বাংলাদেশের বামপন্থীরা অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন করলেন। এই বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার শেষ হয়নি। অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে এ পর্যন্ত বই লেখা হয়েছে প্রায় ২০ হাযার। শুধু ইংরেজী ভাষাতেই প্রায় ৬ হাযার।
সোভিয়েত ইউনিয়নের গোড়াপত্তন থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় পরাশক্তি হয়ে ওঠা পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছিল, সেসব কি করে সম্ভব হয়েছিল এবং স্পষ্ট কোনো পূর্বলক্ষণ ছাড়াই সেই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রটি কেন ও কিভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেল। এই ছোট্ট লেখায় এত বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করার সুযোগ নেই। শুধু শেষের প্রশণটি নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করা যাক, সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ও কিভাবে ভেঙে গেল।
এই প্রশ্নের দুটো সরল উত্তর প্রচলিত আছে। একটা হ’ল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটা ষড়যন্ত্রের ফল। ষড়যন্ত্রের হোতা মিখাইল গর্বাচেভ। তিনি আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এজেণ্ট ছিলেন। তিনি নিজের চারপাশে যেসব লোককে জড়ো করেছিলেন, তাঁরাও সবাই ছিলেন পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের দালাল। এই দালাল চক্র আমেরিকা ও তার পুঁজিবাদী মিত্রদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে। নইলে দেশটির পতনের কোন কারণ ছিল না।
দ্বিতীয় উত্তরটা হ’ল, সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তিই হয়েছে অবৈধভাবে। এটা ছিল একটা অশুভ শক্তি। এর পতনের বীজ এর ভেতরেই লুকোনো ছিল। তাছাড়া এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অস্বাভাবিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বাজার ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র অনন্তকাল চলতে পারে না। গর্বাচেভ ব্যবস্থাটির সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা সংস্কারের যোগ্য ছিল না, বরং সংস্কার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার ভেঙে পড়াই অনিবার্য ছিল। অবশেষে সেটাই ঘটেছে।
১৯৮৫ সালের মার্চে মিখাইল গর্বাচেভ যখন দায়িত্ব নেন, তখন না সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে, না বাইরে কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে পরবর্তী ছয় বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল না, তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করায় খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ১৯৭৩ সালে চতুর্থবারের মতো আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধ বাধলে তা কয়েক মাসের মধ্যে ৪০০ শতাংশ বেড়ে যায়। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ আয় হয়েছে তেল রফতানী থেকে। তেলের দাম বাড়ার ফলে তেল রফতানীকারক আরব দেশগুলোর প্রচুর লাভ হয়। সেই লাভের টাকায় তারা ব্যাপক সামরিকায়ন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনা বাড়িয়ে দেয়। এই সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নেও ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দেশটি আমেরিকার সমকক্ষ হয়ে ওঠে।
পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা জ্বালানি তেলকে বলতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘আকিলিসের গোঁড়ালী’। মানে অত্যন্ত নাযুক জায়গা। গর্বাচেভের দুর্ভাগ্য, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই তেলের দাম কমতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে কমে যায় ৬৯ শতাংশ। তেল বেচাকেনার মুদ্রা মার্কিন ডলারের দামও পড়ে যায়। এর মধ্যে ওই বছরই ঘটে চেরনোবিল আণবিক দুর্ঘটনা, যার প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল।
আরও বড় এবং বেশ গুরুতর সমস্যা হ’ল, সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প-কারখানাগুলো ১৯৮০ দশক নাগাদ সেকেলে ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিশেষতঃ বিশালাকার যেসব শিল্প ১৯৩০ দশকে গড়ে তোলা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই পুরোনো মডেলেই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে ব্রেঝনেভের আমলে যে ব্যাপক সামরিকায়ন চলছিল, তা অব্যাহত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ ব্যয় করা হ’ত সামরিক খাতে।
এ রকম অবস্থায় গর্বাচেভ এসে দেখলেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের আর নেই। এটা থামাতে হবে। তাঁর পররাষ্ট্রনীতির একটা গোড়ার কথা ছিল এটাই। এজন্য তাঁকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হয়েছে। সেটা আন্তরিকভাবে করতে গিয়ে তিনি যে শেষ পর্যন্ত ধোঁকা খেয়েছেন, তা তিনি সেই সময় বুঝতে পারেননি। বুঝেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক বছর পর। এখন তিনি বলেন, ‘আনি আবমানুলি নাস’ (ওরা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে)।
