা বিষয়টিকে অনেক মনোবিজ্ঞানী মানসিক চাপের ফল হিসাবে অভিহিত করেছেন। মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনায় করোনাকালে বিশেষভাবে উচ্চশিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি ও জনসাধারণের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ে। নতুন করে দরিদ্র হয় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।[1] করোনায় উৎপাদন কমে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর জনমনে হতাশার মিটারের পারদ চূড়ায় পৌঁছে। এক গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, করোনায় বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, স্বাস্থ্যগত বিষয় নিয়ে উদ্বেগ, শিক্ষা সমাপন ও ভবিষ্যত ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় ছেদ পড়ার কারণে।[2]
পারিবারিক প্রত্যাশা, সামাজিক ভ্রূকুটি, বেকারত্ব, যোগ্যতানুযায়ী কর্মপ্রাপ্তির অভাবে একসময় ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তরুণরা। আশঙ্কার বিষয় হ’ল, অধুনা এ কাতারে ক্যারিয়ার সফল প্রৌঢ় ও বালক-বালিকারাও যোগ দিচ্ছে। সমাজের জন্য যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। জানা যায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে করোনায় মারা গেছেন ৫২০০ মানুষ। আর তারও দ্বিগুণ প্রায় ১১০০০ মানুষ মারা গেছে আত্মহত্যায়।[3] এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩.৭% মানুষ আত্মহত্যায় মারা যায়।[4] বেসরকারী একটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ১৪,৪৩৬ জন। যা ২০১৯ সালে ছিল ১০ হাযারের কিছু বেশী। ১ বছরে ৪ হাযার আত্মহত্যা বৃদ্ধির ঘটনাকে তারা ‘অশনিসংকেত’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।[5] তথ্যমতে, আত্মহত্যার হার বেশী নারীদের (৫৭%) মধ্যে এবং নিহত ব্যক্তিদের ৪৯ শতাংশই ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী। সবচেয়ে কম (৫%) আত্মহত্যাকারী হচ্ছেন ৪৬ থেক ৮০ বছর বয়সী। আত্মহত্যার প্রধান দু’টি কারণ হ’ল পারিবারিক সমস্যা ও সম্পর্কের টানাপোড়েন। যা যথাক্রমে ৩৫ ও ২৪ শতাংশ আত্মহত্যার কারণ।[6] এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ রোধ সম্ভব হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায়। ২০১৭ সালে জাতীয় যরূরী সেবা ৯৯৯ চালুর পর প্রায় ১৪৯২টি সম্ভাব্য আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।[7]
এদিকে আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা। বিগত ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যার মধ্যে ৬২ জন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।[8] এ বিষয়ক মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণাকারীগণ শিক্ষা সংক্রান্ত চাপ, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পারিবারিক অভিমান, প্রেমঘটিত সম্পর্কের টানাপোড়েন, একাকীত্ব, বেকারত্ব ইত্যাদিকে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।[9] এগুলোর ফলে তীব্র সামাজিক ও পারিবারিক চাপ থেকে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
পাশের দেশ ভারতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আত্মহত্যাকারীগণের অধিকাংশই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রথম সপ্তাহেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশী এ পথ বেছে নিয়েছে ৩০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী (৬১.৩%)। এরমধ্যে ফাঁস গ্রহণ করে ৫৩.৮% ও ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে ১২.৯% মানুষ।[10] বাংলাদেশে গলায় ফাঁস দিয়ে ও বিষপানে আত্মহত্যার হার সর্বাধিক।
করোনাকালে সামাজিক জীব মানুষকে সঙ্গনিরোধে (কোয়ারেন্টাইনে) উদ্বুদ্ধ করা হয়। এতে স্বভাবসুলভ মানব মন বিক্ষুব্ধ হয় তবুও সইতে হয়। কখনো হয়ত মন মানে না, মানা যায় না। বাঁচার তাকীদে মানুষ বাইরে ছুটে যায়। এরপর যখন সে দেখে ইতিবাচক কাজ করার সুযোগ নেই, নেতিবাচক কাজের মতো অসৎ সাহস নেই। তখন এ সমাজ ও জগতের প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে জগত সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এটা যে চরম নেতিবাচক ও অনৈতিক কাজ তা মনে করে না। মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়েও অসন্তুষ্টিতে ভোগে। এ দায় কি একমাত্র তারই? সমাজ কি এ দায় এড়িয়ে যেতে পারে? সমাজে বসবাসকারী হিসাবে আমাদের প্রত্যেককেই এই দায়িত্বশীলতা নিয়ে ভাবতে হবে।
সম্মানিত পাঠক! আমাদের জীবনেও কি কখনো হতাশা আসেনি? কখনো কি চরম বিষণ্ণতায় মন উদাসীন হয়নি? কারো অকৃতজ্ঞতা আর বিশ্বাসঘাতকতায় মন কাতর হয়নি? উত্তর হয়তো হ্যাঁ বা না। ভাবুন, তখন আপনি কি করেছিলেন? সেসময় আপনার পাশে কারা দাঁড়িয়েছিল। অথবা আপনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় কার সাহায্য পাওয়ার আশা রাখেন?
করোনা মহামারীতে আমরা এসব বিষয়ে অসচেতন ছিলাম। পরিস্ফূট হ’ল যে, আমরা অনেকে ধোঁকায় ছিলাম। পূর্বে চকচকে স্বপ্নীল জগত, ক্রীড়াজগত, বিনোদন জগত সবকিছু জনগণের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকলেও করোনার বিপদে কোন নতুন উপযোগ সৃষ্টিতে তা এগিয়ে আসেনি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নতুন কোন পথ দেখাতে পারেনি। নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে নতুন উদ্যোগের প্রসার ঘটানো হয়নি।
চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে একটা সিস্টেমের মাধ্যমে গড়ে তুলে তারপর তাকে একদম শূন্য পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া হয়। যে বিষয় তাকে পাঠদান করানো হয়, সে সম্পর্কিত কর্মক্ষেত্র থাকে নগণ্য বা একদমই থাকে না। তাকে সাফল্যের নানা সংজ্ঞা শুনিয়ে, সে পথগুলোয় তার সামর্থ্য, সক্ষমতা, মেধা, যোগ্যতার সঠিক বিচার করার সুযোগ যথাযথভাবে না দিলেও এ সমাজ কথা শোনাতে বা অপদস্থ করতে ছাড়ে না। রি রি রব পড়ে যায়। দীর্ঘসূত্রীতার বাতাবরণে যৌবনক্ষয়ী শিক্ষার যে পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রতিষ্ঠানগুলো, তার গলদ ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত। ওগুলোয় প্রলুব্ধ হওয়া যেন নির্ঘাত বোকামি। ঘটনা ঘটবার আগেই হুঁশ ফিরলে উত্তম হ’ত। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার খোল নলচে পাল্টানোর কথা বলছেন অনেকে। বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি নিয়েও ভাববার অবকাশ রয়েছে আমাদের। এজন্য আমাদের কর্মক্ষম জনশক্তিকে যোগ্য কর্মে নিযুক্তির মাধ্যমে জনশক্তির সুফল লাভ করতে হবে।
যে মানুষটা আত্মহত্যা করতে প্রবৃত্ত হয়, তাঁর কাছেও জীবনটা খুব সুখের ও আনন্দের। পরিস্থিতি এতই কঠিন হয়ে যায় যে, তার কাছে সমাজ, ধর্ম ও জীবনটা বোঝা হয়ে যায়। এর পেছনের কারণগুলোকে না দুষে শুধু আত্মহত্যাকারীদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করা আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের পরিচায়ক। ছোট থেকেই একটা মানুষকে সমাজের সাথে যতটা সম্পৃক্ত করে গড়ে তোলার, তা তুলতে আমরা ব্যর্থ। প্রজন্মের দূরত্বের সাথে সাথে সামাজিকীকরণের এতটা দূরত্ব হয়েছে যে, প্রৌঢ় বা পঞ্চাশোর্ধ মানুষও যেন পরিবারের সাথে নিজেদের মেলাতে পারছেন না। এই সময়ের একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা হ’ল বৃদ্ধগণ ও শিশুরা নিজেদের সমবয়সী সাথীদের পাশে পাচ্ছে না। এই দূরত্ব মেটাতে তারা বেছে নিচ্ছেন ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মিছে এ নৈকট্যে সাময়িক শ্রান্তি মিললেও হতাশা আরো বাড়ছে। অবসাদ জেঁকে বসছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এর পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে শিশুর বিকাশকালীন সামাজিক পরিবর্তন। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমরা দেখেছি শিশুরা সমাজের সকলের সাথে মিলেমিশে বড় হয়েছে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠগণের আদর-যত্নে, সোহাগ-শাসনে আর সহোদর-সহোদরাদের খুনসুঁটিতে কেটে যেত শৈশব। সভ্য দুনিয়ার ট্রেন্ড হ’ল ছোট পরিবার বা অণু পরিবার। সেজন্য ‘দুটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ শ্লোগানের বিস্তার যেমন ঘটেছে তেমনি ভাই- বোন সংখ্যাও কমতে বসেছে। তথাকথিত পরিবার পরিকল্পনার সুবাদে অনেকের শুধু ভাই আছে তো বোন নেই, বোন আছে তো ভাই নেই অথবা ভাই-বোন কেউই নেই। এরকম চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মামা-চাচা, ভাতিজা-ভাগ্নে, বড়চাচা-ছোটচাচা সম্বোধনগুলো বাংলার সমাজ থেকে জাদুঘরে চলে যাবে।