গর্বাচেভ সামরিক ব্যয় কমানোর প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক গতিসঞ্চারের জন্য শিল্প-কারখানার কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ, সংস্কার করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। যে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যতঃ সবকিছু চালাত, তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল এককেন্দ্রিক। পার্টির ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না; ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতি পার্টির জন্য হয়ে উঠেছিল একটা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। পার্টির নেতাদের অধিকাংশই জনগণ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
গর্বাচেভ অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সংস্কারের (পেরেস্ত্রেইকা) মাধ্যমে। সেজন্য তিনি এসে বললেন, পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র দরকার। গণতন্ত্রের চর্চা হ’লেই সমাজতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। তাঁর পেরেস্ত্রেইকার প্রথম স্লোগান ছিল ‘আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র’।
তিনি পেরেস্ত্রেইকার আগে শুরু করেন ‘গ্লাসনস্ত’ (কথা বলার স্বাধীনতা)। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ গ্লাসনস্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। তারা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যেন বিশাল এক বাঁধ ভেঙে গেল। সোভিয়েত সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল, যেমনটা এর আগে কখনো ঘটেনি। সবাই যখন নির্ভয়ে কথা বলার ও লেখার সুযোগ পেল, তখন যে বিষয়টা প্রকট হয়ে উঠল তা হ’ল, অতীতের সমালোচনা। অতীতের অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ভুল ও ব্যর্থতাগুলো। ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটরা’ চূড়ান্তবাদী হয়ে উঠলেন, তাঁরা বলে উঠলেন, ভুল নয়, ব্যর্থতা নয়, সেগুলো ছিল ‘অপরাধ’। স্ট্যালিনকে তাঁরা আখ্যায়িত করতে লাগলেন ‘প্রিস্ত্তপনিক’ (ক্রিমিনাল) বলে।
এটা গেল একটা দিক। অন্যদিকে সোভিয়েত জনগণ পুঁজিবাদী দুনিয়ার খবর পেতে শুরু করল। টেলিভিশনের পর্দায় তারা দেখতে পেল ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ কত ভালো জীবন যাপন করছে। কি চাকচিক্যময় তাদের জীবন। টেলিভিশনে দেখা যায়, লন্ডনের দোকানগুলোতে ২২ থেকে ৪২ রকমের পাউরুটি বিক্রি হচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে সোভিয়েত জনগণ আবিষ্কার করল, তাদের নিজেদের দেশে দোকানগুলোর তাক ক্রমেই শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মাংস, মাখন, পনির কেনার লাইনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাদের জনগণকে সবসময় বলে এসেছেন, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু জনগণ দেখতে পেল, কথাটা সত্য নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে একটা সময় খোদ কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরেই এমন একটা গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেল, যারা গর্বাচেভের সংস্কারের ধীরগতিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। এই গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে আবির্ভূত হ’লেন পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য ‘বরিস ইয়েলৎসিন’।
গর্বাচেভের প্রত্যাশা মিথ্যা হয়ে গেল, যখন তিনি দেখলেন গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রেইকার ফলে আমলাতন্ত্রে ও কল-কারখানায় ভীষণ বিশৃংখলা দেখা দিল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ল। ‘কো-অপারেটিভে’র নামে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া হয়ে উঠল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের উৎসব। যার নেতৃত্বে ছিলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতিবাজ নেতারা।
জনসাধারণের দুর্দশা ক্রমেই বেড়ে চলল এবং গর্বাচেভের জনপ্রিয়তা কমতে লাগল। জনগণ গর্বাচেভের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল, তাঁকে দোষারোপ করতে লাগল এই বলে যে তাঁদের সব দুঃখ-দুর্দশা ডেকে এনেছেন এই ভদ্রলোক। ১৯৯০ সালের শেষ নাগাদ পিরিস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্ত অকার্যকর হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি, সেনাবাহিনী, কেজিবি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেকে গর্বাচেভের পাশ থেকে সরে গেলেন। তাঁদের মধ্যে লিগাচভ ও রিঝকভের মতো প্রভাবশালী নেতাও ছিলেন।