স্বামী-স্ত্রী কর্মজীবী বেশীরভাগ পরিবারের শিশুরা বাবা-মাকে সবসময় কাছে পাচ্ছে না। অর্থ, যশ-খ্যাতি, জ্ঞান, সম্মান অর্জনের তাকীদে নিরন্তর ছুটে চলা এসব অভিভাবকদের একটু ফুরসত হয় না নিজের সন্তানদের সাথে দুদন্ড বসে গল্প করবার। খোঁজ-খবর নেবার ও অবসর কাটাবার। তাই শিশুদের পরিচর্যার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে বাড়িতে থাকা পরিচারিকাকে বা ডে-কেয়ারের সহকারীকে। উন্নত দেশের আদলে কেউ আবার রাখছেন সন্তান দেখভালের জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত ন্যানী।[11] কিছু ক্যারিয়ার সফল মানুষ সন্তান জন্ম দেবার পরও জাগতিক মোহে নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। বিচ্ছেদ পরবর্তীকালে সন্তানের দায়িত্ব পাবার জন্য সুদূর জাপান থেকে ছুটে আসছেন মা, এমনও নযীর দেখছি।[12] বাবা-মায়ের মধ্যে এমন দ্বন্দ্বের জেরে সন্তানদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি হচ্ছে। তীব্র বিদ্বেষ থেকে জন্ম নিচ্ছে তীব্র হতাশা। এমন মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ সে করতে পারে না আবার সইতেও পারে না। এর অনিবার্য ফল হিসাবে সে সন্তান একসময় মাদক ও খারাপ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে, সংসারত্যাগী বা সংসার বিদ্বেষী হয়, কিংবা নিজেকে নিঃশেষ করতে প্রবৃত্ত হয়।
আত্মহত্যা চূড়ান্ত পদক্ষেপ। তার আগে ঐ ব্যক্তির দীর্ঘদিন মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারীগণ কিছুদিন যাবত অস্বাভাবিক আচরণ করেন, আত্মহত্যার আয়োজন ও পরিকল্পনা করেন। তাই পূর্বে কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, এমন মানুষের এ ঝুঁকি বেশি। এছাড়াও আত্মহননের উপরোক্ত কারণগুলো যাদের মনোজগতে তীব্র প্রভাব ফেলছে তাদের ব্যাপারে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যের প্রতি মনোযোগ দেয়া, প্রতিবেশী, বন্ধু ও অনুসারীদের ব্যাপারে ভাবতে হবে। এর সাথে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে। মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আত্মউন্নয়ন, সমাজ সংস্কার, পরিবেশ উন্নয়ন, নৈতিকতার বিকাশ, স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা পায় এমন কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তিপণ্য ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। ধরা-ছোঁয়া যায় না শুধু স্ক্রীনের পর্দায় দেখা যায়, এমন জ্ঞান শিশুদের বাস্তব জগত সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিশু মনোস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষকগণ। এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুরা দিনে ৪ ঘণ্টার বেশী সময় প্রযুক্তিপণ্যের পর্দার দিকে তাকিয়ে কাটায়, তারা মানসিক অসুস্থতায় তীব্র আশঙ্কায় থাকে।[13] সেজন্য শিশুদের চাক্ষুষ ও বাস্তব পরিদর্শনের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পরামর্শ দিয়েছেন।
দক্ষতা উন্নয়নমূলক কাজ যেমন ভাষাশিক্ষা, শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণ শেখা, শব্দভান্ডার বৃদ্ধি, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লেখা, সূচিকর্ম শিক্ষা, বাড়ির কাজগুলো শেখা, ড্রাইভিং শেখা, সাঁতার শেখা ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা অনেক। এগুলোয় শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে, প্রেষণা (Motivation) দিতে হবে। পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, শারীরিক কসরত করা, দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করা ও খেলাধূলারও সুযোগ করে দিতে হবে শিশুদের।
প্রিয় পাঠক! সময় এসেছে আমাদের কাছের মানুষ, স্বজন, প্রিয় বন্ধুটির খোঁজ নেবার। সেলুলয়েডের মেকি ফ্রেম থেকে চোখ সরিয়ে আপনজনের সাথে একটু কথা বলার, তাকে আত্মবিশ্বাসী করার। একটু হিম্মত যোগানোর। এ সাহস হয়ত তাঁকে আশার সলতে জ্বালিয়ে সামনে পথ চলতে সাহায্য করবে। নিজের হতাশাগুলো কাটাতে আল্লাহর নে‘মতের উপযুক্ত প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এর সাথে কাজের বিকল্প উপায় বের করার চেষ্টা করি। নতুন ধারণা ও মানিয়ে নিয়ে আগানোর প্রয়াস শুরু হোক পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে।
আসুন, আমরা মানবিক সম্পর্কগুলো যোরদারে ব্রতী হই। সম্পর্কগুলোর যত্ন ও সুরক্ষায় নিজের দায়িত্বশীলতা নিয়ে অগ্রসর হই। বিপদে ধৈর্যধারণ করা, একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা, দায়িত্বশীলগণের যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করা, বিভিন্ন আবিষ্কার ও সেবা দেয়া, মানবিক সহযোগিতার হাত সবসময় উন্মুক্ত রাখা ইত্যাদি ইতিবাচক গুণাবলীকে জাগিয়ে তুলি।
ইসলাম সমাজের জন্য কল্যাণ স্বরূপ। ইসলামে শিশুকে আদব শিক্ষা দেবার জন্য পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। উত্তম লালন-পালনের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তির ব্যাপারে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নেক সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করবে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও তার ছওয়াব প্রাপ্তি চলতে থাকবে। সন্তানও পিতামাতার প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য পোষণ করবে, দেখভাল করবে, দো‘আ করবে। তাঁদের প্রতি সদাচরণ করবে, বৃদ্ধকালে কোন ব্যাপারে তাদের প্রতি কষ্টের স্বরে ‘উফ’ উচ্চারণেও নিষেধ করেছেন আল্লাহ তা‘আলা।[14] রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে সন্তানের উত্তম আচরণ পাবার অধিকারী বলেছেন। সাথে সাথে ইসলামী সমাজের নানা কাজে শিশুদের অন্তর্ভুক্তির নযীর রয়েছে রাসূল ও ছাহাবীগণের জীবনীতে। এছাড়াও ভুলের ক্ষমা, কাফফারা, অপরাধের শাস্তি ও সমাজে তার বিস্তৃতি রোধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। যা মেনে চললে সমাজে শিশুরা গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকবে।
আত্মহত্যা ইসলামে বড় পাপের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি এমনতর কাজ করবে সে জাহান্নামেও অনুরূপ কাজ করতে থাকবে। এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, الَّذِي يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِي النَّارِ، وَالَّذِي يَطْعُنُهَا يَطْعُنُهَا فِي النَّار ‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নাম (অনুরূপভাবে) বর্শা বিদ্ধ করতে থাকবে’।[15]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ فَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ شَرِبَ سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، ‘যে ব্যক্তি কোন ধারাল অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে অস্ত্র তার হাতে থাকবে, জাহান্নামের মধ্যে সে অস্ত্র দ্বারা নিজ পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষ পান করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নিচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পতিত হ’তে থাকবে, এভাবে সে ব্যক্তি সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে’।[16]