গর্বাচেভের বিরুদ্ধে এই পক্ষের লোকজনের অভিযোগ ছিল, তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন, পূর্ব ইউরোপকে বিসর্জন দিয়েছেন, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বিলোপ ঘটিয়েছেন। সাঝি উমালাতোভা নামে কংগ্রেসের এক ডেপুটি কংগ্রেসের অধিবেশনে বলেন, ‘মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার হাততালি পেয়ে ভুলে গেছেন তিনি কাদের প্রেসিডেণ্ট’। প্রকাশ্য ফোরামে বলাবলি চলতে থাকে, গর্বাচেভ যদি দেশে শৃংখলা ফিরিয়ে না আনেন, তাহ’লে তাঁকে পদচ্যুত করা হবে। গর্বাচেভ বিরোধী মনোভাব সবচেয়ে বেশী প্রবল হয়ে ওঠে সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। তাঁরা মনে করছিলেন, গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাশক্তির মর্যাদা ধ্বংস করছেন। ১৯৯১ সালের প্রথম দিকে মস্কোসহ বিভিন্ন শহরে এমন গুঞ্জন শোনা যায় যে অচিরেই একটা ‘পিরিভারোত’ (অভ্যুত্থান) হ’তে যাচ্ছে। ‘ঝেলেজনায়া রুকা’ (আয়রন হ্যান্ড) ফিরে আসতে আর দেরী নেই।
অন্যদিকে ইয়েলৎসিনে জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলল। লোকজন ভাবতে শুরু করল, এই লোক তাদের ‘ত্রাণকর্তা’। তিনি এই দুর্দশা থেকে তাদের উদ্ধার করবেন। ১৯৯১ সালের জুন মাসে রুশ প্রজাতন্ত্রের ভোটাররা ইয়েলৎসিনকে তাদের প্রেসিডেণ্ট নির্বাচিত করল। ইয়েলৎসিন ইতিমধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা বন্ধ করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পার্টির অনেক সদস্য। একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে গণহারে পদত্যাগ শুরু হয়। এর পাশাপাশি প্রচুর সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার মানুষ ইয়েলৎসিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা সবাই অতি দ্রুত সোভিয়েত ব্যবস্থার ‘আমূল পরিবর্তন’ চাইছিলেন, কার্যত রাশিয়াকে পুঁজিবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।
একদিকে দেশের শৃংখলা ফিরিয়ে আনার নামে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবী, অন্যদিকে আরও দ্রুত ও ব্যাপক সংস্কারের নামে বাজার ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার দাবী। এই দু’মুখী চাপে গর্বাচেভ প্রায় দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি প্রকাশ্যে কট্টর সংস্কারপন্থী নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এমন রদবদল আনলেন, যাতে মনে হয়, ক্ষমতা সেই সব লোকের হাতে সংহত করা হ’ল যাঁরা সংস্কারের বিরোধী। এটাকে কেউ কেউ বললেন, স্বৈরতান্ত্রিক কট্টরপন্থার দিকে গর্বাচেভের ডিগবাজি। তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কমরেডদের একজন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডোয়ার্ড শেভার্ডনাডজে রেগে গিয়ে পদত্যাগ করে বললেন, স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে’।
কিন্তু গর্বাচেভের সমাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করতে বেশ দেরী হয়ে গেছে। তত দিনে তাঁর সূচিত সংস্কারের রেলগাড়ীটা তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সেই গাড়ির চালক তখন বরিস ইয়েলৎসিন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হওয়ার আগে ওই দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে সমাজতন্ত্র। কার্যতঃ এটা ঘটেছে সংবাদমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা। গ্লাসনস্তের সুযোগে সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রচারণা সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের বৃহত্তর অংশকে ভীষণভাবে বদলে দিয়েছে। তাদের মনে উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়ার মতো বৈষয়িক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে না বলে তাদের মনে হয়েছে।
তাই ১৯৯১ সালের আগষ্ট মাসে গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায় অবকাশ যাপনের সময় কমিউনিস্ট পাটির কট্টর নেতারা যখন তাঁকে ‘অসুস্থ ও দেশ চালাতে অক্ষম’ ঘোষণা করে অভ্যুত্থান ঘটাতে গেলেন, তখন জনগণ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এল। অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থন জানাতে তাঁদের পক্ষের কেউ রাস্তায় নামেনি।
আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল, মাঝামাঝি সংস্কারমূলক পদক্ষেপে তারা আর তুষ্ট থাকতে পারছিল না। ১৯১৭ সালেও তারা কেরেনস্কির বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট হ’তে পারেনি, বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল। বলশেভিকদের অক্টোবর বিপ্লব ঘটতে পেরেছিল সে কারণেই। উভয় ঘটনায় জয় হয়েছে জনগণের চূড়ান্তবাদী প্রবণতার’।
\ সংকলিত \
[এর বিপরীতে আমরা মানুষের স্বভাবগত প্রবণতার বিজয় কামনা করি। যেটি রয়েছে স্বভাবধর্ম ইসলামে। যেখানে পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী অর্থনীতির দুই চরমপন্থী ধারার বিপরীতে রয়েছে ন্যায়বিচার ভিত্তিক অর্থনীতি। বাংলাদেশের জনগণকে আমরা সেপথে আহবান জানাই (স.স.)।]