জুনদুব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ، فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّينًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ، فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ، قَالَ اللهُ تَعَالَى بَادَرَنِى عَبْدِى بِنَفْسِهِ، حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ، ‘তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে (বনী ইসরাঈলের ঘটনা) একজন লোক আঘাত পেয়ে কাতর হয়ে পড়েছিল। এরপর সে একটি ছুরি হাতে নিল এবং তা দিয়ে স্বীয় হাত কেটে ফেলল। ফলে রক্ত আর বন্ধ হ’ল না। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল। মহান আল্লাহ বললেন, আমার বান্দাটি নিজেই প্রাণ দেয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করল (অর্থাৎ সে আত্মহত্যা করল)। কাজেই আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম’।[17]
খায়বার যুদ্ধের এক বিখ্যাত ঘটনা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি যে মুসলিম বলে দাবী করত, তার সম্পর্কে বললেন, লোকটি জাহান্নামী। এরপর যুদ্ধ আরম্ভ হ’লে লোকটি ভীষণভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেল, এমনকি তার দেহের অনেক স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। এতে কারো কারো (রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যৎবাণীর
উপর) সন্দেহের উপক্রম হ’ল। (কিন্তু তারপরেই দেখা গেল) লোকটি আঘাতের যন্ত্রণায় তুণীরের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে তীর বের করে আনল। আর তীরটি নিজের বক্ষদেশে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করল। তা দেখে কতিপয় মুসলিম দ্রুত ছুটে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনার কথা সত্য বলে প্রমাণিত করেছেন। ঐ লোকটি নিজেই নিজের বক্ষে আঘাত করে আত্মহত্যা করেছে। তখন তিনি বললেন, হে অমুক! দাঁড়াও এবং ঘোষণা দাও যে, মুমিন ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অবশ্য আল্লাহ (কখনো কখনো) ফাসেক ব্যক্তি দ্বারাও দ্বীনের সাহায্য করে থাকেন।[18] বোঝা গেল, ইসলামের সামাজিক চেতনা বাস্তবায়নে আত্মহত্যার এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি সম্ভব। তাই সমাজের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী জাযবার প্রসারে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র উদ্ভাবন ও সেসব কাজের মাধ্যমে ইসলামের চর্চা করতে হবে। সকল সমস্যায় ইসলামকে একমাত্র সমাধান হিসাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তবেই সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহু তা‘আলা। আল্লাহ আমাদের এমন সমাজ গঠনের তাওফীক দান করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ ফেরদাঊস
এম. এড., শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. দেশে নতুন দরিদ্র এখন ২ কোটি ৪৫ লাখ : জরিপের ফলাফল, প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০২১, সংগৃহীত : https://cutt.ly/IPeIJbt
[2]. Amit,S., Barua, L. & Al Kafy, A. (2021),A perception-based study to explore COVID-19 pandemic stress and its factors in Bangladesh, Diabetes & Metabolic Syndrome: Clinical Research & Reviews, Volume 15, Issue 4, ISSN 1871-4021, https://doi.org/10.1016/ j.dsx.2021.05.002.
[3]. কোভিডে যখন ৫ হাযার মৃত্যু, দ্বিগুণ মানুষের আত্মহত্যা : পরিসংখ্যান সচিব, বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২১ সংগৃহীত : https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article
1860758.bdnews.
[4].https://worldpopulationreview.com/country-rankings/ suicide-rate-by-country
[5]. এক বছরে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাযারের বেশী মানুষ, প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০২১। সংগৃহীত:https://cutt.ly/KP5nvXI
[6]. ঐ
[7]. লাইভে মহসিন আত্মহত্যা করবেন, ফেসবুক প্রথমে বুঝতে পারেনি: সিআইডি প্রধান, প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, সংগৃহীত: https://cutt.ly/FP5QzQM
[8]. আঁচল ফাউন্ডেশন। মাধ্যম : মতিউর রহমান চৌধুরী (২০২২), গত এক বছরে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে, ভয়েস অব অ্যামেরিকা, জানুয়ারী ২৯, ২০২২ সংগৃহীত : https://www.voabangla.com/a/6418113.html
[9]. ঐ
[10]. Sripad, M.N., Pantoji, M., Gowda, G.S., Ganjekar, S., Reddi, V.S.K. & Math, S. B. (2021), Suicide in the context of COVID-19 diagnosis in India: Insights and implications from online print media reports, Psychiatry Research, Volume 298, 2021, 113799, ISSN 0165-1781, https://doi.org/10.1016/j.psychres.2021.113799.
[11]. ‘ন্যানী’ (Nanny) হ’ল শিশু পরিচারিকা। শিশুর দেখভালের জন্য আলাদাভাবে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়, সে হ’ল ন্যানী। ন্যানী প্রত্যয়টি পশ্চিমের দেশে ব্যবহার হ’লেও আমাদের দেশে এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। তবে বিত্তশালীগণ সন্তানের মাতৃসেবার ঘাটতি পূরণে উচ্চবেতনে ‘ন্যানী’ নিয়োগ করেন। ‘আয়া’, ‘বুয়া’, ‘খালাম্মা’ ইত্যাদি প্রত্যয় দ্বারা যে ধরনের শিশুর দেখভালকারীদের আমরা বুঝি, ন্যানী তার চেয়ে একটু আলাদা আমাদের দেশে। যাঁরা উচ্চশিক্ষিতা (তারা সাধারণত নারী হন), শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার চিকিৎসাজ্ঞান, সূচীকর্ম ও শিশুদের খাবার তৈরির উপযোগী রান্নায় পারদর্শী হন। সাথে সাথে শিশুর বডি গার্ডের মতো কাজ করেন। শিশুর নিরাপত্তা ও কিডন্যাপারের সম্ভাব্য হাত থেকে রক্ষার জন্য শিশুকে বাঁঁচিয়ে লড়াই করার ট্রেনিংও দেয়া হয় কিছু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। যেমন Norland Nanny। এখান থেকে অনেকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন।
[12]. বাঙালী বাবার কাছে দুই মেয়ে : জাপানি মায়ের আপিল শুনানির তালিকায়, জাগোনিউজ অনলাইন, ১১ ডিসেম্বর ২০২১, সংগৃহীত :https://www.jagonews24.com/law-courts/news/722912
[13]. Morgan, A. D. (2014), The internet can be bad for children's mental health, The Independent, 16 May 2014, retrieved from : https://www.independent.co.uk/life-style/health-and-families/health-news/the-internet-can-be-bad-for-children-s-mental-health-9381551.html
[14]. সূরা বানী ইসরাঈল, ১৭/২৩।
[15]. বুখারী হা/১৩৬৫, ই.ফা. হা/১২৮১; মিশকাত হা/৩৪৫৪।
[16]. মুসলিম হা/১০৯।
[17]. বুখারী হা/৩৪৬৩, ই.ফা. হা/৩২১৭।
[18]. বুখারী হা/৪২০৪-৪২০৫, ই.ফা. হা/৩৮৮৯।